ফাদার স্ট্যান স্বামী তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন ঝাড়খন্ডের আদিবাসী সম্প্রদায়দের সঙ্গে থেকে ও কাজ করে। তিনি খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ অঞ্চলের অধিবাসীদের উপর ধনতান্ত্রিক শোষণ আর রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলা ও মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই অপরাধের জন্য আরো অনেকের সঙ্গে তাঁকে ভীমা কোরেগাঁওয়ের মিথ্যা মামলায় জড়িয়েছিল কুখ্যাত জাতীয় তদন্ত এজেন্সী (এন আই এ)।
একদিকে মোদী গণতন্ত্রের গুণগান গাইছে আর অমিত শাহ একটি প্রসিদ্ধ ইংরেজী দৈনিকে নিয়মিত গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারের উৎস সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখছে; আর একই সঙ্গে অন্য দিকে রাষ্ট্র যে কোনো প্রতিবাদী বা সমালোচনাত্মক কন্ঠ, সে সাংবাদিকদের হোক, উদ্বিগ্ন নাগরিকদের হোক, বুদ্ধিজীবীদের হোক বা ছাত্রদের হোক, তাঁদের উপর তীব্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আমরা এটা দেখেছি, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রতিবাদ যাঁরা করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কীভাবে পদক্ষেপ নেওয়া হল তাতে। আমরা দেখেছি, তারা যেভাবে চলমান কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, কীভাবে তাঁদের নামে কুৎসা রটিয়েছে, আক্রমণ করেছে। আমরা দেখেছি তারা কীভাবে ২০২০-র দিল্লীতে সংগঠিত ধর্মীয় গণহত্যার প্রতিবাদ করেছেন যাঁরা, তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। জিঘাংসু রাষ্ট্র যে হিংস্র আইনের সাহায্যে ভীমা কোরেগাঁও মামলাতে জড়িত রাজনৈতিক কর্মীদের যেভাবে আক্রমণ করছে, সেটা হল সম্ভবত কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের উপরে সবচেয়ে মর্মান্তিক আক্রমণের নজীর, এবং সরকারের দিশার সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ।
এই সবগুলিই হল ভারতে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের যেটুকু খোলস পড়ে আছে, তা থেকে ভিন্নমতের কণ্ঠরোধ করা, এবং ওই গণতন্ত্রকে নিশ্চিহ্ন করা। এই কর্মীদের, ছাত্রছাত্রীদের এবং বুদ্ধিজীবীদের দুরবস্থা হল উদাহরণ, যা দিয়ে গোটা দেশকে বোঝানো হচ্ছে, সরকারের নীতিকে কোনোভাবে প্রশ্ন করলে মানুষকে কোন মূল্য দিতে হবে। সরকারের এই নীতি হল এক বিষাক্ত মিশ্রণ, যাতে আছে কৃষিতে কৃষি আইন এবং শিল্প ক্ষেত্রে শ্রম কোডের মাধ্যমে ধনতান্ত্রিক শোষণের চরমতম বাড়াবাড়ি, আর সেই সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী উগ্রজাতীয়তাবাদ, যার আছে ‘অপর’কে বাদ রাখার হিংসাত্মক প্রবণতা। এই দ্বিতীয় ধারাটির ফলে সরকার ক্ষুধা, দারিদ্র, বেকারত্ব, ইত্যাদি প্রসঙ্গ উঠলে যে কোনো সমালোচনাকে ধামাচাপা দেয় মন্দির গড়ার কথা তুলে, বা মনগড়া ধর্মান্তকরণের দাবী তুলে ।
যে ভীমা কোরেগাঁও মামলাতে ফাদার স্ট্যান স্বামী সহ অনেককেই মিথ্যা অভিযোগে ধরা হয়েছে, সেটা তৈরি করাই হয়েছে সব প্রতিবাদী কণ্ঠরোধ করতে। আদালতরা এরকম বহু মামলাতে রাষ্ট্রের কার্যনির্বাহক শাখার অনুগামী হিসেবে কাজ করেছে। আদালত স্ট্যান স্বামীর ৮৪ বছর বয়স হওয়া সত্ত্বেও, এবং তিনি পার্কিনসন্স ডিজিজ-এর মতো রোগে ভোগা সত্ত্বেও, তাঁকে জামিন দিতে রাজি হয় নি। তাঁর স্বাস্থ্য এতটাই ভেঙ্গে পড়েছিল, যে তিনি হাতে একটা কাপ অবধি ঠিক করে ধরতে পারছিলেন না। তাঁর জামিনের আবেদন, এবং সেই সঙ্গে আবেদন যে তাঁকে জেলে একটা সিপার কাপ ব্যবহার করতে দেওয়া হোক, তাতে দেরী হয়, কারণ এন আই এ আদালতরা বারে বারে চূড়ান্ত অমানবিকতা ও সহানুভূতিবিহীন আচরণ করে আবেদন বর্জন করেছিল। তিনি কোভিড নিয়েও জেলে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন, যেটা ধরা পড়ে পরে, যখন তাঁর অবস্থা আরো খারাপ হলে তাঁকে হাসপাতালে পাঠানো অনিবার্য হয়। একজন সামাজিক কর্মীকে এইভাবে সুপরিকল্পিতভাবে, ধীরে ধীরে অত্যাচার করা, হল শাসকদের প্রয়াস, যাতে প্রতিবাদী সকলকে ঠেকানো যায়। ফাদার স্ট্যান স্বামীর নিছক মৃত্যু হয় নি। তাঁকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হত্যা করা হয়েছে।
র্যাডিক্যাল সোশ্যালিস্ট দাবী করছে, ইউএপিএ এবং এন আই এ আইন রদ করতে হবে, এবং সমস্ত রাজবন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। ঝাড়খন্ডের হাজার হাজার আদিবাসী সম্পদায়ের মানুষদের সঙ্গে, এবং দেশ জুড়ে আরো অসংখ্য মানুষের সঙ্গে, আমরাও অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিবেদিতপ্রাণ এই জীবন কেড়ে নেওয়াতে শোকপ্রকাশ করছি।
৭/৭/২০২১