Statements of Radical Socialist

কিউবা প্রসঙ্গে র‍্যাডিক্যাল সোশ্যালিস্টের বিবৃতি

 

সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করুন, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে দাঁড়ান, যে সব রাষ্ট্রীয় নীতি সংকট বাড়ায় সেগুলি সম্পর্কে প্রশ্ন করুন

 

১৯৯২ সাল থেকে, কিউবা প্রতি বছর রাষ্ট্রসংঘের সামনে মার্কিন আরোধ শেষ করার দাবী এনেছে, এবং প্রতিবছর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সেটা সমর্থনও করেছে। সবসময়ে নীরব থেকেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর তার ঘনিষ্ঠতম সহচর ইজরায়েল। এই আবেদন কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপ করে না। মাসখানে আগেই এবছরও এটা আনা হয়েছিল, এবং ১৮৪ ভোট পক্ষে পড়েছিল, ২টি বিপক্ষে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েল) আর তিনটি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে (কলম্বিয়া, ইউক্রেন আর সংযুক্ত আরব আমীরশাহী)।

বছরের পর বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবাতে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘স্বাধীনতা’ র জন্য লড়াই করার অজুহাত দিয়ে চলেছে, অথচ তারা এমন এক অবরোধ চালিয়ে গেছে, যা তারা যে মানুষগুলোকে নাকি মুক্ত করার কথা তুলে থাকে তাদেরই অভুক্ত রেখে দিচ্ছে। এই দাবীটা গত এক সপ্তাহে মার্কিন কংগ্রেসের দুপক্ষের রাজনীতিবিদরাই আবার করে তুলেছে। ১১ জুলাই এক প্রেস কনফারেন্স ডেকে মায়ামির মেয়র ফ্রান্সিস সুয়ারেজ আহ্বান করেছে, মার্কিন নেতৃত্বে কিউবাতে এক আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ হোক।

ভারতীয় বামপন্থীদের বৃহদাংশের কাছে তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রদের বিরুদ্ধে যে কোনো সময়ে, যে কোনো প্রতিবাদই অন্যায্য এবং সাম্রাজ্যবাদের তৈরী। এটা স্তালিনবাদের মৌলিক ধারণা থেকেই আসে। কিউবার ক্ষেত্রে, ভারতীয় স্তালিনবাদীরা সমগ্র দায় রেখেছে সাম্রাজ্যবাদের উপরে, যে কাজে তারা কিউবার কমিউনিস্ট পার্টিকেই অনুসরণ করছে।

নিঃসন্দেহে দীর্ঘমেয়াদী দায়ের সিংহভাগ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের উপরেই পড়বে। কিউবারে এবারের প্রতিবাদ ঘটেছে বিগত ত্রিশ বছরের সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে। গত কয়েক মাস ধরে ভিডিও ঘুরেছে সোশ্যাল মিডিয়াতে,যেখানে দেখা গেছে মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঘাটতির ফলে ক্ষোভ প্রকাশ করছে,খাদ্যের জন্য লম্বা লম্বা লাইন পড়েছে, এবং অতিমারীকে সরকার যেভাবে মোকাবিলা করতে চাইছে তার প্রতি অসন্তোষ আছে। অতিমারির বিশ্বে অবরোধের প্রভাবে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিকতম প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে  ২০১৯-এর মার্চ থেকে ২০২০-র মার্চে মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধ কিউবার অর্থনীতির ৫.৫৭ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি করেছে। অতিমারী যত পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফল তত মারাত্মক হতে বাধ্য।। এই কথা বিশেষ করে বলতে হবে, কারণ দেশের প্রধান শিল্প হল পর্যটন, এবং সেই ক্ষেত্রটি ভীষণভাবে আঘাত পেয়েছে। দেশের মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদন কমেছিল ১১ শতাংশ। ব্যবসা এবং রেস্তোঁরাগুলি বন্ধ, ফলে বহু কিউবান এখন কাজ পাচ্ছেন না। সেপ্টেম্বরের মধ্যে টিকাকরণ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে, কিউবার এই পরিকল্পনা ধাক্কা খেয়েছে কারণ ইঞ্জেকশনের ছুঁচ পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞার ফলে যথেষ্ট পরিমাণে  উৎপন্ন হয় নি।  

কিন্তু এখানে থেমে যাওয়ার অর্থ হবে, কিউবার কমিউনিস্ট পার্টি যা করেছে তার সবকিছুই নিঃশর্তে মেনে নেওয়া। কিউবার বিপ্লবের প্রতি সমর্থনের মানে এই না, যে বর্তমান (বা পূর্বতন) নেতৃত্বের ভূমিকা সম্পর্কে নীরব থাকা। কোনো আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্র, যা কেবল জনগণকে ‘সংগঠিত’ করতে চায়, কিন্তু প্রতিবাদী কন্ঠদের রোধ করে, তার পক্ষে সাম্রাজ্যবাদের চাপ সহ্য করা সম্ভব নয়। ভূতপূর্ব রাষ্ট্রপতি রাউল কাস্ত্রো সরকার যে উদারীকরণ প্রক্রিয়া আরম্ভ করেছিল, সেটা এখন দিয়াজ-ক্যানেল সরকারের তত্ত্বাবধানে দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি, এবং সরকারের ভাষায় ‘অপ্রয়োজনীয় ভর্তুকি ও বিনামূল্যে পরিষেবা’ কেটে বাদ দেওয়ায় জনগণের উপর এক কঠোর ব্যয়সংকোচ নীতি চেপে বসেছে। এটা শুরু হয়েছে ১ জানুয়ারি থেকে ডলারের সঙ্গে বিনিময়যোগ্য পেসো বন্ধ করে দেওয়া এবং পেসোর দাম ২৪ পেসোতে ১ ডলার করে বেঁধে দেওয়া থেকে, যার ফলে মুদ্রার ২৪০০ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। অন্যদিকে, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে এবং ব্যক্তিগত ক্ষেত্রকে (অর্থাৎ কয়েক ডজনের বেশি না, এমন অল্প মানুষকে নিয়োগ করে যে ছোটো ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা, তাদের ) সতেজ করে তুলতে একগুচ্ছ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই সব পদক্ষেপের উদ্দেশ্য ৫০০টির বেশি প্রকল্প যা প্রধানত ভ্রমণশিল্প ও খনিজ তেলের ক্ষেত্রে “সুবিধার পোর্টফোলিও” আনার আশা প্রকাশ করেছে, যাতে নাকি ১২ বিলিয়ন ডলার আনবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ঘোষণা হল যে ভ্রমণ, বায়োটেকনোলজি এবং পাইকারী ব্যবসাতে রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক থাকবে, এই ব্যবস্থার অবসান। 

যে প্রতিবাদগুলি দেখা দিয়েছে তা ভালমন্দ মেশানো এবং এখন অবধি বেশ সীমিত। কিন্তু সরকার তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, ঘোষণা করল সবটাই সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট। প্রেস কনফারেন্সে দিয়াজ-ক্যানেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিন্দা করলেন, সমস্ত প্রতিবাদীকে প্রতিবিপ্লবী বলে চিত্রায়িত করলেন এবং ‘বিপ্লবীদের’ আহ্বান করলেন রাস্তায় নেমে ‘বিপ্লবকে রক্ষা করতে’। অবশ্যই আমরা দক্ষিণপন্থীদের, চার্চকে এবং ‘পাত্রিয়া ই ভিদা’ আন্দোলনকে প্রত্যাখ্যান করি। এরা কিউবার পরিস্থিতির ফলে যে ক্ষোভ দানা বেধেছে, সেটাকে পুঁজি করে কিউবার বিপ্লবের অর্জিত অধিকারগুলি মুছে ফেলতে চায় এবং ধনতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চায়। কিন্তু এটাই পুরো গল্পটা নয়। প্রতিবাদগুলি শুরু হয়েছিল শান্তিপূর্ণভাবে, কিন্তু প্রায় প্রতিটি প্রতিবাদ-বিক্ষোভই শেষ অবধি হিংসাত্মক ঘটনা দেখেছিল। আর সেই কাজটা কিন্তু দুপক্ষই করেছিল। আর,একই সময়ে একের পর এক শহরে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল, এটা সমাজতন্ত্রী কিউবাতে অভূতপূর্ব। ঘটনাগুলি বোঝার সময়ে এই কথাটাও মনে রাখতে হবে।

 ১১ জুলাই কিউবাতে কী ঘটেছিল, তার তিনরকম ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সরকার দাবী করেছে, এটা ছিল প্রতিবিপ্লবীদের সঙ্গে কমিউনিস্টদের সংঘাত। বুর্জোয়া প্রচারমাধ্যম পৃথিবীজুড়ে বলছে এটা ছিল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে নিপীড়িতের বিদ্রোহ। আবার কেউ কেউ বলেছেন, এটা ছিল অবক্ষয়ী আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিপ্লবী শ্রমিক শ্রেণীর উত্থান। বাস্তবে ১১ জুলাইয়ে এই তিনটি বাখ্যারই কিছু কিছু উপাদান দেখা যায়। মার্কিন অর্থপুষ্ট প্রতিবিপ্লবী সংগঠনরা কমিউনিস্ট পার্টিকে আক্রমণ করেছিল। কিছু বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী, যাঁরা মনে করেছেন তাঁদের নাগরিক অধিকার ভীষণভাবে সংকুচিত, তাঁরা সেন্সরশীপের সামনে পড়ছেন, তারাও প্রতিবাদ করেছেন। আর শ্রমিক শ্রেণীর সদস্যরা দাবী করেছেন, সরকার তাঁদের জীবন যাপনের অবস্থা ফেরাক। কিন্তু যদিও প্রতিবাদীদের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ ওই তৃতীয় পর্যায়ে পড়েন তবু এঁদের কোনোভাবে এক সচেতন সমাজতন্ত্রী জনতা হিসেবে দেখা যাবে না, যারা  এক স্থবির আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে আরো সমাজতান্ত্রিক দিকে যেতে চাইছেন।  

প্রতিবাদের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ

·        অধিকাংশ প্রতিবাদীই কোনো প্রতিবিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত না। প্রতিবাদগুলি প্রতিবিপ্লবীদের নেতৃত্বে ঘটেও নি।

·        প্রতিবাদীদের মধ্যে ব্যাপক সংখ্যক যে তরুণ ছিলেন, সেটা দেখায়, সরকারের ন্যায্যতা মানুষের চোখে কমছে।

·        প্রতিবাদগুলি প্রাথমিকভাবে দানা বেধেছিল শ্রমিক মহল্লাতে, যেখানে সামাজিক সমস্যা সবচেয়ে বেশী। আজকের কিউবার সমাজে সামাজিক অসাম্য একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা। দারিদ্র, সামাজিক অবহেলা, সামাজিক নীতিদের অনিশ্চয়তা, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে খাদ্য ও অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহের সীমাবদ্ধতা এবং নিম্নমানের সাংস্কৃতিক নীতি এই সব প্রান্তিক ও নিম্ন-আয় মহল্লাগুলির জীবনের বৈশিষ্ট্য।

·        প্রতিবাদ কোথাও সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন পায় নি। কিউবার জনগনের বড় অংশ এখনো সরকারকেই সমর্থন করেন।

·        প্রতিবাদগুলিতে প্রায় কোনো সমাজতন্ত্রী স্লোগান ছিল না।

·        অল্পসংখ্যক বুদ্ধিজীবী প্রতিবাদগুলির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কিন্তু অবাধ মতপ্রকাশের দাবী, সেন্সরশীপ ছাড়া অবাধে শিল্প সৃজনের দাবী সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে সাড়া জাগায় নি কারণ তারা চাইছিলেন জীবনজীবিকার মৌলিক উন্নতি।

·        হাভানার শান্তিপূর্ণ মিছিলের বিকৃতি ঘটিয়ে লুঠ ও ভাঙ্গচুরের জন্য দায়ী লুম্পেনরা

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সোশ্যাল মিডিয়া মারফত আসা প্রতিবিপ্লবী প্রচার অবশ্যই একটা ভূমিকা পালন করেছিল, কিন্তু এইগুলি প্রতিবাদের জন্ম দেয় নি।    

 

সামনে এগোনোর পথঃ

বিপ্লবকে রক্ষা করা আর রাষ্ট্রে গভীরভাবে গেঁথে থাকা কমিউনিস্ট পার্টির আমলাতন্ত্রকে রক্ষা করা সমার্থক নয়পুঁজিবাদীদের উচ্ছেদ করার দিকে শ্রমিক শ্রেণী যে অগ্রগতি ঘটিয়েছেন তাকে রক্ষা করা। সাম্রাজ্যবাদ বিপ্লবদের উল্টে দিতে পারে। কিন্তু একদলীয় পার্টি-রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্ররাও বিপ্লবদের প্রতি অন্তর্ঘাত করতে পারে যার ফলে ধনতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হতে পারে।   

যারা কিউবার বিপ্লবের অর্জিত জয়গুলি রক্ষা করতে ও তাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে লড়াই করছেন, আমরা তাঁদের স্বাধীনভাবে মিছিল করার, ইউনিয়ন গঠন করার অধিকারের পক্ষে ।

যে কোনো রাজনৈতিক বন্দী তিনি যদি  অন্য কোনো মানুষের জীবন বিপন্ন না করে থাকেন, তবে তাঁদের প্রত্যেকের অবিলম্বে মুক্তি দাবী করি।

সামনে এগোনোর একমাত্র পথ হল গণপ্রতিরোধে অংশ নেওয়া, তার মধ্যে স্বাধীন সমাজতন্ত্রী কর্মসূচীর পক্ষে মত রাখা, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের সরকার উচ্ছেদের প্রয়াসের বিরোধিতা করার সঙ্গে সঙ্গে জনগণের প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ কায়েম করার জন্য লড়াই করা এবং উপর থেকে আমলাতান্ত্রিক শাসনের প্রবক্তা হতে অস্বীকার করা।

১৯ জুলাই ২০২১