দুনিয়া কাঁপানো সেই দিন
- Details
-
Published on Saturday, 19 May 2018 07:32
দুনিয়া কাঁপানো সেই দিন
৭ই নভেম্বর ১৯১৭-র কাহিনী --যেদিন বলশেভিকরা এই পৃথিবীর ইতিহাস পরিবর্তন করেছিল
মূলরচনাঃ চায়না মিয়েভিল
ভাষান্তরঃ কৌশিক চট্টোপাধ্যায়
সম্পাদনাঃ কুণাল চট্টোপাধ্যায়
হ্যাঁ, সেই দিন।– ১৯১৭র ৭ নভেম্বর।
২৫-এর ভোর হল। মরিয়া কেরেনস্কি কসাকদের উদ্দেশ্যে আবেদন করেন, “স্বাধীনতার নামে, আমাদের দেশের মাটির সম্মান ও মর্যাদার স্বার্থে, সোভিয়েত কেন্দ্রীয় কার্য নির্বাহক কমিটি, বিপ্লবী গণতন্ত্র এবং অস্থায়ী সরকারকে সাহায্য করতে, যাতে রাশিয়ার রাষ্ট্র ব্যবস্থা ধংসের হাত থেকে রক্ষা পায়।”
কিন্তু কসাকরা জানতে চায়, পদাতিক বাহিনী বেরিয়ে আসবে কি না। সরকারের জবাবে ইতস্তত ভাব দেখে একটি ছোটো অতি-অনুগত দল ছাড়া বাকিরা উত্তর দেয়, তারা একা কাজ করতে এবং “জীবন্ত লক্ষ্য হতে চায় না”।
বারে বারের, সহজেই, শহরের বিভিন্ন এলাকাতে, সামরিক বিপ্লবী কমিটি অনুগত রক্ষীদের নিরস্ত্র করে তাদের বাড়ি চলে যেতে বলে। অধিকাংশ সময়ে, তাঁরা সেই কাজই করে। বিদ্রোহীরা ইঞ্জিনিয়ারদের প্রাসাদ দখল করেন নিছক হেঁটে সেখানে ঢুকে পড়ে। একটি স্মৃতিচারণে বলা হয়েছে, “ওরা ঢুকে নিজেদের আসন নিল, আর যারা বসেছিল তারা উঠে চলে গেল”। সকাল ছটায় চল্লিশজন বিপ্লবী নাবিক পেত্রোগ্রাদ স্টেট ব্যাঙ্কের কাছে উপস্থিত হন। এর রক্ষীরা ছিল সেমেনভস্কি রেজিমেন্টের, এবং তাঁরা অগ্রিম নিরপেক্ষতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তাঁরা লুটেরা ও অপরাধীদের হাত থেকে ব্যাঙ্ককে রক্ষা করবেন, কিন্তু বিপ্লব আর প্রতিবিপ্লবের মধ্যে পক্ষ নেবেন না। তাঁরা হস্তক্ষেপও করবেন না। অতএব তাঁরা সরে দাড়ালেন এবং সামরিক বিপ্লবী কমিটিকে দখল নিতে দিলেন।
ঘন্টাখানেকের মধ্যে, যখন এক জোলো শীতের আলো শহরকে ধুয়ে দিচ্ছিল, তখন ঝাখারভ নামে এক অনন্যসাধারণ সামরিক স্কুলের ছাত্র, যিনি বিপ্লবের পক্ষে চলে এসেছিলেন, কেক্সগোলমস্কি রেজিমেন্টের একটি অংশকে নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে গেলেন প্রধান টেলিফোন এক্সচেঞ্জের দখল নিতে। এই টেলিফোন এক্সচেঞ্জে কাজ করার দরুণ জাকারভ নিরাপত্তার যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়গুলো জানতেন।তার নেতৃত্বে সেনাদল যখন বিপ্লবীদের পক্ষ নিয়ে এক্সচেঞ্জটিতে প্রবেশ করে, তখন তিনি খুব সহজেই নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ক্ষুব্ধ, কিন্তু ক্ষমতাহীন শিক্ষানবিশদের নিরস্ত্র ও বিচ্ছিন্ন করেন। বিনারক্তপাতে বিপ্লবীরা সরকারী সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সমর্থ ও সফল হন।
তাঁরা কিন্তু দুটি লাইন খুঁজে পেলেন না। এই দুটির সাহায্যে, উইনটার প্যালেসের ম্যালাকাইট রুম বলে পরিচিত সাদার ওপর সোনালী বর্ডার দেওয়া মখমলের পর্দায় কারুকার্য শোভিত ঘরটিতে বসা মন্ত্রী পরিষদের সদস্যরা তাঁদের যৎসামান্য ফৌজী শক্তিদের সাথে সংযোগ রক্ষা করেন। বিচলিত চাপা স্বরে ফোনে তারা তাদের অবশিষ্ট সামরিক শক্তিকে উদ্ভ্রান্তের মতো নির্দেশ দিয়ে চলছিলেন। এই গোলমালের মধ্যে চুপচাপ, উদাসীন ভঙ্গিতে বসেছিলেন কেরেনস্কি।
তখন মাঝ-সকাল। ক্রোনস্টাডের নাবিকরা আগের মতই অস্ত্র হাতে যে যেমন পারেন সমুদ্রযাত্রা করা যায় এমন যানে চেপে বসেন। হেলসিংফোর্স থেকে তাঁরা রওনা হলেন পাচটা ডেস্ট্রয়ার আর একটা পেট্রল বোটে চেপে, সবকটাতেই বিপ্লবের লাল নিশান উড়িয়ে। গোটা পেত্রোগ্রাদ জুড়ে বিপ্লবীরা তখন আরো একবার জেলখানাগুলো খালি করে দিচ্ছিলেন।
স্মোলনিতে বলশেভিক কর্মকাণ্ড-পরিচালন কক্ষে একটা উসকোখুসকো চেহারার লোক ঢুকে পড়েছিল। উপস্থিত কর্মীরা নবাগতের দিকে বিস্মিত ও বিব্রতভাবে তাকান। শেষ পর্যন্ত ভ্লাদিমির বঞ্চ-ব্রুয়েভিচ্ চীৎকার করে হাত বাড়িয়ে দৌড়ে যানঃ “ ভ্লাদিমির ইলিচ , আমাদের প্রিয় নেতা! আমি আপনাকে চিনতেই পারিনি!”
লেনিন একটা ঘোষণাপত্রেরর খসড়া লিখতে বসলেন। তিনি সময়ের ব্যাপারে উদ্বেগে কাপছিলেন, কারণ তিনি ব্যাকুলভাবে চাইছিলেন যে দ্বিতীয় সোভিয়েত কংগ্রেস যখন শুরু হবে, তাঁর আগেই যেন সরকারের উচ্ছেদ চূড়ান্ত হয়ে যায়। তিনি ভালই জানতেন ঘটে যাওয়া ঘটনার একটা ক্ষমতা আছে।
রাশিয়ার সব নাগরিকদের প্রতিঃ
অস্থায়ী সরকারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতা চলে গেছে পেত্রোগ্রাদ শ্রমিক ও সৈনিকদের প্রতিনিধিদের সংস্থা সামরিক বিপ্লবী কমিটির হাতে। এই কমিটি দাঁড়িয়ে আছে পেত্রোগ্রাদের ছাউনী এবং প্রলেতারিয়েতের শীর্ষে।
যে দাবীগুলির জন্য জনগণ লড়াই করেছেন, অর্থাৎ গণতান্ত্রিক শান্তির আশু প্রস্তাব, জমিদারদের জমি দখল, উৎপাদনের উপর শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ, একটি সোভিয়েত সরকার – সেই দাবীগুলির বিজয় আজ নিশ্চিত হয়েছে।
শ্রমিক, সৈনিক ও কৃষকদের বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক!
|
|
সামরিক বিপ্লবী কমিটির উপযোগিতা সম্বন্ধে ইতিমধ্যে লেনিন নিঃসন্দেহ, তাই তিনি ঘোষণাপত্রটি বলশেভিকদের নামে স্বাক্ষর করেন নি, বরং করেছিলেন ঐ “অ-পার্টি” সংস্থার নামে। ঘোষণাপত্রটি দ্রুত মুদ্রিত হল সিরিলিক হরফের বড়, বলিষ্ঠ ব্লকে। মুদ্রিত বিজ্ঞপ্তি দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার হিসেবে লটকে দেওয়া হয়।
তার-যন্ত্রের সাহায্যে বিজ্ঞপ্তির মূল বার্তা সঞ্চালকগণ রাশিয়ার নানা প্রান্তরে ছড়িয়ে দেন।
বাস্তবটা তত সহজ ছিল না, কিন্তু সেটা ছিল একটা ঐকান্তিক প্রচেষ্টা।
উইন্টার প্যালেসে ঘেরাও হয়ে থাকলেও তার-যোগে কেরেনস্কি রাজধানীর জন্য সেনা পাঠানোর বার্তা দিতে তখনও সক্ষম ছিলেন। কিন্তু সেই সেনাদের বাস্তবে কেরেনস্কীর কাছে পৌঁছানো সহজ ছিল না।তিনি পালাতে পারলেও, সামরিক বিপ্লবী কমিটি রেল স্টেশনগুলি নিয়ন্ত্রণ করছিল।
কেরেনস্কির সাহায্যের দরকার ছিল।সেনাপ্রধানদের দপ্তর দীর্ঘ এবং ক্রমেই উন্মত্ত অন্বেষণে অবশেষে একটা নির্ভরযোগ্য মোটর গাড়ি পায়।অনুরোধ করে তারা আমেরিকার দূতাবাস থেকে আরো একটি গাড়ি যোগাড়করে,যেটার সামনে কূটনৈতিক পরিচয়বাহী প্লেট থাকায় তা কেরেনস্কির জন্য সুবিধাজনক ছিল।
২৫ তারিখ। বেলা ১১টার কাছাকাছি হবে।লেনিনের ঘোষণাপত্র, যেটা আগাম ইচ্ছাকে বাস্তব বলে জানাচ্ছিল, চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।এই রকম সময়ে গাড়িদুটো সামরিক বিপ্লবী কমিটি -র যত না সক্ষম তার চেয়ে বেশী উৎসাহী রাস্তা-রোখো পেরিয়ে চলে গেল।
ভগ্ন-বিধ্বস্ত কেরেনস্কি গুটিকয় সাঙ্গোপাঙ্গকে সঙ্গে নিয়ে অনুগত সৈন্যদের খোঁজে শহর ছেড়েছেন।
অনেক নাগরিকেরই মনে হচ্ছিল যে এই আলোড়ন সত্ত্বেও পেত্রোগ্রাদে দিনটা যেন আর একটা স্বাভাবিক দিনেরই মতো। অবশ্যই, কিছুটা ছোটখাটো সংঘর্ষ, হৈ চৈ ও গন্ডগোলকে অস্বীকার করা অসম্ভব হয়ে উঠছিল, কিন্তু অপেক্ষাকৃত অল্পসংখ্যাক মানুষ বাস্তবে লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, আর সেও আবার বাছাই করা কেন্দ্রগুলিতে। এই অল্প সঙ্গখ্যক মানুষ যখন তাঁদের বিপ্লবী বা প্রতিবিপ্লবী কাজ করে চলেছিলেন, পৃথিবী পুনর্বিন্যাস করতে চেয়ে, তখন রোজকার মতো ট্রাম রাস্তায় সচল ছিল, আর অধিকাংশ দোকান-পাট ছিল খোলা।
দুপুর নাগাদ সশস্ত্র বিপ্লবী সৈনিক ও নাবিকরা মারিনস্কি প্রাসাদে পৌঁছায়। প্রাক্-পার্লামেন্টের সদস্যরা যারা সেখানে অধীর আগ্রহে নিজেদের মধ্যে এই নাটকীয় মুহূর্ত সম্পর্কে আলোচনা করছিল, তারা অচিরে এইঘটনাবলীর সক্রিয় কুশীলবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চলেছিল।
এম আর সি-র একজন কমিশার ঝড়ের গতিতে থিয়েটার হলটায় ঢুকলেন। তিনি প্রাক্-পার্লামেন্টের সভাপতির আসনে বসা আভক্সেনতিয়েভের উদ্দেশ্যে নির্দেশ দিলেন প্রাসাদ ত্যাগ করতে। সশস্ত্র সেনা এবং নাবিকরা তাদের অস্ত্রের ঝঙ্কার তুললো। তুমুল হৈ-হট্টগোলের পরিস্থিতি সৃষ্টি হল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় আভক্সেনতিয়েভ দ্রুত স্ট্যারিং কমিটির যতজন সম্ভব সদস্যকে একত্রিত করলেন ।তারা জানেন প্রতিরোধ মূল্যহীন,কিন্তু তারা চলে যাওয়ার আগে যতটা সম্ভব আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ করে গেলেন, এবং প্রতিশ্রুতি দিলেন যে যথাশীঘ্র সম্ভব তাঁরা আবার জমায়েত হবেন।
হুল ফোটানো কনকনে শীতের মধ্যেই তারা বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলেন।নতুন দ্বাররক্ষীরা তাদের কাগজ পত্র পরীক্ষা করলেও, বেশীক্ষণ আটকালো না। করুণ এই প্রাক্-পার্লামেন্ট নয়, আসল যে লক্ষ্য হাতে না পাওয়াতে লেনিন ক্ষেপে যাচ্ছিলেন, সেটা তখনও বিপ্লবীদের এড়িয়ে গিয়েছিল।
সেই অভিষ্ট লক্ষ্য বা পুরষ্কার তখন উইন্টার প্যালেসে, কেরেনস্কিহীন অবস্থায়। সেইখানে, তাঁদের জগত যখন ভেঙ্গে পড়ছে, তখনও অন্তর্বর্তী সরকারের আগুনের শেষ আভাটুকু জ্বলছে।
দুপুরে ম্যালাকাইট রুম নামে পরিচিত মস্ত ঘরটায় টেক্সটাইল মিল মালিক ও কাডেট নেতা কোনোভালভ ক্যাবিনেটের সভা বসালেন।
নৌবাহিনীর মন্ত্রী, অ্যাডমিরাল ভেরদেরেভস্কি চাপা স্বরে বললেন, “এই অধিবেশন যে কেন ডাকা হল তার কারণটাই আমি বুঝে উঠতে পারছি না।” আক্ষেপের সুরে তিনি বলে চলেন, “আমাদের কাছে সেই সামরিক শক্তি নেই যার সাহায্যে আমরা যথাযত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারি।” তিনি প্রস্তাব করলেন, হয়তো প্রাক-পার্লামেন্টের সঙ্গে একত্রে বসা উচিত ছিল – এমন সমেয়ে খবর এল, প্রাক পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে।
তখনও মন্ত্রীরা নানা প্রতিবেদন গ্রহণ করে চলেছেন এবং সেখানে হাজির ক্ষমতাহীন শলাপরামর্শকারীদের উদ্দেশ্যে নানা কাতর আহ্বান জানাচ্ছেন। যারা ভেরদেরেভস্কির শোকার্ত বাস্তবতায়কান দিতে চাইছেন না, তাঁরা কল্পনাবিলাসে লিপ্ত হলেন। ক্ষমতার শেষ সুতোটুকুও যখন উবে যাচ্ছে, তাঁরা তখন নতুন কর্তৃত্বের স্বপ্ন দেখছিলেন।
এই পৃথিবীর সকল ঐকান্তিকতাকে সঙ্গে নিয়ে, রাশিয়ার অস্থায়ী সরকারের ভষ্মতর্ক করতে থাকে, আগামী একনায়ক কাকে করা হবে, যেন নিভন্ত দেশলাইকাঠিরা গল্প শোনাচ্ছে, তারা অচিরে যে বিধ্বংসী অগ্নিকান্ডের শুরু করবে সেটার।
এই সময় ক্রোনস্টাডের বাহিনী জলপথে পেত্রোগ্রাদ পৌঁছালো। তাদের কাছে একটা সাবেকী প্রমোদ তরী – ইয়ট্, দুটো মাইনলেয়ার, প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত একটা জাহাজ, একটা পুরনো যুদ্ধ-জাহাজ, এবং একগুচ্ছ ছোটো ছোটো বার্জ। এ আর এক উন্মত্ত নৈবহর।
মন্ত্রীসভা যেখানে বসে স্বৈরতন্ত্রের কল্পনায় বুঁদ হয়েছিল, তার খুব কাছেই বিপ্লবী নাবিকরা অ্যাডমিরাল্টি দখল করে নৌবাহিনীর উপরমহলকে গ্রেপ্তার করছিল। পাভলভস্কি রেজিমেন্টসেতুগুলোর ওপর পিকেট বসাচ্ছিল। মইকা নদীর উত্তরের অংশ নিয়ন্ত্রণ করছিল কেক্সগোল্মস্কি রেজিমেন্ট।
উইন্টার প্যালেস দখল করার সময় যা নির্ধারিত হয়েছিল সেই দুপুর বারোটা এসে চলে গেছে। সময়কাল তিন ঘন্টা পিছিয়ে দেওয়া হয়, অর্থাৎ সরকারকে গ্রেপ্তার করার সময় ঠিক হল দুপুর দুটোয় সোভিয়েত কংগ্রেস সূচনা হওয়ার পরে। লেনিন এইটাই এড়াতে চেয়েছিলেন। সুতরাং কংগ্রেস সূচনাটা পিছিয়ে দেওয়া হল।
কিন্তু স্মোলনির হল তখন পেত্রোগ্রাদ আর প্রাদেশিক সোভিয়েতগুলি থেকে আসা প্রতিনিধি ঠাসা। তাঁরা খবর চাইছিলেন। তাঁদের অনন্তকাল ঠেকিয়ে রাখা যায় না।
সুতরাং দুপুর দুটো পঁয়ত্রিশে ট্রটস্কী পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের এক জরুরী অধিবেশন শুরু করলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, “সামরিক বিপ্লবী কমিটির পক্ষে আমি ঘোষণা করছি, যে অস্থায়ী সরকারের আর কোনো অস্তিত্ব নেই”।
তাঁর কথা ঝোড়ো উল্লাসের জন্ম দিল। উত্তেজনার উপরে গলা তুলে ট্রটস্কী বলে চললেন, গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানরা সামরিক বিপ্লবী কমিটির হাতে। উইন্টার প্যালেস ক্ষণিকের মধ্যে পড়ে যাবে। আরেকটা বিরাট জয়ধ্বনি শোনা গেল। লেনিন সভাকক্ষে প্রবেশ করছেন।
ট্রটস্কী বলে উঠলেন, “কমরেড লেনিন আমাদের মধ্যে ফিরে এসেছেন। কমরেড লেনিন দীর্ঘজীবি হোন!”
জুলাইয়ের পর এই প্রথম লেনিন প্রকাশ্যে বেরিয়েছেন। তাঁর আগমন ছিল ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু উল্লাসপূর্ণ। তিনি বিশদে কিছু বললেন না, কিন্তু ঘোষণা করলেন, “নতুন পর্ব শুরু হয়েছে”, এবং উদ্বুদ্ধ করলেনঃ “দুনিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।”
যারা উপস্থিত তাঁদের অধিকাংশ হর্ষধ্বনিতে মুখরিত হলেন। কিন্তু বিরোধী মত ছিল। কেউ একজন চীৎকার করে বলে, “তোমরা সোভিয়েত কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত আগাম স্থির করছ”।
ট্রটস্কী পাল্টা ডেকে বললেনঃ “সোভিয়েদের দ্বিতীয় কংগ্রেসের ইচ্ছা নির্ধারিত হয়েছে শ্রমিক ও সৈনিকদের অভ্যুত্থানের বাস্তবতা দিয়ে। এখন আমাদের বাকি শুধু এই বিজয়কে বিকশিত করা”।
কিন্তু ভোলোদারস্কি, জিনোভিয়েভ এবং লুনাচারস্কির ঘোষণাদের মাঝে, ছোট একদল নরমপন্থী, অধিকাংশ মেনশেভিক, সোভিয়েতের কার্যনির্বাহী প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে সরে গেলেন। তাঁরা সতর্ক করলেন, এই চক্রান্তের ফল হবে ভয়াবহ।
প্রায় আট ঘণ্টা দেরী করার পর সোভিয়েত প্রতিনিধিদের আর ঠেকানো যাচ্ছিল না। ঐ প্রথম কামান দাগার ঘন্টাখানেক পর স্মোলনির সুবিশাল এসেম্বলি হল ঘরে সোভিয়েত দ্বিতীয় কংগ্রেস আরম্ভ হয়।
সিগারেটের ঝাপসা নীল ধোঁয়ায় ঘরটার মধ্যে বারবার শোনা যাচ্ছে যে ধূমপান নিষিদ্ধ, যদিও ধূমপায়ীরাও সহর্ষে ধূমপায়ীরা সেই নিষেধজ্ঞার পুনরুচ্চারণ করছিলেন। সুখানভ শিহরণের সঙ্গে লিপিবদ্ধ করে গেছেন যে প্রতিনিধিদের অধিকাংশের ছিল “বলশেভিক প্রদেশগুলির ধূসরতা”। তাঁর সূক্ষ্ম এবং বৌদ্ধিক চোখে তাঁদের লাগছিল “গোমড়া’, এবং “আদিম” এবং “ঘোর কালো” “অভদ্র এবং অজ্ঞ” ।
৬৭০ প্রতিনিধির মধ্যে ৩০০ জন ছিলেন বলশেভিক। ১৯৩ জন সোশ্যালিস্ট-রেভল্যুশনারি, যাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশী তখন পার্টির বামপন্থী অংশে; ৬৮ জন মেনশেভিক এবং ১৪ জন মেনশেভিক-আন্তর্জাতিকতাবাদী। বাকীরা কোনো দলের অনুমোদিত নন, অথবা ক্ষুদ্র কোনো গোষ্ঠীর সদস্য।বলশেভিকদের উপস্থিতির আয়তন দেখিয়ে দেয়, যারা ভোট দিয়ে প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে বলশেভিকদের প্রতি সমর্থন বাড়ছিল, এবং ঢিলেঢালা নির্বাচন পদ্ধতির ফলে তাঁরা আনুপাতিক হারের চেয়ে বেশীই প্রতিনিধি পেয়েছেন। তা হলেও, বামপন্থী সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীদের সমর্থন ছাড়া সংখ্যাধিক্যের কোনো সম্ভাবনা ছিল না।
তবেসভা সূচনারঘণ্টা যিনি বাজালেন, তিনি কিন্তু বলশেভিক নন, একজন মেনশেভিক।বলশেভিকরা দানের আত্মম্ভরিতার সুযোগ নিয়ে তাঁকে এই ভূমিকা পালনের প্রাস্তাব দিলেন।কিন্তু তিনি ততক্ষণাৎ আন্তঃপার্টি সহযোগিতার আশায় ঠান্ডা জল ঢেলে দিলেন।
দান ঘোষণা করলেন, “কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি আমাদের প্রথাসিদ্ধ প্রারম্ভিক রাজনৈতিক সম্ভাষণকে অপ্রয়োজনীয় বিবেচনা করে।এমনকি এখনও, আমাদের যে সব কমরেডদের আমরা দায়িত্ব দিয়েছিলাম, তাঁরা নিঃস্বার্থভাবে তা পালন করতে উইন্টার প্যালেসে গোলাগুলির মুখে দাঁড়িয়ে আছেন”।
দান এবং অন্যান্য নরমপন্থীরা, যাঁরা মার্চ মাস থেকে সোভিয়েত পরিচালনা করছিলেন, তাঁরা আসন ছেড়ে দিলেন এক নতুন, আনুপাতিক হারে নির্বাচিত সভাপতি মন্ডলীকে। তুমুল সমর্থনের মধ্যে নির্বাচিত হলেন চোদ্দজন বলশেভিক, যাদের মধ্যে ছিলেন কোলোন্তাই, লুনাচারস্কি, ট্রটস্কি এবং জিনোভিয়েভ, ও সাতজন বামপন্থী এস আর, যাদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত মারিয়া স্পিরিদোনোভা। মেনশেভিকরা প্রবল অসন্তোষে তাদের তিনটে আসন পরিত্যাগ করলেন।মেনশেভিক-আন্তর্জাতিকতাবাদীদের জন্য একটা আসন বরাদ্দ ছিলঃ একই সঙ্গে মর্যাদাপূর্ণ এবং করুণ পদক্ষেপে মার্তভেরগোষ্ঠী আসন তখন নিল না, কিন্তু পরে নেওয়ার অধিকার জানিয়ে রাখল।
নতুন বিপ্লবী নেতৃত্ব যখন তাদের পরবর্তী কর্মসূচী নির্ধারণের কাজে বসেছেন, ঠিক তখনই কামানের একটা গোলা বিস্ফোরণের প্রতিধ্বনিতে গোটা ঘরটা কেঁপে উঠলো।
সকলে যেন স্তব্ধ হয়ে গেলেন।
এবারের কামান গর্জন এসেছিল পিটার ও পল দূর্গ থেকে। অরোরা যুদ্ধজাহাজ যেখানে ফাঁকা আওয়াজ করছিল, এক্ষেত্রে কিন্তু তা নয়।
বোমা বিস্ফোরণের তৈলাক্ত চমক নেভা নদীর উপর দেখা দিল। গোলা বাঁকা পথে উপরে উঠছিল, আর রাতের আঁধারে সশব্দে নামছিল তাদের লক্ষ্যর দিকে। অনেকগুলো, হয় দয়াবশত, অথবা অযোগ্যতার দরুণ, দৃশ্যমানভাবে ফাটলো আকাশে,ফাঁকা আওয়াজ করলো।অন্য অনেকগুলি আবার গভীর জলে পড়ল, চারিদিকে জল ছিটিয়ে দিল।
লালরক্ষী বাহিনীও তাদের অবস্থান জানান দিয়ে গুলি-গোলা ছুঁড়ছিল।তাদের বুলেটগুলি উইন্টার প্যালেসের দেওয়ালে দাগ ফেলছিল।সরকারের অবশেষটুকু তখন ভয়ে গুটিসুটি মেরে টেবিলের তলায়, তাঁদের চারদিকে কাচের টুকরো বর্ষিত হচ্ছিল।
স্মোলনিতে সেই গোলাবর্ষণেরর করাল ধ্বনির মধ্যে মার্তভ তাঁর কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠেবলতে উঠলেন।তিনি একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজছিলেন।ভাঙ্গা গলায়তিনি যুদ্ধ বিরতির আহ্বান জানান।তিনি একটা সমাজতান্ত্রিক জোট সরকার চাইছিলেন যেটা রাজনৈতিক দলগুলির সমবেত বোঝাপড়ায় গঠিত হবে।
সহস্র শ্রোতার মিলিত কলরোলে বক্তাদের আহ্বান মাঝে মাঝেই থেমে যাচ্ছিল।সভাপতিমণ্ডলীর থেকেইবাম এসআর নেতা মস্তিস্লাভস্কি মার্তভকে পূর্ণ সমর্থন দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন। চীৎকার উঠলোঃ খুব হয়েছে! থামুন! মুর্দাবাদ। একেবারে নীচের স্তরের বলশেভিক সদস্যরা এটা করছিল।
পার্টির নেতৃত্বের পক্ষে লুনাচারস্কি বলতে উঠলেন। ব্যাপক উত্তেজনায় তিনি ঘোষণা করলেন, “আমরা বলশেভিকরা মার্তভ উত্থাপিত এই প্রস্তাবের ওপর ভোটে যাবো না।”
উপস্থিত প্রতিনিধিদের মধ্যে মার্তভ-এর প্রস্তাবের ওপর ভোট শুরু হয়। সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব পাস হয়।
সান ফ্রান্সিস্কো বুলেটিন পত্রিকার সাংবাদিক বেসি বেট্টি ঘরটায় ছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে তিনি যা দেখছেন তার ঝুঁকি কোথায়। তিনি লিখছেন, “রাশিয়ান বিপ্লবের ইতিহাসে এটা ছিল একটা জটিল মুহূর্ত।” দেখে মনে হল যেন একটা গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক জোটের জন্ম হতে চলেছে।
কিন্তু সময় যত বয়ে চললো, নেভার উপরে তোপের ধ্বনি বাড়তে লাগলো। আর তার প্রতিধ্বনি ঘরটাকে কাঁপিয়ে তুলছিল – এবং পার্টিদের মধ্যে ফাটলটা ক্রমে আবার স্পষ্ট হতে লাগলো।
এক মেনশেভিক সামরিক অফিসার, খারাশ ঘোষণা করলেন, “সারা রুশ কংগ্রেসের নেপথ্যে একটা অপরাধমূলক রাজনৈতিক অভিসন্দি কাজ করছে।” আরও স্পষ্ট করে তিনি বললেন, “মেনশেভিক এবং এসআররা তার সর্বশক্তি দিয়ে এখানে যা চলছে তা প্রত্যাখান করছে এবং অঙ্গীকার করছে যে তারা সরকারকে ক্ষমতাহীন করার সকল প্রচেষ্টাকে দৃঢ় ভাবে রুখে দেওয়ার চেষ্টা করবে।”
এক ক্রুদ্ধ সৈনিক চীৎকার করে বলেঃ “ও দ্বাদশ আর্মির প্রতিনিধিত্ব করছে না! সেনাবাহিনী দাবী করছে সোভিয়েতদের হাতে সব ক্ষমতা!”
এক গুচ্ছ আক্রমণাত্মক মন্তব্য। দক্ষিণপন্থী মেনশেভিক এবং এস আররা, পালা করে বলশেভিকদের প্রতি নিন্দাসূচক মন্তব্য চীৎকার করে বলতে থাকেন। তাঁরা সাবধান করে দেন, তাঁরা কার্যপ্রণালী থেকে সরে যাবেন। বামপন্থীরা চীৎকার করে তাঁদের থামিয়ে দেন।
পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে লাগলো। মস্কো সোভিয়েতের খিঞ্চুক বলতে ওঠেন। তিনি বলেনঃ“বর্তমান সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের একমাত্র পথ হল অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে আপোস আলোচনা চালিয়ে যাওয়া।”
হট্টমেলা। খিঞ্চুক-এর হস্তক্ষেপ ছিল হয় কেরেনস্কীর প্রতি মানুষের ঘৃণা যে কতখানি তা সর্বতোভাবে বুঝতে না পারা, অথবা এক সচেতন উস্কানী। এতে সাড়া দিয়ে তীব্রভাবে আক্রোশ প্রকাশ করলেন এক বিশাল স্তরের মানুষ, শুধু বলশেভিকরা না। অবশেষে, এই তুমুল শব্দের মধ্যে খিঞ্চুক চীৎকার করে জানালেন, “আমরা বর্তমান কংগ্রেস ত্যাগ করছি।”
সভাকক্ষে এমন ছিছিক্কার, অবজ্ঞাসূচক ধ্বনি, শিষ দেওয়ার আওয়াজ প্যাঁক, টিটকিরি সত্ত্বেও মেনশেভিক এবং এসআররা ইতস্তত করছিলেন। তারা জানতেন যে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি হল শেষ তুরুপের তাস।
পেত্রোগ্রাদের অন্য প্রান্তে, দুমা আলোচনা করছিল ম্যাসলভের মৃত্যু-বার্তা-বাহক টেলিফোন কলটি।এসআর দলের নাউম বাইখভস্কি বলেনি-- “আমাদের কমরেডদের জানিয়ে দেওয়া হোক যে আমরা তাদের ত্যাগ করিনি, তাদের জানতে হবে যে আমরা তাদের সঙ্গেই মরবো।” নরমপন্থী এবং রক্ষণশীলরা উঠে দাঁড়িয়ে ভট দিলেন, তাঁরা উইন্টার প্যালেসে যারা বাঙ্কারে আটক, তাঁদের সঙ্গে যোগ দেবেন। বর্তমান সরকারের জন্য প্রাণ দিতে তারা প্রস্তুত। ক্যাডেট দলের কাউন্টেসসোফিয়া পানিনা ঘোষণা করেন, তিনি“কামানের সামনে বুক পেতে দাঁড়াবেন।”
বলশেভিক প্রতিনিধিরা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিলেন। তারা জানালেন যে তারাও যাএন – কিন্তু উইন্টার প্যালেসে না, সোভিয়েতের দিকে।
নাম ডাকার কাজ শেষ হল। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী শোভাযাত্রা হাঁটা দিল অন্ধকারের মধ্যে।
স্মোলনিতে ইহুদী সোশ্যাল-ডেমোক্রাটদের সংস্থা বুন্দের পক্ষে এরলিশসভার কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়ে নগর দুমা প্রতিনিধিদের শোভাযাত্রার খবর দিলেন। তিনি বললেন, “যারা চান না যে রক্তস্নান ঘটুক” তাঁরা যেন মন্ত্রীসভার প্রতি সংহতি জ্ঞাপন করে প্রাসাদের দিকে শোভাযাত্রায় যোগ দেনআবারও বামপন্থীদের নিন্দাসূচক ধ্বনির মধ্যে মেনশেভিকরা, বুন্দ সদস্যরা, এস আর রা, এবং অল্প সংখ্যক অন্যরা উঠে, অবশেষে বেরিয়ে গেলেন। থেকে গেলেন পড়ে রইলো বলশেভিকরা, বাম এসআর-রা এবং উত্তেজিত মেনশেভিক-আন্তর্জাতিকতাবাদীরা।
ধীর পদক্ষেপে বৃষ্টিস্নাত শীতের রাতে হেঁটে স্মোলনি থেকে স্বেচ্ছা-নির্বাসিত নরমপন্থীরা পৌঁছলেন নেভস্কি প্রসপেক্টে এবং দুমাতে । সেখানে তাঁরা যোগ দিলেন দুমা ডেপুটিদের সঙ্গে, কৃষক সোভিয়েতের কার্যনির্বাহী কমিটির মেনশেভিক এবং এসআর সদস্যদের সঙ্গে, এবং ঐক্যবদ্ধভাব তাঁরা সকলে রওনা দিলেন মন্ত্রীসভার সঙ্গে সংহতি জানাতে। চারজন করে এক সঙ্গে হাঁটতে থাকলেন যোগান মন্ত্রী সেরগেই প্রকোপোভিচ্ এবং মেয়র শ্রাইদারের পিছনে।তিনশ জনের এই দলটি অস্থায়ী সরকারের জন্য প্রাণ দিতে বেরিয়ে পড়ল, হাতে তাদের মন্ত্রীদের উদরপূর্তির জন্য রুটি আর সসেজ, গলায় কাঁপা কাঁপা স্বরে [ফরাসী বিপ্লবের গান] লা মার্সেয়াস।
তারা এক ব্লকের বেশী যেতে ব্যর্থ হয়েছিল। ক্যানেলের কোনার দিকটায় তাদের যাওয়ার পথেই বরং বিপ্লবীরা তাঁদের পথ আটকে দেয়।
“আমাদের পথ ছেড়ে দেওয়ার দাবি করছি!” – শ্রাইদার এবং প্রোকোপোভিচ্ চীৎকার করে বলে। “আমরা উইন্টার প্যালেসে যেতে চাই।”
একজন নাবিক হতবুদ্ধি হয়ে গেল। যদিও সে তাদের যেতে দিতে অস্বীকার করলো।
মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা বলল, “তুমি চাইলে আমাদের গুলি করে মারতে পারো!আমরা মরতে রাজী, যদি তুমি রাশিয়ানদের এবং কমরেডদের মারতে চাও...আমরা তোমার বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিচ্ছি।”
সেই অদ্ভুত পরিস্থিতি চলতেই থাকলো। বামপন্থীরা গুলি চালাতে অস্বীকার করে, আর দক্ষিণপন্থীরা দাবী করে হয় তাঁদের যেতে দিতে হবে না হলে গুলি করতে হবে।
“তুমি কি করতে চাও?” চীৎকার করে প্রশ্ন করা হল সেই নাবিকটির প্রতি, যে তাঁদের হত্যা করতে অরাজী ছিল।
এরপর কি ঘটলো তা জন রীডের প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণে বিখ্যাত হয়ে আছে।
অন্য একজন নাবিক একমুখ বিরক্তি নিয়ে দ্রুত এগিয়ে এলো। “আমরা তোমায় একটা থাবড়া মারবো!” সে সর্বশক্তি দিয়ে চীৎকার করে উত্তর দিল। “এবং যদি প্রয়োজন পড়ে আমরা তোমায় গুলি করেও মারতে পারি। বাড়ি যাও, আমাদের শান্তিতে থাকতে দাও।’’
গণতন্ত্রেরযোদ্ধাদের জন্য এটা কেমন বেমানান ভবিতব্য ঠেকছিল। একটা বাক্সের ওপর দাঁড়িয়ে প্রোকোপোভিচ্ তাঁর ছাতাটা নেড়ে অনুগামীদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলেন যে তাঁরা এই নাবিকদের তাঁদের নিজেদের হাত থেকে বাচাবেনঃ “এই অজ্ঞ লোকগুলির হাতে আমাদের নির্দোষ রক্ত থাকবে, এ আমরা হতে দিতে পারি না...। এখানে রেলের কর্মচারীদের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মরা [এবং অবশ্যই থাপ্পড় খাওয়া] আমাদের মর্যাদার নীচে পড়ে। বরং দুমায় ফিরে গিয়ে দেশ ও বিপ্লব বাঁচাবার সর্বোত্তম উপায় নিয়ে আলোচনা করা ভালো।”
অতঃপর নীরব মর্যাদায় উদারনৈতিক গণতন্ত্রের স্ব-ঘোষিত মরণযাত্রা পিছন ফিরল, তার অতীব লজ্জাকর হ্রষ প্রত্যাবর্তন পথে পা বাড়াল, আর তাদের সসেজ নিতে ভুললো না।
মার্তভ তখনও এ্যসেম্বলি হলে জনগণের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত। তিনি তখনও রফার জন্য ব্যাকুল। এবার তিনি প্রস্তাব আনলেন, বলশেভিকদের সমালোচনা করে, যে বলশেভিকরা সোভিয়েত কংগ্রেসের ইচ্ছা আগাম ভেবে নিয়েছেন, এবং আবারও বলতে চাইলেন যেন প্রশস্ত, সকলকে নেওয়া সমাজতান্ত্রিক সরকার গড়ে তোলা যায়। এই প্রস্তাব দু’ঘণ্টা আগে দেওয়া তাঁর প্রস্তাবের অনুরূপ। তখন, লেনিনের নরমপন্থীদের সঙ্গে ভাঙ্গন চাইলেও, বলশেভিকরা ঐ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন নি।
কিন্তু দু’ঘণ্টা ছিল অনেকটা সময়।
যেই মার্তভ বসলেন, তখনই একটা আলোড়ন দেখা গেল। দুমার বলশেভিক অংশ হলটাতে প্রবেশ করলো। প্রতিনিধিরা কিছুটা বিস্মিত এবং কিছুটা উজ্জীবিত হল। তাঁরা বললেন, তাঁরা এসেছেন, “সারা রুশ সোভিয়েত কংগ্রেসের সঙ্গে মৃত্যু অথবা গৌরবময় সাফল্য অর্জন করতে।”
উল্লাস ও হর্ষধ্বনী যখন কিছুটা স্তিমিত হল, ট্রটস্কি স্বয়ং উঠলেন মার্তভের কথার উত্তর দিতে। তিনি বললেনঃ “একটা গণ অভ্যুত্থানের কোনো যৌক্তিকতা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। যা ঘটেছে তা একটা অভ্যুত্থান, কোনো ষড়যন্ত্র নয়। আমরা পেত্রোগ্রাদের শ্রমিক ও সৈনিকদের বিপ্লবী শক্তিকে শান দিয়েছি,; আমরা প্রকাশ্যেই জনগণের চেতনাকে গড়ে তুলেছি, কোনো ষড়যন্ত্র করিনি। জনগণ আমাদের নিশানকে অনুসরণ করেছেন এবং আমাদের অভ্যুত্থান সাফল্য পেয়েছে। এবং এখন আমাদের বলা হচ্ছেঃ তোমাদের জয় তোমরা পরিহার করো, ছাড় দাও, আপোসে এসো। কিন্তু কার সঙ্গে আপোস? আমি প্রশ্ন করিঃ কাদের সঙ্গে আমরা আপোস-আলোচনা করবো? সেই সব ঘৃণ্য, নোংরা গোষ্ঠীর সঙ্গে যারা আমাদের এক সময় দূরে সরিয়ে দিয়েছিল, অথবা যারা এই অসাম্যের প্রস্তাবনা গঠন করেছে? কিন্তু আমরা তাদের পুরোপুরিভাবে চিনি। রাশিয়ার কেউই প্রায় এখন আর এদের সঙ্গে নেই।আমাদের নাকি সমানে সমানে একটা বোঝাপড়ায় আসতে হবে, যার একদিকে কয়েক লক্ষ শ্রমিক এবং কৃষক যাদের এই কংগ্রেস প্রতিনিধিত্ব করছে, আর একদিকে তারা, যারা তৈরি, এটা প্রথম নয় আবার শেষও নয়, বুর্জোয়ারা যেমন চায় তেমন ভাবে [ঐ শ্রমিক-কৃষকদের] বিকিয়ে দিতে। না, আপোস করা সম্ভব নয়। যারা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, অথবা যারা আমাদের এটা করতে বলছে, তাদেরকে বলবোঃ তোমরা দুর্দশাগ্রস্ত দেউলিয়া, তোমাদের খেলা শেষ। তোমরা যাও যেখানে তোমাদের খাঁটি জায়গা, সেই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে!”
উল্লাসে, হর্ষধ্বনিতে ঘরটা ফেটে পড়ল। দীর্ঘ হাততালির মধ্যেই মার্তভ উঠে দাঁড়িয়ে চীৎকার করে বললেনঃ “তাহলে আমরা এখান থেকে বেরিয়ে যাবো!”
তিনি ঘুরে দাঁড়াতেই একজন প্রতিনিধি তাঁর পথ আগলে দাঁড়ালো। লোকটা তাঁর দিকে তাকালো যেভাবে তাতে দুঃখ এবং অভিযোগ - দুয়েরই মিশ্রণ ছিল। সে বলে উঠলো, “আমাদের ভাবনা ছিল যে মার্তভ অন্তত আমাদের সঙ্গে থাকবেন।”
মার্তভ বললেন, “একদিন তোমরা বুঝবে,” তার কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ হল, “কোন্ অপরাধমূলক কাজে তোমরা অংশ নিয়েছো।”
তিনি দ্রুত ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলেন।
মার্তভ সহ অন্যান্যদের এই চলে যাওয়া প্রসঙ্গে কংগ্রেস দ্রুত এক আক্রোশসূচক প্রকাশ্য নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপন করলো। এই ধরনের জ্বালা-ধরানো মন্তব্য ঘরে তখনও উপস্থিত বাম এসআর এবং মেনশেভিক আন্তর্জাতিকতাবাদীদের চোখে ছিল অনাকাঙ্খিত এবং অপ্রয়োজনীয়। এমন কি, কিছু বলশেভিকও তেমনই মনে করেছিলেন।
বরিস ক্যামকভকে করতালি দিয়ে রক্তিম অভিনন্দন জানানো হল যখন তিনি ঘোষণা করলেন যে তার দল, বাম এসআর এই সভায় অংশ নেবে। তিনি মার্তভ-এর প্রস্তাবনাকে আবার নতুন করে তুলতে চাইলেন, এবং মৃদুভাবে বলশেভিক সংখ্যাগরিষ্ঠকে সমালোচনা করলেন । তিনি শ্রোতাদের মনে করিয়ে দিতে চাইলেন যে বলশেভিকরা কৃষকদের, এবং সামরিক বাহিনীর বড় অংশকে, সঙ্গে টেনে নিতে পারেন নি । আপোস-আলোচনার প্রয়োজনীয়তা এখনও ফুরায়নি।
এবার উত্তর ট্রটস্কি দিলেন না, দিলেন জনপ্রিয় লুনাচারস্কি – যিনি আগে মার্তভ-এর প্রস্তাবের সমর্থক ছিলেন। সামনের দিনগুলি যে দুঃসহ, তাতে তিনি সহমত হয়েই বললেন, “কিন্তু আমাদের সম্পর্কে ক্যামকভের সমালোচনা ভিত্তিহীন।”
লুনাচারস্কি বলে চলেছেন, “ক্যামকভকে সঠিক বলা যেত, যদি এই অধিবেশন সূচনার শুরুতে আমরা অন্য পক্ষদেরপ্রত্যাখ্যান করতে বা বাতিল করে দিতে কোনো পদক্ষেপ নিতাম। কিন্তু আমরা তো সকলেই সর্বসম্মতিক্রমে সংকট সমাধানের শান্তিপূর্ণ পথ প্রসঙ্গে মার্তভ-এর প্রস্তাবনা মেনে নিয়েছিলাম। এবং তার পর থেকে শুরু হল ঘোষণার পর ঘোষণার মহাপ্লাবন চলতেই থাকলো।... আমাদের কথা শোনা হয়নি, এমনকি তারা (মেনশেভিক এবং এসআর) তাদের নিজেদের প্রস্তাবনার ওপর আলোচনা করার প্রয়োজন বোধটাও করেনি। আমাদেরকে তারা এড়িয়ে চলছিল।”
এর জবাবে কেউ লুনাচারস্কিকে বলতে পারতেন যে সপ্তাহ কয়েক আগে থেকেই লেনিন জোর দিচ্ছিলেন যে তাঁর দলকে একাই ক্ষমতা দখল করতে হবে। কিন্তু সেই সেই শুভনাস্তিক্য থাকলেও, লুনাচারস্কি ঠিক ছিলেন।
মার্তভ যখন প্রথম সহযোগিতার, অর্থাৎ একটি ঐক্যবদ্ধ সমাজতন্ত্রী সরকারের প্রস্তাব করেছিলেন, তখন উল্লসিত সংহতিতে, বা অতীব আপত্তির সঙ্গে, বা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায়, বা যে কারণেই হোক না কেন, আর সব দলের অন্য সকলের মতই, হলে উপস্থিত বলশেভিকরা সকলেই সেটা সমর্থন করেছিলেন।
বেসি বিট্টির মতে, প্রথম প্রস্তাবের জবাবে ট্রটস্কী যে যত দ্রুত সক্রিয় হওয়া যায় ততটা হন নি, তার কারণ হয়তো “তিনি এই সব অন্য নেতাদের হাতে অতীতে যে সব অপমান সহ্য করেছিলেন তার তিক্ত স্মৃতির দরুণ”। এটা নিয়ে তর্ক করা যায়, এবং যদি বাঁ এই কথা সত্যি হয়, মেনশেভিকরা, দক্ষিণপন্থী এস আর-রা, এবং অন্যরা ঐ ভোট বলশেভিকদের মুখে ছুঁড়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁরা ঐখান থেকে সোজা বিরোধিতার জায়গায় চলে গিয়েছিলেন, এবং যারা তাঁদের চেয়ে বামপন্থী, তাঁদের নিন্দা করেছিলেন।
লুনাচারস্কির প্রশ্নটা যথার্থ ছিলঃ তুমি তাদের সঙ্গেকীভাবে সহযোগিতার পথে অগ্রসর হবে যারা সহযোগিতা প্রত্যাখ্যান করছে?
যেন তাঁর এই উক্তির যাথার্থ্য প্রমাণ করার জন্যই, সেই মুহূর্তে হল ঘরটা থেকে বেরিয়ে আসা নরমপন্থীরা সোভিয়েত কংগ্রেসকে “বলশেভিক প্রতিনিধিদের একটা ব্যক্তিগত সমাবেশ” তকমা দিচ্ছিলেন। তাঁরা ঘোষণা করলেন, “কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি মনে করে দ্বিতীয় কংগ্রেসঅনুষ্ঠিত হয়নি”।
হলের মধ্যে জোট সংক্রান্ত বিতর্ক চলতে থাকে গভীরতম রাত অবধি। কিন্তু ইতিমধ্যে জনম ঘুরে গেছে লুনাচারস্কি এবং ট্রটস্কীর দিকে।
উইন্টার প্যালেসে তখন শেষ খেলা।
চূর্ণ বিচূর্ণ ভাঙা কাঁচের মধ্যে দিয়ে কনকনে ঝোড়ো হাওয়া অনাহুতের মত ঢুকছে। বিশাল ঘরগুলি ঠান্ডা। আশাহত সৈনিকরা লক্ষ্যহীন হয়ে সিংহাসন ঘরের দু-মাথা ঈগলের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। আক্রমণকারীরা সম্রাটের ব্যক্তিগত কক্ষে পৌছল। ঘরটা ছিল ফাঁকা। তারা সময় নিয়ে সম্রাটের প্রতিকৃতিগুলিকেই আক্রমণ শুরু করল। দেওয়াল থেকে তাকিয়ে থাকা সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাসের আড়ষ্ট, শান্ত ছবিটাকে তারা বেয়নেট দিয়ে আঘাত করতে থাকল। বড় বড় নখওয়ালা পশুর আঘাতের মত করে তাঁরা ছবিটাকে শতছিন্ন করলো -- ভূতপূর্ব সম্রাটের মাথা থেকে পা অবধি।
কিছু ছায়ামূর্তি চোখের গোচরে-অগোচরে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, কিন্তু কে যে কি তা বোঝা তখন দুষ্কর ছিল।
লেফটেন্যান্ট সিনেগুব নামে একজন তখনও সরকার রক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।তিনি এলোমেলো ঘন্ট ধরে বারান্দাগুলোতে পায়চারি করে চলেন। তিন অপেক্ষা করছিলেন আক্রমণের, এবং ভেসে চলেছিলেন একরকম প্রাশান্ত ত্রাসে, এক অতীব নারকোটিক অবসাদে। তিনি পেরিয়ে যাচ্ছিলেন বহু দৃশ্য, যেন আধ-শোনা গল্পের এক একটা দৃশ্য --নৌসেনাধ্যক্ষের পোশাকে একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক, যিনি একটি নিশ্চল আরাম কেদারায় বসে আছেন; একটা পরিত্যক্ত সুইচবোর্ড, একটা গ্যালারির তৈলচিত্রের নীচে সৈন্যরা হাঁটু মুড়ে বসে থাকা।
সিঁড়িগুলোতে খন্ডযুদ্ধ বাধে। মেঝের পাটাতনগুলোতে তে যে কোনো ধরনের ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ হয়ত বিপ্লবের আগমনের শব্দ। এই দৌড়ে এল এক যুঙ্কার, যাচ্ছে কোনো দিকে একটা দায়িত্ব নিয়ে। সে অলংকারবহুল শান্ত কণ্ঠে সাবধান করে দিল, সিনেগুব সদ্য যে লোকটাকে পেরিয়ে এসেছেন – হ্যাঁ, তিনি এইমাত্র একজনকে পেরিয়ে এসেছেন বটে -- সম্ভবত সে ছিল একজন শত্রু। “ভালো, খুব ভালো”, সিনেগুব বললেন। “এই দেখো! আমি এখনই নিশ্চিত করছি।” তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকে নিশ্চল করলেন, খেলার মাঠের মারপিটে বাচ্চারা যেভাবে করে, সেইভাবে তার কোটটা টেনে নামিয়ে, যাতে হাতদুটো নাড়াতে না পারে—দেখলেন, অন্য লোকটা সত্যিই বিদ্রোহীদের দলের একজন ছিল ।
রাত দুটো নাগাদ সামরিক বিপ্লবী কমিটির ফৌজ বেশ শক্তি নিয়ে প্রাসাদে প্রবেশ করলো।
উদভ্রান্তের মত কোনোভালভ টেলিফোনে শ্রেইদারকে জানিয়েছেঃ “আমাদের সঙ্গে আছে শুধু ছোটো একদল শিক্ষানবীশ অফিসার। আমাদের গ্রেপ্তার আগতপ্রায়।” সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
হলঘরটা থেকে মন্ত্রীরা বিফল গোলাবর্ষণের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। এটা তাদের আত্মরক্ষার শেষ চেষ্টা। পদধ্বনি। একজন ফ্যাকাশে চেহারার কাদেত নির্দেশের জন্য ছুটে এলো। সে জানতে চাইলঃ “শেষ বিন্দু পর্যন্ত লড়ে যাব?”
“আর রক্তক্ষয় নয়!” তারা চিৎকার করে উঠলো। “আমরা আত্মসমর্পণ করবো।”
তারা অপেক্ষা করেছিল। এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। সবচেয়ে ভালোভাবে কীভাবে দেখা দেওয়া যায়?নিশ্চয়ই ট্রেনের জন্য অপেক্ষারত একদল ব্যবসায়ীরমত হাতে ওভারকোট ধরে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় না।
ডিক্টেটর বলে ঘোষিত কিসকিন অবস্থা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিলেন। তিনি তাঁর শাসনপর্বের শেষ দুটি নির্দেশ জারী করলেন।
“তোমাদের ওভারকোট ত্যাগ করো এবং এসো আমরা আলোচনায় বসি”, সে বলল।
তারা এই নির্দেশকে মান্যতা দিল । তারা সেই মন্ত্রীসভার মিটিঙের মূর্তিবৎ স্থানু মূকনাট্য করে বসে রইল, যখন আন্তনোভ নাটকীয়ভাবে ঢুকে এলেন, তাঁর উতকেন্রদীক শিল্পীর টুপি তাঁর লাল চুলের উপর দিয়ে পিছনে ঠেলা। তার পিছনে সৈন্য, নাবিক ও লাল রক্ষীরা হাজির।
কোনোভালোভ মর্যাদাপূর্ণ শোভনীয়তায় বললেন, “সাময়িক সরকার এখানে উপস্থিত।” তিনি যেন বোঝাতে চাইলেন তিনি দরজায় টোকা মারার জবাব দিচ্ছেন, অভ্যুত্থানের জবাব নয়।
“তোমরা কি চাও?”
আন্তোনভ দৃঢ়ভাবে বললেনঃ“আমি তোমাদের সকলকে জানাতে চাই যে তোমরা, সাময়িক সরকারের প্রতিনিধিরা গ্রেপ্তার হলে।”
বিপ্লবের আগে, একটা গোটা রাজনৈতিক জীবন আগে, অন্যতম উপস্থিত মন্ত্রী মালিয়ান্তোভিচ তার বাড়িতে আন্তোনভকে একবার আশ্রয় দিয়েছিলেন। দুজন মানুষ নিজেদের মধ্যে চাওয়াচায়ি করলো, কিন্তু কিছু বললো না।
লাল রক্ষীরা ক্ষোভে ফেটে পড়লো যখন তারা জানতে পারলো যে কেরেনস্কী অনেক আগেই প্রাসাদ থেকে পালিয়ে গেছে। রক্তপিপাসুদের মতো চিৎকার করে একজন বললো, “কুত্তার বাচ্চাগুলোকে সঙিন দিয়ে কোতল কর।”
“আমিএদের বিরুদ্ধে কোনো হিংসা অনুমোদন করব না।” আন্তনোভ খুব ধীর এবং শান্ত গলায় জানালেন। এরপরেই মন্ত্রীদের নিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন। তারা ফেলে রেখে গেলেন কিছু ঘোষণার খসড়া, যার বেশীরভাগটাই কেটে দেওয়া হয়েছে, এই কাটাকুটিগুলো এঁকেবেকে চলে গেছে যেন স্বৈরতন্ত্র কায়েমের স্বপ্নের নকশায় পরিণত হয়ে। একটা টেলিফোন বেজে উঠলো।
করিডোর থেকে সিনেগুব গোটা ঘটনাটার উপর নজর রাখছিলেন। যখন এটা শেষ হল, তার সরকারও গেল, তাঁর দায়িত্বও শেষ হল। তিনি তখন শান্তভাবে হেঁটে সার্চলাইটের আলোয় বেরিয়ে গেলেন।
লুঠেরারা ঘরগুলোকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখতে থাকে। তারা শিল্পকলার নিদর্শনগুলি অবহেলা করে নিতে থাকল কাপড়চোপড়, নানা টুকিটাকি। সারা মেঝে জুড়ে তারা কাগজপত্র ছড়ালো, ছেটালো। সেই ঘর থেকে তারা বেরোলে বিপ্লবী সৈনিকরা তাদের তল্লাসি করে এবং তাদের কাছ থেকে লুঠের জিনিস বাজেয়াপ্ত করতে শুরু করলো। “এটা জনগণের প্রাসাদ”, একজন বলশেভিক লেফটেনান্ট ভর্ৎসনার সুরে বলে উঠলেন। “এটা আমাদের প্রাসাদ। জনগণের সম্পত্তি চুরি করবেন না।”
একটা ভাঙা তরবারির হাতল, একটা মোমবাতি। লুঠেরাদের দল তাদের সেইসব লুঠের মাল জমা দিচ্ছিল। তাতে ছিল একটা কম্বল, একটা সোফার তাকিয়া এবং আরও অনেক কিছু।
প্রাক্তন মন্ত্রীদের আন্তোনভ প্রাসাদের বাইরে নিয়ে এলেন। বাইরে এসে তারা একটা উদ্ধত, ভয়ানক ক্রুদ্ধ জনতার মুখোমুখি হলেন। তিনি তার পিছনে বন্দীদের কিছুটা আড়াল করে চলছিলেন। “এদেরকে আঘাত কোরো না।” তিনি এবং অন্যান্য অভিজ্ঞ, গর্বিত বলশেভিকরা বলছিলেন। “এটা আমাদের সংস্কৃতি বিরোধী”-
কিন্তু রাস্তায় ক্ষোভের আগুন এতো সহজে নেভার ছিল না। উৎকণ্ঠার সেই মুহূর্ত পরে, কাকতালীয়ভাবে কাছেই কোথাও মেশিনগানের গুলির শব্দে সতর্কঘন্টাও ক্রমশঃ স্পষ্ট হতে লাগলে জনতা কিছুটা ছত্রভঙ্গ হয়। সেই সুযোগকে কাজে লাগান আন্তোনভ। তিনি তাঁর বন্দীদের নিয়ে দৌড়ে ব্রিজটা অতিক্রম করে যান। ভিড় ঠেলে বন্দীদের পিটার-পল কারাদূর্গে নিয়ে আসেন।
জেলের দরজা যখন প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, তখনই মেনশেভিক অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রী নিকিতিন তার পকেট থেকে টেলিগ্রামটি খুঁজে পান। টেলিগ্রামটি এসেছিল ইউক্রেনের পার্লামেন্ট ভারখোভনা ‘রাডা’ থেকে।
“আমি এটা গতকাল পেয়েছি”, সে বললো। আন্তোনভকে সেটি দিয়ে নিকিতিন আরও বললেন, “এবার এটা তোমার বিষয়।”
স্মোলনিতে আগত প্রতিনিধিদের এই খবরটি দিলেন সেই একগুঁয়ে হতাশাবাদী কামেনেভঃ “উইন্টার প্যালেসে গেঁড়ে বসা প্রতিবিপ্লবের নেতাদের বিপ্লবী গ্যারিসন বন্দী করেছে।” তিনি আনন্দপ্রকাশের তুমুল উচ্ছাসের উদ্রেক ঘটালেন।
সময় তখন রাত তিনটে অতিক্রম করে গিয়েছে, অথচ কাজ আরো বাকি। দু’ঘণ্টারও বেশী সময় ধরে কংগ্রেসে রিপোর্ট শোনার কাজ চলতে থাকে- বিভিন্ন ইউনিট তাঁদের পক্ষে চলে আসার রিপোর্ট, সেনাধ্যক্ষরা সামরিক বিপ্লবী কমিটির কর্তৃত্ব। মতবিরোধ ছিল না যে তা নয়। কেউ একজন বন্দী এস আর মন্ত্রীদের ছেড়ে দেওয়ার দাবী তোলেন। ট্রটস্কী তাঁদের মেকী কমরেড বলে কষাঘাত করেন।
ভোর চারটের সময় মার্তভের বহির্গমনের পুনশ্চ হিসেবে তাঁর গোষ্ঠীর একদল প্রতিনিধি মেনিমুখো হয়ে কক্ষে প্রবেশ করলো, এবং আবার তারা একটা সমাজতান্ত্রিক জোট সরকার গঠনের পক্ষে তাঁর প্রস্তাব নতুন করে পেশ করতে গেল। কামেনেভ সভাকে মনে করিয়ে দিলেন যে মার্তভ যাদের সঙ্গে সহযোগিতা প্রস্তাব করেছিলেন তাঁরা পিঠ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তবু, অনন্ত নরমপন্থী, তিনি প্রস্তাব করলেন সোশ্যালিস্ট-রেভলিউশনারি এবং মেনশেভিকদের নিন্দা করে ট্রটস্কীর আনা প্রস্তাব পদ্ধতিগত কারণে সরিয়ে রাখা হোক, যাতে পরে আলোচনা আবার শুরু হলে কেউ বিব্রত না হয়।
লেনিন সেই রাতে আর সভায় ফিরবেন না। সম্ভবত সেই মিটিঙে ফিরে আসেননি। তিনি পরিকল্পনা করছিলেন। কিন্তু তিনি একটি দলিল লিখেছিলেন, যেটি পেশ করার দায়িত্ব পড়ে লুনাচারস্কির উপর।
শ্রমিক, সৈনিক এবং কৃষকদের প্রতি ঘোষণায় লেনিন সোভিয়েত ক্ষমতা ঘোষণা করলেন, এবং অঙ্গীকার করলেন দ্রুত একটি গণতান্ত্রিক শান্তি প্রস্তাব করবার। জমি হস্তান্তর করা হবে কৃষকদের মধ্যে। শহরগুলিতে পর্যাপ্ত রুটির যোগান জারি থাকবে। সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত জাতিদের জন্য এল আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু সেই সঙ্গে লেনিন সাবধান করে দিলেন যে বিপ্লব তখনও ভিতরের ও বাইরের বিপদে্র সম্মুখীন।
“কর্নিলভপন্থীরা... পেত্রোগ্রাদের বিরুদ্ধে সৈন্যদের আনতে চেষ্টা করছে। ... সৈনিকরা! কর্নিলভবাদী কেরেনস্কির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান!... রেলশ্রমিকরা! পেত্রোগ্রাদের বিরুদ্ধে কেরেনস্কির পাঠানো সৈন্যবাহী ট্রেনগুলি থামিয়ে দিন! সৈনিক, শ্রমিক ও কর্মচারীগণ! বিপ্লব এবং গণতান্ত্রিক শান্তির ভবিষ্যৎ আপনাদের হাতে!”
নথির সবটা পড়ে শোনাতে অনেকটা সময় লাগল, কারণ পড়ে শোনানোটা বারে বারে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল অনুমোদনের জয়ধ্বনিতে। এক জায়গায় ছোট্টো একটা কথা পাল্টে বাম এসআর-দের সম্মতি নিশ্চিত করা গেল।একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মেনশেভিক উপদল ভোটদানে বিরত থাকলো, এবং এইভাবে বাম-মার্তভপন্থার সঙ্গে বলশেভিকদের কাছাকাছি আসার পথ তৈরী করল। সে যাই হোক। অবশেষে ২৬শে অক্টোবর ভোর পাঁচটায় লেনিনের ইস্তেহার বিপুল ভোটে পাস হল।
একটা হুংকার। তার প্রতিধ্বনি হাল্কা হতে থাকে, যখন চীৎকার করে গৃহীত প্রস্তাবের গুরুত্ব ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে। সমবেত মানুষজন একে অপরের দিকে তাকায়। এইটা পাশ করা গেছে। ওইটা করা হয়েছে।
বিপ্লবী সরকারকে ঘোষণা করা হয়েছে।
বিপ্লবী সরকার ঘোষিত হইয়েছিল, এবং সেটা একরাত্রের পক্ষে যথেষ্ট। প্রথম মিটিঙের জন্য তা অনেক বেশী।
নিশ্চিতভাবেই।
রণক্লান্ত, ইতিহাসে বুঁদ, তবু লৌহশলাকার মতো টানটান স্নায়ুতে সোভিয়েতের দ্বিতীয় কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা অনিশ্চিত পা ফেলে স্মোলনি ছাড়লেন। তাঁরা মেয়েদের উঁচু ক্লাসের স্কুলবাড়িটা থেকে বেরিয়ে এলেন ইতিহাসের এক নতুন মুহূর্তে - এক নতুন ধরনের প্রথম দিন যা ছিল শ্রমিকের সরকারের, যা ছিল এক নতুন শহরের সকাল এবং শ্রমিক রাষ্ট্রের রাজধানীর।
তারা শীতের মধ্যে হেঁটে চললো সেই আলো আঁধারিতে যখন পূবের লাল আকাশটা ক্রমে উজ্জ্বল হচ্ছে।