Marxist Theory

স্তালিন ও বিশ্ববিপ্লব

স্তালিন ও বিশ্ববিপ্লব

কুণাল চট্টোপাধ্যায়

২০১৩-র ভূমিকা

 

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটেছে ১৯৯১ সালে। তারপর দুই দশক অতিক্রান্ত। উদ্ধত, বর্বর সাম্রাজ্যবাদ সারা পৃথিবীতে আক্রমণ তীব্রতর করেছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীদের মতাদর্শগত হাতিয়ার ভোঁতা হয়ে গেছে। গণতন্ত্র মানেই বুর্জোয়া গণতন্ত্র, খোলা বাজার ছাড়া গণতন্ত্র টেঁকে না, তাদের এই দাবী ক্রমেই দুর্বল হয়েছে। কেবল অনুন্নত দেশে নয়, ইউরোপ – আমেরিকাতেও পুঁজিবাদ বিরোধী লড়াই তীব্রতর হয়েছে। কিন্তু সেই লড়াইয়ের মধ্যেও থেকে গেছে মতাদর্শগত অস্বচ্ছতা। সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের নিজেদের স্বার্থে স্তালিনবাদী স্বৈরতন্ত্র, আমলাতান্ত্রিক সুবিধাভোগী স্তরকে সমাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্রী নেতৃত্ব বলেছিল, কারণ তাহলে সমাজতন্ত্রের ধারণার সম্পর্কে কুৎসা রটনা সহজ হয়।আর অন্যদিকে, আজ ধনতান্ত্রিক শোষণে নিষ্পেষিত মানুষ যখন ধনতন্ত্র বিরোধী লড়াই করতে চাইছেন, তখন তাঁদের মতাদর্শগত অস্বচ্ছতার সুযোগ নিচ্ছে পুরোনো, পচা-গলা স্তালিনবাদী দলগুলির অবশিষ্টাংশ।

একবিংশ শতাব্দীতে নতুন করে প্রলেতারীয় সমাজতন্ত্রের ধারণাকে গড়ে তুলতে হলে যেমন মার্ক্সের চিন্তায় ফিরতে হবে, তেমনি বিংশ শতাব্দীর মেকী মার্ক্সবাদকে চিনতে হবে, তার নির্মম সমালোচনা করতে হবে, তাকে বর্জন করতে হবে।

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে শ্রমিক শ্রেণীর ভিতর থেকে গড়ে ওঠা দুটি প্রধান বিপদের একটি সুপরিচিত। তা হল সোশ্যাল ডেমোক্রেসী। গোড়ায় সোশ্যাল ডেমোক্রেসী ছিল বিপ্লবী মার্ক্সবাদী আন্দোলনের নাম। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ইউরোপ-আমেরিকার মার্ক্সবাদীরা এই নাম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু স্থিতিশীল বুর্জোয়া সমাজের মধ্যে তাদের বিকৃতি ঘটে। দল, ট্রেড ইউনিয়ন ও অন্য গণসংগঠনে বেতনভুক এক ধরণের কর্মী-নেতা তৈরী হয়, যারা ক্রমে দীর্ঘমেয়াদী লড়াইয়ের দিশা হারিয়ে ফেলে। মতাদর্শগত ক্ষেত্রেও, নতুন বুর্জোয়া আক্রমণের মোকাবিলা না করে তারা আপোসের পথ ধরে। ফলে শেষ পর্যন্ত তারা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সময়ে ‍‍‍‘‍‘‍নিজের‍’’ মালিক শ্রেণীর যুদ্ধ প্রয়াসকে সাহায্য করে বসে। উপরন্তু, তারা ক্রমেই দাবী করতেথাকে যে বুর্জোয়া রাষ্ট্রে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পেয়ে ধীরে ধীরে সংস্কার করে শ্রমজীবি মানুষের স্বার্থ দেখা যায়।

বর্তমান প্রবন্ধে সোশ্যাল ডেমোক্রেসী প্রসঙ্গে আলোচনা হবে না।যেটুকু বলা হল, তার কারণ, এই বিপদটি সম্পর্কেই বারবার শ্রমিকদের সচেতন করা হয়। কিন্তু ভারতের মত দেশে, সেখানে‍‍ ‍‘‍‘বামপন্থী‍’’ আন্দোলনে এখনো স্তালিনবাদ, মাওবাদ ও তাদের উত্তরাধিকার-ই বড় ক্ষেত্র দখল করে আছে, সেখানে স্তালিনবাদকে শ্রমিক শ্রেণীর বিপদ হিসাবে চিহ্নিত করা হয় না। আমরা র‍্যাডিকাল পত্রিকায় কয়েকটি প্রবন্ধের মাধ্যমে স্তালিনবাদ কেন শ্রমিকশ্রেণীর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অন্যতম শত্রু, তা ব্যাখ্যা করব। এই সংখ্যায় পুনর্মুদ্রণ করা হল ‍‘‍‘নয়া আন্তর্জাতিক’’ পত্রিকা বুলেটিন ৪, (১৯৯১) তে প্রকাশিত প্রবন্ধ স্তালিন ও বিশ্ববিপ্লব। স্বভাবতই, দুই দশক আগে প্রকাশিত বিতর্ক পড়তে আজকের পাঠক কিছুটা অসহায় বোধ করতে পারেন। কিন্তু মূল বিষয়টি, অর্থাৎ বিশ্ববিপ্লবের প্রতি স্তালিনবাদী আক্রমণের বর্ণনা, আজও প্রাসঙ্গিক। ১৯৯১-এর পরে যে সব গবেষণা আমার চোখে পড়েছে, তার আলোকে প্রবন্ধটির সামান্য কিছু পরিমার্জন করা হয়েছে ।

১৯৯১-এর প্রবন্ধ

 

অনীক পত্রিকার জুন, ১৯৯১ সংখ্যায় কমরেড মণি গুহ এক দীর্ঘ প্রবন্ধে সমাজতন্ত্রের এ বিপযর্য় কেন, এই প্রশ্নের আলোচনা করেছেন। মণি গুহর রচনার গুরুত্ব এখানেই, যে তিনি মার্ক্সীয় তত্ত্ব জেনে বুঝেও স্তালিনবাদের পক্ষাবলম্বী হয়েছেন. অতএব তত্ত্ব ও ইতিহাসের এক অসত্য ও আংশিক সত্যের মিশ্রণকে কীভাবে আজও স্তালিনের (ব্যক্তিগতভাবে) এবং স্তালিনবাদের পক্ষে ব্যবহার করা যায়, তাঁর রচনা তার এক চমৎকার উদাহরণ।

মণি গুহ-র বক্তব্য রুশ বিপ্লবের অধঃপতনের মূল কারণ বিশ্ব বিপ্লবের ব্যর্থতা। আপাতঃভাবে, এযেন মার্ক্সীয় চিন্তায় মৌলিকভাবে প্রত্যাবর্তন। তিনি এ কথা জানেন. তাই “এক দেশে সমাজতন্ত্র গঠনের” তত্ত্বকে তিনি সৃজনশীল মতবাদ ইত্যাদি যতটা না বলেছেন, তার চেয়ে বেশি চিহ্নিত করেছেন পশ্চাদপসরণ হিসাবে। কিন্তু তাঁর বক্তব্যের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য বেরিয়ে আসে দু-তিনটি কথা থেকেঃ ‍‍‘‍‘নিজেদের দেশের বিপ্লবকে রক্ষা করা এবং সমাজতন্ত্র গঠন করার কাজ, তাই, তাদের করতে হয় স্বতন্ত্রভাবে, এককভাবে, নিজের পায়ের ওপরে দাঁড়িয়ে, প্যারি কমিউনের আদর্শ বুকের গোপন কক্ষে জীইয়ে রেখেই। (এটা যারা বুঝতে পারবেন না তারা কোনো না কোনো ব্যাপারে ট্রটস্কীর সঙ্গে ঐকমত পোষণ করবেনই)। সুতরাং ত্রুটি বিচ্যুতি, খামতি খুবই স্বাভাবিক।‍’’ (অনীক, জুন ১৯৯১, পৃঃ ১৯)।

দ্বিতীয়ত, তাঁর মতে বিশ্ব বাজারকে হঠিয়ে রেখে, প্রায় সম্পূর্ণভাবে আভ্যন্তরীন সম্পদ, ও আভ্যন্তরীণ বাজারের উপর নির্ভরতাই ছিল সফল সমাজতন্ত্র গড়ার চাবিকাঠি. (ঐ, পৃঃ ২২)।

তৃতীয়ত, বিশ্ব বিপ্লবের ব্যর্থতা ও সোভিয়েত কাজকর্মকে তিনি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দাবী করেছেন, ব্যর্থতা বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণীর ও কমিউনিস্ট পার্টিগুলির, স্তালিন বা সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনো দায়িত্ব ছিল না।

কমরেড গুহ ধরে নিয়েছেন যে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসের প্রতিটি পর্বের সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানা সময় সাপেক্ষ ও কঠিন, আর তিনি সেই সুযোগটির সদ্ব্যবহার করতে চান।

কিন্তু মার্ক্স আমাদের শিক্ষা দেন, , যে কোনো তত্ত্বই প্রয়োগের মাধ্যমে আরো স্পষ্ট হয়, তার ভুল ত্রুটি শুধরে নেওয়া যায়। বিশ্ব বিপ্লবের তত্ত্ব এবং বিশ্ব বিপ্লবের ইতিহাস একত্রে অধ্যয়ন না করলে তাই বিপদ দেখা দেবে।

 

সোভিয়েত আমলাতন্ত্রের উত্থান ও বিশ্ববিপ্লব

 

সোভিয়েত আমলাতন্ত্রের চরিত্র কি, তার উত্থান কীভাবে হল, তা এই প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয নয়। নয়া আন্তর্জাতিক তা আগে অলোচিত হয়েছে। পরেও হবে। বর্তমান প্রবন্ধে আমাদের দেখা দরকার, বিশ্ব বিপ্লবের সঙ্গে সোভিয়েত রাষ্ট্রের, এবং বিস্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সম্পর্ক কি ছিল ।

১৯১৪ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গোড়ায় আন্তর্জাতিক সোশ্যাল ডেমোক্রেসীর বিশ্বাসঘাতকতার ফলে, লেনিন, ট্রটস্কী, রোজা লুক্সেমবুর্গ, সকলেই এক নতুন, বিপ্লবী আন্তর্জাতিক গঠনের আহ্বান করেন। রুশ বিপ্লবের পর সেই আহ্বানকে বাস্তব রূপ দিতে চেষ্টা করা হয়, এবং ১৯১৯-এ প্রতিষ্ঠিত হয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক।

১৯১৭-২১ ছিল বিশ্ববিপ্লবের বস্তুগত দিক থেকে উত্থানের পর্ব। কিন্তু তখন যা ছিল না, তা হল বিপ্লবের মনোগত দিকের শক্তি – অর্থাৎ বিপ্লবী পথ কি, সে বিষয়ে শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে স্বচ্ছ ধারণা, এবং শ্রমিকশ্রেণীর অগ্রণী অংশকে সংগঠিত করে গড়ে ওঠা বিপ্লবী দল। ১৯১৯-এ জার্মানীতে,, ১৯২০ তে ইতালীতে, এবং অত বড় আকারে না হলেও অন্য বিভিন্ন দেশে জয় ও পরাজয়ের হিসেব-নিকেশ করেই কমিউনিস্ট পার্টিগুলি দাঁড়াতে পারত।

বিশ্ববিপ্লবের প্রথম পর্যায়ে পরাজয় তাই আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের উপর ততটা প্রভাব ফেলেনি, যতটা ফেলেছিল কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সংগঠনের ওপর ও সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর।

সোভিয়েত ইউনিয়নের গৃহযুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ, এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিঃসঙ্গতার ফল হল শ্রমিক গণতন্ত্রে অবক্ষয়, এবং সুবিধাভোগী আমলাতন্ত্রের উত্থান। মনি গুহ বিশ্ব বিপ্লবের সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে সযত্নে এই নিষ্ঠুর বাস্তব কথাটি এড়িয়ে গেছেন।

এই আমলাতন্ত্রের অবস্থা কি ছিল ? যদি উৎপাদনের উপাদানগুলি জাতীয়করণ না হত, যদি বুর্জোয়া শ্রেণীকে উচ্ছেদ করা না হত, তাহলে রাষ্ট্রের হাতে এতটা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হত না. যদি শ্রমিক গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে না পড়ত, তাহলে ঐ ঘটনা থেকে অদূর বিলম্বে দেখা যেত উৎপাদকদের যৌথ প্রয়াসে চালিত এক সমাজ, যাতে, রাষ্ট্রের শক্তি ক্রমেই কমে যেত। যদি-র বৃত্তান্ত না বাড়িয়ে বলা দরকার, যা হল, তা অনিবার্য ছিল না। বলশেভিক নেতৃত্বের কাজে কিছু ত্রুটি হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল, [কারণ তাঁরা একেবারে অচেনা পথে পা বাড়িয়েছিলেন]।. কিন্তু তাঁদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি ত্রুটি হল, শিল্প পরিচালনায় ফ্যাক্টরী কমিটিদের পরিবর্তে বিশেষজ্ঞ প্রশাসক বসানো এবং গৃহযুদ্ধের ফলে অবশ্যম্ভাবী যে সাময়িক গণতন্ত্র সংকোচন, তাকে যথেষ্ট জোরের সঙ্গে সাময়িক বলে চিহ্নিত না করা। প্রথম ঘটনাটির ফলে, শিল্পক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিকতা দেখা দিল। দ্বিতীয়টির ফলে, রাষ্ট্রযন্ত্রে তো বটেই, পার্টিতেও আমলাতান্ত্রিক ঝোঁক দেখা দিল এবং তাকে অবহেলা করা হল। রাষ্ট্র যদি শ্রমিকশ্রেণীর হয়, তবে বিশেষজ্ঞরা মৌলিক কোনো ক্ষতি করতে পারবে না – এ ছিল লেনিন, ও ট্রটস্কীর মত। সমস্যা ছিল দুটি। প্রথমত, ধনতন্ত্র থেকে সাম্যবাদে উত্তরণের অর্থ অর্থনীতিতে শ্রমিকশ্রেণীর প্রত্যক্ষ প্রশাসন আনা। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্র ও পার্টি একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে যাওয়ায় রাষ্ট্র দিয়ে, বা পার্টি দিয়ে শ্রেণী যে ম্যানেজার ইত্যাদিকে নিয়ন্ত্রণ করবে, সে সম্ভাবনাও কমে গেল।

কিন্তু ১৯২১-২২-এর মধ্যে পরিস্থিতি এতটা খারাপ হয় নি, যে আমলাতন্ত্রের জয় অনিবার্য। পার্টির মধ্যে আমলাতান্ত্রিক ধারা ও প্রলেতারীয় ধারার লড়াই শুরু হল ১৯২২ থেকে। লেনিন তাঁর সক্রিয় জীবনের শেষ এক বছর (এপ্রিল ১৯২২ – মার্চ ১৯২৩) আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইকে প্রধান লড়াই বলে দেখেছিলেন। শেষ অবধি তিনি বুঝলেন, আমলাতন্ত্রের ক্ষমতার কেন্দ্র পার্টির সম্পাদকমণ্ডলীর মধ্যে, এবং তাই তাঁর তথাকথিত ‘‍‘উইল’’[প্রকৃতপক্ষে পার্টিকে লেখা তাঁর চিঠি]–এ স্তালিনকে অবিলম্বে সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে হঠানোর কথা বললেন। মণি গুহ-র সূক্ষ্ণ কৌশল, তিনি লেনিনের ‘উইল’ কথাটি বলেন, অথচ, লেনিনের এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ লেখাপত্রের কথা কিন্তু বলেন নি, এক বছর ধরে বিভিন প্রশ্নে স্তালিন তথা বিকাশমান আমলাতন্ত্রের সঙ্গে লেনিনের সংগ্রাম ও সেখানে ট্রটস্কীর সঙ্গে তাঁর জোটের উল্লেখ করেন নি।

১৯২২ থেকে ১৯২৭ ছিল প্রলেতারীয় নেতৃত্ব ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে লড়াইয়ের যুগ. । বামপন্থী বিরোধী গোষ্ঠীর পরাজয় ও পার্টি থেকে বহিষ্কার এই পর্বের অবসান ঘটায়।

এই লড়াইয়ের অন্যতম ক্ষেত্র ছিল বিশ্ববিপ্লবী আন্দোলন। বিশ্ব বিপ্লব নিছক হেরে যায়নি। বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণী সম্পর্কে মণি গুহ কার্যত যে কদর্য কুৎসা রটনা করতে চেয়েছেন, তা মিথ্যা কুৎসাই, সত্য নয়। বিশ্ব বিপ্লবকে পরাস্ত করার জন্য স্তালিনবাদী নেতৃত্ব সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছিল। আমরা একটু বিস্তারিতভাবে সেই বিশ্বাসঘাতকতার, সেই পিছন থেকে ছুরি মারার ইতিহাসটা দেখব।

 

হাওয়া বদলের শুরু – জার্মানী ১৯২৩

 

১৯২৩ ছিল বিপ্লবী রাশিয়া ও কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ। ১৯১৭-র পর বহু দেশে বিপ্লবীরা মনে করেছিলেনবিপ্লব আগতপ্রায়। ফলে তাঁদের অনেকের ধারণা হয়েছিল, একমাত্র আক্রমণাত্মক রণনীতিই উপযোগী। অন্যদিকে শ্রমিকশ্রেণী কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দিকে চলে যাচ্ছেন দেখে সুবিধাবাদী নেতারাও অনেকে ঐ সংগঠনে যোগদানের চেষ্টা করে। এই অবস্থায় লেনিন, ট্রটস্কী, জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের একাংশ, ও অন্যরা, একই সঙ্গে সুবিধাবাদ ও হঠকারীতার বিরুদ্ধে লড়তে চেষ্টা করেন। কিন্তু এর ফলে অন্য একটি বিপদ দেখা যায়। প্রথমতঃ রুশ বিপ্লবের সাফল্য ও অন্যান্য বিপ্লবের ব্যর্থতার ফলে ইতিমধ্যেই সোভিয়েত পার্টির নেতাদের মর্যাদা ছিল বাকিদের চেয়ে বেশী। দ্বিতীয়ত, ঐ বারংবার ব্যর্থতার ফলে, বলশেভিক অভিজ্ঞতাকে আত্মস্থ করার যে ন্যায় সঙ্গত ইচ্ছা, তা পরিণত হল কিছুটা বলশেভিক নেতৃত্বের উপর রাজনৈতিক নির্ভরতায়। ১৯২২-এ, কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের চতুর্থ বিশ্ব কংগ্রেসে লেনিন এই বিপদ সম্পর্কে সাবধান করে দিয়ে বলেন যে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দলিল বড় বেশী রুশ অভিজ্ঞতা প্রসূত (লেনিন সংগৃহীত রচনাবলী, খণ্ড ৩৩, পৃঃ ৪৩১)।

যদি বলশেভিক নেতৃত্বে কোনো দ্বিমত না থাকত, তাহলে এই যে সাময়িক একপেশে অবস্থাটা কাটিয়ে ওঠা যেত। কিন্তু ১৯২২-এই, স্তালিন, গ্রিগরী জিনোভিয়েভ এবং লেভ কামেনেভ, পলিটব্যুরোর তিন সদস্য, অসুস্থ ও স্পষ্টতই মৃত্যুপথযাত্রী লেনিনের পর ক্ষমতা নিজেদের হাতে আনার জন্য গোপন পরিকল্পনা ফাঁদেন। পরে, ১৯২৬-এ পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় জিনোভিয়েভ এ কথা স্বীকার করেছিলেন।

কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সভাপতি বলে এবং ১৯১০ থেকে ১৯১৭-র মধ্যে লেনিনের ঘনিষ্টতম সহকর্মী হিসেবেজিনোভিয়েভের যে বিশেষ মর্যাদা ছিল, ১৯২৩-এ তিনি সোভিয়েত পার্টি ও কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকে তা ব্যবহার করেন। ১২শ পার্টি কংগ্রেস মূল রিপোর্ট তিনিই পেশ করেন। আর কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকে তিনি হঠকারীতাকে প্রশ্রয় দেন। প্রথম, অপেক্ষাকৃত ছোটো, তবু গুরুত্বপূর্ণ পরাজয় ঘটল বুলগেরিয়াতে। বুলগেরিয়ার পার্টি ছিল দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত একটি বিপ্লবী দল। কিন্তু ১৯২৩ থেকে ১৯২৫-এর মধ্যে তারা পরপর দুটি চূড়ান্ত ভুল করে। ১৯২৩-এর জানুয়ারীতে, মোটামুটি গণতান্ত্রিকভাবে অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনে ধনী চাষীদের দল ৪৩৭,০০০ ভোট পায়। কমিউনিস্ট পার্টি পায় ২৩০,০০০ ভোট।. বড় বুর্জোয়া দলগুলি ও দক্ষিণপন্থী সমাজতন্ত্রীরা পায় যথাক্রমে ২২০,০০০ এবং ৪০,০০০ ভোট। এপ্রিলে সাধারণ নির্বাচনে কৃষক ইউনিয়ন পায় ৫ লক্ষ ভোট।

৯ই জুন দক্ষিণপন্থী দলগুলির প্ররোচনায় সেনাবাহিনী ও পুলিশ কৃষক ইউনিয়নের সরকার ও তাদের নেতা স্তাম্বুলিস্কির বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করে। নিঃসন্দেহে স্তাম্বুলিস্কি সরকার প্রলেতারীয় সরকার ছিল না। কিন্তু ১৯১৭তে কর্নিলভের অভ্যুত্থানের সময়ে বলশেভিকরা যখন লড়াই করেছিলেন, তখন তা নিছক কেরেনস্কীকে বাঁচানোর জন্য নয়, উগ্র দক্ষিণপন্থাকে হারানোর জন্য। বুলগেরিয়ার নেতৃবর্গ একথা বুঝতে না পেরে অভ্যুত্থানে ‘‍‘নিরপেক্ষ’’ থাকলেন।

যখন স্যাংকভের প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থানে এক সামরিক সরকার গঠিত হল ও স্তাম্বুলিস্কির দলকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল, তখন কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সঠিকভাবেই আহ্বান করল যে কৃষকদের সঙ্গে এবং প্রযোজনে স্তাম্বুলিস্কির সঙ্গে, যৌথভাবে শ্বেত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করা হোক। কিন্তু জিনোভিয়েভ গোপনে তাঁর দুই অনুচর কোলারভ ও ডিমিট্রভকে পাঠালেন যেনতেন প্রকারেণ পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটাতে। যুক্তফ্রন্ট ও প্রতিরোধ নয়, গোপনে প্রস্তুত করা অভ্যুত্থানই ছিল তাদের লক্ষ্য। রাজনৈতিক পরিকল্পনাবিহীন এই উত্থানের ফল হল মারাত্মক। পার্টি পরাস্ত হল। আরও প্রবল শ্বেত সন্ত্রাস নেমে এল।

কিন্তু এ ছিল ছোটো স্তরের নিয়ন্ত্রণ। অনেক বড় ঘটনা ঘটল জার্মানীতে। ১৯২১-এর হঠকারিতার পর ঐ দল যুক্তফ্রন্টের কৌশল গ্রহণ করে যথেষ্ট সফল হয়েছিল। ১৯২২-এর শেষে দলের সদস্য সংখ্যা ছিল ২১৮,০০০। ১৯২২ থেকে জার্মানীতে প্রচন্ড অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। ঐ বছর জুনে এক ডলারের মূল্য ছিল ৩০০ জার্মান মার্ক। ১৯২৩-এ মুদ্রাস্ফীতি এমন এক স্তরে পৌঁছাল যে সবচেয়ে নরমপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন নেতারও লড়াই না করে উপায় ছিল না। ইতিমধ্যে জার্মানীর ওপর ফরাসী অর্থনৈতিক চাপের ফলে অবস্থা আর‍ও জটিল হয়। ১৯২৩-এর বসন্তকালে সর্বত্র শ্রমিকদের মিলিশিয়া গড়ে ওঠে, এবং ফ্যাক্টরী কমিটি, শ্রমিক নারীদের কমিটি, ইত্যাদির উদ্যোগে মূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বাধে। ১৯২৩-এর প্রথম ছ’মাসে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সংখ্যা বাড়ে ৭০,০০০। ১১ই আগষ্ট সাধারণ ধর্মঘটের ফলে দক্ষিণপন্থী কানো সরকার পদত্যাগ করে। স্ট্রেসেম্যানের নতুন বুর্জোয়া সরকারকে আস্থাসূচক ভোট দেওয়ার প্রশ্ন উঠলে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির ১৭১ জন সদস্যের মধ্যে ৫৩ জন পার্টির বুর্জোয়া তোষণ নীতি মানতে অস্বীকার করেন। কিন্তু কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের নেতৃত্ব এই সময়ে এক বড় রকম ভুল করেন, যা ছিল সোভিয়েত পার্টির আমলাতান্ত্রিক বিপর্যয়ের সঙ্গে যুক্ত। বিপ্লবী অভ্যুত্থানের যে পরিকল্পনা করা হল, তা ছিল বহু ত্রুটিপূর্ণ, এবং বাম সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের সমর্থনের উপর নির্ভরশীল। ট্রটস্কী যখন প্রস্তাব করেন, এই বিপ্লব জার্মান কমরেডদের একক দায়িত্ব নয়, এবং তিনি জার্মানীতে যেতে ও অভ্যুত্থানে অংশ গ্রহণ করতে প্রস্তুত, তখন তাঁর এই প্রস্তাব খারিজ করা হয়। তাঁর চেয়ে বড় কথা, প্রথমে কমিউনিস্ট পার্টির উপর চাপ দেওয়া হল যে তাঁরা যেন স্যাক্সনী এবং থুরিঞ্জিয়ায় বাম সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট শাসিত সরকারগুলিতে অংশ নেন, এবং তাঁর মাধ্যমে শ্রমিকদের সশস্ত্র করেন। জার্মান পার্টি নেতা ব্র্যান্ডলার পরে বলেছিলেন, তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন, কারণ রাজ্য সরকারদের হাতে অস্ত্র ছিল না। কিন্তু তারা সরকারে গেলেন এবং যখন সেনাবাহিনী তাঁদের বিরুদ্ধে নামল, তখন আশা করলেন, ঐ বাম সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা অস্ত্র হাতে লড়বেন। ফলে শেষ অবধি বিনা বাধায় স্ট্রেসেম্যান ও বুর্জোয়া শ্রেণীর জয় হয়। জার্মানীর পক্ষে পরাজয় চূড়ান্ত ছিল না। সেদেশে কমিউনিস্ট পার্টি আরো এক দশক সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া ও কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের কাছে এই পরাজয় ছিল নির্ণায়ক।

১৯২৩-এর অক্টোবরে জার্মান বিপ্লবের পরাজয় আমলাতান্ত্রিক মহলে বিশ্ববিপ্লব সম্পর্কে আশা-আশঙ্কার অবসান ঘটালো। এর পরই তারা নিশ্চিন্তে পার্টির প্রলেতারীয় অংশের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করল। অক্টোবরের গোড়ায় ফেলিক্স জারজিনস্কি প্রস্তাব করলেন, পার্টিতে উপদল দেখা দিলে শুধু পার্টি কন্ট্রোল কমিশনকে নয়, চেকাকেও তা জানাতে হবে। অর্থাৎ পার্টিতে মতভেদ হলে এবার তার তত্ত্বাবধান করবে গোপন পুলিশ। শুধু তাই নয়, তিনি দাবী করলেন, শিল্পক্ষেত্রে ধর্মঘট হলে পার্টি সদস্যদের দায়িত্ব ধর্মঘটের নেতাদের পুলিশের কাছে চিহ্নিত করা। এর বিরুদ্ধে ট্রটস্কীর এবং ৪৬ জন নেতার প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে দেখা দিল ১৯২৩-এর শেষের বিতর্ক। ভোটে ব্যাপক জালিয়াতি করে ট্রটস্কীর সমর্থকদের হারানোর মাধ্যমে আমলাতন্ত্র পার্টিতে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করে নিল।

কিন্তু তখনও তার জয় চূড়ান্ত নয়। দেশে ও বিদেশে, ট্রটস্কী তথা বিপ্লবী ধারার বিরুদ্ধে আমলাতন্ত্রের প্রয়োজন ছিল কিছু মেকী বিপ্লবীয়ানার। তাই স্তালিন নিজেকে সামনে আনতে সাহস পেলেন না। তুলনায় অনেক পরিচিত বিপ্লবী বলে খ্যাত জিনোভিয়েভকে সামনে ঠেলে দিলেন।

১৯২৩-এর শেষে শুরু হল ‘‍‘ট্রটস্কীবাদ’’ বিরোধী প্রচার। জার্মানী, ফ্রান্স এবং পোল্যান্ডের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা এর প্রতিবাদ জানান। তার শোধ তোলা হল জার্মানীতে ব্র্যান্ডলার, থালহেইমার প্রমুখকে,, ফ্রান্সে মোনাত, রসমার ও সুভার‍্যাঁকে, এবং পোল্যান্ডে ভারস্কি, ভালেকি এবং কোস্ত্রিয়েওয়াকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে। নতুন নেতৃবর্গ ভাল কি মন্দ, তার চেয়ে বড় কথা, জার্মানীতে ম্যাসলো, ফিশার ও তাঁদের সমর্থকরা; ফ্রান্সে ত্রেয়াঁত ও জিরল্ট আর পোল্যান্ডে ডোমস্কি, উনশ্লিক্ট, এবং লেনস্কি, প্রত্যেককে সমর্থন করা হল তাঁরা সেই মূহুর্তে ট্রটস্কীর বক্তব্যের বিরোধিতা করছেন বলে। উপরন্তু, ফ্রান্স ও পোল্যান্ডের এই ‘‍‘বাম’’ নেতারা পার্টিতে সংখ্যাগুরু অংশের সমর্থন পান নি। আন্তর্জাতিকের কর্তৃত্ব দেখিয়ে এই নেতৃত্ব চাপিয়ে দিয়ে যে রেওয়াজ শুরু হল, তা বহুকাল কমিউনিস্ট আন্দোলনে ক্ষতি করে, এবং আন্তর্জাতিকতাবাদ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি করে।

সোভিয়েত বৈদেশিক নীতি ও কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকে বাম-ডান আবর্তন

 

১৯২৪ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের পঞ্চম কংগ্রেসের স্লোগান ছিল বলিশেভিকীকরণ। এর বাস্তব অর্থ ছিল, সমস্ত স্বাধীন কমিউনিস্টের কন্ঠরোধ করা। এই কাজ করা হল প্রথমত এই চাপ দিয়ে যে সোভিয়েত পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু অংশকে সমর্থন করা অনুচিত। দ্বিতীয়ত, বিপ্লবী শৃঙ্খলার নামে লেনিনের চিন্তাকে ধর্মীয় চেহারা দেওয়া হল, যার ব্যাখ্যা করার যোগ্য কেবল বলশেভিক পার্টির নেতারা। তৃতীয়ত, সোভিয়েত রাষ্ট্রকে রক্ষা করার যে কর্তব্য ন্যায়সঙ্গতভাবেই সমস্ত কমিউনিস্ট অনুভব করতেন, তাকে বিকৃত করে এবং বিশ্ববিপ্লবের প্রসারই যে শেষ বিচারে তার একমাত্র পন্থা এ কথা তত্ত্বের জাল বুনে এড়িয়ে গিয়ে, দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টিদের রণনীতিকে আমলাতন্ত্রের বৈদেশিক নীতির হাতিয়ারে পরিণত করার প্রক্রিয়া শুরু হল।

১৯২৪-২৮ পর্বের সমগ্র ইতিহাস পর্যালোচনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু কয়েকটি প্রসঙ্গে কথা বলা আবশ্যক । ১৯২৪-এর মধ্যভাগে বাস্তবে সর্বত্র শ্রেণী সংগ্রামে ভাঁটার যুগ ছিল। কিন্তু যে কোনো মূল্যে আক্রমনের হঠকারী প্রবক্তাদের সাচ্চা বামপন্থী বলে প্রমাণ করার জন্য জিনোভিয়েভ- স্তালিন নেতৃত্ব দুটি মারাত্মক কাজ করলেন। মুখে যুক্তফ্রন্ট কৌশলের কথা স্বীকার করলেও, তাঁরা বললেন, কেবল ‘‍‘নীচে থেকেই’’ যুক্তফ্রন্ট হতে পারে।

যুক্তফ্রন্ট সম্পর্কে লেনিন, ট্রটস্কী এবং জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা অনেকে, যেমন জেটকিন, ১৯২১-২২-এ যে প্রস্তাব করেছিলেন, তা প্রযোজ্য নির্দিষ্ট কিছু শর্তসাপেক্ষে। প্রথমত, যে দেশে কমিউনিস্ট ও সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক, উভয় দলই শক্তিশালী, সে দেশেই এই কৌশল সম্ভব। দ্বিতীয়ত, এই কৌশলের উদ্দেশ্য সেই সব লড়াই করা, যা শ্রমিকশ্রেণীর তাৎক্ষণিক সমস্যা থেকে শুরু করবে এবং যেখানে পার্টিগত ও কর্মসূচীগত প্রভেদ প্রাথমিক স্তরেই যুক্ত লড়াইয়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। শ্রেণী সংগ্রামে ছোটো লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা, এবং সেই লড়াইয়ে জয়ের ফলে প্রাপ্ত আশা, শ্রমিকদের বিপ্লবী দলের দিকে নিয়ে যাবে, এ ধারণা ছিল যুক্তফ্রন্ট কৌশলের উৎসের কারণ। স্পষ্টতই, যদি বাস্তবে পরিস্থিতি হয় বিপ্লবী, যদি ক্ষমতা দখলের লড়াই আসন্ন হয়, তাহলে যুক্তফ্রন্টের এই কৌশল অকেজো হয়ে পড়ে, আরণ সংস্কারবাদীরা বুর্জোয়া ব্যাবস্থার উচ্ছেদ চায় না। জিনোভিয়েভ বা স্তালিন জানতেন, ক্ষমতা দখলের লড়াই তাঁদের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু “বাম”-দের তাঁরা হাতে রাখতে চেয়েছিলেন। অতএব “নীচে থেকে” যুক্তফ্রন্টের স্লোগান। এ হল এক অসাধু প্রস্তাব। কোনো সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক শ্রমিক যদি নিজের দল ছেড়ে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে কাজ করেন, তবে তা যুক্তফ্রন্ট নয়। আর, সেই প্রস্তাব তো কমিউনিস্টরা সবসময়েই তাঁদের কাছে করেন। “নীচে থেকে যুক্তফ্রণ্ট” মানে, সংস্কারবাদী দল, দলের নেতা, এদের সঙ্গে যুক্তফ্রণ্ট না করা।

এর সঙ্গে যুক্ত হল সোশ্যাল ফ্যাসীবাদের কুখ্যাত তত্ত্ব। স্তালিন ঘোষণা করলেন, সোশ্যাল ডেমোক্রেসী এবং ফ্যাসীবাদ পরস্পর বিরোধী নয়, বরং তারা হল যমজ। প্রকৃতপক্ষে, সোশ্যাল ডেমোক্রেসী এবং ফ্যাসীবাদ বুর্জোয়া সমাজকে বাঁচায় একেবারে পরস্পরবিরোধী ভাবে। সোশ্যাল ডেমোক্রেসী বুর্জোয়া ব্যবস্থায় ক্ষমতায় গিয়ে সংস্কারের কথা, ও তার মাধ্যমে সমাজতন্ত্র আনার কথা বলে। তারা শ্রমিকদের তাৎক্ষণিক চেতনাকে চিরস্থায়ী করতে চায়। তারা শ্রমিকশ্রেণীর গণতান্ত্রিক চেতনাকে বুর্জোয়া গণতন্ত্রে আটকে রাখতে চায়। কিন্তু এজন্য তাদের চাই একদিকে এক নিয়ন্ত্রিত, বশীভূত, কিন্তু সজীব শ্রমিক আন্দোলন, আর অন্যদিকে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আর ফ্যাসীবাদ বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে রক্ষা করার জন্য শ্রমিক আন্দোলনকে-- তার সবচেয়ে নরমপন্থী ধারাকেও --ধ্বংস করতে চায় এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায় এক ফ্যাসীবাদী আমলাতন্ত্রের হাতে। স্তালিন যথেষ্ট জানতেন, ঐ সময়েই, ইতালীতে ফ্যাসীবাদ ক্ষমতা দখল করেছিল সবরকম শ্রমিক দল ও ট্রেড ইউনিয়নকে আক্রমণ করে। যে ১৯২৪ সালে স্তালিন ঘোষণা করলেন যে সোশ্যাল ডেমোক্রেসী এবং ফ্যাসীবাদ যমজ, সেই বছরই পার্লামেণ্টে তীব্র ফ্যাসীবিরোধী বক্তৃতা দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে ফ্যাসিবাদী খুনেবাহিনীর হাতে মৃত্যু হয় সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক নেতা গিয়াকোমো মাত্তেওত্তির ।

এই আপাতঃভাবে বাম, কার্যত শ্রমিক আন্দোলনের পক্ষে ক্ষতিকর তত্ত্ব তখনই খুব বড় রকম ক্ষতি করে নি, কারণ অচিরে সোভিয়েত আমলাতন্ত্রের স্বার্থে এক দক্ষিণপন্থী নীতি গৃহীত হল। কিন্তু এর ফল পরে দেখা গিয়েছিল।

১৯২৫-এর গোড়া থেকে স্তালিন ও জিনোভিয়েভের মধ্যে বিভেদ দেখা দেয়। ব্যক্তিগত স্বার্থে ট্রটস্কীর বিরোধিতা করলেও, জিনোভিয়েভ লেনিনের আন্তর্জাতিকতাবাদ এতটা গ্রহণ করেছিলেন যে তাঁর পক্ষে আমলাতন্ত্রের যোগ্য নেতা হওয়া সম্ভব ছিল না। স্তালিন ও তাঁর নতুন মিত্র বুখারিন সোভিয়েত ইউনিয়নের একক ক্ষমতায় সমাজতন্ত্র গঠনের কথা ঘোষণা করলেন। এটা যে বিশ্ব বিপ্লব পিছু হঠার ফলশ্রুতি নয়, বরং এই “তত্ত্ব” কে বাস্তবে রূপ দেওযার জন্য তাঁরা বিশ্ববিপ্লবের অপরিসীম ক্ষতি করলেন, তার অজস্র্ প্রমাণ আছে।

১৯২৫ সালে ঘোষিত হল, এক কৃষক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কীভাবে পেটি বুর্জোয়া কৃষকরা আন্তর্জাতিকতাবাদে উদ্বুদ্ধ হল, তা ব্যাখ্যা করা হল না। বুলগেরিয়ার পূর্বোল্লিখিত কৃষক ইউনিয়নের নেতাদের ২ কোটি দীনার অর্থ সাহায্য দেওয়া হল এবং তারা তা নিয়ে নীরবে পালিয়ে গেল। (দ্রঃ ই এইচ কার, সোশ্যালিজম ইন ওয়ান কানট্রি, খণ্ড ৩, পৃঃ ২১৫-১৬)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বুর্জোয়া ফার্মার-লেবার পার্টিকে কমিউনিস্ট ঘেঁষা বলে ঘোষণা করে, কমিউনিস্ট পার্টিকে তাদের মধ্যে প্রবেশ করতে বলা হল। এই দল স্বাভাবিকভাবেই এক বছরের মধ্যে ভেঙে গেল। ক্ষতিগ্রস্ত হল কমিউনিস্ট পার্টি। পোল্যাণ্ডে ডমস্কি ও উনশ্লিশটকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে ইতিমধ্যে ডাইনে মোড় নেওয়া ভারস্কিকে নেতৃত্বে ফেরৎ আনা হল। ১২ই মে ১৯২৬ জোসেফ পিলসুডস্কি সামরিক ক্যু–এর মাধ্যমে উগ্র দক্ষিণপন্থী শাসন চালু করলেন। কমিউনিস্ট আওন্তর্জাতিক জানাল তিনি পোল্যান্ডের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতা, প্রায় একজন পোলিশ ক্রমওয়েল, তাই তাঁকে সমর্থন করা দরকার।

কেন এসব হল? তার সবচেয়ে স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যাবে ব্রিটেন ও চীনের ঘটনার দিকে তাকালে। একটি দেশের একক ক্ষমতায় সমাজতন্ত্র গড়তে হলে আবশ্যক ছিল সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ থেকে মুক্তি পাওয়া। স্তালিনীয় যুক্তিটি ছিল সরল। যদি কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক অন্যান্য দেশে বিপ্লবের চেষ্টা বন্ধ রাখে, তা হলে সাম্রাজ্যবাদ নিশ্চয় প্রতিদান স্বরূপ সোভিয়েত ইউনিয়নকে সুখে থাকতে দেবে। কার্যত, ক্রুশ্চেভ পরে যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের তত্ত্ব খাড়া করলেন, এই তার সূচনা।

ব্রিটেন ও চীনে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ভূমিকা এই বিষয়টি স্বচ্ছভাবে দেখায়। ১৯২৫-এ গঠিত হয় ব্রিটেনের সুবিধাবাদী ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বের সঙ্গে সোভিয়েত ট্রেড ইউনিয়নের যুক্ত কমিটি। এ বিষয়ে স্তালিন, বুখারিন ও, টমস্কি (তিনজনেই পলিটব্যুরো সদস্য) এবং ট্রেড ইউনিয়ন নেতা লঝভস্কি দুটি কথা বলেন। প্রথমত, তাঁরা বলেন যে ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টি খুব ছোটো। এই যুক্ত কমিটির মাধ্যমে এমন বহু শ্রমিককে বিপ্লবী আন্দোলনে, টানা যাবে যাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির নাগালের বাইরে। অর্থাৎ পার্টি গঠনের ঐতিহাসিক কারণটিই অনেকাংশে অস্বীকার করা হল।

দ্বিতীয়ত, তাঁরা দাবী করলেন যে এ কমিটি হবে সোভিয়েত বিরোধী সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের প্রত্যুত্তর। এই কমিটির মাধ্যমে ব্রিটেনের শ্রমিকশ্রেণীকে সোভিয়েত রাষ্ট্র রক্ষার কাজে টানা যাবে।

অর্থাৎ, তত্ত্বগতভাবে, বিশ্ব বিপ্লব এবং সোভিয়েত রাষ্ট্র রক্ষা ও সেইদেশে সমাজতন্ত্র গঠন, এই দুটি কাজকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হল। আবশ্যই, মেকী মার্ক্সবাদী পরিভাষা ব্যবহার করে এই সংশোধনবাদী তত্ত্বকে “লেনিনবাদী” বলে চালানোর চেষ্টা করা হল।

১৯২৫-এর শেষদিকে ব্রিটেনের খনি শ্রমিকদের সঙ্গে সরকারের বিরোধ বাড়তে থাকে। ১৯২৬-এ খনি শ্রমিক ধর্মঘট থেকে গড়ে ওঠে সাধারণ ধর্মঘট। ন’দিনের সাধারণ ধর্মঘটে ব্রিটেনে প্রায় স্তব্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করে সংস্কারবাদী ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবর্গ।

ব্রিটেনের ট্রেড ইউনিয়নগুলিতে এ সময়ে মাইনরিটি মুভমেন্ট নামে কমিউনিস্ট প্রভাবিত একটি ধারা ছিল। সাধারণ ধর্মঘটের আগে থেকেই তারা সক্রিয় ছিল। কিন্তু তারা যখন ট্রেড ইউনিয়নের সরকারী নেতাদের সুবিধাবাদী চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে, তখন ঐ সুবিধাবাদী নেতারা তাদের বিপ্লবী বন্ধুদের সার্টিফিকেট দেখিয়ে শ্রমিকদের প্রতারণা করতে সক্ষম হয়। মাইনরিটি মুভমেন্ট ক্রমে ভেঙে যায়। এরপর সাহস সঞ্চয় করে ট্রেড ইউনিয়নের ঐ নেতারা সোভিয়েত শ্রমিকশ্রেণী প্রেরিত আন্তর্জাতিকতাবাদী সাহায্যকে “মস্কোর টাকা” আখ্যা দিয়ে ফেরৎ পাঠান। বামপন্থী বিরোধী গোষ্ঠী এই সময়ে বারবার ঐ যুক্ত কমিটি ভেঙে দেওযার দাবী তোলে। স্তালিনপন্থীরা সমাজতন্ত্রকে বাঁচানোর নামে তাদের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে। অবশেষে, ১৯২৭ সালে যখন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে কুটনৈতিক সম্পর্ক ছেদ করে, এবং তার অজুহাত দেয় ভারতে কমিউনিস্ট প্রচার, তখন সংস্কারবাদী ব্রিটিশ ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের অনুসরণ করে ইঙ্গ রুশ ট্রেড ইউনিয়ন কমিটি ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

এই ঘটনায় উল্লেখযোগ্য, যুক্তফ্রন্ট কৌশলের হঠকারী অপব্যাখ্যা থেকে স্তালিন কত সহজে মেনশেভিক দক্ষিণপন্থী অপব্যাখ্যায় চলে গেলেন। কেবল নীচে থেকে যুক্তফ্রণ্টের পরিবর্তে প্রস্তাব এল যুক্তফ্রণ্টের নামে পারস্পরিক অনাক্রমন চুক্তি। ত্রিশের দশকে এ পন্থারই বিকশিত রূপ হল পপুলার ফ্রন্টের রাজনীতি, এবং আজকের দিনের যুক্তফ্রন্ট, বাম ফ্রন্ট ইত্যাদি।

চীনেও একই সময়ে বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ বহ্নিশিখায় পরিণত হচ্ছিল। চীনের শ্রমিক আন্দোলন ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টি উভয়েই বয়স ছিল অল্প। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াই করে তারা শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। ১৯২৩ সালে, যখন চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ছিল একটি ছোটো বুদ্ধিজীবি গোষ্ঠী, তখন কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক প্রস্তাব করে পার্টির সদস্যরা যেন ব্যক্তিগতভাবে বুর্জোয়া কুওমিনতাং দলে যোগদান করেন। এই প্রস্তাবের সীমিত উপকারিতা ছিল। যে স্তরে বামপন্থী জাতীয়তাবাদ থেকেই কমিউনিস্ট কর্মী গঠন ছিল তাৎক্ষণিক কাজ (ভারতে, চীনে, সব রকম উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশেই কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের প্রথম পর্ব ছিল কিছুটা এই রকম) তখন এই প্রস্তাব গ্রহণ যোগ্য হতে পারে। কিন্তু যখনই এর ফলে পার্টির প্রাথমিক কর্মী ভিত্তি গড়ে ওঠে, তখন বুজোর্য়া জাতীয়তাবাদ ও কমিউনিস্ট মতবাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠে। তাই ১৯২৩-এ এই কাজ যতটুকু ঠিক হোক না কেন, ১৯২৫-এ যখন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সংখ্যা হল ৩০,০০০; ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা ৩০ লক্ষ, এবং বড় বড় দরিদ্র কৃষক সংগঠন গড়ে উঠল, তখন অত্যাবশ্যক ছিল স্বাধীন পার্টি, এবং স্বাধীন শ্রেণীভিত্তিক রাজনীতির মাধ্যমে প্রতি পদে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে সন্দেহ জাগ্রত করে তোলা।

১৯২৫-এর মধ্যভাগ থেকে ক্যান্টন ও অন্যান্য শিল্পনগরী গুলিতে ব্যাপক ধর্মঘট শুরু হল। লড়াইয়ের নেতৃত্বে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি। কিন্তু লড়াইয়ের মতাদর্শ ছিল বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ প্রভাবিত। কুওমিনতাং-এর বুর্জোয়া নেতৃত্ব কিন্তু ভীত ছিল। তারা একদিকে সচেতন ছিল যে চীনের সমরনায়ক আধা স্বাধীন প্রাদেশিক শাসকদের এবং তাদের পিছনে দাঁড়ানো সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের পরাস্ত করতে হলে গণআন্দোলন আবশ্যক। অন্যদিকে তারা শ্রমিক-কৃষকের গণ আন্দোলনকে ততটাই ভয় পেত, যতটা ভয় পেত হংকং-সাংহাই ব্যাঙ্কের ব্রিটিশ মালিকরা।

এই অবস্থায় বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের স্ববিরোধকে প্রকাশ্যে টেনে আনা, এবং তার ফলে বহু জঙ্গী জাতীয়তাবাদীকে কমিউনিস্ট রাজনীতিতে আনা, ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের অগ্রগতি নিশ্চিত করা, ছিল সম্ভাবনার মধ্যে।

কিন্তু স্তালিন নিয়ন্ত্রিত কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের মত ছিল অন্যরকম। ইতিমধ্যে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিককে যথেষ্ট পরিমাণে সোভিয়েত পার্টির নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছিল। ফলে ঐ দলের পলিটব্যুরো সদস্যরাই প্রাথমিকভাবে চীন বিপ্লবের গতিপ্রকৃতি স্থির করতেন। একথাও উল্লেখযোগ্য যে চীন বিপ্লবকে ধ্বংস করার স্তালিনীয় নীতির প্রতিবাদে ট্রটস্কী যখন পার্টি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের কার্যকরী সমিতির কাছে আবেদন করেন, তখন স্তালিন তাঁর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ এনে পার্টির কেন্দ্রীয় কনট্রোল কমিশনে তাঁর “বিচার” দাবী করেন। অর্থাৎ কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের নেতৃত্বের কাছে বিশ্ববিপ্লবের নীতি সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হল সোভিয়েত পার্টির শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা।

কি ছিল স্তালিনীয় লাইন? আমলাতন্ত্রের বৈদেশিক নীতির স্বার্থে চীনের কমিউনিস্টদের চীনা বুর্জোয়াশ্রেণীর পদানত রাখা। এই জন্য কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ঘোষণা করল যে কুওমিনতাং হল শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী ও শহুরে গণতন্ত্রীদের জোট। ১৯২৬-এর জানুয়ারীতে বলশেভিক পার্টির ১৪শ কংগ্রেসের সভাপতিমন্ডলী ভবিষ্যদ্বাণী করল যে কুওমিনতাং “এশিয়াতে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের ভিত ধ্বংস করে দেবে”। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ভ্রাতৃত্বমূলক পার্টি হিসেবে এল কুওমিনতাং। সোভিয়েত পার্টির পলিটব্যুরোতে এর বিরুদ্ধে একটি মাত্র ভোট পড়েছিল --– সেই ভোট ট্রটস্কীর।

সোভিয়েত অস্ত্রে সজ্জিত, সোভিয়েত অর্থে সমৃদ্ধ এবং সোভিয়েত সামরিক বিশেষজ্ঞদের কাছে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কুওমিনতাং সেনাবাহিনী ১৯২৬-এর জুলাইয়ে উত্তর চীনের সমরনায়কদের দমন করার অভিযানে বেরোলো। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় বিপ্লবের পতাকা তোলা হল। কিন্তু ইতিমধ্যে কুওমিনতাং নেতা চিয়াং কাই শেক দাবী করলেন, কমিউনিস্টরা কুওমিনতাং-এর নেতৃত্বে আসতে পারবে না। যে কোনো নেতৃস্থানীয় কমিটিতে এক-তৃতীয়াংশের বেশী সদস্য যেন কমিউনিস্ট না হয়। কুওমিনতাং-এর সব কমিউনিস্ট সদস্যদের নামের তালিকা তুলে দিতে হবে। তাঁর এই দাবীগুলি মেনে নেওয়া হল। অতঃপর ১৯২৬-এর মার্চ মাসে চিয়াং ক্যান্টনে সামরিক অভ্যুত্থান করে বহু কমিউনিস্ট নেতা ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের গ্রেপ্তার করলেন। মনে রাখা ভাল, এর পরেই চিয়াং কাই শেককে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের কার্যকরী সমিতির সান্মানিক সদস্য নির্বাচিত করা হল। সোভিয়েত পত্রপত্রিকায় চীন সম্পর্কিত প্রকৃত তথ্য চেপে যাওয়া হল। মণি গুহ হয়ত বলবেন, এ সবের কারণ হল সোভিয়েত শ্রমিকশ্রেণীর মনোবল অটুট রাখার ইচ্ছা। তাহলে আমরা ও বলব, কোনো কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিকশ্রেণীকে ধোঁকা দিয়ে বিপ্লবের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারে না।

সুতরাং ক্যান্টনে ঘর গুছিয়ে তবেই চিয়াং উত্তরাঞ্চল অভিযান শুরু করে। তার যাত্রাপথে সর্বত্র বিদ্রোহ দেখা দেয়, কারণ জনগণ বিপ্লবের বাস্তব সমর্থক ছিলেন। কিন্তু ২৯শে জুলাই ক্যান্টনে সামরিক আইন জারী হল। ১লা অগাস্ট “উত্তরাঞ্চল অভিযান চলাকালীন” সবরকম শ্রমিক আন্দোলন নিষিদ্ধ করা হল। কোয়াংটুং প্রদেশের গ্রামাঞ্চলে চিয়াং-এর সমর্থনপুষ্ট ভূস্বামীরা কৃষক সমিতিগুলিকে আক্রমণ করল।

চীনে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের প্রতিনিধিদের মধ্যে স্তালিনের প্রত্যক্ষ প্রবক্তা বোরোদিন বললেন, কৃষকদের এখন অপেক্ষা করতে হবে। কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি যখন বোরোদিনের কাছে আবেদন করে যেন কিছু সোভিয়েত অস্ত্র কৃষক সমিতিদের দেওযা হয়, বোরোদিন তা অগ্রাহ্য করেন এই কারণে, যে তার ফল হবে “কুওমিনতাং-এর বিরুদ্ধে কৃষকদের প্রতিরোধ”।

১৯২৭-এর ২১শে মার্চ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সাংহাইয়ের শ্রমিকশ্রেণী অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু কুওমিনতাং-এর সঙ্গে মৈত্রী অক্ষত রাখার নামে দুদিন পর চিয়াং-এর ফৌজকে বিনা বাধায় সাংহাই প্রবেশ করতে দেওয়া হয়।১২ই এপ্রিল চিয়াং তার জবাব দেয়। দুপুরের মধ্যে সাংহাইয়ের কমিউনিস্ট পার্টি দপ্তর, সবকটি ট্রেড ইউনিয়ন দপ্তর, ইত্যাদি তার ফৌজ দিয়ে দখল করে। সন্ত্রাসের রাজত্ব নামানো হয়।

এবার স্তালিন বলেন, “বাম” কুওমিনতাং নেতা ওয়াংচিং ওয়েই হল যথার্থ মিত্র। তিনি আরো বলেন যে ১৯০৫-এর রুশ বিপ্লবে সোভিয়েতগুলি যে কাজ করেছিল চীনে বাম কুওমিনতাং সেই কাজ করছে। এবার একই বিয়োগান্ত নাটক অনুষ্ঠিত হল মধ্যচীনে, উহান এলাকায়।

অবশেষে, ১৯শে সেপ্টেম্বর ১৯২৭, কমিউনিস্ট পার্টিকে নিজের নামে আত্মপ্রকাশ করতে দেওয়া হল। কিন্তু বিপ্লব এখনো এগোচ্ছে, এই মিথ্যা দাবী করে ১১-১৩ ডিসেম্বর ক্যান্টনে এক হঠকারী অভ্যুত্থান সংগঠিত করা হয়। অবশ্যই, মহান স্তালিন যেহেতু দোষহীন, তাই প্রথমের দক্ষিণপন্থী বিশ্বাসঘাতকতার জন্য দায়ী করা হল চীনা পার্টির সাধারণ সম্পাদক চেন তুসিউ-কে এবং পরের হঠকারীতার জন্য চু চিউ পাইকে। চেন অবশ্য বোরোদিন বা মানবেন্দ্রনাথ রায় প্রস্তাবিত কৌশলের বেশ কিছুটা বিরোধী ছিলেন।

সুতরাং বিশ্ব বিপ্লব যে ধাপে ধাপে পিছু হঠছিল, তা কাকতালীয় নয়। মনি গুহ সযত্নে কার্যকারণ সম্পর্কটা উল্টে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু প্রকৃত তথ্যানুগ ইতিহাস দেখায়, ১৯২৩-এ জার্মানীতে পরাজয় যেমন আমলাতন্ত্রের উত্থানে প্রয়োজনীয় ছিল, তেমনি ১৯২৭-এ চীন বিপ্লবের চরম পরাজয়ও ছিল আবশ্যক। চীন বিপ্লব যদি আংশিকভাবেও জয়ী হত, তবে বিজয়ী চীনা কমিউনিস্ট পার্টির যেসব নেতারা কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক আরোপিত রণনীতিতে অখুশী ছিলেন, তাঁরা নিশ্চিতভাবে অনেক নির্ভয়ে, অনেক জোর গলায় নিজেদের মত ব্যক্ত করতেন। উপরন্তু, বিপ্লব প্রসারিত হলে একটি দেশে স্বয়ংসম্পূর্ণ আমলাতান্ত্রিক “সমাজতন্ত্র” বরবাদ হয়ে যেত। চীন বিপ্লবকে তাই পরাজিত করানোর দরকার ছিল, যাতে রুশ বিপ্লবের প্রতেলারীয় নেতৃত্বকেও শেষ পর্যন্ত পরাস্ত করে, পার্টি থেকে বহিস্কার করে, এবং প্রলেতারীয় অগ্রণী বাহিনীকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে, আমলাশাহী ছয় দশকের জন্য নিজেকে ক্ষমতা কায়েম করতে পারে। ক্যান্টন অভ্যুত্থানের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল একটিমাত্র। চীন বিপ্লব জীবিত, এই দেখিয়ে আসন্ন ১৫শ বলশেভিক পার্টি কংগ্রেসে বামপন্থী বিরোধীদের প্রতিরোধকে পর্যুদস্ত করা। এই অভ্যুত্থানের ফলে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির শেষ প্রলেতারীয় ঘাঁটি চলে গেল। মস্কোয় তারই যেন প্রতিধ্বনি শোনা গেল- পার্টি থেকে কয়েক হাজার নেতৃত্বস্থানীয় বিরোধীকে বহিস্কার করার ঘোষণায়।

‘বাম’ বিপ্লবীয়ানার আড়ালে প্রতিবিপ্লবের সহায়তা

বামপন্থী বিরোধীদের বহিষ্কার করার পর স্তালিন ও বুখারিনের দ্বন্দ্ব সামনে চলে এল। বহু বামপন্থী বিরোধী ভ্রান্তভাবে মনে করেছিলেন যে শিল্পায়ণ প্রসঙ্গে বুখারিনের সঙ্গে তাঁদের যে বিতর্ক, তাই শ্রেণী সংগ্রামের মূল মতাদর্শগত বিতর্ক। এই কারণে তাঁরা স্তালিনের আপাতঃ বাম লাইনের সমর্থন করলেন। তবে সে বিষয়ে আমরা এখানে বিস্তারিত আলোচনা করতে পারব না। আমাদের দেখতে হবে বিশ্ব বিপ্লবী সংগ্রামে এই ‘বাম’ নীতির প্রভাব কি হল?

১৯২৮-এ কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ষষ্ঠ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হল। এতে আনুষ্ঠানিকভাবে একদেশে সমাজতন্ত্র গড়ার তত্ত্বকে আন্তর্জাতিকের কর্মসূচী হিসেবে গ্রহণ করা হল। অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হল, সারা পৃথিবীর কমিউনিস্ট আন্দোলনের মূল কর্তব্য আর বিশ্ববিপ্লবের অগ্রগতি ঘটানো নয়, সোভিয়েত রাষ্ট্রে ‘সমাজতন্ত্র’ (এবং ৩০-এর দশকের মধ্যভাগে থেকে এমনকি ‘সাম্যবাদ’) গড়ে তোলা।

ষষ্ঠ কংগ্রেসের এই নীতি ছিল চরম দক্ষিণপন্থী নয়া-মেনশেভিকবাদ। কিন্তু সাময়িকভাবে তাকে ‘বাম’ মোড়কে ঢেকে রাখা হল।১৯২৯ সালে বলা হল, সারা পৃথিবীতে বিপ্লবী পরিস্থিতির যুগ বিরাজ করছে। বিপ্লবী শ্রমিকদের স্বতন্ত্রভাবে সংগঠিত করার নামে যেখানে সম্ভব সেখানেই ট্রেড ইউনিয়ন ভাঙা ও ‘লাল’ ইউনিয়ন গড়া শুরু হল। সোশ্যাল ফ্যাসীবাদের তত্ত্বকে হিমঘর থেকে বার করে আনা হল।

১৯২৯-এর শেষদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক ভযাবহ অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হল। অতি দ্রুত, সমস্ত ধনতান্ত্রিক জগত সেই মন্দার কবলে পড়ল। তার ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হল জার্মানী। ১৯১৭তে যে অর্থে লেনিন রাশিয়াকে“দুর্বলতম ক্ষেত্র” বলে চিহ্নিত করেছিলেন, সেই অর্থে এখন ধনতন্ত্রের শিকলে দুর্বলতম ক্ষেত্র ছিল জার্মানী। সংকট জর্জরিত জার্মানীতে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ভিত ক্ষয়ে যেতে থাকল। ১৯২৮ সালের নির্বাচনে সোশ্যাল ডেমোক্রেসী পেয়েছিল ৯২ লক্ষ ভোট, এবং ‘মূলস্রোতের’ বুর্জোয়া ও ভূস্বামী দলগুলি পেয়েছিল ৯৮ লক্ষ ভোট। শতাংশ হিসাবে তা ছিল ২৯.৮ এবং ৩১.৭। কমিউনিস্ট পার্টি পেয়েছিল ১০.৬ শতাংশ, বা ৩৩ লক্ষ ভোট। নাজী দল পেয়েছিল ৮ লক্ষ ভোট। ১৯৩০-এর নির্বাচনের ছবিটা ছিলঃ

দলভোট (লক্ষ)শতাংশসাংসদ
সোশ্যাল ডেমোক্রেসী ৮৬ ২৪.৫ ১৪৩
কমিউনিস্ট ৪৬ ১৩.১ ৭৭
‘মূলস্রোত’ বুর্জোয়া দলসমূহ ৭০ ১৯.৮ ১১৯
ইকনমিক পার্টি ১৪ ৩.৯ ২৩
নাজী ৬৪ ১৮.৩ ১০৭
ক্যাথলিক সেন্টার ৪১ ১১.৮ ৬৮
ফোক পার্টি ১০ ৩.০ ১৯

অর্থাৎ ১৯২৮ থেকে ১৯৩০-এর মধ্যে একদিকে কমিউনিস্টদের ও অন্যদিকে, অনেক প্রকান্ডভাবে নাজীদের শক্তি বৃদ্ধি হয়েছিল। এলাকাভিত্তিক ভোট বিশ্লেষণ দেখিয়ে দেয়, নাজীদের ভোট বেড়েছিল প্রধানত বুর্জোয়া-ভূস্বামী দলগুলির পেটি বুর্জোয়া সমর্থকবৃন্দের মত পরিবর্তনের ফলে, আর কমিউনিস্ট ভোট বেড়েছিল সোশ্যাল জেমোক্রেসীর অনুগামী শ্রমিকদের একাংশের সমর্থন লাভের ফলে। কিন্তু একথাও বোঝা যায় যে কমিউনিস্টদের চেয়ে অনেক নাটকীয়ভাবে শক্তিবৃদ্ধি হয়েছিল নাজীদের। ফলে যুক্তফ্রন্টের কৌশল যথাযথভাবে প্রয়োগ করার এই ছিল সময়।

কিন্তু বিপ্লব আসন্ন, এই তত্ত্বের সঙ্গে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের স্তালিনবাদী নেতৃত্ব আরো বলল, ক্রমবর্ধমান “সামাম্রাজ্যবাদী অন্তর্দ্বন্দ্বের ও শ্রেণী সংগ্রাম তীব্রতর হওয়ার এই পরিস্থিতিতে, ফ্যাসীবাদ ক্রমে ক্রমে হয়ে পড়ে বুর্জোয়া শাসনের প্রধান রূপ। যে সব দেশে শক্তিশালী সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক দল আছে, সেখানে ফ্যাসীবাদ সামাজিক ফ্যাসীবাদের রূপ নেয়, ফ্যাসীবাদী একনায়তন্ত্রের সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রামকে পক্ষাঘাতগ্রস্থ করার কাজ করে ক্রমবর্ধমান রূপে বুর্জোয়াদের সেবা করে।” (জেন জেগ্রাস, দ্য কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালঃ ডকুমেন্টস, খন্ড ৩, পৃঃ ৪৪)। অতএব, এই যুগে নাকি সব বুর্জোয়া সরকারই ফ্যাসীবাদী বা ফ্যাসীবাদমুখী। যুক্তফ্রন্ট সম্ভব কেবল নীচে থেকে। মূল শত্রু হল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা। জার্মানীর ক্ষেত্রে স্পষ্টতই একথা মিথ্যা ছিল।

কেন এই নীতি গৃহীত হল? সোশ্যাল ডেমোক্রেসী তো নানাভাবে শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষতি নিশ্চয়ই করছিল। কিন্তু তার উত্তরে ট্রেড ইউনিয়ন ভাঙায় জার্মানীতে জঙ্গী কমিউনিস্ট শ্রমিকরা ব্যাপক শ্রমিকদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন।

১৯২৪-২৫-এর অতিবামপন্থা ছিল ভ্রান্ত, কিন্তু তা ছিল বিপ্লবীদের হঠকারী রণনীতি। ১৯২৯-৩৪ পর্বের “বামপন্থা”কিন্তু তা ছিল না। ১৯২৪-২৫-এর ‘বাম’ নেতারা অভ্যুত্থান সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন. লড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯২৮-৩৪-এ যাঁরা নেতা হলেন, তাঁরা ছিলেন স্তালিন, মলোটভদের মনোনীত নেতা, যাঁদের কোনো গণভিত্তি ছিল না বা যা ছিল তা হল সোভিয়েত সূর্যের রশ্মি গায়ে পড়ে প্রতিফলিত আলো মাত্র।

কমিউনিস্ট কর্মীরা অনেকে পূর্ববর্তী পর্বের দক্ষিণ-পন্থায় ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাই তাঁরা এই আপাতঃ বাম লাইনকে আসল বামপপন্থা বলেই আঁকড়ে ধরলেন।

স্তালিনের প্রকৃত উদ্দেশ্য খুঁজতে হলে তাকাতে হবে সোভিয়েত পররাষ্ট্র নীতির দিকে। ১৯২৩-এর বিপ্লবী আন্দোলন ব্যর্থ হলেও, রুশ-জার্মান সম্পর্ক তার ফলে ক্ষুন্ন হয়েছিল। স্ট্রেসেম্যানের সরকার ক্রমেই পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতির উপর জোর দেওয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সমস্য বাড়ছিল।‘‘একদেশে সমাজতন্ত্রের’’ পূর্বশর্ত হল, আমরা আগেই দেখেছি, সাম্রাজ্যবাদ দেশকে মিত্র হিসেবে পেলে তাতে সুবিধা হবে – এই ছিল স্তালিন মলোটভদের চিন্তা।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে “একদেশে সমাজতন্ত্র”গড়ার অর্থ তাহলে বিশ্ব ধনতন্ত্র ও তার শ্রমবিভাজনের উপর নির্ভরতা। দশ বছরে পাশ্চাত্যকে ছাড়িয়ে যেতে হবে – এই অবাস্তব স্লোগানকে অন্তত আংশিকভাবে কার্যকর করার জন্য প্রয়োজন ছিল জার্মান প্রযুক্তির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ। চারটি প্রধান সাম্রাজ্যবাদী দেশ থেকে সোভিয়েত আমদানীর শতকরা হিসেব এই নির্ভরতার ধারাবাহিক চরিত্র দেখিয়ে দেয়।

বছরমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রব্রিটেনফ্রান্সজার্মানী
১৯২৯ ২০.১ ৬.২ ৪.৩ ২২.১
১৯৩০ ২৫.০ ৮.০ ২.৮ ২৪.০
১৯৩১ ২১.০ ৬.০ ১.৩ ৩৭.০
১৯৩২ ৫.০ ৫.০ ০.৫ ৪৬.০

(তথ্যসূতরেঃ রবার্ট ব্ল্যাক, ফ্যাশিজম ইন জার্মানী, খন্ড ২, পৃঃ ৭৪৪)।

অর্থাৎ, প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সফল করার ক্ষেত্রে জার্মান প্রযুক্তি ও ভারী শিল্পের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে শিল্পপতিরা হিটলারের উত্থানের পিছনে প্রধান মদতদাতা, তারাই ছিল সোভিয়েত পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বড় সমর্থক। এ এক অনন্যসাধারণ যুক্তফ্রন্ট।

কিন্তু এই নির্ভরতারই উল্টো পিঠ ছিল জার্মান প্রলেতারীয় বিপ্লবের পিঠে ছুরি বসানো। ১৯৩৭ সালে সোভিয়েত আমলাতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করার পর ওয়াল্টার ক্রিভিটস্কি যে বহু গোপন তথ্য ফাঁস করে দেন, তার একটি হলঃ “যদি ক্রেমলিনে জার্মানপন্থী বলে কারো কথা বলা যায়, তবে তিনি হলেন স্তালিন।.....নাজীদের জয় তাঁর মধ্যে জার্মানীর সঙ্গে নিবিড়তর সম্পর্কের অনুসন্ধানের ইচ্ছা দৃঢ়তর করল।” (ওয়াল্টার ক্রিভিটস্কি, আই ওয়াজ স্ট্যালিনস এজেন্ট, লন্ডন ১৯৩৯, পৃঃ ১৮)।

ক্রিভিটস্কির বক্তব্যের সমর্থনে স্তালিনের বহু রচনা ও বক্তৃতার উল্লেখ করা যায়। স্থানাভাবে আমরা একটিই করছি। ১৫তম পার্টি কংগ্রেসে স্তালিনের বক্তৃতায় ফরাসী ও জার্মান ধনিকদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কথা বলা ছিল। কিন্তু জার্মানদের ক্ষেত্রে তিনি সাম্রাজ্যবাদ কথাটি ব্যবহার করেন নি। উপরন্তু, তিনি দাবী করেন যে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক হল পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী আঁতাতের চর অর্থাৎ জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেসী যে নীতি অনুসরণ করছে তা জার্মান সাম্রাজ্যবাদ নয়, ইঙ্গ মার্কিন-ফরাসী সাম্রাজ্যবাদের অনুগামী।

জার্মান কূটনীতিবিদ গুস্তাভ হিলগার তাঁর স্মৃতিচারণে লিখেছেন যে ১৯২৩-এর শেষে যখন ট্রটস্কী জার্মান বিপ্লবের মূল সমর্থক হিসেবে দেখা গিয়েছিলেন, তখন থেকে সোভিয়েত বিদেশ বিষয়ক কমিশার চিচেরিন তাঁকে ও জার্মান রাষ্ট্রদূত কাউন্ট ব্রকডর্ফ র‍্যান্টঝাউকে বুঝিয়েছিলেন যে জার্মানীর (অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী জার্মানীর) স্বার্থ জড়িত আছে স্তালিনপন্থীদের সঙ্গেই। (জি হিলগার ও এডুয়ার্ড মেয়ার, দি ইনকমপ্যাটিবল অ্যালাইস, নিউ ইয়র্ক, ১৯৫৩, পৃঃ ১২৩-২৪, ২১১-১৩)। ১৯২৯ সালে ম্যাক্সিম লিটভিনভ জার্মান কূটনীতিবিদদের সঙ্গে আলোচনকালে বলেন, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা সরকারে না আসাই শ্রেয়। (হিলগার ও মেয়ার, পৃঃ ১৫২-৫৩)।

ক্রেমলিনের কূটনীতি কীভাবে জার্মান শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষতি করেছিল, তার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস আজও লেখা হয় নি। ১৯৩০ সাল থেকে জার্মানীতে নাজীদের উত্থানের সময় থেকে, ফ্যাসীবাদী সন্ত্রাস রোধে ও শ্রমিক শ্রেণীর আর্থ সামাজিক পরিস্থিতির উন্নতিকল্পে আবশ্যক ছিল যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলা। নাজীদের নির্বাচনী সাফল্যের পরদিন থেকে, শেষ পর্যন্ত, এ ছিল ট্রটস্কীর অক্লান্ত আহ্বান। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ও জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি এই আহ্বান অগ্রাহ্য করে, এবং নীতিগতভাবে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গড়তে অস্বীকার করে। তাদের ছিল দুটি যুক্তি – প্রথমতঃ সোশ্যাল ডেমোক্রেসী হল “সামাজিক ফ্যাসীবাদ” এবং দ্বিতীয়ত, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক হল ভার্সাই চুক্তির বিজেতা সাম্রাজ্যবাদী জোটের দালাল। যে “নেতারা” এই দাবী করছিলেন, তাঁরা একবারও ভাবেননি যে অদূর ভবিষ্যতে জার্মান সাম্রাজ্যবাদই বিশ্ব শ্রমিক আন্দোলনের সবচেয়ে বিপজ্জনক শত্রুতে পরিণত হবে। বরং, ১৯৩১ সালের ১১ই জুন পার্টি নেতা নিউবাউয়ার লিখলেন যে জার্মানী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের অধীনস্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে, এবং তার কারণ হল জার্মানীর বুর্জোয়া শ্রেণীর শ্রেণীগত অন্ধত্ব, যার দরুণ তারা সোভিয়েত ইউনিয়েনের সঙ্গেআরো দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন করছে না। (ইনন্টারন্যাশনাল প্রেস করেসপন্ডেন্স, খন্ড ১১, নং ৩১, ১১ জুন ১৯৩১, পৃঃ ৫৮৮)। ফ্যাসীবাদের বিরুদ্ধে লড়তে অস্বীকার করে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক পত্রিকায় বলা হল, জার্মানীতে কমিউনিস্টদের কর্তব্য জার্মান জনগণের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে ফ্যাসীবাদী মুখোস থেকে মুক্ত করে অন্য পথে নিয়ে যাওয়া। (কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল, খন্ড ৭, নং ১০, ১ সেপ্টেম্বর ১৯৩০, পৃঃ ১৬৮)। শ্রমিক শ্রেণী নয় জনগণ। সাম্রাজ্যবাদী জার্মানীতে “জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম”। অধঃপতনের আর কি বাকী ছিল, কেউ প্রশ্ন করতে পারেন।

দুর্ভাগ্যক্রমে, ছিল। ১৯৩০ – ৩১-এ, পার্লামেন্টে বার বার দেখা গেল, নাজীরা ও কমিউ্নিস্টরা একই দিকে ভোট দিচ্ছে।

১৯৩১-এর মধ্যভাগে প্রাশিয়ার প্রাদেশিক (সোশ্যাল ডেমোক্রোটিক) সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থাসূচক গণভোটের দাবী করে নাজীদল ও বিভিন্ন পুরোনো রাজতন্ত্রী দল। জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির এক সংকীর্ণতাবাদী, কিন্তু সৎ, নেতা হাইনজ নিউম্যান এই সময় স্লোগান তোলেন, ফ্যাসীবাদীদের যেখানে পারবে সেখানেই মারবে। নিউম্যানের স্ত্রী মার্গারেট বুবার-নিউম্যানের স্মৃতিচারণে আমরা জানতে পারি, “১৯৩১-এর গোড়ায়, নিউম্যানের সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে স্তালিন তাঁর নাজী বিরোধী লড়াইয়ের পদ্ধতির সমালোচনা করেন।....১৯৩১-এর শেষে, (আরেকটি) আলোচনা প্রসঙ্গে হাইনজ ক্রমবর্ধমান নাজী বিপদের উল্লেখ করে তাঁর নীতির পক্ষে কথা বলতে চেষ্টা করেন। স্তালিন তাঁকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করেন, তোমার কি মনে হয় না, নিউম্যান, যে জাতীয়তাবাদীরা যদি জার্মানীতে ক্ষমতায় আসে, তবে তারা পাশ্চাত্যের সঙ্গে এত (গোলমালে) জড়িয়ে পড়বে যে আমরা শান্তিতে সমাজতন্ত্র গড়তে পারব?”(মার্গারেট বুবার-নিউম্যান, ফন পটসডাম নাখ মস্কো, স্টুটগার্ট, ১৯৫৭, পৃঃ ২৮৪-৮৫)।

অতএব, জার্মান কমিউনিস্টদের উপর চাপ দেওয়া হল, যেন তাঁরা নাজী সমর্থিত গণভোটে সোশ্যাল ডেমোক্র্যটদের বিরুদ্ধে ভোট দেন। ২১শে জুলাই জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক সরকারকে একটি চার দফার দাবী সনদ পেশ করে ঘোষণা করল, ঐ দাবী না মানলে তারাও নাজীদের সহ্গে গণভোটে সরকার ফেলার জন্য আন্দোলন করবে। এটা কোনো যুক্তফ্রন্ট ছিল না, কিন্তু নিকৃষ্ট রাজনৈতিক ব্ল্যাকমেল। আর, ব্ল্যাকমেল কাজে না লাগায় পার্টি গণভোটের প্রচারে নামল। তারা যুক্তফ্রন্ট করল সেই সব প্রসিদ্ধ বিপ্লবীদের সহ্গে যাঁরা হলেন হিটলার, হুগেনবার্গ, বৃহৎ শিল্পপতি থিসেন, প্রমুখ।

১ আগস্ট ১৯৩১, পার্টির একটি পত্রিকা, ‘ফ্যানফ্যারেন’ একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করল, যাতে বলা হল, যারা জনগণের বিপ্লব ও মুক্তির জন্য বিপ্লবী যুদ্ধের বিরোধিতা করে, তারা তাঁদের প্রতি বেইমানী করছে, যাঁরা গত যুদ্ধে (অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধে) স্বাধীন জার্মানীর জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। হায় লুক্সেমবুর্গ. হায় লিবক্লেশট।

গণভোট ব্যর্থ হল কিন্তু জার্মান শ্রমিকদের কমিউনিস্টদের পক্ষে টানা আরো কঠিন হয়ে পড়ল। উপরন্তু, সংস্কারবাদী সোশ্যাল ডেমেমাক্র্যাটরাও যা করেননি, কমিউনিস্ট নেতারা সেই কাজ করলেন – একই রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে নাজীদের সঙ্গেযৌথভাবে প্রচার করা।

এই নীতির তীব্র ও ধারাবাহিক সমালোচনা করেছিলেন ট্রটস্কী। তাঁর উত্তরে পার্টির মুখপত্র রোটে ফাহন্ (লাল পতাকা) বলল “ট্রটস্কীর কাছে কেবল জাতীয় সমাজতন্ত্রীরাই ফ্যাসীবাদী. জরুরী অবস্থা ঘোষণা, প্রচন্ডভাবে বেতন হ্রাস, ধর্মঘট কার্যত নিষিদ্ধ করা.... সব ট্রটস্কীর মতে ফ্যাসিবাদ নয়” (ট্রটস্কীর কর্তৃক উদ্ধৃত – দ্রঃ, দি স্ট্রাগল এগেনস্ট ফ্যাশিজম ইন জার্মানী, পৃঃ ১৮৮)।

১৯৩১ ধরে হিটলারের নিজস্ব ফৌজের সংখ্যা ১ লক্ষ থেকে বেড়ে হল ৪ লক্ষ। বেকার সংখ্যা ১৯৩২-এ দাঁড়াল ৫০ লক্ষে। এপ্রিল ১৯৩২-এ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নাজীরা পেল ১ কোটি ৩৪ লক্ষ ভোট। সেপ্টেম্বর ১৯৩২-এ স্তালিনের মুখপাত্র, আর্নেস্ট থ্যালম্যান বললেন, “ট্রটস্কীবাদীরা এস পি ডি এবং কে পি ডি-র ঐক্যের স্লোগান তোলে জনগণের মধ্যে ঐক্যের চাহিদাকে মিথ্যা পথে প্রবাহিত করার জন্য....আজকের জার্মানীতে দুজনে (স্যোশাল ডেমোক্রেসী ও ফ্যাসীবাদ) “যমজ ভাই” হিসেবে স্বমূর্তি ধারণ করেছে।” (ডেগ্রাস,দ্য কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালঃ ডকুমেন্টস, খন্ড ৩, পৃঃ ২১৩)।

কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকল, কিন্তু প্রধানতঃ বেকার ও শ্রেণীচ্যুতদের মধ্যে। ১৯২৮ সালে পার্টি সদস্যের ৬২.৩% ছিলেন ফ্যাক্টরি শ্রমিক। ১৯৩১-এ ফ্যাক্টরি শ্রমিক ছিলেন মাত্র ২০.২২% । (ফ্রাঞ্জ বোর্কেনাউ, ওয়ার্ল্ড কমিউনিজম, পৃঃ ৩৬৪)।

১৯৩২-এর নভেম্বরেও নাজীরা যেখানে ৩৩.১% ভোট পায়, সেখানে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা পায় ২০.৪% এবং কমিউনিস্ট পার্টি ১৬.৯% ।

কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি যুক্তফ্রন্টের চেষ্টা করতে অস্বীকার করল। অতএব, জানুয়ারী ১৯৩৩- হিটলার বিনাবাধায় ক্ষমতা দখল করে। কমিউনিস্ট, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট, ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী, সকলের কন্ঠরোধ করা হল। পরবর্তী কয়েক বছরে ১ কোটি ৫০ লক্ষ জার্মান হিটলারের কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে প্রবেশ করেন। ১মে ১৯৩৩, কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল পত্রিকা লিখল, “জার্মান পরিস্থিতি সম্পর্কে কমরেড হেকার্টের রিপোর্ট শুনে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের কার্যকরী সমিতির সভাপতিমন্ডলী ঘোষণা করছে যে কমরেড থ্যালম্যানের নেতৃত্বে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি অনুসৃত রাজনৈতিক লাইন ও সাংগঠনিক নীতি, হিটলারের ক্ষমতা দখল পর্যন্ত এবং তা ঘটার সময়ে ছিল সম্পূর্ণ সঠিক” (কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল, খন্ড ১১, নং ৮, ১ মে , ১৯৩৩)। আর মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

 

ডাইনে মোড়: পপুলার ফ্রন্ট

 

১৯৩৪-এর জানুয়ারীতে অনুষ্ঠিত হল সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সপ্তদশ কংগ্রেস। এই কংগ্রেস সরকারীভাবে পরিচিত বিজয়ীদের কংগ্রেস বলে। সমাজতন্ত্রের বিজয় সংক্রান্ত মিথ্যা ও অলীক কল্পনা ছাড়া, বাস্তব একটা বিজয় ছিল বটে। বলপূর্বক বহু লক্ষ কৃষককে খতম করা হয়েছিল। বাকিদের জোর করে ভরা হয় যৌথ খামারে। প্রচন্ড কৃষক ও শ্রমিক নিপীড়নের ভিত্তিতে শিল্পোৎপাদনবাড়ানো হয়। কিন্তু বিজয়ীদের মধ্যে মতৈক্য ছিল না। কিরভকে কেন্দ্র করে আমলাতন্ত্রে এক উদারপন্থী অংশ চেয়েছিল সন্ত্রাস কমিয়ে আনতে। ১ ডিসেম্বর ১৯৩৪ কিরভকে হত্যা করা হয়। এর পর আসে ঐ হত্যার অজুহাতে পার্টি ও রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্র সহ সর্বস্তরের উপর সন্ত্রাস। স্তালিন, মলোটভ, ভিশিনস্কি, ইয়েজভ, (পরে তাকেও হত্যা করা হয়) বেরিয়া, ঝদানভ,এবং সাধারভাবে গোপন পুলিশের রাজ কায়েম করা হল পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে। এ ছিল আমলাতান্ত্রিক শাসনের মধ্যেও চরম স্বৈরতান্ত্রিক পর্যায়। সমস্ত পুরোনো বলশেভিকদের ঝাড়ে বংশে নির্মূল করা হয়। এমন কি, ঐ ১৭ তম কংগ্রেসের ১৯৬৬ জন প্রতিনিধির মধ্যেও ১১০৮ জনকে প্রতিবিপ্লবী আখ্যা দিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ঐ কংগ্রেসে নির্বাচিত ১৩৯ জন কেন্দ্রীয় কমিটির ৯৮ জনকে, অর্থাৎ ৭০% কে গ্রেপ্তার করে গুলি করে মারা হয়।

স্তালিনের ব্যক্তিগত রাজের এই পর্বে আন্তর্জাতিকভাবে ক্ষমতা সংহত করার জন্য বিপ্লবী বামপন্থী সমালোচনা ঠেকানো আবশ্যক ছিল। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক এখন চলে গেল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক দলগুলির চেয়েও ডাইনে। যে শ্রমিকরা এই নীতির বিরোধিতা করলেন, তাঁদের আখ্যা দেওয়া হল “ট্রটস্কীবাদী ফ্যাসীবাদী”।

দুটো ঘটনার মধ্যে যোগাযোগ স্পষ্ট। রাশিয়ায় চরম সন্ত্রাসের মাধ্যমে বলশেভিক পার্টির সমস্ত ঐতিহ্যকে মুছে ফেলা, আর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিপ্লবী রণনীতি বর্জন করা, এক কাজের দুটো দিক।

হিটলার ক্ষমতায় আসার অল্পদিনের মধ্যে আমলাতন্ত্র বুঝে গেল, হিটলার বিসমার্কের মত পূর্ব-মুখী বৈদেশিক নীতি চায় না। রুশ-মৈত্রী অটুট রাখা তার উদ্দেশ্য না। অতএব ১৯৩৫-এ কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেস ঘোষণা করল, শান্তির জন্য ব্যাপকতম যুক্তফ্রন্ট। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট নাম ব্যবহার করলেও বাস্তবে এর কোনো শ্রেণী ভিত্তি নীতি ছিল না। এমন কি, তথাকথিত প্রগতিশীল ঔপনিবেশিক জাতীয় বুর্জোয়াদের সঙ্গে মৈত্রীর কথাও আর প্রধান থাকল না। শান্তিরক্ষা ও ফ্যাসীবাদকে রোখার নামে পৃথিবীর দুই প্রধান সাম্রাজ্যবাদ, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সঙ্গে মৈত্রী হল বড় কথা।

তার প্রমাণ পাওয়া যায়, সপ্তম কমিন্টার্ন কংগ্রেসের বক্তৃতাগুলি দেখলে। উপনিবেশগুলির প্রতিনিধিরা ছিলেন সংখ্যায় কম। তাঁদের কন্ঠ ছিল রূদ্ধ। ১৯১৯-এর পর এই প্রথম কোনো ভারতীয় বক্তৃতা দিলেন না। ভিয়েতনামের প্রতিনিধির বক্তৃতায় ফরাসী সাম্রাজ্যবাদের কথা শোনা গেল না।

ফ্যাসীবাদের বিপদ সর্বত্র শ্রমিকশ্রেণীকে নাড়া দিয়েছিল। ফ্যাসীবিরোধী লড়াই করতে তাঁরা তৈরী ছিলেন। ৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৩৪ ফরাসী ফ্যাসীবাদীরা পার্লামেন্ট ভবন আক্রমণ করে। ১২ই ফেব্রুয়ারী তার জবাবে সংস্কারবাদী ও স্তালিনবাদীদের পরিচালিত দুটি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন সাধারণ ধর্মঘট ডাকে। কমিউনিস্ট পার্টি ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের মধ্যেও যুক্ত সংগ্রামের চুক্তি সাক্ষরিত হয়। কিন্তু অতি দ্রুত, তাতে নিয়ে আসা হয় মধ্য-দক্ষিণপন্থী বুর্জোয়া দল র‍্যাডিকাল পার্টিকে। ১৯৩৬-এর নির্বাচনে এই মোর্চা বিপুলভাবে জয়লাভ করে। সমাজতন্ত্রীরা পায় ১৮২টি আসন, র‍্যাডিক্যালরা ১১৬টি, কমিউন্স্টি পার্টি ৭২টি।

সমাজতন্ত্রীলিওন ব্লামের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। কিন্তু তার পরই আসে প্রবল শ্রমিক সংগ্রাম। জুন মাসে ৬০ লক্ষাধিক শ্রমিক ধর্মঘটে জড়িয়ে পড়েন। ট্রেড ইউনিয়নভুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা চার পাঁচ মাসে ১১ লক্ষ থেকে বেড়ে হয় ৫০ লক্ষ। এই ধর্মঘট নিছক বেতন বৃদ্ধির জন্য হয় নি। ক্ষমতার জন্য লড়াইয়ের সম্ভাবনা সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়। কিন্তু ফরাসী কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে যে চুক্তি সম্পাদিত হয়, তা ছিল নিছক অর্থনৈতিক। বামপন্থী সমাজতন্ত্রী নেতা পিভের বললেন, এখন সব কিছু সম্ভব। স্তালিনবাদী থোরেজ তার উত্তরে বললেন, কখন ধর্মঘট শেষ করতে হবে তাও জানতে হয়। সাধারণ ধর্মঘট থেকে বিপ্লবের পথে যাওয়া ছিল ট্রটস্কীবাদ।

অতঃপর ব্লামের সরকার দক্ষিণপন্থী প্রতিবিপ্লবের হাতে আক্রান্ত স্পেনের পপুলার ফ্রন্ট সরকারকে অস্ত্র সাহায্য করতেও অস্বীকার করে।

দু বছরের মধ্যে একের পর এক পরাজয়ে শ্রমিক শ্রেণীর মনোবল ভেঙে পড়ে। যে প্রগতিশীল বৈদেশিক নীতি নাকি পপুলার ফ্রন্টের ভিত্তি ছিল, তাও একের পর এক লঙ্ঘিত হল। যখন কমিউনিস্ট পার্টি পপুলার ফ্রন্ট থেকে বেরোলো, তখন শ্রমিক আন্দোলন পরাজয়ের মুখে। পপুলার ফ্রন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা সমৃদ্ধ সংসদ ১৯৩৯-এর সেপ্টেম্বরে কমিুনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করল। ঐ সাংসদদের ভোটে ১৯৪০-এর জুনে হিটলারের করদ সরকার গঠিত হল পেত্যাঁ ও লাভালের নেতৃত্বে।

স্পেনের পপুলার ফ্রন্টে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি, ও প্রাক্তন ট্রটস্কীপন্থী পি ও ইউ এম। তার নির্বাচনী বিজয়ের পিছনে ছিল নৈরাজ্যবাদী ট্রেড ইউনিয়নের সমর্থন। প্রথম প্রধান মন্ত্রী হলেন রক্ষণশীল আজানিয়া, যাকে ১৯৩৫ পর্য়ন্ত কমিউনিস্ট পার্টি ফ্যাসীবাদী বলত। বুর্ঝোয়া ইতিহাসবিদ ই এইচ কার লিখেছেন, যে এই সরকারের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য ছিল কোনো মৌলিক সামাজিক অর্থনৈতিক কর্মসূচীর অনুপস্থিতি।

অর্থাৎ সরকারটি ছিল একেবারেই বুর্জোয়া সরকার তাতে কমিউনিস্টরা থাকলেও । কিন্তু দেশে প্রতিক্রিয়া ও বিপ্লবের সামাজিক শক্তির দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীল নেতারা অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে। স্থানীয়ভাবে শ্রমিক শ্রেণীর উদ্যোগে পাল্টা অভ্যুত্থান হয়। তার ফলে কার্যত মার্চ ১৯১৭-র রাশিয়া বানভেম্বর ১৯১৮-র জার্মানীর মত দ্বৈত ক্ষমতা দেখা দেয়। আতঃপর কমিউনিস্ট পার্টি বুর্জোয়া রাষ্ট্র পুনরায় গড়ে তোলর কাজে নামে। গণতন্ত্র রক্ষা ও ট্রটস্কীবাদ এবং ফ্যাসীবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষিত হয়। স্পেনের প্রলেতারীয় বিপ্লবকে দুই শত্রুর সন্মুখীন হতে হয়। জেনারেল ফ্র্যাঙ্কোর শত্রুতা ছিল সবার জানা। ফ্র্যাঙ্কোর পিছনে যে বুর্জোয়ারা, তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার স্লোগান তোলেন এমন কি সমাজতন্ত্রী দলেরও কিছু নেতা। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি তার বিরোধিতা করে। স্পেনের উপনিবেশ মরক্কোর স্বাধীনতা ঘোষণা করলে, মরক্কোর স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতা আবদুল করিমের সঙ্গে মৈত্রী করলে ফ্র্যাঙ্কোর মূর সেনাদের মধ্যে ভাঙন আনা যেত। কিন্তু তা ছিল অসম্ভব। কারণ এই উপনিবেশের স্বাধীনতাকে সমর্থন করলে মরক্কোর ফ্রান্স অধিকৃত অংশ, বা আলজিরিয়া, ইত্যাদি দেশেও স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখা দিত। আর তা হলে ইঙ্গ ফরাসী সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে মৈত্রী অসম্ভব হয়ে পড়ত।

ফ্র্যাঙ্কো বিরোধী শিবিরের মধ্য শ্রেণীদের প্রধান মুখপাত্র হিসেবে দেখা দিল কমিউনিস্ট পার্টি। পার্টির দৈনিকের সম্পাদক জেসাস হার্নান্দেজ বললেন, “আমরা কোনো সামাজিক উদ্দেশ্য নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছি এ কথা বলা যায় না।....আমরা কেবলমাত্র গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রকে রক্ষা করতে চাই।” (ফেলিক্স মরো, রেভল্যুশন অ্যান্ড কাউন্টার রেভল্যুশন ইন স্পেন, লণ্ডন, ১৯৬০, পৃঃ ৩৪)।

যখন ক্যাটালোনিয়া ও ভ্যালেন্সিয়াতে শ্রমিক ও দরিদ্র কৃষকরা নৈরাজ্যবাদীদের ও পি ও ইউ এম এর নেতৃত্বে শ্রেণী সংগ্রাম তীব্রতর করে তোলেন, তখন কমিউনিস্ট পার্টি তাঁদের দমন করার কাজে সামনের সারিতে থাকে। পি. ও. ইউ. এম. নেতা আঁদ্রে নিনকে গুমখুন করে মিথ্যা প্রচার করা হয়, তিনি নাজীদের কাছে পালিয়ে গেছেন। বিপ্লব দমনের কাজ সাফল্যমন্ডিত হলে, বুর্জোয়াদের আর কমিউনিস্ট পার্টিকে দরকার হল না। তারা এবার সরকারকে উচ্ছেদ করে ফ্র্যাঙ্কোকে ডেকে আনে। স্তালিনবাদের প্রত্যক্ষ ফল হল স্পেনের ঐতিহাসিক বিপ্লবের নির্মম পরাজয়।

 

কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের অবসান ও তারপর

 

১৯৩৯-এর অগাস্টে স্তালিন হঠাৎ হিটলারের সঙ্গে গোপন চুক্তির দিকে এগোলেন। বহুকাল ধরে স্তালিনবাদীরা দাবী করে এসেছেন, এর কারণ হল, ইঙ্গ-ফরাসী সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র। একথা অনস্বীকার্য যে সবকটি সাম্রাজ্যবাদী দেশই সোভিয়েত ইউনিয়নে ধনতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় উৎসাহী ছিল। কিন্তু এই দীর্ঘ প্রবন্ধে আমরা দেখাতে চেয়েছি, ধনতন্ত্রকে ঠেকানোর একমাত্র নিশ্চিত পথ, বিশ্ববিপ্লবের প্রসার, স্তালিন ও স্তালিনবাদের সক্রিয় প্রয়াসের ফলে যা পরাস্ত হয়েছিল।

যে কোনো সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গেই সাময়িক রফা হতে পারে। তাতে কে “গণতান্ত্রিক” সাম্রাজ্যবাদ আর কে “স্বৈরতান্ত্রিক” সাম্রাজ্যবাদ, সেই বাছবিচার গৌণ। কিন্তু রফার চরিত্র কেমন হবে ? হিটলারের সঙ্গে গোপন চুক্তি মোতাবেক পোল্যান্ডের একাংশ দখল করা, বাল্টিক প্রজাতন্ত্রগুলি দখল করা – এও কি প্রগতিশীল কাজ ছিল ?হিটলারের সঙ্গে চুক্তির আরেক শর্তানুযায়ী, কয়েকশ জার্মান কমিউনিস্ট ও জার্মান ইহুদী শরণার্থীকে যে নাজীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল, তাও কি সমাজতন্ত্র গড়ার জন্য ? ঐ পর্বে যে ফরাসী কমিউনিস্ট পার্টি ঘোষণা করল, হিটলার এখন শান্তির পক্ষে, আর আগ্রাসী কেবল ইঙ্গ-ফরাসী সাম্রাজ্যবাদ, তাকে মণি গুহরা কোন ডায়ালেকটিকস দিয়ে ব্যাখ্যা করবেন ? হয়ত, কেউ বলবেন, থোরেজের উক্তির জন্য স্তালিনকে কেন দায়ী করব ? কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক কি ঘোষণা করল, তাই দেখা যাক। নভেম্বর ১৯৩৯-এ তারা বলল, এই যুদ্ধ বিশ্বে আধিপত্যের জন্য যুদ্ধ। অতএব এ যুদ্ধ অন্যায়, প্রতিক্রিয়াশীল। তবে কি কমিন্টার্ন তার প্রতিষ্টার যুগের বিপ্লবী নীতিতে ফিরে গেল ? না, তা নয়। ১৯৩৫ থেকে ফ্যাসীবাদকে প্রধান শত্রু বলার পর তারা হঠাৎ দাবী করল, ‘শান্তি’ চাই, অর্থাৎ হিটলারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এমন এক শান্তি, যাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিশ্চিন্তে পূর্ব পোল্যান্ড ও তিন বাল্টিক প্রজাতন্ত্রকে হজম করতে পারে।

এই স্লোগানও বেশী দিল থাকল না। ১৯৪১-এর ২২শে জুন যুদ্ধটা আবার “গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধে” পরিণত হল, কারণ হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করেছিল। এরপর এল আরো কলঙ্কজনক এক অধ্যায়। মূল শত্রু নিজের দেশে, লেনিন লুক্সেমবুর্গ-লিবক্লেশটের সেই বিখ্যাত রণধ্বনির পরিবর্তে, গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ করার আহ্বান করা হল। “গণতান্ত্রিক” শিবিরে কমিউনিস্ট পার্টিদের কাজ হল নিজ নিজ সাম্রাজ্যবাদের বিজয় নিশ্চিত করা। অতএব ১৯৪২-এ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা। অতএব চীনে স্তালিনবাদী ওয়াংমিং প্রমূখ মাওকে চাপ দিলেন চিয়াংকাই শেকের সঙ্গে কেবল সাময়িক চুক্তি নয়, বরং কুওমিনতাং যতদূর যাবে, তার বেশী এক পা-ও রাজনৈতিকভাবে এগোনো চলবে না। অবশেষে চার্চিল ও রুজভেল্টকে খুশী করার জন্য, ১৯৪৩-এর মে মাসে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের কার্যকরী সমিতি সংগঠন ভেঙে দেওয়ার আহ্বান করে। ৮ই জুন ১৯৪৩ আনুষ্ঠানিকভাবে সংগঠন ভেঙে দেওযা হয়। তারপর থেকে, স্তালিনবাদী শিবির দৃঢ়ভাবে বলে এসেছে আন্তর্জাতিক সংগঠন অপ্রযোজনীয়। কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সংগঠম থাকলে বরং নিয়ন্ত্রণ কষ্টকর হয়ে উঠতে পারত। তাছাড়া স্তালিনবাদ ও সোশ্যাল ডেমোক্রেসী মিলে বিংশ শতাব্দীর অধিকাংশ বছরগুলি জুড়ে পূর্ববর্তী এক শতাব্দীর প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদী চেতনাকে এতটা ভেঙে দিতে পেরেছে যে তার পর আর আন্তর্জাতিকতাবাদকে অবিপ্লবী খাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিককে বজায় রাখা ছিল অপ্রয়োজনীয়। বরং আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের বহু নেতা, যাঁরা মস্কোয় আশ্রয় নিয়েছিলেন, যথা হাঙ্গেরীর বিপ্লবের নেতা বেলা কুন, জিমারওয়াল্ড সম্মেলনে ল্যাটভিয়ার প্রতিনিধি জ্যান বারঝিন, ফিনল্যান্ডের ১৯১৮-র বিপ্লবের নেতা ম্যানার, পোল্যান্ডের ভারস্কী, ভালেকি, কোস্ত্রিয়েওয়া, ডোমস্কি ও উনশ্লিসট, জার্মানীর হুগো এবারলেইন (প্রথম কমিন্টার্ন কংগ্রেসে জার্মান প্রতিনিধি) ও হাইনজ নিউম্যান, যুগোস্লাভ পার্টির টিটো ছাড়া অন্য সব নেতা এবং অবশ্যই লেনিন যুগের বলশেভিক নেতৃত্বের ব্যাপক অংশ, ট্রটস্কী, জিনোভিয়েভ, বুখারিন, রাডেক, টমস্কি, রাইকভ, কামেনেভ, একে একে সকলকেই হত্যা করে, অবশেষে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের শবদেহকেও কফিনে পোরা হল। সোভিয়েত আমলাতন্ত্রের প্রধান নেতা হিসেবে স্তালিন ক্ষমতার দিকে এগোলেন প্রতি পদক্ষেপে বিশ্ব বিপ্লব ও বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতাবাদীদের ঐতিহ্যকে নষ্ট করে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগ্রামের অস্থি দুপায়ে মাড়িয়ে।

সোভিয়েত ইউনিয়নে যা গড়ে উঠেছিল, তা ছিল সমাজতন্ত্র, এ হল মণি গুহ-র মত। ইতিহাস ও মার্ক্সবাদী তত্ত্ব, উভয়েই দেখায়, এ মত সবৈর্ব মিথ্যা। কিন্তু বর্তমান প্রবন্ধে আমরা সে তর্কে যাব না। সে জন্য প্রয়োজন স্বতন্ত্র প্রবন্ধ। মণি গুহর যে বক্তব্যের দিকে আমরা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করব, তা হল, সমাজতন্ত্রের সংকটের জন্য “দায়ী বিশ্বের কমিউনিস্ট পার্টি ও শ্রমিক শ্রেণী, দায়ী বিশ্ব বিপ্লবের অনুপস্থিতি” ( অনীক, পৃঃ ২৩), এবং, “পরিশেষে, সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের মূল উৎস বিশ্ব বিপ্লবের অনুপস্থিতি হলেও, একদেশে সমাজতন্ত্রের লেনিনীয় তত্ত্ব নাকচ হয়ে যায় না” (ঐ, পৃঃ ২৪), প্রথমত, তথ্যের সাহায্যে আমরা দেখিয়েছি, মণি গুহ স্তালিনের ব্যক্তিগত “সুনাম”কে সঠিকভাবে নিক্ষেপিত পঙ্ক থেকে উদ্ধার করতে চান, এবং বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের বুকে নতুন করে এই ক্যান্সার রোগটি চাপিয়ে দিতে চান। বিশ্বের বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টি, যারা স্তালিনবাদের অধীনে এসেছিল, তারা নিশ্চয়ই দায়মুক্ত নয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকেই কেন্দ্রীয় দায় নিতে হবে। আর, যে শ্রমিকরা ঐ সব কমিউনিস্ট পার্টি বা তাদের প্রভাবিত গণ সংগঠনে এসেছিলেন, তাঁরা ঐ দলকে বিপ্লবী মনে করেই এসেছিলেন। হ্যাঁ তাঁদের দায়িত্ব এইটুকু, যে তাঁরা বিশ্বাসঘাতক, অপ্রলেতারীয় নেতৃত্বকে যথাসময়ে চিনতে পারেন নি। কিন্তু হিটলারের হাতে সচেতনভাবে জার্মান শ্রমিক আন্দোলনকে সঁপে দিয়েছিল স্তালিনবাদ। স্পেনে বিপ্লবী শ্রমিকদের গুলি করে হত্যা করেছিল স্তালিনবাদীরা।বিশ্ব বিপ্লব অনুপস্থিত ছিল না, তাকে সাম্রাজ্যবাদ, সোশ্যাল ডেমোক্রেসী এবং স্তালিনবাদ একত্রে হত্যা করেছিল। মণি গুহরা কি তথ্য সহকারে এর জবাব দেবেন ? না, তাঁরা চলে যাবেন স্তালিন-ডিমিট্রভ-পাম দত্তদের রচনার উদ্ধৃতিতে, অথবা কোন বুর্জোয়া কূটনীতিবিদ, অধ্যাপক বা সাংবাদিক স্তালিনের গুণগান গেয়েছিলেন তার উদ্ধৃতিতে। আর, বিশ্ব বিপ্লবের অনুপস্থিতির ফলে শেষ পর্যন্ত বিংশ শতাব্দীর প্রলেতারীয় অগ্রগতির বৃহদাংশ ন্যসাৎ হয়ে গেল, এমন কি উনবিংশ শতাব্দী থেকে গৃহীত আন্তর্জাতিক সংগঠন করার নীতি পর্যন্ত ব্যাপক শ্রমিক বর্জন করলেন, তা আজ তর্কাতীত। তাই এর পর এক দেশে সমাজতন্ত্র গড়ার আষাঢ়ে গল্প শুধু অসত্য নয়, তা শ্রমিকশ্রেণীকে বিভ্রান্ত করে, কদর্য স্তালিনীয় রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থাকে সমাজতান্ত্রিক বলে সমাজতন্ত্রের প্রতি শ্রমিকের আস্থা নষ্ট করে। তাই তা এক চরম প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব। বিশ্ব বিপ্লবের প্রসার, সমাজতন্ত্রের অগ্রগতি, তাই হতে পারে স্তালিনবাদকে ধ্বংস করে, স্তালিনবাদী তত্ত্ব বর্জন করে, মার্ক্সীয় পথে, চতুর্থ আন্তর্জাতিকের পতাকার নীচে।

 

তথ্য সংক্রান্ত সংযোজন

 

এই প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে কমিউনিস্ট কর্মীদের জন্য, পন্ডিতদের সেমিনারের জন্য নয়। তাই অগণিত পাদটীকার ভারে একে ভারাক্রান্ত করা হয় নি। কিন্তু আমরা জানি, এতে যে তথ্যাদির উল্লেখ করা হয়েছে, তার প্রতিবাদে স্তালিনবাদী স্তাবকরা সোচ্চার হবেন। আমরা তাই একটি সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ তালিকা যুক্ত করে দিচ্ছি।

 

1. A. Adler (Ed) – Theses, Resolutions and Manifestos of the First Four Congresses of the Communist International, London, 1980

2. J. Degras, The Communist International. Documents, 3 Volumes, London, 1956, 1960 and 1965.

3. W. Abendroth, A Short History of the European Working Class, London, 1972.

4. L. Trotsky. The Third InternationalAfter Lenin, New York, 1973.

5. L. Trotsky, On China, New York, 1976.

6. L. Trotsky, The Struggle Against Fascism in Germany, New York, 1971

7. E. H. Carr, The Twilight of the Comintern, London, 1982.

8. R. Black, Fascism in Germany, London, 1974.

9. G. Novack, d. Frankel, F. Feldman, The First Three Internationals, New York, 1974.

10. W. Krivitsky, I was Stalin’s Agent, New York, 1939.

 

-----x-----