Marxist Theory

সমাজতন্ত্র ও পরিবেশ

সমাজতন্ত্র ও পরিবেশ

অমিতাভ বসু

 

          পরিবেশবাদীরা অনেকে মনে করেন, মার্ক্সবাদ একটি উৎপাদনসর্বস্ব মতাদর্শ এবং পরিবেশ সম্পর্কে তার না আছে চিন্তা, না আছে বিশেষ বক্তব্য। একথা মনে করার কারণ হল, বিংশ শতাব্দীতে মার্ক্সবাদের নামে প্রধান যে রাজনীতি চলেছিল, সেই স্তালিনবাদের প্রকোপ। স্তালিনবাদী রাজনীতি ভারতেও কীভাবে পরিবেশকে অবহেলা করেছে তার যথেষ্ট নজীর আছে। কার হাতে প্রযুক্তি, সেটাই তাদের মতে শেষ কথা। অর্থাৎ, নিউক্লিয়ার প্রযুক্তির মধ্যে সমস্যা নেই, যদি “সমাজতন্ত্রীরা” ঐ প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ করেন। তাই চের্নোবিলের ভয়ংকর দুর্ঘটনার পর যখন কলকাতায় অ্যান্টি নিউক্লিয়ার ফোরামের পক্ষ থেকে মিছিল ডাকা হয়, তখন সেই মিছিলকে ঘিরে রেখেছিল মিছিলের চেয়ে বহুগুণ বড় এক পুলিশ বাহিনী, যাদের মোতায়েন করেছিল বামফ্রণ্ট সরকার

        মার্ক্স-এঙ্গেলসের রচনা দেখলে বোঝা যায়, তাঁরা ঐ ধরণের চিন্তা করতেন না। কিন্তু সমালোচকরা অনেকেই ধরে নিয়েছেন মার্ক্স-এঙ্গেলস পুঁজিবাদের অর্থবহ বিশ্লেষণ করলেও পরিবেশের উপর পুঁজিবাদের বা প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে চিন্তা করেন নি। তাঁরা নাকি মনে করেছিলেন, একবার প্রযুক্তি শ্রমিক শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে এলে সমগ্র মানবজাতির স্বার্থে তার সীমাহীন সম্প্রসারণ ঘটানো সম্ভব মার্ক্সের এই তথাকথিত ধারণাকে বলা হয়েছে, প্রমেথীয় ধারণা। গ্রীক ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী প্রমেথিউস নামে এক “টাইটান” বা দৈবশক্তি দেবরাজ জিউসের কাছে থেকে প্রযুক্তি ও অগ্নি চুরি করে মানুষকে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ প্রযুক্তিই উন্নতির ও সভ্যতার সোপান, এই নাকি মার্ক্সের মত। বিগত কয়েক দশকে, বিশেষত জন বেলামি ফস্টার ও পল বার্কেটের রচনার ফলে এ নিয়ে ভিন্ন মত দেখা দিয়েছে।

        এ বিষয়ে আলোচনা আজকের যুগে প্রচন্ড জরুরী, নিছক ইতিহাসের খাতিরে নয়, ভবিষ্যতের প্রয়োজনে। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের গোড়ার দিকের কল্পনাসমূহের বিপরীতে দাঁড়িয়ে মার্ক্স-এঙ্গেলস এক সময়ে বলেছিলেন, ভবিষ্যতের সমাজ কেমন হবে, তা নিয়ে অনুমান করা আমাদের কাজ নয়। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে সমাজতন্ত্রের নামে এমন বহু রাষ্ট্র ও অর্থনীতি ও সমাজ দেখা দিয়েছে যেগুলি বাস্তবে শ্রমিক শ্রেণীর ও অন্য শোষিত মানুষের স্বার্থ বিরোধী। আজও চীনে, উত্তর কোরিয়াতে সমাজতন্ত্রের নামাবলী জড়িয়ে কোথাও উগ্র পুঁজিবাদী বিবর্তন ঘটেছে, কোথাও পারিবারিক শাসন চালু রয়েছে। তাই আজকের দিনে বিংশ শতাব্দীর অভিজ্ঞতার আলোকে বলা দরকার, সমাজতন্ত্র বলতে আমরা কী বুঝি ? তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল, সমাজতন্ত্র মানুষ ও পরিবেশের মধ্যে সম্পর্ককে কীভাবে দেখছে বা দেখবে ?

        এখানে সর্বাগ্রে বলা দরকার, ধ্রুপদী মার্ক্সবাদকে দৈববাণী বলে মনে করার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু মার্ক্সবাদের বিশ্লেষণ ও চিন্তাপদ্ধতি মানুষ ও প্রকৃতির আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে এমন অন্তর্দৃষ্টির সুযোগ দেয়, যা  বায়োস্ফিয়ারে আমাদের স্থান বুঝতে খুবই সাহায্য করে।

        মার্ক্স-এঙ্গেলস সমাজতন্ত্র/সাম্যবাদ বলতে যা বুঝতেন, তার গোড়ার কথা হল উৎপাদকরা স্বাধীনভাবে একজোট হয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজের ভবিষ্যত গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করবেন যে শ্রমিক-কৃষকরা বিপ্লব সংঘটিত করবেন, তাঁরাই বিপ্লবের ফল ভোগ করবেন। অর্থাৎ, তাঁরা গণতান্ত্রিকভাবে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থে অর্থনীতি ও সমাজের গতি নির্ধারণ করবেন। এমন এক সমাজ নির্মিত হবে যেখানে উৎপাদন হবে মানুষের প্রয়োজনের ভিত্তিতে, মুনাফার স্বার্থে নয়।

        ১৯২০-এর দশকের শেষ থেকে শুরু হয় স্তালিনীয় প্রতিবিপ্লব। ১৯৩০-এর দশকে এক পার্টি-রাষ্ট্রভিত্তিক আমলাতন্ত্র ক্ষমতা দখল করে। এর পর সমাজতন্ত্রের তকমা এঁটে যত দেশই দেখা দিক না কেন,কিউবার আংশিক ব্যতিক্রম  ছাড়া সবক্ষেত্রেই আমলাতান্ত্রিক পার্টি অর্থনীতি পরিচালনা করছে। এই দেশগুলির অর্থনীতিতে পুঁজির শাসন অক্ষত ছিল না। কিন্তু একটি পরজীবি আমলাতন্ত্র শ্রমিকের উৎপাদনে থাবা বসাতো। যেহেতু গণতন্ত্র ছিল না, তাই আমলাতন্ত্র পরিকল্পনা নামে উপর থেকে যা চাপিয়ে দিত, তার পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতিরও হিসেব করা হত না। প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতা ও বিশ্ববিপ্লবের দিশা ছেড়ে এল জাতীয়তাবাদ, এক দেশ সমাজতন্ত্র তত্ত্বের নামে আমলাতন্ত্রের স্বার্থরক্ষার কর্মসূচী। ফলে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির সঙ্গে প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়ন, পরে চীন, পাশ্চাত্যের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সমতার চেষ্টায় যে পথ ধরেছিল, তা পরিবেশ ধ্বংসকারী।

        এই কারণে, আমরা প্রথমে মার্ক্স ও অন্য মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদের পরিবেশ চিন্তা সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করব।

শিল্পায়ণ, বিশ্ব উষ্ণায়ন ও সাম্যবাদ

         

          যদি পৃথিবীর গড় তাপ আজকের চেয়ে ৬ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড বেড়ে যায়, যার প্রবল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তাহলেও বহু লক্ষ, এমন কি বহু কোটি বছর পর এই গ্রহে নতুন প্রাণের উদ্ভব সম্ভব, বায়োডাইভারসিটিও ফিরতে পারে। কিন্তু তা হবে মানুষের ধরা ছোঁয়া এমন কি কল্পনারও বাইরেপার্মিয়-ট্রায়াসিক যুগে, অর্থাৎ ২৫ কোটি বছরেরও বেশী আগে, প্রায় ৯৫ শতাংশ প্রাণ (উদ্ভিদ, পশু সবই) ধ্বংস হয়ে যায়। পৃথিবীর বায়োডাইভারসিটি তার পুরোনো স্তরে ফিরতে পেরেছিল ৫ কোটি বছর পরে। বিশ্ব উষ্ণায়ণ হলে সভ্যতা ভেঙে পড়বে। এবং তার ফলে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু হবে। শুধু তাই নয়, দ্রুত পরিবেশ পরিবর্তনের ফলে ৫০ থেকে ৯০ শতাংশ প্রজাতির মৃত্যু হবে।

        এক শতাব্দীর বেশী আগে ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস শ্রেণীবিভক্ত সমাজে স্বল্পমেয়াদী স্বার্থসিদ্ধি ও তার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা উদ্রেকের নিবিড় আন্তঃসম্পর্ক ব্যাখ্যা করেছিলেন। আমরা মানুষরা প্রকৃতির উপর যে বিজয় অর্জন করেছি তা নিয়ে নিজেদের বেশী পিঠ চাপড়ানি দেওয়ার দরকার নেই। প্রতিটি বিজয়ের জন্য প্রকৃতি আমাদের উপর প্রতিশোধ নেয়। একথা ঠিক যে প্রতিটি বিজয় প্রথমত, আমরা যে ফল চেয়েছিলাম, তা এনে দিয়েছে; কিন্তু দ্বিতীয়ত এবং তৃতীয়ত, ভিন্ন, অপ্রত্যাশিত ফল দেখা দিয়েছে, যা অনেক ক্ষেত্রে প্রথমটির নেতি ঘটিয়েছে। মেসোপটেমিয়া, গ্রিস, এসিয়া মাইনর ও অন্যত্র যারা বনভূমি ধ্বংস করে কৃষিযোগ্য জমি সংগ্রহ করেছিল, তারা স্বপ্নেও ভাবেনি যে বনের সঙ্গে জল সংগ্রহের কেন্দ্র বা আর্দ্রতার ভান্ডার সরিয়ে তারা ঐ দেশগুলির বর্তমান হতাশ পরিস্থিতির ভিত্তি স্থাপন করছেআল্পসের ইতালীয়রা যখন উত্তরের ঢালে সযত্নে রক্ষিত পাইন বনগুলিকে দক্ষিণের ঢাল থেকে কেটে সাফ করে, তখন তারা জানত না যে এর ফলে তারা বছরের বড় সময়ের জন্য তাদের পার্বত্য ঝর্ণাগুলির জল কেড়ে নিচ্ছে। তার ফলে আবার বর্ষাকালে আরো তীব্রভাবে তাদের জলধারা সমতলভূমিরতে আসতে থাকে.....। এইভাবে, প্রতি পদক্ষেপে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, যে আমরা প্রকৃতির উপর সেইরকম শাসন চালাই না, যা চালায় কোনো বিজয়ী এক বিদেশী জাতির উপর, যেন আমরা প্রকৃতির বাইরে দাঁড়িয়ে। বরং আমরা, আমাদের রক্ত, মাংস ও মগজ  সহ,   প্রকৃতির অঙ্গ;  আমরা তার মাঝেই বিদ্যমান, এবং আমরা তার উপর প্রভুত্ব করার যে কথা বলি, তার বাস্তবতা এইটুকুই, যে অন্য সব প্রাণীর তুলনায় আমাদের সুবিধ্‌ আমরা তার নিয়মাবলী শিখতে ও সার্থকভাবে প্রকাশ করতে পারি।

        মানুষের কাজের দীর্ঘমেয়াদী ফল কী হতে পারে মানুষ কেন তাকে যথাযথভাবে দেখে নি ? এর কারণ হল, শ্রেণীবিভক্ত সমাজে, একদিকে রয়েছে শাসক শ্রেণী, যাদের কাছে গচ্ছিত আছে জ্ঞান (অন্তত সাধারণভাবে), অথচ যারা সেই জ্ঞানকে ব্যবহার করতে চায় নিছক তাদের শ্রেণীস্বার্থে; আর অন্যদিকে শ্রমজীবি মানুষ, যারা বিকল্প চায়, কিন্তু বিকল্প কোন পথে, সে সম্পর্কে সব সময় তাদের ধারণা স্বচ্ছ নয়। এই কারণে, শাসক শ্রেণী বিরোধী বিদ্রোহ-বিপ্লবকে অনেক ক্ষেত্রেই কুক্ষিগত করে নতুন উদীয়মান উচ্চবর্গীয়রা। এই পদ্ধতিতেই, ইউরোপে সামন্ততন্ত্র বিরোধী লড়াইয়ে শ্রমিক, ক্ষেতমজুর, ছোটো চাষী, এরা সকলেই সামিল হলেও, নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়েছিল বুর্জোয়া শ্রেণী। আর বুর্জোয়া শ্রেণী ক্ষমতা দখল করার ফলে দীর্ঘমেয়াদী ফল বিশ্লেষণ করার চেষ্টা আরো সরে গেল।

        বিখ্যাত বুর্জোয়া (সংস্কারপন্থী, এবং যে সব বামপন্থীরা বুর্জোয়া ববস্থার মধ্যেই শ্রমিকের কর্মসংশ্থান, রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ, এ সবের স্বপ্ন দেখেন তাঁদের গুরু) অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনসের এক প্রসিদ্ধ উক্তি হল, “in the long run we will all be dead”অর্থাৎ, বেশী দীর্ঘমেয়াদী ফলের কথা ভেবে কী হবে ? আমরা তো সবাই একদিন মরব।

        ধনতন্ত্রের বিকাশের ফলে, প্রতিটি পুঁজিপতি অন্য প্রতিটি পুঁজিপতির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। সবচেয়ে কম ব্যয়ে উৎপাদন করে কীভাবে মুনাফার হার বৃদ্ধি ও পুঁজি সঞ্চয় করা যায়, তাই হয় তাদের একমাত্র লক্ষ্য। ফলে তারা একই সঙ্গে নির্মম আঘাত হানে শ্রমিকের উপর এবং পরিবেশের উপর। আমরা আবার এঙ্গেলসের রচনার দিকে তাকালে দেখতে পাব তিনি লিখেছিলেনঃ

        শাস্ত্রীয় পোলিটিক্যাল ইকনমি, যা হল বুর্জোয়া শ্রেণীর সমাজবিজ্ঞান, তা উৎপাদন ও বিনিময়ের ক্ষেত্রে মানুষের কাজের সামাজিক প্রভাবগুলিকে ততটুকুই পরীক্ষা করে দেখে, যতটুকু বাস্তবে চাওয়া হয়েছে। এই তত্ত্ব যে সামাজিক সংগঠনের তত্ত্বগত বহিঃপ্রকাশ, তার সঙ্গে এই দৃষ্টিভঙ্গি খাপ খেয়ে যায়। ব্যক্তি পুঁজিপতি যেমন তাৎক্ষণিক লাভের জন্যই উৎপাদন আর বিনিময়ে লিপ্ত হয়, তেমনি [এই সমাজবিজ্ঞানে] তাই কেবলমাত্র সবচেয়ে নিকটবর্তী, সবচেয়ে তাৎক্ষণিক ফলাফলগুলিকেই হিসেবের মধ্যে নেওয়া হয়। একজন ব্যক্তি উৎপাদক বা বণিক যতক্ষণ উৎপাদিত বা ক্রয় করা পণ্য তার সাধারণ কাম্য মুনাফায় বিক্রি করতে পারে, ততক্ষণ সে খুশী থাকে। সে ভাবে না, ঐ পণ্য আর তার ক্রেতাদের এর পরে কী হবে? একই কথা প্রযোজ্য, ঐ একই কাজের পরিবেশগত প্রভাবের প্রতি। কিউবাতে স্পেনদেশীয় কুঠিয়ালদের কী এসে গিয়েছিল, যারা পাহাড়ের ঢালে জঙ্গল পুড়িয়ে যে ছাই পেয়েছিল তা দিয়ে এক প্রজন্মের মত ভীষণ লাভজনক কফি গাছের মতো সার পেয়েছিল, তাদের কী এসে গিয়েছিল যে এর পর ভারী ক্রান্তিয় বর্ষা জমির উপরিতল ধুয়ে নিয়েছিল, আর রেখে গিয়েছিল কেবল ন্যাড়া পাথর। যেমন সমাজের প্রেক্ষিতে, তেমনই প্রকৃতির প্রেক্ষিতে, বর্তমান উৎপাদন ব্যবস্থা প্রধানত চিন্তা করে কেবল তাৎক্ষণিক, সবচেয়ে হেতেনাতে পাওয়া যায় এমন ফলের জন্য

        আজকের জগতে মানুষের এবং সেই সঙ্গে বর্তমানে জীবিত বহু প্রজাতির বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যক হল আবহাওয়া পরিবর্তনের (Climate Change) যে সার্বিক সংকট ঘনীভূত হয়েছে, তাকে  ঠেকানো। আমরা বর্তমান প্রবন্ধের পরিপূরক, অন্যান্য কয়েকটি প্রবন্ধে সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। এই মুহুর্তে আমাদের দাবী যে যে কাজ করলে, যে যে নতুন পথ নিলে, বিপজ্জনক পরিবর্তন বন্ধ হবে, তার প্রযুক্তি ইতিমধ্যেই মানুষের করায়ত্ব। তাহলে কেন সে সব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না ? তার কারণ ধনতন্ত্র। টাকা নেই বলে নয়, সমাধান নেই বলেও নয়, আমাদের বিদ্যমান সামাজিক সম্পর্ক, সর্বাগ্রে উৎপাদন সম্পর্ক, তা চায় না বলেই পদক্ষেপগুলি নেওয়া হচ্ছে না। ১৯২৬ সালে ত্রৎস্কি লিখেছিলেনঃ

        আমার একটা সময়ের কথা মনে আছে, যখন মানুষ লিখেছিল বিমান আবিষ্কারের ফলে যুদ্ধের অবসান ঘটবে, কারণ তা গোটা জনসমষ্টিকে সামরিক কাজের আওতায় টেনে আনবে, গোটা দেশের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে, ইত্যাদি। বাস্তবে কিন্তু বাতাসের চেয়ে ভারী উড়ন্ত যান আবিষ্কার সমরবাদের ইতিহাসে এক নতুন ও নিষ্ঠুরতর অধ্যায়ের সূচনা ঘটালো।....প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের নিজস্ব যুক্তি রয়েছে – প্রকৃতিকে  জানার যুক্তি এবং তাকে মানুষের স্বার্থে ব্যবহার করার যুক্তি। কিন্তু প্রযুক্তিকে সমরবাদী বা শান্তিবাদী কোনোটাই বলা যাবে না। যে সমাজে শাসক শ্রেণী সমরবাদী, সেখানে প্রযুক্তি সমরবাদের সেবাতেই লাগে”

        ধনতন্ত্রের একমাত্র চিন্তা হল ক্রমাগত অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ভিত্তিতে মুনাফা বাড়ানো। ফলে ধনতন্ত্র মানুষকে প্রকৃতির থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। সে জমিকে ব্যক্তি মালিকানায় এনেছে, সমস্ত কিছুকে পণ্যে পরিণত করেছে। এমনকি দূষণও আজ পণ্য। যে দেশ অনগ্রসর তাই তার শিল্প দূষণ কম, তাকে দূষণ দিয়ে তার বিনিময়ে ডলার- ইউরো দিচ্ছে পুঁজিবাদ। মানুষকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার এই প্রক্রিয়াকে সনাক্ত করে মার্ক্স লিখেছিলেনঃ

        খামারের মালিক, শিল্পপতি ও ক্ষেতমজুর, কেউ যে জমিকে ব্যবহার করে তার সঙ্গে যুক্ত নয় এমন মালিক বা শ্রমিক যে ফ্যাক্টরীতে সুতিবস্ত্র বা পশম উৎপাদন করে সেই ফ্যাক্টরীরর সঙ্গে যুক্ত নয়। তারা টান অনুভব করে কেবল তাদের উৎপাদনের মূল্যের প্রতি

        এই কারণে, আমাদের গ্রহকে যদি তার বর্তমান অবস্থায়, বর্তমান প্রাণীজগতকে নিয়ে বাঁচতে হয়, তাহলে পুঁজিবাদের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব অনিবার্য। ধনতন্ত্র যেহেতু ক্রমাগত বাড়তে চায়, তাই তার ক্রমাগত বেশী শক্তি দরকার, দরকার অজস্র কাঁচামালের। পুঁজিবাদীরা যদিও দাবী করে, তারা অধিক দক্ষ ভাবে কাঁচামাল ব্যবহার করছে, তবু বর্জ্য পদার্থ বেড়েই চলেছে। শিল্পোন্নত দেশগুলির অর্থনীতি সম্পর্কে ২০০০ সালে পাঁচটি বড় গবেষণা কেন্দ্রের গবেষমা থেকে দেখা যাচ্ছে, সম্পদ ব্যবহার বাড়ছে, কমছে না, এবং অর্থনীতিতে বার্ষিক যত সম্পদ প্রবেশ করছে তার অর্ধেক থেকে তিন চতুর্থাংশ এক বছরের মধ্যে বর্জ্য পদার্থ হিসেবে পরিবেশে ফিরে আসছে

        ধনতন্ত্র মানুষ ও পৃথিবী উভয়কেই শোষণ করে, উভয়ের স্বার্থকেই জলাঞ্জলি দেয় মুনাফার লোভে। ধনতন্ত্র এমন এক সর্বগ্রাসী ব্যবস্থা, যে এই ব্যবস্থার উচ্ছেদ না করলে ব্যক্তিগতভাবে একজন যতই পরিবেশবন্ধু হতে চান না কেন, তাঁকে পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতেই হবে। গান্ধী চেয়েছিলেন, এবং মদৎ দিয়েছিলেন, নেচারোপ্যাথিকে মানুষের দেহ, প্রকৃতির সঙ্গে তার সম্পর্ক, পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে দেহের উপযোগী খাদ্য সরবরাহ, চিকিৎসা, ইত্যাদি তারা মূল কথা। বাস্তবে কী হয় ?  পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নেচারোপ্যাথি পরিণত হয় একরকম বাণিজ্যে। আর তার সঙ্গে যুক্ত হয় পুঁজিবাদের অন্যান্য অঙ্গ। তাই প্রবল অনিয়ম অত্যধিক মদ্যপান, বিপুল পরিমাণ মাংস ভক্ষণ, সাপ্তাহিক “পাটি-র পর দেহ যখন টক্সিনে (বিষাক্ত পদার্থ) পরিপূর্ণ হয়ে যায়, তখন “ডি-টক্সিফিকেশন (বিষ তাড়ানো)-এর জন্য বহু মানুষ বিপুল অর্থব্যয় করে কোলোন হাইড্রোথেরাপী, নিয়মিত জীবন যাপন, নিরামিষ ও কম তেলের রান্না খাওয়া, ব্যায়াম করা, এ সবের জন্য ভারেতের বিভিন্ন স্থানে নেচারোপ্যাথি কেন্দ্রে জান এবং হাজার হাজার টাকা ব্যয় করেন।

        উপরের উদাহরণ গান্ধীবাদের  “ব্যর্থতা” প্রমাণের জন্য দেওয়া হয় নি। আমাদের বক্তব্য ধনতন্ত্র যে বিচ্ছিন্নতা ঘটায় এবং যে মুনাফা সর্বস্ব দর্শনকে প্রাধান্য দেয়, তার ফলে যে কোনো সমাধানই অসম্পূর্ণ, যতক্ষণ ধনতন্ত্র অক্ষত থাকছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে ধনতন্ত্রকে উচ্ছেদ করা পর্যন্ত পরিবেশের দিকে আমরা তাকাবো না।

        ক্যাপিটাল, ১ম খন্ডে পুঁজিবাদ যে বিচ্ছিন্নতা ঘটায় সে বিষয়ে মার্ক্স আলোচনা করেছেনঃ

        ধনতান্ত্রিক উৎপাদন.... মানুষ ও পৃথিবীর মধ্যে Metabolic আদান-প্রদানে ব্যাঘাত ঘটায়; অর্থাৎ, মানুষ খাদ্য বস্ত্ররূপে জমির যে সব উপাদান গ্রহণ করেছে, সেগুলিকে জমিতে ফিরে যাওয়ার পথে বাধা দেয়। তার ফলে ধনতন্ত্র জমির ধারাবাহিক উর্বরতা রক্ষার শর্তাবলীকে লঙ্ঘন করে....। শ্রম প্রক্রিয়াসমূহের সামাজিক সংযোগ ও সংগঠন পর্যবসিত হয় শ্রমিকের ব্যক্তিগত প্রাণশক্তি মুক্তি ও স্বাধীনতাকে চুরমার করে দেওয়ার এক সংগঠিত পদ্ধতিতে ....উপরন্তু ধনতান্ত্রিক কৃষিতে সব প্রগতিই হল একাধারে শ্রমিক এবং জমি, উভয়কেই লুন্ঠন করে এমন এক বিদ্যার প্রগতিএকটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জমির উর্বরতাবৃদ্ধিতে যত প্রগতি, তা হল দীর্ঘমেয়াদী ভাবে ঐ উর্বরতা বিনষ্ট করার উৎসের দিকেো প্রগতি। একটি দেশ যত তার বিকাশের সূচনা করবে আধুনিক শিল্পের ভিত্তিতে যেমন করেছে, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মার্কিন পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রযুক্তির বিকাশ ঘটায়.... কেবল সব সম্পদের মূল উৎস, অর্থাৎ জমি ও শ্রমিক, তাদের শুষে নিয়ে

        এ থেকে বোঝা যায়, মার্ক্স-এঙ্গেলস উৎপাদন সর্বস্ব দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করেন নি। মানুষ ও প্রকৃতির পাস্পরিক সম্পর্কের বিষয়ে মার্ক্স উক্তি করেছিলেন যে প্রকৃতি যেখানে মানব দেহ নয়, সেখানে প্রকৃতি মানুষের অজৈব দেহ। মানুষ প্রকৃতির দ্বারাই জীবনধারণ করে, এবং প্রকৃতির সঙ্গে ধারাবাহিক কথোপকথন তাকে চালাতেই হবে। “মানুষের শারীরিক ও মানসিক জীবন প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত, এ কথা বলার অর্থ কেবল, প্রকৃতি নিজের সঙ্গে যুক্ত, কারণ মানুষ প্রকৃতির একটি অঙ্গ।১০

        মানবদেহ পরিবেশের উপর প্রভাব ফেলে। একই সঙ্গে পরিবেশও মানবদেহের উপর প্রভাব ফেলে। এই পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে উভয়েরই পরিবর্তন ঘটে। এই দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী, পরিবেশ নিস্ক্রিয় না। যে কোনো জীবিত প্রাণী, যাদের মধ্যে মানুষও পড়ে, মানুষের সামাজিক ক্রিয়াও পড়ে, তারা সকলে সকলের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ততারা ধারাবাহিকভাবে এতে অপরের সঙ্গে আদান-প্রদান ঘটায় এবং একে অপরকে রূপান্তরিত করে। আমরা যখন বলি, ‘ক’ প্রজাতি অমুক পরিবেশগত স্থান দখল করেছে (has occupied বা is occupying an environmental niche) তখন একটা ধারণা তৈরী হয়, যেন ঐ স্থান বা niche-টি এমনিই তৈরী ছিল, আর ঐ প্রাণীটি পথ চলতে চলতে সেটি দেখতে পেয়ে আনন্দের সঙ্গে নিজেকে সেখানে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। বস্তুত, প্রাণীদের সঙ্গে সম্পর্ককে প্রথম থেকে মাথায় না রাখলে “পরিবেশ কথাটাই অর্থহীন। মার্ক্স-এঙ্গেলসের যৌবনের যুগ্ম রচনা দ্য জার্মান আইডিওলজি ব্যাখ্যা করেছিল, ধনতান্ত্রিক সমাজে মানুষের ক্রিয়া কেন যেকোনো প্রাণীকে তাদের পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রবণতা দেখায়

        “মাছের নির্যাস হল তার অস্তিত্ব, জল...। মিঠেপানির মাছের নির্যাস হল নদীর জল। কিন্তু ঐ পদার্থটি মাছের নির্যাস হওয়া বন্ধ হয়, অতএব তার অস্তিত্বের উপযোগী মাদ্যমে থাকে না, সেই নদীকে সিল্পের সেবায় লাগানো হয়, যেই কৃত্রিম রং এবং অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ তাকে দূষিত করে, বাষ্পীয়গোচরে যখন তার উপর দিয়ে চলে, বা যখনই তার জলকে খালে সরিয়ে দেওয়া হয়, যেখানে নিছক সেচের দ্বারা মাছকে তার অস্তিত্বের মাধ্যম থেকে বঞ্চিত করা যায়।১১

        আবহাওয়া, এবং সাধারণভাবে পৃথিবীর ইকোসিস্টেম, গতিশীল ও জটিল। বহু উপাদানের পাস্পরিক ঘাত-প্রতিঘাতের সমষ্টি হিসেবেই তাকে দেখা দরকার। প্রতিটি পরিবর্তন সব উপাদানের উপর নতুন করে প্রভাব ফেলে। এর ফলে দুটো তত্ত্বগত ধারণার উল্লেখ করা যায়। একটা হল এমন একটা মূহুর্ত আসা, যখন মৌলিক রূপান্তর ঘটে (tipping point)অন্যটা হল গোটা সিস্টেমকে একত্রে দেখার চাহিদা। এই দুই ধারণাই কিন্তু মার্ক্সীয় দর্শনেরও কেন্দ্রীয় বিষয়ের মধ্যে পড়ে। সমাজ পরিবর্তন এবং আবহাওয়া পরিবর্তন, দুই ক্ষেত্রেই, অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে গোটা ব্যবস্থাটার উপর জোর ধাক্কা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। মানব সমাজ ও আবহাওয়া ব্যবস্থা, দুটো ক্ষেত্রেই অনেক সময়ে কোনো বাহ্য প্রতিক্রিয়া ছাড়াই চাপ জমতে থাকে। তারপর হঠাৎ যেন শূন্য থেকে দ্রুত ও তীব্র পরিবর্তন ফেটে বেরোয়। বাস্তবে কিন্তু তা শূন্য থেকে ঘটে না। ছোটো ছোটো, আপাতঃভাবে নগণ্য পরিবর্তন, যা এক দীর্ঘ সময় ধরে ঘটেছিল, তা অবশেষে ব্যাপক রূপান্তর ঘটায়। এ কথা আবহাওযা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সত্য। এ কথা সত্য বৈপ্লবিক সামাজিক রূপান্তরের ক্ষেত্রেওদুইক্ষেত্রেই, পরিমাঙত পরিবর্তন গুণগত পরিবর্তনের জন্ম দেয়। বিজ্ঞানীদের মধ্যে গভীর চিন্তা যে গোটা পৃথিবীর আবহাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা এই রকম এর রূপান্তরের খুব কাছে দাঁড়িয়ে। সমস্য হল, সামাজিক ক্ষেত্রে যেমন কোনো রূপান্তর কাছে নেই, যাতে পৃথিবীজোড়া বিপর্যয়কে রোখা যায়।

মার্ক্স-এঙ্গেলসের পরবর্তীকালের সমাজতন্ত্র

         

          স্তালিনবাদী প্রতিবিপ্লবের সাফল্য এখানে, যে  তাকেই সমাজতন্ত্র বলে মেনে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রাক-স্তালিনবাদী ও অ-স্তালিনবাদী, এবং স্তালিনবাদ বিরোধী সমাজতন্ত্র পরিবেশ সম্পর্কে অনেক সচেতন ছিল।

        মার্ক্সবাদ কোনো ধর্ম নয়, তাই কোনো আদি গ্রন্থে তার নির্যাস বন্ধ থাকে না। একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও কর্মপদ্ধতি হিসেবে তার পরিবর্তন হয়। নতুন পরিস্থিতি থেকে, নতুন জ্ঞানের ভিত্তিতে,  তার বিবর্তন ঘটে। তাই পরিবেশ চিন্তার ক্ষেত্রে আরো বিভিন্ন মার্ক্সবাদী ও অন্যান্য সমাজতন্ত্রীর অবদান পর্যালোচনা করা দরকার।

        ১৯২০-র দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে এক বিশিষ্ট সমাজতান্ত্রিক পরিবেশবাদী সক্রিয় ছিলেন। তিনি হলেন ভ্লাদিমির ভার্নাদস্কিবলশেভিক সরকারের সমর্থক এক অগ্রগণ্য বিজ্ঞানী ভার্নাদস্কি ১৯২২ সালের এক বক্তৃতায় পরমাণু শক্তির অপব্যবহারের বিপদ সম্পর্কে শ্রোতাদের সচেতন করেন। ১৯২৬ সালে তিনি প্রকাশ করেন তাঁর গ্রন্থ দ্য বায়োস্ফিয়ার।

        প্রায় যেন মার্ক্সের অনুসরণে ভার্নাদস্কি পৃথিবী গঠনে সব রকম জৈব ও অজৈব পদার্থের যোগাযোগের কথা লেখেন। তিনি বলেন, জীবন এইভাবে ক্রমাগত আমাদের গ্রহের উপরিতলে রাসায়নিক জাড্যের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছেতা প্রকৃতির বর্ণ ও রূপ সৃষ্টি করে, পশু ও গাছ-গাছড়ার সংযোগ ঘটায়, সভ্য মানুষের সৃজনশীল শ্রম সৃষ্টি করে, এবং ভূত্বকের বিবিধ রাসায়নিক প্রক্রিয়ার অঙ্গে পরিণত হয়ভূত্বকের এমন কোনো বড় রাসায়নিক ভারসাম্য নেই, যার উপর জীবনের প্রভাব দৃশ্যমান নয়, এবং যেখানে রসায়ন জীবনের কাজ দেখায় না। সুতরাং জীবন ভূত্বকের একটি বাহ্য বা আকস্মিক ঘটনা নয়.... সব জীবিত পদার্থকে বায়োস্ফিয়ারের কার্যপ্রণালীর একটি অখন্ড অস্তিত্ব মনে করা যায়১৪

        সুতরাং ভার্নাদস্কির চোখে বায়োস্ফিয়ার হল বৃহত্তম ‘সিস্টেম’, যার মধ্যে পড়ে সব জীবিত ও প্রাণহীন পদার্থ। মানবসমাজ তার একটি উপ-সিস্টেম। অর্থনীতি মানব সমাজের একটি অঙ্গমাত্র, যদিও সমাজ বিবর্তনে অত্যন্ত কেন্দ্রীয় অঙ্গ। বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদদের কাছে ঘটনাটা ঠিক উল্টো। অর্থনীতিই তাদের চোখে সিস্টেম। মানব সমাজ আর পরিবেশের যেটুকু দেখার তাদের প্রয়োজন আছে, তারা সবাই তার অধীন। এই উল্টোদিক থেকে দেখার ভিত্তিতে, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে ধারণার জন্ম হয় তা হল, অর্থনীতি সীমাহীনভাবে বেড়ে চলতে পারে, এবং ধনতন্ত্রের সম্প্রসারণের কোনো সীমা নেই। এই দাবী যে মহাবিশ্বের পদার্থবিদ্যা ও জীববিদ্যা সংক্রান্ত নিয়মাবলীর বিরোধী, তা স্বীকার করা হয় না। বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির যে ব্যাখ্যা দেন, তাকে মনে হয়, ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রায় উনবিংশ শতাব্দীতে অবাস্তব বলে প্রমাণিত চিরন্তন গতি যান (perpetual motion machine)-এর নতুন সংস্করণতাপগতিবিদ্যার প্রথম ও দ্বিতীয় সূত্র মহাবিশ্বের মৌলিক সূত্র। অথচ, অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের ব্যবহার করলেও অর্থনীতির ক্ষেত্রে তাদের কার্যত অস্বীকার করা হয়। সে কারণে কল্পনা করতে হয় যে অর্থনীতি প্রকৃতি থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন।

        মার্ক্সবাদী ঐতিহ্য ছিল ভিন্ন। তত্ত্ব ও প্রয়োগ, উভয় ক্ষেত্রেই সোভিয়েত ইউনিয়ন লেনিন, বুখারিন, লুনাচারস্কিদের দৃষ্টিভঙ্গী ছিল পরিবেশের প্রতি ইতিবাচক। ভার্নাদস্কি ছাড়াও ভাভিলভ, হেসেন ও অন্যান্য বিজ্ঞানীরা পরিবেশ নিয়ে চিন্তা করেছিলেন।

        ভাভিলভ ছিলেন লেনিন কৃষি আকাদেমির প্রথম সভাপতি। গাছ, তৃণজ প্রাণ, এদের জিন-এর প্রভেদ সম্পর্কে তিনিই প্রথম বস্তুবাদী বিশ্লেষণ করেন। ভাভিলভ বলেন, মানব সংস্কৃতি সাতটি প্রধান কেন্দ্রে গড়ে উঠেছিল। সেগুলি ছিল জেনেটিক বৈচিত্র্যের কেন্দ্র। সমস্ত প্রধান শস্য ঐ কেন্দ্রগুলি থেকে উদ্ভূত। ভাভিলভের গবেষণার বহু দশক পর পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীরা বারে বারে ঐ সব কেন্দ্রগুলিতে (মেক্সিকো, পেরু, ইথিওপিয়া, তুরস্ক, তিব্বত, ইত্যাদি) গেছেন ও তথ্য সংগ্রহ করে উন্নত পুঁজিবাদী দেশের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানদের মুনাফা বাড়ানোর কাজ করেনআজ সাম্রাজ্যবাদ ও অনুন্নত দেশগুলির মধ্যে লড়াইয়ের অন্যতম বিষয়বস্তু হল ঐ সব এলাকার জিন ব্যাঙ্ক, যা সাম্রাজ্যবাদী কৃষি-বাণিজ্য সংস্থাগুলি দখল করতে চায়, ও তাদের উপর পেটেন্ট নিতে চায়।

        বুখারিন-ঘনিষ্ঠ দুই বিজ্ঞানী ডি.এল. কোমারোভ এবং বোরিস হেসেন সম্পর্কে সংক্ষেপে কথা বলা যায়। কোমারোভ এঙ্গলসের অনুসরণ করে বলেন, ব্যক্তি মালিকানা যেহেতু নিছক লাভ চায়, তাই তার কাজ কৃষিকে ধ্বংস করা। বোরিস হেসেন বিজ্ঞানের ইতিহাস চর্চা প্রসঙ্গে দেখালেন যে বুর্জোয়া বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও দর্শন যান্ত্রিক বস্তুবাদ এবং ভাববাদের মধ্যে  আবর্তিত হতে থাকে।১৫

        স্তালিনবাদের উত্থানের আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিবেশবাদী তত্ত্বের প্রয়োগে পৃথিবীর সবচেয়ে অগ্রণী দেশ ছিল। বিপ্লবী সোভিয়েত রাষ্ট্রই প্রথম পরিবেশবিদদের পরামর্শ শুনে অনেকটা করে জমি নিয়ে ঝাপোভেদনিকি বা প্রাকৃতিক এলাকা প্রতিষ্ঠা করে। এই অঞ্চলগুলিতে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছাড়া অন্য কোনো রকম মানব হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ ছিল। গাছ কাটা, শিকার, চাষ, বা ভ্রমণ, সবই নিষিদ্ধ ছিল।

        অক্টোবর বিপ্লবের পরেই যে যে  মৌলিক আইন প্রণীত হয়, তার মধ্যে অন্যতম ছিল জমি বিষয়ক আইন। এই আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি ব্যক্তিগতভাবে জমির পূর্ণ মালিকানা পেতে পারত না। তা সত্ত্বেও, দেখা গেল, বনাঞ্চলে বেআইনী গাছ কাটা, শিকার, ইত্যাদি চলছে। ১৯১৮-র মে মাসে লেনিনের উপস্থিতিতে প্রণীত হল বনাঞ্চল বিষয়ক ডিক্রী। ১৯২৩-এ গৃহীত হয় ফরেস্ট কোড

        ১৯১৯ সালে, গৃহযুদ্ধে যখন বলশেভিকদের পরিস্থিতি সবচেয়ে সঙ্গীন, যখন লাল ফৌজ পেত্রোগ্রাদকে বাঁচাবার লড়াই লড়ছে, তখনও বলশেভিকরা পরিবেশ বিষয়ক চিন্তা ত্যাগ করেন নি। ঐ অবস্থাতেও লেনিন কৃষিবিশারদ এন.এন. পোদিয়াপোলস্কির সঙ্গে ঝাপোভেদনিক প্রতিষ্ঠা নিয়ে আলোচনা করেন এবং পোদিয়াপোলস্কিকে দায়িত্ব দেন, আইনের খসড়া রচনা করার১৬

        লালফৌজ শ্বেতরক্ষীদের পরাস্ত করার পর ১৯২১ সালে নতুন আইন প্রণীত হয়। ১৯২৪ সালে গঠিত হয় সারা রাশিয়া সংরক্ষণ সমিতি। এই সংগঠনের পত্রিকা ওখরানা প্রিরোদিতে পরিবেশ বিষয়ক তত্ত্বগত প্রবন্ধ, সংবাদ, ইত্যাদি প্রকাশ করা হত। ১৯২৪ থেকে রাশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে ইকলজির আনুষ্ঠানিক চর্চা শুরু হয়।

        ১৯২০-র দশকের শেষ দিক থেকে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে থাকে। প্রকৃতিকে রক্ষা করার দাবীকে বুর্জোয়া আখ্যা দেওয়া হয়। ঘোড়দৌড় চালিয়ে যে কোনো মূল্যে পাশ্চাত্যের ধনতান্ত্রিক দেশগুলির চেয়ে উন্নত অর্থনীতি তৈরী করে এক দেশে সমাজতন্ত্র গঠন সম্পূর্ণ করার অবাস্তব স্লোগানের ফল হল অর্থনীতি, পরিবেশ, সব কিছুতে বিকৃতি আনা। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার নামে যে আমলাতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু হল, তাতে সব প্রাণীদের অন্য চোখে দেখা হল। যেগুলি দ্রুত সমাজতন্ত্র নির্মাণের জন্য উপযোগী, তারা ভাল, বাকিদের নির্মূল করা সম্ভব।

        আমরা দেখেছি, লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। এবার দেখা যাক স্বৈরতন্ত্রী নেতার সম্বন্ধে ম্যাক্সিম গোর্কীর স্তুতি।

        স্তালিন একটি পেনসিল ধরে আছেন। তাঁর সামনে রয়েছে এলাকাটির মানচিত্র। জনবর্জিত উপকূল। দূরবর্তী গ্রাম। পাথরে ঢাকা কুমারী মাটি। আদিম অরণ্য। বস্তুত, বড় বেশী অরণ্য; তা সেরা জমিকে ঢেকে রেখেছে। আর জলাভূমি। জলাভূমি সর্বদা ঝিলমিল করছে, জীবনকে করে তুলেছে ভোঁতা, অপরিচ্ছন্ন। কর্ষিত জমি বাড়াতে হবে। জলাভূমি সেচ করতে হবে......। কারেলিয় সাধারণতন্ত্র শ্রেণীহীন সমাজের স্তরে প্রবেশ করতে চায় ফ্যাক্টরী ও মিলদের প্রজাতন্ত্র হিসেবে। এবং কারেলিয় সাধারণতন্ত্র শ্রেণীহীন সমাজে প্রবেশ করবে নিজের চরিত্র পাল্টে১৭

        স্তালিন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের পরোয়া করলেন না, যদি না তা মতাদর্শগতভাবে পার্টির শাসনকে ন্যায্যতা অর্পন করত, বা পাশ্চাত্যের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার তত্ত্বকে সঠিক বলে প্রমাণ করত। ফলে কোনো বিজ্ঞানীর বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ আনা হত যে তিনি বিজ্ঞানের জন্য বিজ্ঞান অনুশীলন করছেন, তার অর্থ হত, তিনি বুর্জোয়া, প্রতিবিপ্লবী, এবং বিধ্বংসী। তেমন ব্যক্তির জন্য জুটত বিচার, গুলাগ, মৃত্যুদন্ড।১৮ পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, পরিবেশবিদ্যা, প্রতিটি বিজ্ঞানের স্বাধীনতার দাবীকে কড়া হাতে দমন করা হয়। পরিবেশবিদ্যার ক্ষেত্রে, এর ফল হল শুধু নির্দিষ্ট কিছু বিজ্ঞানীর কারাদন্ড, নির্বাসন বা মৃত্যু নয়, গোটা সরকারী দপ্তরদের রেচন বা নিছক অবলুপ্তি। যেমন, ইউক্রেনে ১৯৩০-এর দশকে প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক সমস্ত সরকারী ও বেসরকারী (পেশাদার, স্বেচ্ছামূলক) সমিতিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। উন্নয়ন”--এর চেয়ে পরিবেশকে গুরুত্ব দেওয়ায় অনেককে জাতীয়তাবাদী, প্রতিবিপ্লবীদের মিত্র‌ প্রভৃতি আখ্যা দেওয়া হয়। প্রধান সংরক্ষণবাদী কমিটির এক-তৃতীয়াংশের বেশী সদস্যকে হত্যা করা হয়।

 

রাশিয়ার বাইরে মার্ক্সবাদ, স্তালিনবাদ ও পরিবেশ ভাবনা

         

          মার্ক্স এবং এঙ্গেলসের পরবর্তী মার্ক্সবাদের দার্শনিক অবস্থান সবসময় প্রতিষ্ঠাতাদের গভীরতা অর্জন করতে পারে নি। এঙ্গেলস তাঁর শেষ জীবনে মার্ক্সের ডক্টরাল থিসিসের সঙ্গে আধুনিক দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের নিবিড় সম্পর্কের উপর জোর দিয়েছিলেন। রুশ বিপ্লবী অ্যালেক্সেই ভোডেন প্লেখানভের প্রতিনিধি হিসেবে এঙ্গেলসের কাছে গেলে এঙ্গেলস তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে অষ্টাদশ শতাব্দীর যান্ত্রিক বস্তুবাদীদের চেয়ে গ্রীক দার্শনিক এপিকুরাস অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ভোডেনের স্মৃতিচারণ থেকে বোঝা যায়, প্লেখানভ এঙ্গেলসের সঙ্গে একমত ছিলেন না। প্লেখানভ, কাউটস্কি প্রমুখের দর্শনে পজিটিভিজমের প্রভাব যথেষ্ট ছিল। এর প্রতিক্রিয়াতে ১৯২০-র দশকে লুকাচ, কর্শ ও গ্রামসি, এবং পরে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল, পজিটিভিজমকে ঠেকাতে গেলেন জ্ঞানতত্ত্বের ভিত্তিতে, যা ভাববাদী তত্ত্বগত অনুশীলনে জড়িয়ে পড়ল। এটা দেখা যায় এঁদের অনুগামী পাশ্চাত্য মার্ক্সবাদীরা এঙ্গেলস-এর যে  সমালোচনা করেছেন তা থেকে। তাঁরা দাবী করেছেন যে এঙ্গেলসের বস্তুবাদ ছিল যান্ত্রিক, আবার তিনি নাকি হেগেল থেকে উদ্ভূত এক ভাববাদী প্রকৃতি-দর্শন মার্ক্সবাদের উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন। এ ধরণের সমালোচনা কার্যত বিজ্ঞানতত্ত্ব ও বস্তুজগৎ যে মার্ক্সীয় বিশ্ববীক্ষার অঙ্গ হতে পারে তাকেই অস্বীকার করে।

        পাশ্চাত্য মার্ক্সবাদে কেউ বিজ্ঞানকে গুরুত্ব দেন নি, তা নয়। ১৯৩০-এর দশকে, স্তালিনবাদের উত্থান এবং কমিউনিস্ট পার্টির উপর তার সর্বময় কর্তৃত্ব সত্ত্বেও কিছু কমিউনিস্ট ঘেঁষা বিজ্ঞানী উল্লেখযোগ্য কাজ করেন। ১৯৩১ সালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাসের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বুখারিন, ভাভিলভ ও হেসে্নের উপস্থাপনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জন বার্নাল এবং জোসেফ নীডহ্যাম বিজ্ঞানের ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক ও বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করেন। জন বানার্ড স্যান্ডারসন হ্যালডেন সোভিয়েত জীবরসায়নবিদ ওপারিনের সঙ্গে সমান্তরাল (কিন্তু স্বাধীনভাবে) প্রাণহীন জগতে প্রাণের উদ্ভবের প্রথম প্রকৃত বস্তুবাদী ব্যাখ্যা করেন। আজ এই তত্ত্ব ওপারিন-হ্যালডেন তত্ত্ব নামে খ্যাত।

        কিন্ত পাশ্চাত্যের মার্ক্সবাদে সে যুগের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চিন্তাবিদের অবদান বিস্মৃতপ্রায়এই চিন্তাবিদ এক তরুণ, ক্রিস্টোফার সেন্ট জন স্প্রিগ, যিনি তাঁর ছদ্মনামেই বেশী পরিচিত -- ক্রিস্টোফার কডওয়েল। ১৯৩৭ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধে ফ্যাসীবাদীদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে তিনি শহীদের মৃত্যু বরণ করেন। এর আগে, মাত্র দুবছরের (১৯৩৫-১৯৩৬) মধ্যে, তিনি রচনা করেন ইলিউশন অ্যান্ড রিয়্যালিটি, স্টাডিজ অ্যান্ড ফার্দার স্টাডিজ ইন আ ডাইং কালচার, দ্য ক্রাইসিস ইন ফিজিক্স, রোম্যান্স অ্যান্ড রিয়্যাকশন, এবং হেরেডিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট। সবই প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পরে। স্তালিনবাদী প্রভাব তাঁকে কোথাও স্পর্শ করে নি, এমন কথা বলা যায় না। কিন্তু কডওয়েল একটি মৌলিক সত্য বুঝেছিলেন। স্টাডিজ অ্যান্ড ফার্দার স্টাডিজ এর মুখবন্ধে তিনি উক্তি করেছিলেন, হয় শয়তান স্বয়ং মহা শক্তি ধারণ করে আমাদের মধ্যে নেমে এসেছে, নচেৎ অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও শিল্পের মধ্যে সাধারণ এক রোগের কোনো কার্যকারণ ভিত্তিক ব্যাখ্যা রয়েছে।১৯

        কডওয়েল বুর্জোয়া সমাজে সবরকম চিন্তার মধ্যে এক সাধারণ সমস্যা বা রোগ দেখেছিলেন, যা হল প্রতিটি ক্ষেত্রের আপাতঃ স্বয়ংসম্পূর্ণতার দাবীর আড়ালে প্রত্যেকটি খন্ডের বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব। প্রকৃতি ও সমাজের মধ্যে ভেদরেখা, ভাববাদ ও যান্ত্রিকতার আপাতঃ বিভেদ, ইত্যাদি তার চারিত্রিক গঠনের অঙ্গ। এই দ্বৈতবাদ, এ একপেশে যুক্তিসর্বস্বতা হল বুর্জোয়া সমাজের আত্মরক্ষার প্রয়াস, একটি মূমূর্ষূ সংস্কৃতির নিজেকে বাঁচাবার লড়াইয়ের অঙ্গ।

        এ প্রসঙ্গে কডওয়েল নিজে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হলেও, স্তালিনবাদী দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের জ্ঞানতত্ত্বকে আক্রমণ করেন। তিনি মনে করেছিলেন, মার্ক্সের বস্তুবাদ ছিল সক্রিয় ও দ্বান্দ্বিক, এবং তা যে পূর্ববর্তী যান্ত্রিক বস্তুবাদের উর্দ্ধে উঠতে পেরেছিল, তার কারণ অংশত বিবর্তনবাদী তত্ত্ব, এবং বিজ্ঞানের মধ্যে তা যে অধিকতর বস্তুবাদী ও দ্বান্দ্বিক সংহতি এনে দিয়েছিল। এই ধারণা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছিল হেরেডিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এ। কিন্তু এই রচনাটি ১৯৮৬ পর্যন্ত, অর্থাৎ অর্ধ-শতাব্দীর জন্য, অপ্রকাশিত থাকে।

        এই অসাধারণ রচনাতে কডওয়েল জীববিদ্যায় উদ্ভূত সংকটের জ্ঞানতাত্ত্বিক এবং মতাদর্শগত সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। ঐ সংকটের কারণ ছিল ডারউইনবাদী তত্ত্বের সংকট, নয়া-লামার্কবাদের উত্থান, এবং জেনোটিকসের বিকাশ কডওয়েলের বিশ্লেষণে ত্রুটি রয়েছে। কিন্তু পরবর্তী বেশ কয়েক দশকের মার্ক্সবাদী তত্ত্বের চেয়ে তা অনেক অগ্রসর ছিল। তিনি বলেন, প্রাণী ও পরিবেশের মধ্যে সম্পর্কটা যে একটা সম্পর্ক, তার অর্থ হল, এরা একে অপরকে প্রভাবিত করে এবং এরা যুক্ত থাকে বস্তুগত রূপান্তরের সঙ্গে। এই রচনায় তিনি নয়া-লামার্কবাদকে আক্রমণ করেন। তার মধ্যে ছিল ত্রোফিম লাইসেঙ্কোর নেতৃত্বে স্তালিনবাদী মেকী-জীববিদ্যার উপর সরাসরি আক্রমণএই কারণেই হেরেডিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অপ্রকাশিত থেকে যায়।

        অবশ্যই, বর্তমান প্রবন্ধে আমরা পরিবেশ রক্ষার আজকের লড়াইয়ের প্রসঙ্গসমূহে সরাসরি আসি নি। কিন্তু আমরা দেখেছি, স্তালিনবাদী প্রতিবিপ্লবের আগে, মার্ক্সবাদের মধ্যে পরিবেশ ও শ্রেণী সংগ্রামকে যুগ্মভাবে দেখা্র, এবং পরিবেশ রক্ষাকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচীগত উপাদান হিসেবে দেখার চেষ্টা ছিল। আজকের সমস্যার দিকে যখন তাকাব, তখন আমরা ঐ মার্ক্সবাদী উপকরণগুলি ব্যবহার করে বিশ্লেষণ করতে পারি

 

টীকা

                        

১. ধ্রুপদী মার্ক্সবাদের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের জন্য দেখুন Soma Marik, Reinterrogating the Classical Marxist Discourses of Revolutionary Democracy, Aakar Books, Delhi, 2006. স্তালিনবাদের উত্থান ঐ গ্রন্থে সংক্ষেপে আলোচিত হযেছে। স্তালিনবাদ কীভাবে সাম্যবাদী আন্দোলনের গণতান্ত্রিক মর্মবস্তুকে ধ্বংস করেছে সে প্রসঙ্গে দেখুন Tariq Ali (Ed), The Stalinist Legacy, Penguin, Harmondsworth, 1984.

2. স্তালিনবাদ কীভাবে পরিবেশ ও বিজ্ঞান বিরোধী ছিল, সে প্রসঙ্গে দেখুন Zhores Medvedev, Nuclear Disaster in the Urals, W.W Norton & Co., 1979; KunalChattopadhayay, ‘Class Struggle Among the Molecules ; The Rise and Fall of “Proletarian Science”, Jadavpur University Journal of History, vol xv, 1996-97, pp 35-46;  এবং কুনাল চট্টোপাধ্যায়, বিজ্ঞানের ইতিহাসের মার্ক্সবাদী চর্চা ও বোরিস হেসেন, বিভাগীয় সভাপতির ভাষণ, ভারত ব্যতীত অন্যান্য দেশ বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ, ইতিহাস অনুসন্ধান-২১, কলকাতা, ২০০৭।

৩. একদেশে সমাজতন্ত্র গড়া সম্পূর্ণ করার তত্ত্বে্র ফল, এক দেশের অর্থনীতির মধ্যে উৎপাদন সর্বস্বতা চরমে নিয়ে যাওয়া

৪. Fredrick Engels, ‘The Part Played by labour in the Transition from Age to Man’, in Marxist Internet Archive, www.marxist.org/archive/marx/works/1876/part played labour/index.htm.

৫. ঐ

৬. Leon Trotsky, Problems of Everyday life, Pathfinder Press, New York, 1973, p.317

৭. Karl Marx, The Poverty of Philosophy, New York, International Publishers, 1963, pp. 98-99.

৮. এ প্রসঙ্গে দেখুন James GustaveSpeth, The Bridge at the End of the World, New Haven, CT, Yale University Press, 2008, p.56.

৯. Karl Marx, Capital, vol 1, in www.marxists.org/archive/marx/works/1867-c1/ch15.htm.

১০. Karl Marx, ‘Economic and Philosophical Manuscripts of 1844’ http://www.marxists.org/archive/marx/works/1844/manuscripts/labour.htm.

১১. Karl Marx and Fredrick Engels, The German Ideology, http://www.marxists.org/archive/marx/works/1845/german-ideology/ch01b.htm.

১২. Fredrick Engels, ‘The Part Played by Labour….’,পূর্বোক্ত।

১৩. Karl Marx, quoted by John Bellamy Foster, ‘A Failed System’, www.amandapublishers.co.za/special-featured/global-financial-crisis/73-a-failed-system.

১৪. Vladimir Vernadsky, The Biosphere, New York, Nevranmont Publishing Company, 1998, p.57.

১৫. হেসেন প্রসঙ্গে কুণাল চট্টোপাধ্যায়ের পূর্বোল্লিখিত প্রবন্ধ ছাড়া দেখুন Gideon Freudenthal, ‘The Hessen-Grossman Thesis, An attempt at Rehabilitation’, in Perspectives on Science, Summer 2005, vol.13, no.2, pages 166-193; এবং Pablo Huerga Melcón, La ciencia en la encrucijada. Análisiscrítico de la célebreponencia de Boris Mihailovich Hessen, "Las raícessocioeconómicas de la mecánica de Newton", desdelascoordenadas del materialismofilosófico", Biblioteca Filosofía en español, Fundación Gustavo Bueno, Pentalfaediciones, Oviedo 1999.

১৬. দেখুন, Douglas Weiner, Models of Nature : Ecology, Conservation and Cultural Revolution in Soviet Russia, Pittsburgh, P.A.: University of Pittsburgh, 2000, p.27.

১৭. ঐ, পৃঃ ১৬৯।

১৮. এ প্রসঙ্গে দেখুন Michael Lowy, ‘Stalinist Ideology and Science’, in Tariq Ali (Ed), The Stalinist Legacyএবং টীকা -২-এ উল্লিখিত প্রবন্ধ।

১৯. Christopher Caudwell, Studies and Further Studies in a Dying Culture, New York, Monthly Review Press, 1971, p.xix.