সাধারণ ধর্মঘট ২০১৩
- Details
-
Published on Saturday, 25 May 2013 16:53
সাধারণ ধর্মঘট ২০১৩ – ফৌজি শক্তির চেয়েও সবল
সোমা মারিক, সুশোভন ধর, কুণাল চট্টোপাধ্যায়
১৯১৫ সালে মার্কিন বিপ্লবী ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী র্যালফ চ্যাপলিন রচনা করেছিলেন তাঁর অমর সঙ্গীত – Solidarity Forever। শ্রমিক শক্তির মধ্যে লুকিয়ে থাকা সম্ভাবনা যে বাস্তব দুর্বলতার বৈপরীত্য টেনে তিনি লিখেছিলেন –
We can break their haughty power,
gain our freedom when we learn that
The union makes us strong
ঐ গানেই তিনি বলেন -
In our hands is placed a power
greater than their hoarded gold
Greater than the might of armies
magnified a thousand fold
We can bring to birth a new world
from the ashes of the old for
The union makes us strong.১
২০-২১ ফেব্রুয়ারী ২০১৩, ভারতের সমস্ত প্রান্তে ১০ কোটির বেশী শ্রমিক ধর্মঘট করেন। নিখুঁত সংখ্যা জানা কঠিন, কিন্তু ইউনিয়ন নেতৃত্ব এবং শাসক শ্রেণী, উভয়েরই হিসেবের চেয়ে অংশগ্রহণ বেশী হয়েছিল। দুদিন ধরে, ভারতের প্রায় সমস্ত টেলিভিশন চ্যানেল, রেডিও এবং ইন্টারনেট ভর্তি ছিল অজস্র মন্তব্য ও টীকা টিপ্পনীতে, যার মর্মার্থ হল, ধর্মঘট ব্যর্থ, ধর্মঘট করা অর্থহীন, শ্রমিকরা হিংস্র, ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা সবাই স্বার্থপর, ধাপ্পাবাজ লোক, যারা বেচারা গরীব শ্রমিকদের মিথ্যে নাচাচ্ছে, ইত্যাদি। এই প্রচারের তীব্রতাই কিন্তু দেখায় এক ঘুমন্ত মহাশক্তি, ভারতের শ্রমিক শ্রেণী, স্বল্পমাত্রায় হলেও নিজের সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। সচেতনতা বাড়লে, লক্ষ্য স্থির হলে, তার শক্তি ফৌজী ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশী। কিন্তু এখনও অনেকাংশে তার পায়ে বেড়ী লাগানো। ধর্মঘটের পর্যালোচনা করতে হলে লড়াই ও সীমাবদ্ধতা, দুটোই বুঝতে হবে।
সাধারণ ধর্মঘটঃ
সাধারণ ধর্মঘট কথাটা বেশী লঘু করে ব্যবহার করলে সমস্যা থাকে। বিশেষত আজকের দিনে, কেবল ১৯০৫-এর পর লুক্সেমবুর্গ বা ট্রটস্কী কী লিখেছিলেন, বা বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইউরোপের অভিজ্ঞতা কী ছিল, তা দেখলে হয় না।
খুব সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা দেখায়, সাধারণ ধর্মঘটের ধারণার প্রথম উদ্ভব হয় নৈরাজ্যবাদী-সিন্ডিক্যালবাদীদের মধ্যে। তাঁরা মনে করেছিলেন, ঐ লড়াই হবে অন্তিম লড়াই, যখন ধনতন্ত্র ও রাষ্ট্র, উভয়েই পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়বে। এই তত্ত্বই গ্রহণ করেছিলেন আমেরিকার ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স অভ দ্য ওয়ার্ল্ড বা আই.ডব্লু.ডব্লু। চ্যাপলিন তাদেরই কর্মী ছিলেন। নৈরাজ্যবাদী-সিন্ডিক্যালবাদীদের মতে, শ্রমিকরা লক আউট করে শিল্পের নিয়ন্ত্রণ মালিকদের হাত থেকে কেড়ে নিতে পারবেন, ফলে পৃথিবীর বুক থেকে ধনতন্ত্র বিলুপ্ত হবে।
তাঁরা মনে করতেন, আধুনিক যুগে, আধুনিকভাবে নির্মিত শহরগুলিতে ও ফৌজী প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে, ব্যারিকেডের লড়াই সম্ভব নয়। কিন্তু দেশজোড়া, বা আন্তর্জাতিক ধর্মঘটের এমনই বিপুল শক্তি হবে যে সেনাবাহিনী তাকে ভাঙতে পারবে না। দ্বিতীয়ত তাঁদের মতে, আধুনিক পুঁজিবাদের বিন্যাস এমন, যে শ্রেণীর সংখ্যালঘু অংশও যদি সাধারণ ধর্মঘট শুরু করে, তারা ঠিক মতো জায়গায় সুসংহত হলে মালিকরা ধর্মঘট ভাঙতে পারবে না। কিন্তু দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মার্ক্সবাদীরা অন্যভাবে ভেবেছিলেন। তাঁরা নৈরাজ্যবাদীদের বিরোধিতা করেছিলেন, কারণ তাঁরা জানতেন, শ্রমিকশ্রেণীর সব অংশের মধ্যে শ্রেণী চেতনা একইভাবে বিকশিত হয় না। তাই উপর থেকে ডাকা সাধারণ ধর্মঘট সর্বাত্মক হবে না। কিন্তু এই নেতিবাচক বক্তব্যের পর তাঁদের নরমপন্থী অংশ ক্রমেই সংসদীয় নির্বাচনকেই লড়াইয়ের প্রধান ক্ষেত্র বলে মনে করতে থাকেন।
১৯০৫-এর বিপ্লবের ফলে রোজা লুক্সেমবুর্গ ও লিওন ট্রটস্কী সাধারণ ধর্মঘট সম্পর্কে নতুন ভাবনাচিন্তা শুরু করেন। লুক্সেমবুর্গ ব্যাখ্যা করেন, সাধারণ ধর্মঘট গড়ে ওঠে লড়াই থেকে। প্রথমে জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেসীর দক্ষিণপন্থী আমলাতন্ত্র, পরে স্তালিনবাদী আমলাতন্ত্র, ধর্মঘট সম্পর্কে লুক্সেমবুর্গের ধারণার বিকৃতিসাধন করেছিল করেছিল। বাস্তবে তিনি মনে করতেন যে সাধারণ ধর্মঘট একটি স্বয়ং-সম্পূর্ণ ঘটনা হতে পারে না। বস্তুত, সাধারণ ধর্মঘট হল শ্রেণী সংগ্রামের বিকাশের প্রমাণ। দ্বিতীয়ত, তিনি আদপে বলেন নি যে স্বতঃস্ফূর্ত সাধারণ ধর্মঘট থেকে বিপ্লব হবে। বরং, বিপ্লবী যুগ সেই সব রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিবেশের সৃষ্টি করে যার ফলে সাধারণ ধর্মঘট হয়। তিনি বলেছিলেন, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত লড়াইকে পার্টি পুরো ছক বেঁধে বা শৃঙ্খলা চাপিয়ে পরিচালন করতে পারে না। তবে তিনি মনে করেছিলেন, পার্টির কাজ অবশ্যই সেরকম লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেওয়া। তিনি লেখেন, “পার্টি কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত মারফৎ ঐতিহাসিক পরিস্থিতি ঘটানো যায় না, ... কিন্তু [পার্টির] কার্যক্রমকে প্রস্তুত করা যায়।”১
১৯০৫-এ রাশিয়াকে সাধারণ ধর্মঘটের অভিজ্ঞতা থেকে ট্রটস্কীও মনে করেছিলেন, শ্রেণী সংগ্রামের একটা স্তরে সাধারণ ধর্মঘট ক্ষমতার প্রশ্ন উত্থাপিত করবে, যদিও সাধারণ ধর্মঘট সরাসরি শ্রমিকদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেবে না।
ইউরোপে ১৯১৮-র জার্মান বিপ্লব, ১৯৩৬-এ ফ্রান্সের সাধারণ ধর্মঘট, ইত্যাদি দেখায়, শ্রেণী সংগ্রাম তীব্র হলে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দাবী একত্রে চলে আসে।
ভারতের ক্ষেত্রে, সাধারণ ধর্মঘটের ধারণাটা দুভাবে গড়ে ওঠে। গান্ধীবাদী নেতৃত্ব শ্রেণী সংগ্রামকে বর্জন করতে চাইত। তাই ভারতীয় জাতীয়তাবাদ কখনো প্রলেতারীয় লড়াইয়রে ধাঁচ গ্রহণ করেনি। তার বাছাই করা রূপ ছিল হরতাল, যেখানে দোকান, বাজার, সবই বন্ধ থাকবে। কিন্তু লড়াই থেকেই এর মধ্যেও জঙ্গী ধারা কখনো কখনো দেখা দিত, গান্ধীবাদ তখন তার বিরোধিতা করত। দ্বিতীয় যে পথে সাধারণ ধর্মঘটের ধারণা গড়ে উঠল তা হল কমিউনিস্ট আন্দোলন ও জঙ্গী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের বিকাশ। বড় বড় শিল্প ধর্মঘট থেকে সাধারণ ধর্মঘটের ধারণা গড়ে ওঠে। ১৯৪৬ সালে ধর্মঘটের ডাক ও তার কর্মীদের সমর্থন আনুষ্ঠানিক সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয় নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস – সেকালের একমাত্র সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন। এর আগেই বড় বড় ধর্মঘট হয়েছিল আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপ্টেন রশিদ আলীর বিচারকে কেন্দ্র করে এবং বোম্বাইয়ের নৌবিদ্রোহের সমর্থনে।
স্বাধীনতার পর “জাতির নেতা” হওয়ার পরিচিতি ব্যবহার করে কংগ্রেস দলের নেতৃত্ব একটা বড় সময়ের জন্য শ্রমজীবি মানুষের উপর বুর্জোয়া শ্রেণীর মতাদর্শগত আধিপত্য রাখতে পেরেছিল। ফলে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি যখন হঠকারীভাবে সাধারণ ধর্মঘট ডাকে, তখন তা পরাস্ত হয়।
ইতিমধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনেও রূপান্তর ঘটে। নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (এ.আই.টি.ইউ.সি) ক্রমে সিপিআই দলের নিয়ন্ত্রণে আসে। একের পর এক দল তার জবাবে দলীয় নিয়ন্ত্রণাধীন ইউনিয়ন গঠন করে। ফলে ভারত আজ অনেকগুলি সর্বভারতীয় ফেডারেশন আছে। এক একটি কর্মক্ষেত্রে বহু ইউনিয়নের রেষারেষি শ্রমিক ঐক্যকে দুর্বল করে।
নয়া-উদারনীতি ও শ্রেণী সংগ্রাম
নয়া-উদারনীতির আক্রমণের ফলে বহুধা-বিভক্ত শ্রমিক আন্দোলনেও পরিবর্তন আরম্ভ হয়। সংগঠিত ক্ষেত্রে প্রকৃত আয় কমতে থাকে। চাকরীর নিশ্চয়তা কমে। চুক্তিতে শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ে। ফলে শিল্প ও পরিষেবার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধর্মঘট বাড়ে। বৃহত্তর (সাধারণ) ধর্মঘটও বাড়ে। ১৯৯১ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০১২-র মধ্যে ভারতে ১৫টি সাধারণ ধর্মঘট হয়। অবশ্যই, তার অর্থ এই নয় যে দীর্ঘ ২২ বছর ধরে শ্রেণী সংগ্রাম ক্রমাগত তীব্র হয়েছে। ১৯৯১ সালে মূলতঃ বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন ও অন্যান্য গণ সংগঠনের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল জাতীয় প্রচার কমিটি। কিন্তু ভারতের বামপন্থী আন্দোলনে স্তালিনবাদী প্রাধান্যের প্রভাব এখানেও পড়ে। প্রথমত, আজ স্তালিনবাদ ক্রমেই সোশ্যাল ডেমোক্রেসীতে রূপান্তরিত হচ্ছে। ফলে শ্রেণী সংগ্রামের প্রসঙ্গে তাদের কোনো স্পষ্ট দিশা আদৌ নেই। দ্বিতীয়ত, স্তালিনবাদী রাজনীতির অন্যতম স্তম্ভ “ফ্যাসীবিরোধী যুক্তফ্রণ্টের” মুখোশ পরে শ্রেণী সমঝোতামূলক পপুলার ফ্রন্টের রাজনীতি, শ্রমিক শ্রেণীর পা বেঁধে রেখেছিল। ১৯৯২ সালে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসীবাদী সংঘ পরিবার বাবরি মসজিদ ধ্বংস করল। এর পরে এল সিদ্ধান্ত, যে ফ্যাসীবাদকে রোখার জন্য নয়া-উদারনীতি বিরোধী লড়াইয়ের তীব্রতা কমাতে হবে।২ ফলে বামপন্থী দলগুলি সংসদে নরসিংহ রাওয়ের সরকারকে “কম পাপী” মনে করে মেনে নিল। তারপর এল তথাকথিত যুক্তফ্রন্ট সরকার। সিপিআই-এতে যোগ দিল। সিপিআই(এম) এবং আর.এস.পি. বাইরে থেকে তাকে সমর্থন করল। কিন্তু এতে নয়া-উদারনীতির অগ্রগতি একটুও থামল। পি চিদাম্বরম, যিনি অতীতে নরসিংহ রাওয়ের সরকারে মন্ত্রী ছিলেন, এবং পরে আবার মনমোহন সিংহ সরকারের মন্ত্রী হবেন, তিনি অর্থমন্ত্রী হিসেবে যে বাজেট পেশ করলেন, বুর্জোয়া শ্রেণী সেই বাজেটকে “স্বপ্নের বাজেট” বলে ঘোষণা করল। তারপর এল বিজেপি নেতৃত্বাধীন এন.ডি.এ. সরকার। তারা আনল সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, গুজরাটের মারাত্মক গণহত্যা। সঙ্গে সঙ্গে সরকারী বামপন্থীরা আবার “যুক্তি” খুঁজে পেলেন, কেন ইউ.পি.এ.-১ গঠন ও কংগ্রেসকে সমর্থন করতে হবে।৩ যদিও ২০০৪-এর নির্বাচনে ভারতীয় সংসদীয় নির্বাচনের ইতিবাসে বামপন্থীরা সবোর্চ্চ সংখ্যক আসন পান, তবু, যে নীতির আপাতঃ সমর্থক হিসেবে তাঁরা ভোট পেয়েছিলেন, তার জন্য আপ্রাণ লড়াই করার বদলে, তাঁরা ঐ প্রসঙ্গগুলিকে যথাসম্ভব মোলায়েম করে দেখতে চাইলেন। পশ্চিমবঙ্গে তো বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কেন্দ্রের অনুগামী হয়ে সরকার চালাতে চাইলেন।
অন্যদিকে, অ-বাম ইউনিয়নগুলি, যথা কংগ্রেসের অনুগামী আই.এন.টি.ইউ.সি বা বিজেপি-ঘনিষ্ঠ বি.এম.এস.ও অতীতে জঙ্গী লড়াইয়ের সমর্থন করতে তৈরী ছিল না। বিজেপি মুখে “স্বদেশীর” নামে নয়া-উদারনীতির সমালোচনা করে। কিন্তু কাজে তারা সরকারে থাকলে ঐ নীতিই চালু করেছিল। ফলে সাধারণতঃ বি.এম.এস. বড় মাপের লড়াই করে নি। ২০১০-এও সাধারণ ধর্মঘটে তারা অংশ নেয় নি।
২০১২-১৩-র মধ্যে কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছিল। ১৯৯১-৯২তে বাম দলগুলি ও তাদের অনুগামী সব ট্রেড ইউনিয়ন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের আামলাতন্ত্র শাসিত শ্রমিক রাষ্ট্রগুলির পতনে ভেঙে পড়েছিল। আজ এক নতুন শ্রমিক শ্রেণী গড়ে উঠেছে -- অনেক সময়ে অসংগঠিত, কিন্তু অতীতের পরাজয়ের স্মৃতি এবং মিথ্যা মতাদর্শের ঠুলিও তাদের ভরাক্রান্ত করেনি।
শ্রমিকরা এই যে বারে বারে ধর্মঘট করেছেন, তা ভারতের বাইরেও এ ভিন্ন ছবি নিয়ে গেল। তাঁদের লড়াই দেখাল, ভারত কেবল “অর্থনৈতিক যাদু”র দেশ নয়। তাতে হল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমিক শ্রেণীরও দেশ, যে শ্রমিক শ্রেণী আজও লড়াকু।
পুরোনো ও নতুন ইউনিয়নঃ
কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি এত বড় লড়াইয়ে নামল কেন ? প্রথমত, শ্রমিক শ্রেণীর উপর ক্রমাগত চাপ ছিল। ফলে তাঁদের মধ্যেও বেতন হ্রাস, শিল্প ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান কমা, ঠিকা শ্রম প্রথার বৃদ্ধি ইত্যাদি নিয়ে আক্রোশ বেড়েছে। এই শ্রমিকদের একটা অংশই এই সব ইউনিয়নের সদস্য। ফলে তাঁরা ইউনিয়নদের কাছে কোনো না কোনো পদক্ষেপের দাবী করছিলেন। ইউনিয়ন নেতৃত্ব যত আমলাতান্ত্রিক হোক না কেন, তারা নীচে থেকে আসা এ চাপ অগ্রাহ্য করতে পারে না। অবশ্যই, প্রধান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনগুলির জাতীয় নেতৃত্বরা লড়াইকে প্রতীকী স্তরে রাখতে পারলে খুশি হতেন। কিন্তু তলা থেকে দাবী বেড়েছে, জঙ্গী লড়াই চাই, প্রয়োজনে ধর্মঘট চাই। এ কারণেই, গত বছরের এক দিনের ধর্মঘটের ৪ পর এবছর দুদিনের ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হল।
একরকম অতিবাম মত আছে, যাতে ট্রেড ইউনিয়ন আমলাতন্ত্রের ব্যবহারে কেবল বিশ্বাসঘাতকতাই ধরা পড়ে। আমরা মনে করি, ট্রেড ইউনিয়ন আমলাতন্ত্র তাদের সামাজিক অবস্থান, মালিকের কাছ থেকে ছিটে-ফোঁটা আদায়, সবই ভোগ করে শ্রমিক শ্রেণীর উপর তাদের নিয়ন্ত্রন শক্তি আছে বলেই। আর সেটা রাখতে হলে তাদের মাঝেমধ্যে লড়াই না করলে চলেনা। তাই বিশ্বায়নের পর সামাজিক সম্পর্ক পাল্টানোয় তারা গভীরভাবে বিচলিত। কোনো কোনো সময়ে তারা সংস্কারবাদী কাঠামোর মধ্যেই, বামপন্থী দলগুলির নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ২০১০ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন ট্রেড ইউনিয়নদের সমালোচনা করে বলেন, তারা বড় সহজে ধর্মঘট করে, তখন এ.আই.টি.ইউ.সি. নেতা গুরুদাস দাসগুপ্ত বলেন, “বুদ্ধদেব জন্মানোর আগে থেকে, আমি জন্মাবার আগে থেকে শ্রমিক ধর্মঘটের মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছেন।”
গত দু-দশকে ট্রেড ইউনিয়নদের সদস্য সংখ্যা বাড়ছে না, হয়ত বা কমেছে। তাদের সক্রিয়তা কমবেশী সীমাবদ্ধ ছিল সংগঠিত ক্ষেত্রে, বিশেষত রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে, যেখানে রয়েছে তাদের সদস্যদের ৯০ শতাংশের বেশী। অতীতে, বহু শিল্পে রাষ্ট্রীয় মালিকানা এবং ট্রেড ইউনিয়নদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলির নিবিড় সম্পর্কের ফলে ইউনিয়ন গঠনও সহজ ছিল, রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলিতে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়াও সহজ ছিল। কিন্তু উদারীকরণ প্রক্রিয়ার ফলে রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রকে দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে। অতএব ট্রেড ইউনিয়নদের পক্ষে দাবী আদায়ের জন্য রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবিত করার ক্ষমতাও কমে গেল। তার ফলে শ্রমিক অন্দোলন অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।
উপরন্তু, পার্টি ইউনিয়ন সন্পর্কের অনিবার্য ফল, ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যাবৃদ্ধি। প্রতিটি কর্মক্ষেত্রেই প্রায় একাধিক ইউনিয়ন তৈরী হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অতি-কেন্দ্রীভূতভাবে। সংগঠন চলে চটজলদি সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে, সেকেলে রণনীতি নিয়ে, শ্রমিকদের সঙ্গে সম্পর্কহীন এবং অত্যন্ত বয়স্ক নেতাদের উপর ভর করে। বহু ইউনিয়নে নেতৃত্ব ব্যক্তিকেন্দ্রীক, এবং নেতৃত্ব ক্ষমতার দিকে তাকানো। দ্বিতীয় স্তরের নেতৃত্ব নেই, এবং নেতৃত্ব, দাবী, কর্মসূচী কোনো স্তরেই খুব একটা লিঙ্গ সচেতনতা নেই। এ সবের ফলে ট্রেড ইউনিয়ন ও ব্যাপক শ্রমিকদের মধ্যে বড় ফারাক তৈরী হয়েছে। যদিও শ্রমিকরা আনুষ্ঠানিকভাবে ইউনিয়নের সদস্যপদ রেখেছেন, তবু আজ আর অতীতের মতো তাঁদের মধ্যে ইউনিয়নের অঙ্গ হওয়ার অনুভূতি নেই। ২০০৪-এ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO)-র একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, শিল্পসমৃদ্ধ গুজরাটে মাত্র ২০ শতাংশ উত্তরদাতা ট্রেড ইউনিয়নের সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, এবং কর্মক্ষেত্রে স্বার্থরক্ষার সেরা পন্থা কী, এই প্রশ্নের উত্তরেরর ৩৩ শতাংশ বলেন, মালিকের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ, ৭.৪ শতাংশ বেছে নেন ইউনিয়নকে, এবং ১৪.৮ শতাংশ পছন্দ করেন সরাসরি যৌথ লড়াইকে।
অতীতে রাজনৈতিক দলগুলি শ্রমিকের উপর আধিপত্য রাখার জন্য এবং নির্বাচনে ভোট পওৈয়ার জন্য ট্রেড ইউনিয়নদের উপর নির্ভর করত। কিন্তু পুঁজি সঞ্চয়ের আধুনিকতম পর্বে, পার্টিরা ইউনিয়নদের আমল দেয় না, কারণ জঙ্গী শ্রমিক আন্দোলনের অনুপস্থিতিতে, তারা নখদন্তহীন। শাসক কংগ্রেস দলের ট্রেড ইউনিয়ন আই.এন.টি.ইউ.সি.-র সভাপতি জি. সঞ্জীব রেড্ডি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য, অথচ পার্টির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিশার ক্ষেত্রে তাঁর কোনো জোর নেই। এরকম আরেকটি ঘটনা হল, ২০০৬ সালে বিমানবন্দর বেসরকারীকরণের জন্য চারদিনব্যাপী ধর্মঘট ও সর্বাত্মক সংগ্রামের সময়ে, সিটু তথা সিপিআই(এম) নেতা এম. কে. পান্ধে আন্দোলনকে সমর্থন করেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করেন। অথচ সিপিআই(এম) নেতা ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শিল্পপতিদের এক সভায় গিয়ে কলকাতা বিমানবন্দর বন্ধ করার ক্ষেত্রে তাঁর পার্টির শ্রমিক সদস্যদের ভূমিকার জন্য মার্জনা ভিক্ষা করেন। এবারেও , বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সাধারণ ধর্মঘটের বিরোধিতা করেন। আর পশ্চিমবঙ্গে বুর্জোয়া চাপে নতি স্বীকার করে সিপিআই(এম) । মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের নামে তারা সিটুর থেকে দলকে বিচ্ছিন্ন করে।৫
বছরের পর বছর মূলস্রোতের বামপন্থী দলগুলি শ্রমিক শ্রেণীর স্বাধীন লড়াই গড়ে তোলার বদলে আঞ্চলিক ক্ষমতাকেন্দ্র গড়া, পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি, এবং তার ভিত্তিতে স্থানীয় ছোটো পুঁজিপতি থেকে বেকার তরণ – এদের নিয়ে বামফ্রণ্ট এক অন্যরকম গণভিত্তি তৈরী করার দিকে ঝুঁকেছে। বছরের পর বছর, দশকের পর দশক, তারা পুঁজিবাদী ব্যস্থার মধ্যে কাজ করে চলেছে। ফলে শ্রমিকদের উপর আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার কোনো বিকল্প তাদের সামনে থাকে না। ১৯৫০-এর বা ১৯৬০-এর দশকে, পার্টি নেতৃত্বে ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল। বর্তমানে, ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা খুব কম সময়েই প্রভাবশালী পার্টি নেতা।
১৯৮০-র দশকের মধ্যভাগে থেকে, সংগঠিত শ্রমিকরা শাসক শ্রেণীর মতাদর্শকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন নি। বহু ইউনিয়ন থাকায় আন্তঃ-ইউনিয়ন দ্বন্দ্ব বেড়েছে। সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর জন্য নেতাদের মধ্যে অনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়েছে। অবশেষে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইউনিয়নরা বোঝে, সদস্যরা যে ইউনিয়নের প্রতি প্রকৃতই অনুগত, তার উদ্যোগে স্বাধীন, শক্তিশালী আন্দোলন গড়লেই কেবল মালিক ও সরকারের মোকাবিলা করা যাবে। যেহেতু মনে হচ্ছিল যে জাতীয় ইউনিয়ন বা ইউনিয়ন ফেডারেশনরা বিভিন্ন দলের পিছনে হাঁটছিল, তাই “স্বাধীন” ইউনিয়ন যারা গড়ে উঠল তাদের অনেকে এক সময়ে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার নামে রাজনীতি ছেড়ে দেয়। কিন্তু আরেক ধরণের ইউনিয়নও তৈরী হয়, যেগুলি কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত নয়, কিন্তু জঙ্গী। ফ্যাক্টরী স্তরে এমন ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গে কানোরিয়া ও ভিক্টোরিয়া জুট মিলে, মহারাষ্ট্রের কামানি টিউবস-এ, কেরালায় মাদুরা কোটস-এ এবং মানেসরে মারুতি ফ্যাক্টরীতে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বাধীন ইউনিয়নরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও লড়াই করেছে। সিমেন্স, ব্রুক বন্ড, ফাইজার, ইত্যাদি বহুজাতিক কোম্পানীদের ক্ষেত্রেও স্বাধীন ইউনিয়ন রয়েছে।
এই পথে, দেখা গেছে কিছু কিছু স্বাধীন ইউনিয়ন শ্রমিকদের কাছে বেশী গ্রহণযোগ্য। নিউ ট্রেড ইউনিয়ন ইনিশিয়েটিভ (NTUI) নামে যে স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ গড়ে উঠেছে, বর্তমানে তার সদস্য সংখ্যা ১১ লক্ষের বেশী। শ্রমিক শ্রেণীর অনৈক্য কত ক্ষতিকর, তা বুঝে একদল জঙ্গী ও সমাজ সচেতন শ্রমিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন এমন এক সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন গড়তে, যা শ্রেণী সংগ্রামের পথ ধরবে কিন্তু যার কোনো দলীয় আনুগত্য থাকবে না। তাঁরা শ্রমিকদের মধ্যে বিভাজন বাড়াতে চান না। তাই গোড়া থেকেই NTUI –র স্লোগান হল “আমাদের দিশা ঐক্য”। NTUI প্রতিটি লড়াইয়ে এ.আই.টি.ইউ.সি., সিটু, এইচ.এম.এস. প্রভৃতির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্য চেয়েছে। এই অবস্থায়, পুরোনো ধরণের ট্রেড ইউনিয়নরা শ্রমিকদের চাপ একেবারে অগ্রাহ্য করলে তাদের গণভিত্তিই কমত।
নয়া উদারপন্থার যুগে শ্রমিক শ্রেণীঃ
বুর্জোয়া পত্রপত্রিকায় প্রাবন্ধিকদের রচনা, বা তথাকথিত “সাধারণ মানুষ” যারা ঘন্টার পর ঘন্টা ইন্টারনেটে লিখতে পারে, তাদের মতামত পড়লে মনে হয়, অলস শ্রমিকরা চাইছে, সরকার তাদের জন্য ব্যয়বরাদ্দ বাড়াক, যার বোঝাটা পড়বে পরিশ্রমী সাচ্চা মানুষদের উপর। যেমন, ইন্টারনেটে এক ব্যক্তির উক্তিঃ “নাগরিকরা বিলিয়ে দেওয়া টাকায় নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে এটাই হয়। ট্রেড ইউনিয়নরা দেখল দিয়ে সরকার হরির লুঠ দিচ্ছে। তাই তারাও এখন ভাগ চাইছে. কেউ বুঝতে পারছে না, টাকা উপার্জন করতে হয়। টাকা নিছক ছাপা যায় না। যত বেশী ছাপা হবে, তত তার দাম কমবে, ফলে পরিস্থিতি বেহাল হবে।”৬
শাসক শ্রেণীর উগ্র দক্ষিণপন্থী কন্ঠ দ্য টেলিগ্রাফ, যারা মুনাফা বৃদ্ধির স্বার্থ ফ্যাশিষ্ট নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চায়, তাদের সম্পাদকীয়তে বলা হলঃ
“যদি ধর্মঘটের উদ্দেশ্য হয় সরকারের কিছু কিছু নীতি বদল করানো, তবে তা ইতিমধ্যেই ব্যর্থ হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়নদের চাপে সরকার সংস্কারবাদী নীতিগুলি ঠেলে পিছিয়ে দেবে মনে হয় না। ট্রেড ইউনিয়নরা যে সব সংস্কারবাদী নীতির বিরোধী, সেগুলি দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মঘটের অন্যতম কারণ হল শ্রম আইন লঙ্ঘন। বাস্তব ঘটনাটা হল ভিন্ন। বস্তাপচা শ্রম আইনের জন্যই ভারতে বিনিযোগের হার কম, উৎপাদনশীলতাও কম। শ্রম আইনকে সংশোধন করে তাদের একটি আধুনিক অর্থনীতির উপযোগী করতে হবে। মূল্যবৃদ্ধি সরকার ও সাধারণ মানুষ উভয়ের কাছেই সমস্যা। কিন্তু, যারা মনে করেন ধর্মঘট করে দাম কমানো যাবে তাঁদের অবশ্যই একটি অর্থনীতি কীভাবে চলে সে বিষয়ে অদ্ভূত ধারণা আছে।”৭
২০শে ফেব্রুয়ারী গোটা দিন ধরে টেলিভিশন চ্যানেলরা একটা দৃশ্য দেখিয়ে গেল – একটা গাড়িতে আগুন লাগানো হচ্ছে এবং একটা ফ্যাক্টরীর অফিসে ইট ছোঁড়া হচ্ছে। এই গুলিই হল আলোচনার সূচনাবিন্দু।
আমরা জানতে পারছিঃ
· ধর্মঘটীরা হিংস্র (মালিকরা নয় ?)
· শ্রম আইন বস্তাপচা, তাই তাকে অর্থনীতির স্বার্থে, উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর স্বার্থে, পাল্টাতে হবে
· ধর্মঘট দাম কমাতে পারে না
· শ্রমিকরা অলস, এবং কাজ না করে টাকা চায়।
২০০৮ থেকে ২০১১-র মধ্যে ভারতে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বেড়েছে ৭.৬ শতাংশ, আর শ্রমিকদের প্রকৃত আয় কমেছে ১ শতাংশ। ILO-র ২০১২-র বিশ্ব বেতন প্রতিবেদন এই তথ্য দিয়ে দেখাচ্ছে, “সংস্কার” অল্পবিত্ত মানুষের উপকার করবে, এই দাবী রূপকথা মাত্র। ১৯৯৯ থেকে ২০০৭ পর্বে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বেড়েছিল ৫ শতাংশ, এবং শ্রমিকের প্রকৃত আয় কমেছিল ১ শতাংশ। অর্থাৎ, বারো বছরে উৎপাদনশীলতা বেড়েছে ১২.৬ শতাংশ, আর প্রকৃত আয় কমেছে ২ শতাংশ। তথ্যটা দু টুকরো করে দিয়ে আমরা দেখাতে চাই, বিশ্ব পুঁজিবাদী সংকটের আগে হোক বা পরে, উগ্র নয়া-উদারপন্থী “সংস্কার” শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে গেছে এবং শ্রমিকদের নিংড়ে নিয়েছে।
দুজন গবেষক প্রদত্ত তথ্য থেকে আমরা জানতে পারি৮ যে অর্থনৈতিক উদারনীতি আনার ফলে বাজারে পুঁজিকরণে সবচেয়ে বড় ৫০টি প্রতিষ্ঠানের ভাগ ১৯৯৭-এ ছিল ৩২ শতাংশ, এবং ২০০১-এ প্রায় ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ একচেটিয়া বড় পুঁজিই সবচেয়ে লাভ করছে।
গত এক দশকে বেতনের তুলনায় মুনাফার অনুপাত দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। এটা উৎপাদন ও পরিষেবা, দুই ক্ষেত্রেই ঘটেছে। কোম্পানীরা, এমনকি সরকার নিজেও শ্রম আইনের গলতি ব্যবহার করে তাকে স্রেফ অগ্রাহ্য করে, চুক্তিবদ্ধ (কন্ট্র্যাক্ট) শ্রমিক ব্যবহার করে, বেতন কমিয়েছে এবং শ্রমের উতপাদন্সীলতা বাড়িয়েছে শোষণের মাত্রা তীব্রতর করেই।
সুতরাং ১৯৭০-এর কন্ট্র্যাক্ট লেবার রেগুলেশন অ্যান্ড অ্যাবলিশন এ্যাক্ট এমন এক আইন, যা মালিকরা অগ্রাহ্য করে, এবং যাকে তারা পুরোপুরি খারিজ করতে চায়। মীনাক্ষি রাজীবের গবেষণা৯ দেখায়, তিনি যে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের নিয়ে গবেষণা করেছেন, তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের মাসিক আয় ২০০০ টাকা মাত্র।
আইন অনুযায়ী, কন্ট্র্যাক্ট শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড পাওয়ার কথা। এটা তাদের উপর চাপ বাড়ায় কারণ তাদের মাইনে থেকে টাকা কাটা হয়, কিন্তু কন্ট্র্যাক্টর পাল্টালে আগের টাকা উদ্ধার করা যায় না।
অনেক অরেজিস্ট্রীকৃত কন্ট্র্যাক্ট প্রতিষ্ঠান আছে যারা টাকাটা কেটে নেয়, কিন্তু কখনোই জমা দেয় না, এবং কয়েক বছর বাদে অফিস পাল্টে, নাম পাল্টে, একই ব্যবসায় নামে। এদের কর দিতে হয় না, শ্রমিকদের ই.এস.আই. বা পি.এফ. দিতে হয় না, ফলে মুনাফা বাড়ে।
শিল্প ক্ষেত্রে, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রেই চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের সংখ্যা ৫০ শতাংশের উপর। বেসরকারী ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ৮০ শতাংশের বেশী। একটি সরকারী সংস্থানের সমীক্ষা দেখাচ্ছে, লাইসেন্স প্রাপ্ত কন্ট্র্যাক্টরদের কাছেই তিন কোটি ষাট লক্ষ শ্রমিক কাজ করেন। শ্রমমন্ত্রকের হিসেবে কন্ট্র্যাক্ট শ্রমিকরা ভারতের ৪৫ কোটি ৯০ লাখ শ্রমিকের ২৮ শতাংশ (এতে আছে সবরকম কন্ট্র্যাক্ট শ্রমিক, এবং এই হারে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের সংখ্যা হবে ১২ কোটি ৮০ লক্ষ)।
ভারত সরকারের অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০০৭ অনুযায়ী, ১৯৯১ থেকে ২০০৬-এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে ৮,৭০,০০০ চাকরী কমানো হয়েছিল। একই সময়ে ‘ঠিকা’ বা ‘চুক্তিবদ্ধ’ শ্রমিকের চাকরীর সংখ্যা বাড়ে। এরকম প্রতিটি ঘটনা, ভারতের শ্রম আইনের আওতায় পড়া শ্রমিকদের সংখ্যা কমায়। আনুষ্ঠানিকভাবে যাঁরা “ফর্ম্যাল” ক্ষেত্রে পড়েন, তাঁদের অনেকেও আইনের সাহায্য পান না। ২০০৫-এ ভারতের মোট ৪৫.৭ কোটি শ্রমজীবি ৩৯.৫ কোটি ছিলেন “ইনফর্ম্যাল” ক্ষেত্রে। যাঁরা “ফর্ম্যাল” ক্ষেত্রে, তাঁদেরও ৪৭ শতাংশের চাকরী ছিল অনুরূপ। নানা পরিসংখ্যান দেখানো হয়, কিন্তু সাধারণভাবে আমরা অনুমান করতে পারি যে শ্রমজীবিদের ৯০ শতাংশ শ্রম আইনের আওতায় পড়েন না। সুতরাং লড়াইয়ের চরিত্রটা স্পষ্ট। কেন্দ্রীয় সরকার থেকে টেলিগ্রাফ, সকলে চায়, বাকি ১০ শতাংশও যেন শ্রম আইনের সাহায্য থেকে বঞ্চিত হন, তাঁদের আয় যেন প্রবলভাবে কমে যায়। “শ্রমিকরা অলস”-- কথাটার প্রকৃত অর্থ হল, কোন সাহসে শ্রমিকরা দুবেলা পেট ভরে খেতে চায়, নিজেদের সন্তানদের স্কুল-কলেজ পড়াতে চায়, সুচিকিৎসা চায় ? এসব চাওয়া, দিনে ১২ ঘন্টা কাজ করতে না চাওয়া, হল আলস্যের লক্ষণ।
বিশ্ব ব্যাঙ্কের বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০১৩: চাকরী অনুযায়ী, ভারতে আংশিক সময়ের কাজ বাড়ছে। দেশে অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যার ২০০৯ সালে বেড়েছিল ৯ শতাংশ, ২০১০-এ ১৮ শতাংশ। সংগঠিত ক্ষেত্রেও এরকম শ্রমিক বেড়েছে -- ২০০০ সালে সিমেন্ট, লৌহ ও ইস্পাত, বস্ত্রশিল্প ও চটশিল্পে, ঠিকা শ্রমিকের সংখ্যা ৬০-৭০ শতাংশ। নির্মাণ শিল্পে তা ৮০-৯০ শতাংশ।
নয়া উদারনীতির অধীনে শ্রমিক শ্রেণী প্রতিনিয়ত বিদ্রোহে ফেটে পড়েন নি। কিন্তু তাঁদের বিচ্ছিন্নতাবোধ বেড়েছে। “বিশ্বজোড়া ফ্যাক্টরীর” ফলে চাকরীর পুনর্বিন্যাস ক্রমাগত ঘটে চলেছে। মেয়েদের ক্ষেত্রে অবস্থাটা আরও খারাপ।
১৯৯৫ সালেই মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দেখিয়েছিল, দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারীদের ৭০ শতাংশ নারী। নারী ও পুরুষ উভয়ে শোষণ নির্যাতন সহ্য করে হুবহু এক ভাবে নয়, স্বতন্ত্রভাবে, যেহেতু পিতৃতন্ত্র ধনতন্ত্রের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। এক দিকে চাহিদা আছে মেয়েদের সরাসরি পুঁজির নিয়ন্ত্রণ মজুরী শ্রমের আওতায় টেনে আনার। অন্যদিকে শ্রমশক্তি পুনরুৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে পরিবারকে বজায় রাখারও চাহিদা রয়েছে. ফলে পরিবারের মধ্যেও মেয়েদের গৃহশ্রমিকের ভূমিকাকে অক্ষত রাখার চেষ্টা করা হয়। এই পরস্পরবিরোধী প্রবণতা ধরা রয়েছে শ্রম প্রক্রিয়া সংগঠনের বিভিন্ন পন্থায় – “নমনীয়” কাজের শিফট (flexible Shift), আংশিক সময়ের কাজ, বাড়ি থেকে কাজ করা ইত্যাদি। তার মানে এই না, যে মজুরী শ্রমিক এবং গৃহশ্রমিক, এই দুটি স্বত্ত্বা মেয়েদের জীবনে সুষম ভাবে যুক্ত। পরিবারে পুরুষেরা পারিবারিক সম্পদ সম্পর্কে অধিকাংশ সিদ্ধান্ত নেয়। কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের মর্যাদা পুরুষদের সমান হয় না। তাদের অধিকাংশ পড়ে থাকে কম মাইনে, কম দক্ষতা এবং অনিয়মিত শ্রম প্রক্রিয়ায়। বিশ্বায়ন এই প্রক্রিয়াকে তীব্রতর করেছে। কর্মক্ষেত্রেও লিঙ্গ বৈষম্য পুনরায় সৃষ্ট হয়। মালিক, ম্যানেজার ও সুপারভাইজাররা অধিকাংশই পুরুষ, আর অ্যাসেম্বলী লাইনের শ্রমিকরা মেয়ে। মেয়েরা নিয়মিত অভিযোগ করে, তাদের শৌচাগারে যাওয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা হয়। কাজের জায়গার ভিতরে ও বাইরে যৌন হয়রানি নিয়মিত ঘটে। কাজের পরিবেশ এত খারাপ, যে পেশাজনিত রোগ বাড়ে, ফলে সেই সব মেয়েদের কাজ চলে যায়। এই দারিদ্র্য, বহু রকম চাপ, এদের ফলেই মেযেদের উপর একটা হিংসা বাড়ে। একটি অতি সাম্প্রতিক ঘটনা হল মহারাষ্ট্রের সুর্মাদিতে ৫, ১০ এবং ১১ বছর তিনটি গরীব মেয়েকে খাদ্যের লোভ দেখিয়ে ধর্ষণ ও খুন করা। যে সব মেয়েরা শিল্পক্ষেত্রে কাজ করে, তারা প্রতিদিন ঝুঁকিতে থাকে। অর্থনৈতিক সংকট যত বাড়ে, মেয়েরা তত নিরাপত্তাহীন হতে থাকে।
মূল্যবৃদ্ধি ও কম বেতন হালফিল শ্রমিক অসন্তোষের পিছনে অন্যতম প্রধান কারণ। ২০০১-এর হিসেবকে ১০০ ধরে দেখা যাচ্ছে, শিল্প শ্রমিকদের নির্বাচিত ভোগ্যপণ্যের দাম সরকারী হিসেবে প্রবলভাবে বেড়েছে। কলকাতা শহরের পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, সরকারী হিসেবে ২০০৬ থেকে ২০১০-এর মধ্যে শ্রমিকদের ভোগ্য পণ্য মূল্য বেড়েছে নীচের সারণী অনুযায়ীঃ১০
পণ্য ২০০৬-এর মূল্য ২০১০-এর মূল্য
(টাকায় কিলো প্রতি) (টাকায় কিলো প্রতি)
চাল ১৩.৬৭ ২২.২১
গম ১০.৬৫ ১৬.৭৮
ডাল (বিভিন্ন) ৩৩ থেকে ৪৫ ৭০ থেকে ১১০
ভোজ্য তেল (বিভিন্ন)৪৬ থেকে ৪৭ ৬০ থেকে ৬৭
মাছ ৯১ ১৫৭
পেঁয়াজ ৯.৫৮ ২৮.৬
আমরা কলকাতার তথ্য দেখালাম। সরকারী হিসেব দেখাচ্ছে প্রত্যেক শহরেই একই চিত্র। ২০০২-২০১২ এই দশকে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ২৮৪ শতাংশ। বাড়ি কেনা, ভাড়া করা, স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা সবের ব্যয় বেড়েছে বিপুলভাবে। এবং শ্রমজীবি মানুষের কাছে সর্বাধিক জরুরী রাজনৈতিক প্রসঙ্গ হল খাদ্য পাওয়া। ভারতের পুষ্টির মাপকাঠি পৃথিবীতে অন্যতম নিকৃষ্ট। গত ক-বছরে মাথাপিছু ক্যালোরী গ্রহণ আরো কমেছে।
মূল্যের উল্টোদিক হল বেতন। দিল্লীতে অদক্ষ শ্রমের ন্যূনতম দৈনিক বেতন ২০৩ টাকা, দক্ষ শ্রমের জন্য ২৪৮ টাকা। মহারাষ্ট্রে তা হল ১১৬-৫৪ থেকে ৩১০-৬২ (চলচ্চিত্র শিল্প); পশ্চিমবঙ্গে ৮৭.৫০ থেকে ১৬৩.৩০। কিন্তু সুপ্রীম কোর্টের রায় অনুযায়ী চার প্রধান নগরীতে দৈনিক ন্যূনতম মজুরী হওয়া উচিৎ ৩৪৬.৪২ টাকা।
কৃষিক্ষেত্রে ন্যূনতম মজুরী এত কম যে ক্ষেতমজুরেরা প্রতিটি দিন কাজ পেলে এবং ন্যূনতম মজুরী পেলেও, তারা পঞ্চদশ ভারতীয় শ্রম কংগ্রেস নির্ধারিত মানদন্ড এবং ইউনিচয় বনাম কেরালা ১৯৬১, এবং র্যাপট্যাকোস, ব্রেট বনাম শ্রমিকবৃন্দ, ১৯৯১ এ দুটি মামলায় সুপ্রীম কোর্টের রায় অনুযায়ী পরিবারের মৌলিক চাহিদার যে সংজ্ঞা, তা মেটাতে পারবে না। সুপ্রীম কোর্ট বিভিন্ন সময়ে বলেছে যে মানবিকতার স্বার্থে, ঘোষিত ন্যূনতম মজুরীর নীচে মজুরীকে নামতে দেওয়া যাবে না, এবং কীরকম প্রতিষ্ঠান, তার লাভ-ক্ষতি কত, ও সব না দেখেই ঐ ন্যূনতম মজুরী দিতে হবে। তা না দেওয়া হল সংবিধানের ২৩ তম ধারায় নিষিদ্ধ “বাধ্যতামূলক শ্রম”, এবং মালিক যদি নূন্যতম মজুরী না দেয় তবে তার প্রতিষ্ঠান চালাবার কোনো এক্তিয়ার নেই।
অ্যাডভাইজরি বোর্ডরা যেভাবে নূন্যতম মজুরী স্থির করে, সেখানে বেতনের সঙ্গে মহার্ঘ্যভাতা যুক্ত নয়। ফলে প্রকৃত আয় কমতে থাকে। আরেকটা সমস্যা হল, ন্যূনতম মজুরী আইন অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছরে ন্যূনতম মজুরী বাড়ানোর কথা, কিন্তু কার্যত তা ঘটে না, ফলে শ্রমিকের উপর চাপ বাড়ে।
আইনমাফিক ন্যূনতম মজুরীতে তাই একেবারে নীচের দিকে যারা আছে, অর্থাৎ মেয়েরা, অনগ্রসর জাতিভুক্ত শ্রমিকরা, রাজ্যের বাইরে থেকে আসা শ্রমিকরা, তারা কিছুটা উপকৃত হয়। আইনমাফিক মাপিক ন্যূনতম মজুরী চালু করলে দারিদ্র্য কমত। আইনত ন্যূনতম মজুরী হল মজুরীর একেবারে নীচের তলা। আজ উল্টে তা হইয়ে দাঁড়িয়েছে অসংগঠিত ক্ষেত্রে মজুরীর ছাদ। দারিদ্র্য দূরীকরণের বদলে তা হয়ে পড়েছে দারিদ্র্য সৃজনের মজুরী।
ধর্মঘটের দাবীঃ
পুর্বোল্লিখিত পরিস্থিতিগুলি ধর্মঘটের মূল কতকগুলি দাবী নির্ধারণ করেছিল। সেগুলি হল –
· সবার জন্য মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে বাঁধা হারে বাঁচার মজুরী;
· সার্বজনীন খাদ্য নিরাপত্তা;
· NREGA মজুরী ন্যূনতম মজুরীর চেয়ে কম রাখা চলবে না;
· ন্যূনতম মজুরী মাসিক ১০,০০০ টাকা করতে হবে;
· সার্বজনীন, রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে চিকিৎসা;
· চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক ও নারী শ্রমিকদের জন্য সমান কাজে সমান বেতন চাই;
· কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বন্ধ কর, প্রতিটি কর্মক্ষেত্রের যৌন হয়রানি নিরোধেক কমিটি প্রতিষ্ঠা কর;
· রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকে রক্ষা করা ও পুনরুজ্জীবিত কর।
অধিকাংশ দাবীকে আর ব্যাখ্যা করা অপ্রয়োজনীয়। শুধু বলে রাখা দরকার আন্তর্জাতিক খাদ্য নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ২০১১-র বিশ্ব ক্ষুধা ইনডেক্স অনুযায়ী, ভারতের ৬ কোটি শিশু অপুষ্টিতে ভোগে এবং তাদের ওজন প্রয়োজনের চেয়ে কম। গোটা জনসংখ্যার ২১ শতাংশ অপুষ্টিতে ভোগে।১১ আরেকটি সমীক্ষা দেখাচ্ছে যে ২০০০ সালে ১৫-৪৯ বছরে বয়স্কা মেয়েদের মধ্যে যা গর্ভবতী তাদের ৭৫ শতাংশ এবং বাকিদের ৭০ শতাংশ অপুষ্টিতে ভুগছিল।১২
সরকার দাবী করেছে, নরেগা (NREGA) হল দারিদ্র কাটানোর রাস্তা। দক্ষিণপন্থীরা একে আক্রমণ করছে। বাস্তবে, এ হল এক করুণ আধা-পদক্ষেপ, যদিও যে দেশে বেকার সমস্যা এমন মর্মান্তিক সেখানে এটুকুও কাজে লাগে। NREGA প্রকল্প অনুযায়ী, প্রতি পরিবারে একজন করে সদস্যকে বছরে ১০০ দিন করে কাজ দেওয়া হবে। বাস্তবে এতটাও হচ্ছে না। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে মানুষ NREGA তে যতখানি কাজ পাচ্ছে তাদের ততখানি অন্তত কম মজুরীর বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি আসছে – অবশ্য যদি NREGA–র মজুরী সরকার নির্ধারিত নূন্যতম মজুরী হয় তবেই।
শ্রমিক সংগ্রামের অন্যতম প্রধান দাবী ছিল শ্রমিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা। যেহেতু ভারতে লোকসভা, বিধানসভা, পৌরসভা ও পঞ্চায়েতে নির্বাচন হয়, তাই দাবী করা হয়, ভারতে যথেষ্ট গণতন্ত্র আছে। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণীর ব্যাপক অংশের দৈনন্দিন জীবনে গণতন্ত্রের ছোঁয়া লাগে না। তাই ধর্মঘটের দাবীগুলির মধ্যে ছিল ৪৫ দিনে বাধ্যতামূলকভাবে ট্রেড ইউনিয়নের রেজিস্ট্রীকরণ; এবং ILO–র ৮৭ নং এবং ৯৮ নং কনভেনশন অবিলম্বে মেনে নিতে হবে। ILO-র ৮৭ নং কনভেনশন রাষ্ট্রের নিজের হস্তক্ষেপমুক্ত পথে পছন্দসই ট্রেড ইুনিয়ন বাড়ার পূর্ণ স্বীকৃতি দেয়, আর ৯৮ নং কনভেনশন ইউনিয়ন গড়ার অধিকারকে শক্তিশালী করে এবং রাষ্ট্র কি কি করতে পারবে না, সে কথা বলে।
কেন্দ্রীয় স্তরে লিঙ্গ সচেতনার অভাব পরিলক্ষিত হয়, যখন আমরা দেখি নারী শ্রমিক-নির্দিষ্ট দাবীগুলি জোরের সঙ্গে উঠে আসে নি। ক্রেশে প্রতিষ্ঠা এবং মেয়েদের জন্য স্বতন্ত্র শৌচাগার নির্মাণের মত সহজ দাবীও দাবী সনদে যথাযোগ্য স্থান পায় না। কিন্তু কিছু দাবী উঠেছে। আমরা দেখেছি কেন্দ্রীয় দাবীর মধ্যেই সমান কাজে সমান মজুরী এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা বন্ধের দাবী উঠেছে। ভাঁওরি দেবীর ঘটনা ও তারপর বিশাখা রায়ের সময় থেকে যৌন আক্রমণ, হয়রানি, কিছুটা নজরে এসেছে। কিন্তু এটা আজও বাস্তব, যে বিশাখা মামলার রায়ে১৩ যে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেরকম কমিটি চালু নেই। যদি মেয়েরা সমান মানুষ হিসেবে কাজ করতে চান, তাহলে তাঁদের উপর যৌন হিংসা বন্ধ হতে হবে এবং ট্রেড ইউনিয়নরা যে এ দাবী তুলেছে তা দেখায় ইউনিয়নরা এ বিষয়ে সচেতন। অন্যদিকে, মালিক ও ম্যানেজমেন্ট এ প্রসঙ্গে এখনও দায়িত্ব নেয় না।
ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে যুক্ত মেয়েরা আরো অনেক বেশী দাবী রেখেছেন। সামাজিক নিরাপত্তার দাবীর সঙ্গে রাখতে হবে সব মেযেদের জন্য মাতৃত্ব কালীন সুবিধার দাবী। যেখানে এত মেয়ে অসংগঠিত ও চুক্তিবদ্ধ সেখানে তা করা শক্ত কিন্তু আবশ্যক।
“ধর্মঘট সমস্যার সমাধান করে না”
এই কথাটা বুর্জোয়া রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকদের প্রিয় উক্তি। গত দুই দশকের রেকর্ড অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সঙ্গে আয়ের অসাম্য দ্বিগুণ হয়েছে। তথাকথিত “আগন্তুক” অর্থনীতিদের মধ্যে ভারত সবার পিছনে। মূল্যবৃদ্ধি, শ্রমের পুনর্বিন্যাস, বেসরকারীকরণ ও অর্থনৈতিক নিয়মমুক্ত করা, বেতন বৃদ্ধি বন্ধ করা ও নয়া-উদারনৈতিক অন্যান্য পদক্ষেপ, যারা কাজ পেয়েছে তাদের জীবনকেও দুর্বিসহ করে তুলেছে। আর শহরতলী ও গ্রামের বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন দারিদ্র্যে পূর্ণ।
প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি নিয়ে ক্রমান্বয় হৈ-হট্টগোল দেখা গেছে. আন্না হাজারেকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন, তা গরম বুকনিতে ভরা ছিল। তার পিছনে ছিল কর্পোরেট পুঁজির একাংশ, যারা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের আক্রমণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দেশজোড়া ধূমায়িত বিক্ষোভকে বিপথগামী করা।
ভারতের বুর্জোয়া প্রচারমাধ্যমগুলি মেহনতী মানুষের প্রকৃত সমস্যগুলির বিষয়ে ঘৃণ্য নীরবতা পালন করে চলেছে, এবং ক্রমাগত ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা বাড়িয়ে তুলছে। কিন্তু ১১টি বড় কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়ায় নেতিবাচক প্রচারের বন্যা বয়ে গেল। উপরে দ্য টেলিগ্রাফের যে সম্পাদকীয় থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে, তা ছিল এ প্রচারের মোদ্দা বক্তব্যঃ ধর্মঘট সফল হতে পারে না, কারণ সরকার তোমাদের দাবী মানবে না।
গোটা ভারত থেমে না গেলেও, বাস্তব ঘটনা হল, এবারের ধর্মঘট ছিল শাসক শ্রেণীর মতাদর্শগত এজেন্টদের চাপানো সবরকম সংস্কার, বিভাজন অগ্রাহ্য করে ভারতের শ্রমিক শ্রেণীর অন্যতম প্রধান লড়াই। ২০১২-র মতই, এবারও ধর্মঘট ডেকেছিল সবকটি সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্থানীয় ইউনিয়ন। মোটামুটি দশ কোটি শ্রমিক ধর্মঘট যোগ দেন। তলা থেকে শ্রমিকদের চাপ এত তীব্র ছিল যে ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদের ধর্মঘটের ডাক দিতেই হত, যদি তাঁরা শ্রমিকদের মধ্যে সমান্যতম সমর্থন বজায় রাখতে চান। শাসক কংগ্রেস দলের নেতা তথা আই.এন.টি.ইউ.সি.-র সভাপতি জি. সঞ্জীব রেড্ডীকে বলতে হল – “আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবী হল ঠিকা শ্রমের অবসান এবং বল্গাহীন মূল্যবৃদ্ধি রোধ।” এমন কি ভারতীয় জনতা পার্টির সঙ্গে যুক্ত ইউনিয়নরাও ধর্মঘটে যোগ দেয়।
আমরা যদি প্রাথমিক রিপোর্টগুলি দেখি, এবং বুর্জোয়া প্রচার মাধ্যমের বক্তব্য খুঁটিয়ে দেখি, তাহলে বুঝব, কি প্রচন্ড বিদ্রোহ ঐ দুদিন ফেটে পড়েছিল। আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে ট্রেড ইউনিয়নদের কাছ থেকে পাওয়া রিপোর্টগুলি অগ্রাহ্য করে “গুরুগম্ভীর” বুর্জোয়া পত্রপত্রিকাদের প্রতিবেদন দেখছি, কারণ সেগুলিতে শাসক শ্রেণী নিজের সঙ্গে কথা বলে।
ওড়িষা থেকে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের প্রথম দিনের প্রতিবেদনঃ “রাজ্যে স্বাভাবিক জীবনযাপন পন্ড হয়েছিল, কারণ রাজ্যের অধিকাংশ জায়গায় গাড়ি পথে বেরোয় নি। রেল পরিষেবাও বিপর্যস্ত হয়। রেল রোকো-র ফলে নটি এক্সপ্রেস ট্রেনকে গন্তব্যস্থলের আগেই থামানো হয়, একটিকে বন্ধ করা হয়, এবং দুটির সময় পাল্টাতে হয়।
বনধের প্রভাব বেশী ছিল রাউরকেল্লা, পারাদ্বীপ, সুন্দরগড়, কেওনঝাড়, তালচের ও আঙ্গুলের মত শিল্প নগরীতে।
আঙ্গুল-ঢেঙ্কানল শিল্পাঞ্চলে বনধের প্রভাব ছিল মিশ্র। জি.এম.আর এনার্জি এবং ভূষণ স্টীলে কোনো শ্রমিক কাজে না আসায় তাদের ইউনিটগুলি বন্ধ ছিল। তবে আঙ্গুলে কয়লাখনি সহ বিভিন্ন শিল্পে কাজ হয়েছিল।
ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশনের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ন্যাশনাল অ্যালুমিনিয়াম কোম্পানীর ধাতু গলানোর কেন্দ্রে কাজ হয়েছিল, যদিও অ্যালুমিনিয়াম প্রতিষ্ঠানে হাজিরা ছিল অল্প।
মহানদী কোল ফিল্ডস লিমিটেডের কর্মকর্তারা বলেন, তালচের এবং ইব উপত্যকায় সব নিয়মিত শ্রমিকরা কাজ করতে এলেও ঠিকা শ্রমিকরা কাজ করতে আসেন নি।”১৪
ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিনে আরেকটি সংবাদ জানায়ঃ
“ব্যাঙ্ক পরিষেবা স্তব্ধ হয়ে পড়ে এবং ৮০,০০০ কোটি টাকা মূল্যের ১ কোটি ৪০ লক্ষ চেক গত দুদিনে খালাস হয় নি, কারণ ক্লিয়ারিং হাউসগুলি বন্ধ ছিল।”১৫
বিজনেস লাইন পত্রিকা জনায়, দেশের প্রধান বন্দরগুলিতে ধর্মঘট জনিত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১০০ কোটি টাকা।১৬
আরেকটি প্রতিবেদন জানায়, সারা দেশে পরিবহন বিপর্যন্ত হয়েছিল। অধিকাংশ প্রতিবেদন এ কথাও জানায় যে পশ্চিমবঙ্গে (যেখানে সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টকে হারিয়ে ভোটে জিতেছে তৃণমূল কংগ্রেস) বনধ ব্যর্থ ছিল। এই দাবী আরেকটু তলিয়ে দেখতে হবে। প্রথমতঃ অধিকাংশ সংবাদপত্র সাধারণ ধর্মঘট কথাটা ব্যবহার না করে বনধ কথাটা ব্যবহার করেছে। এর যথেষ্ট কারণ আছে। ভারতে “বনধ”-এর রাজনীতি নির্দিষ্টভাবে প্রলেতারীয় নয়। দ্বিতীয়ত বহু সময়ে আদালতরা রায় দিয়েছে, ধর্মঘট করার অধিকারের মধ্যে “বনধ” পড়ে না। এমন কি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে বনধ হলে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে, যে দলগুলি বনধ ডেকেছে তারা তার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে।
দ্বিতীয়ত, ১৯৭৭-২০১১ তে, বামফ্রন্টের শাসনকালে, সিপিআই(এম) বহু সময়ে বনধ সফল করার জন্য রাষ্ট্রশক্তি ও ক্যাডারশক্তি প্রয়োগ করতে। বনধের সাফল্য মাপা হত, শিল্প শ্রমিকরা কতটা ধর্মঘট করলেন তা দেখে নয়, নিছক সরকারী অফিসে হাজিরা কত, তা দেখে। শ্বেত কলার সরকারী কর্মচারীরাও অবশ্যই শ্রমজীবিদের অংশ। কিন্তু তাঁরা বাকি প্রায় সবার চেয়ে সামান্য হলেও ভাল আছেন। যথেষ্ট না হলেও, তাঁদের চাকরীতে মহার্ঘ্যভাতা পান (পশ্চিমবঙ্গে গত ফেব্রুয়ারীতেই তা দেওয়া হয়েছে)। আর অন্যদিকে নতুন যে উগ্র দক্ষিণপন্থী সরকার এসেছে, তারা সরকারী কর্মচারীদের উপর এমন কোপ নামিয়েছে যে ধর্মঘট অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁরা এবার একটু কমজোর ছিলেন।
কিন্তু কলকাতা সহ গোটা রাজ্যে পরিবহন ছিল অল্প। অফিসের সময়েও বাসে বসা যাচ্ছিল। চটকলে, চা বাগানে আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে, এবং অন্যত্র, ধর্মঘটে অংশগ্রহণের হার যথেষ্ট ভাল ছিল। ৪২০০০ বেসরকারী বাস ও মিনিবাসের মধ্যে মাত্র ২০০০ বেরিয়েছিল. বলপূর্বক সরকারী বাস বার করে কিছুটা ঠেকা দেওয়া হয়েছিল। উত্তরবঙ্গের ১২০টি চা বাগানের মাত্র কয়েকটিতে স্বাভাবিক কাজ হযেছিল। ব্যাঙ্ক একেবারে বন্ধ ছিল। ব্যারাকপুর ও তারাতলা অঞ্চলে ধর্মঘট ভাল সাড়া জাগাতে পেরেছিল।
দুটি প্রতিবেদন ও একটি অগ্রগতিঃ
২০ ফেব্রুয়ারী সমস্ত দিন টেলিভিশনে বারে বারে দেখানো হয়েছে একটি ঘটনা। আরেকটি ঘটনা, ২১ তারিখ খবরের কাগজে ছোটো করে লুকোনো। দ্বিতীয় খবরটি হল, এক দালাল ড্রাইভার আম্বালাতে এক এ.আই.টি.ইউ.সি.-র নেতাকে ধাক্কা মেরেছে ও তিনি নিহত হয়েছেন। আর বিশাল খবরটা হল নয়ডাতে শ্রমিকরা একটা গাড়িতে আগুন লাগিয়েছিল, এবং ফ্যাক্টরী অফিস আক্রমণ করেছেন। এই খবরটা ফলাও করে দেখানো জরুরী ছিল। এইভাবে প্রমাণ করতে হবে তো, যে হিংসার পথ নেয় -- সরকার নয়, মালিক নয়, ট্রেড ইউনিয়নরা। ঠিক যেমন গতবছর মানেসরে হিংসাত্মক ঘটনার পর শুধু রিপোর্ট করে বলা হল, শ্রমিকরা একজন ম্যানজারকে মেরেছেন; বলা হল না যে শ্রমিকদের উপর হিংসাত্মক ব্যবহার করা হয়েছিল, ফ্যাক্টরী গেট বন্ধ করে মারধোর করা হয়েছিল বা জাতের নামে অপমান করে গোলযোগের সূত্রপাত করা হয়েছিল।১৭
গুরগাঁও, মানেসর, নয়ডা, এ সব হল ট্রেড ইউনিয়নরা চিরাচরিতভাবে দুর্বল, এমন এলাকা। এখানে ইউনিয়ন গঠন করতে গেলে সরকার ও মালিক হাত মিলিয়ে বাধা দিয়েছে, আক্রমণ করেছে, ছাঁটাই করেছে। এ সব জায়গায় ঠিকা শ্রমের পরিমাণও বেশী।
প্রসেনজিৎ বোস ও সৌরীন্দ্র ঘোষের গবেষণা থেকে জানা যায় মারুতি-সুজুকিতে ২০০৭ থেকে ২০১১তে শ্রমিকদের বার্ষিক আয় বেড়েছিল ৫.৫ শতাংশ, যেখানে ফরিদাবাদের ভোগ্যপণ্যের গড় বৃদ্ধি ছিল ৫০ শতাংশের বেশী, আর মারুতি কোম্পানীর লাভ, ২০০১ থেকে কর দেওয়ার পর বেড়েছে ২২০০ শতাংশ।১৮
তাঁরা লিখেছেনঃ
“মারুতি-সুজুকি ইন্ডিয়া লিমিটেড-এর গুরগাঁও কারখানায় শ্রমিকরা ২০০৭-এ যা পেতেন এবং এখন যা পান (গুঁরগাও এবং মানেসরের বেতন বিন্যাস অনুরূপ), দেখায় সময়ের সঙ্গে বেতন কীভাবে পাল্টেছে। ২০০৭ সালে, একজন প্রবীণ স্থায়ী শ্রমিক এক বছরে একদিনও ছুটি না নিলে আয় করতেন বড় জোর ২ লাখ ৮০ হাজার। আজ তাঁর সর্বমোট বার্ষিক আয় হতে মোটামুটি ৩ লাখ, অর্থাৎ ৫.৫ শতাংশ বৃদ্ধি। কিন্তু হরিয়ানার ফরিদাবাদ কেন্দ্রে ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০৭ থেকে ২০১১-র মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশী। ফলে স্থায়ী শ্রমিকদের প্রকৃত আয়ের উপর চাপ বাড়ছে।...
“এর বিপরীতে, মারুতি-র প্রধান কার্যনির্বাহী অফিসারের বেতন ছিল ২০০৭-০৮-এ ৪৭ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা, আর ২০১০-১১-তে তা বেড়ে হল ২ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা, অর্থাৎ ৪১৯ শতাংশ বৃদ্ধি। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের বার্ষিক আয় বেড়েছে ৯১.৪ শতাংশ। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, প্রতিষ্ঠানের বিক্রী ও মুনাফা বাড়ার লাভ প্রশাসন ও শ্রমিকের মধ্যে কেমন অসমভাবে বন্টন করা হচ্ছে”।১৯
এই কারণেই সব রকম হুমকি অগ্রাহ্য করে, এ সব এলাকার শ্রমিকরা দলে দলে ধর্মঘটে যোগ দিয়েছিলেন। মালিকদের পক্ষে অপ্রত্যাশিত এ ঘটনার ফলে শাসক শ্রেণী যতটা ভেবেছিল, ধর্মঘট তার চেয়ে বেশী আঘাত দিয়েছে তাদের। অ্যাসোচ্যামের বিবৃতিতে বলা হয়েছেঃ “প্রাথমিক হিসেব ছিল যে মোট আভ্যন্তরীন উৎপাদনে টান পড়বে ১৫০০০-২০০০০ কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে তা বেড়ে হয়েছে ২৬০০০ কোটি টাকা।”২০
শাসক শ্রেণী এই এলাকাগুলি বন্ধ করে রাখতে চেয়েছিল। কোনো কিছু ঘটার আগেই তিনশ-র বেশী এফ.আই.আর করা হয়েছিল, শতাধিক মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। শাসক শ্রেণী ও সরকারের এই হিংস্র আক্রমণ, গণতান্ত্রিক অধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন, এ থেকেই দুয়েকটি ক্ষেত্রে পাল্টা হিংসা ঘটেছে। শাসক শ্রেণীর স্তাবকরা তো সেদিকেই তাকিয়ে ছিল। তারা সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল। দাবী উঠল, “বিনিয়োগকারীদের আস্থা” ফেরাতে হবে।
ধর্মঘটের পরঃ
গত এক দশকের কিছু বেশীদিন ধরে, পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক পন্ডিতরা ভারতকে কুমীর ছানার মত তুলে ধরে দেখাচ্ছিলেন, নয়া-উদারনীতি কীভাবে একটা দেশের আধুনিকীকরণ সম্ভব করে তোলে। একটা উল্লেখযোগ্য মধ্য শ্রেণী স্ফীত হয়েছে। তাদের ক্রয়ক্ষমতা ও ভোগের চরিত্র পাল্টেছে। বড় বড় উৎপাদকরা তাই লোলুপ দৃষ্টে তাকিয়ে আছে ভারতের বাজারের দিকে। উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, ভারতের গাড়ি শিল্প বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম। ২০১১তে তার বার্ষিক উৎপাদন ছিল ৩৯ লাখ ইউনিট।২১ ঐ একই বছরের মোবাইল ফোন হ্যান্ডসেট বিক্রী ২১ কোটি ৩০ লাখ ইউনিটে পৌঁছায়।২২ কম্পিউটার বিক্রী হয় ১ কোটি ১১ লাখ ৫০ হাজার।২৩
যা রিপোর্টে বেরোয় নি, তা হল অর্থনৈতিক বৃদ্ধির একপেশে চরিত্র। দুই দশক ধরে নয়া উদারনীতি চালু থাকার পর “অর্থনীতিতে বৃদ্ধি এলে শ্রমিকরাও উপকৃত হবেন”, এই বুকনিতে ছাতা পড়ে গেছে। ইউনিয়নদের সঙ্গে সরকারের লড়াইয়ের মধ্যে একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হল, বাঁচার মত পেনশন পাওয়ার লড়াই। সরকার পেনশন বিলের মাধ্যমে মজুরের মাইনে থেকে টাকা কেটে তা বিনিয়োগ করতে চায় বাজার চালিত আর্থ সংস্থায়, যাতে বেসরকারী ইনসিওরেন্স ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের লাভ বাড়ে। এতে শ্রমিকদের অবসরকালীন আয় বিপদে পড়বে।
আজ যে দ্বন্দ্ব রয়েছে, তা হল তলা থেকে বিপুল চাপ বনাম চিরাচরিত ইউনিয়নদের সীমাবদ্ধতা। ইউনিয়নদের যত সদস্য তার চেয়ে ধর্মঘটে অংশ নিয়েছেন অনেক বেশী। বুর্জোয়া দল এবং সংস্কারবাদী দল, দুয়ের সঙ্গে যুক্ত ইউনিয়নদেরই তাই ভূমিকা সন্দেহজনক। মুখে “সাধারণ ধর্মঘট” কথাটা বললেও, তারা এক প্রধান পরিবহণ ক্ষেত্র, অর্থাৎ রেল শ্রমিকদের অন্তত দুঘন্টার জন্য প্রতীক ধর্মঘট করার জন্যও অনুপ্রেরণা দেয় নি। এসব ক্ষেত্রে নেতৃত্ব আসতে হবে নিউ ট্রেড ইউনিয়ন ইনিশিয়েটিভের মত উদ্যোগের কাছ থেকে। মূল স্রোতের বাম দলগুলির “বিক্ষুব্ধ”-দের এবং “বিপ্লবী” বাম দলগুলিকে, ট্রেড ইউনিয়নে কাজ করাকে কেন্দ্রীয় কাজ হিসেবে দেখতে হবে। এই সব রকম শক্তির ঐক্য থেকেই গড়তে হবে বিকল্প, প্রকৃত বামপন্থী জোট।
টীকা
১. Rosa Luxemburg, The Mass Strike, in M.A. Waters (Ed), Rosa Luxemburg Speaks, New York, Pathfinder Press, 1980, p.205
২. দ্রষ্টব্য, Kunal Chattopadhayay, ‘The Fascist Upsurge’, http://www.radicalsocialist.in
৩. দ্রষ্টব্য, Kunal Chattopadhyay and Soma Marik, ‘ The Left Front and the United Progressive Alliance(2004), http://www.radicalsocialist.in
৪. দ্রষ্টব্য, Kunal Chattopadhyay ‘A First Assesment of Indian Strike: To Break Their Haughty Power’, http:internationalviewpoint.org
৫. দ্রষ্টব্য, Class struggle versus Serving the Rulers and Becoming Regional Linguistic Chauvinist : The Retreat of CITU in the coming General Strike, http://www.radicalsocialist.in/blog
৬. http://www.firstpost.com/india/bharat-bandh-live-maruti-suzuki-workers-to-join-strike- tomorrow-632059.html
৭. দ্য টেলিগ্রাফ, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১২।
৮. J. Dennis, Rajakumar and John S. Henley, ‘Growth and persistence of large Business Groups in India,’ journals.hil.unb.ca/index.php/JCIM/article/download/5676/6681
৯. Meenakshi Rajeev, Contract Labour Act in India : A Pragmatic View, http://www.igidr.ac.in/pdf/publication/pp-062-33.pdf.
১০. http://labourbureau.nic.in/CPI_Prices.htm
১১. http://www.ifpri.org/publication/2011-global-hunger-index
১২. Sunny Jose and K. Naraneethem, ‘A Factsheet on Women’s Malnutrition in India’, http://www.jstor.org.stable/40277858
১৩. http://www.iiap.res.in/files/Visaka vs Rajasthan_1977.pdf
১৪. http://www.business-standard.com/article/current-affaires/trade-unions-strike-hits-normal-life- inodisha-113022000740-1.html
১৫.hhhhttp://www.livemint.com/Politics/PAVKmFkOoAnwenQZUX4ubP/Strike-paralyses-bank- industry-for-second-day.html
১৬. http://www.thehindubusinessline.com/industry-and-economy/logistics/major-porrts-suffer-rs- 100cr-loss-as-strike hits-operrations/article 4439447.ece? homepahe = true & rf = wl_home
১৭. http://www.radicalssocialist.in/articles/statement-radical-socialist/news/489 & http://kafila.org/2012/07/19
১৮. http://www.the hindu.com/opinion/op-ed/article2490903.ece
১৯. ঐ
২০. http://www.assocham.org/prels/shownews.php? Id = 3908
২১. http://oica.net/wp-content/uploaads/all-vehicles-2010-provisional.pdf
২২. http://www.ndtv.com/article/technology/mobile-device-sales-in-india-to-reach-231-mn-152315
২৩. http://articles.economictimes.indiatimes.com/2011-08-31/news/29949477-1-indian-pc-market- india-pc-first-tablet-computers.
সমাজতন্ত্র ও পরিবেশ
- Details
-
Published on Saturday, 25 May 2013 16:47
সমাজতন্ত্র ও পরিবেশ
অমিতাভ বসু
পরিবেশবাদীরা অনেকে মনে করেন, মার্ক্সবাদ একটি উৎপাদনসর্বস্ব মতাদর্শ এবং পরিবেশ সম্পর্কে তার না আছে চিন্তা, না আছে বিশেষ বক্তব্য। একথা মনে করার কারণ হল, বিংশ শতাব্দীতে মার্ক্সবাদের নামে প্রধান যে রাজনীতি চলেছিল, সেই স্তালিনবাদের প্রকোপ। স্তালিনবাদী রাজনীতি ভারতেও কীভাবে পরিবেশকে অবহেলা করেছে তার যথেষ্ট নজীর আছে। কার হাতে প্রযুক্তি, সেটাই তাদের মতে শেষ কথা। অর্থাৎ, নিউক্লিয়ার প্রযুক্তির মধ্যে সমস্যা নেই, যদি “সমাজতন্ত্রীরা” ঐ প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ করেন। তাই চের্নোবিলের ভয়ংকর দুর্ঘটনার পর যখন কলকাতায় অ্যান্টি নিউক্লিয়ার ফোরামের পক্ষ থেকে মিছিল ডাকা হয়, তখন সেই মিছিলকে ঘিরে রেখেছিল মিছিলের চেয়ে বহুগুণ বড় এক পুলিশ বাহিনী, যাদের মোতায়েন করেছিল বামফ্রণ্ট সরকার।
মার্ক্স-এঙ্গেলসের রচনা দেখলে বোঝা যায়, তাঁরা ঐ ধরণের চিন্তা করতেন না। কিন্তু সমালোচকরা অনেকেই ধরে নিয়েছেন মার্ক্স-এঙ্গেলস পুঁজিবাদের অর্থবহ বিশ্লেষণ করলেও পরিবেশের উপর পুঁজিবাদের বা প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে চিন্তা করেন নি। তাঁরা নাকি মনে করেছিলেন, একবার প্রযুক্তি শ্রমিক শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে এলে সমগ্র মানবজাতির স্বার্থে তার সীমাহীন সম্প্রসারণ ঘটানো সম্ভব। মার্ক্সের এই তথাকথিত ধারণাকে বলা হয়েছে, “প্রমেথীয়” ধারণা। গ্রীক ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী প্রমেথিউস নামে এক “টাইটান” বা দৈবশক্তি দেবরাজ জিউসের কাছে থেকে প্রযুক্তি ও অগ্নি চুরি করে মানুষকে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ প্রযুক্তিই উন্নতির ও সভ্যতার সোপান, এই নাকি মার্ক্সের মত। বিগত কয়েক দশকে, বিশেষত জন বেলামি ফস্টার ও পল বার্কেটের রচনার ফলে এ নিয়ে ভিন্ন মত দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে আলোচনা আজকের যুগে প্রচন্ড জরুরী, নিছক ইতিহাসের খাতিরে নয়, ভবিষ্যতের প্রয়োজনে। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের গোড়ার দিকের কল্পনাসমূহের বিপরীতে দাঁড়িয়ে মার্ক্স-এঙ্গেলস এক সময়ে বলেছিলেন, ভবিষ্যতের সমাজ কেমন হবে, তা নিয়ে অনুমান করা আমাদের কাজ নয়। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে সমাজতন্ত্রের নামে এমন বহু রাষ্ট্র ও অর্থনীতি ও সমাজ দেখা দিয়েছে যেগুলি বাস্তবে শ্রমিক শ্রেণীর ও অন্য শোষিত মানুষের স্বার্থ বিরোধী। আজও চীনে, উত্তর কোরিয়াতে সমাজতন্ত্রের নামাবলী জড়িয়ে কোথাও উগ্র পুঁজিবাদী বিবর্তন ঘটেছে, কোথাও পারিবারিক শাসন চালু রয়েছে। তাই আজকের দিনে বিংশ শতাব্দীর অভিজ্ঞতার আলোকে বলা দরকার, সমাজতন্ত্র বলতে আমরা কী বুঝি ? তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল, সমাজতন্ত্র মানুষ ও পরিবেশের মধ্যে সম্পর্ককে কীভাবে দেখছে বা দেখবে ?
এখানে সর্বাগ্রে বলা দরকার, ধ্রুপদী মার্ক্সবাদকে দৈববাণী বলে মনে করার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু মার্ক্সবাদের বিশ্লেষণ ও চিন্তাপদ্ধতি মানুষ ও প্রকৃতির আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে এমন অন্তর্দৃষ্টির সুযোগ দেয়, যা বায়োস্ফিয়ারে আমাদের স্থান বুঝতে খুবই সাহায্য করে।
মার্ক্স-এঙ্গেলস সমাজতন্ত্র/সাম্যবাদ বলতে যা বুঝতেন, তার গোড়ার কথা হল উৎপাদকরা স্বাধীনভাবে একজোট হয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজের ভবিষ্যত গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করবেন।১ যে শ্রমিক-কৃষকরা বিপ্লব সংঘটিত করবেন, তাঁরাই বিপ্লবের ফল ভোগ করবেন। অর্থাৎ, তাঁরা গণতান্ত্রিকভাবে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থে অর্থনীতি ও সমাজের গতি নির্ধারণ করবেন। এমন এক সমাজ নির্মিত হবে যেখানে উৎপাদন হবে মানুষের প্রয়োজনের ভিত্তিতে, মুনাফার স্বার্থে নয়।
১৯২০-এর দশকের শেষ থেকে শুরু হয় স্তালিনীয় প্রতিবিপ্লব। ১৯৩০-এর দশকে এক পার্টি-রাষ্ট্রভিত্তিক আমলাতন্ত্র ক্ষমতা দখল করে।২ এর পর সমাজতন্ত্রের তকমা এঁটে যত দেশই দেখা দিক না কেন,কিউবার আংশিক ব্যতিক্রম ছাড়া সবক্ষেত্রেই আমলাতান্ত্রিক পার্টি অর্থনীতি পরিচালনা করছে। এই দেশগুলির অর্থনীতিতে পুঁজির শাসন অক্ষত ছিল না। কিন্তু একটি পরজীবি আমলাতন্ত্র শ্রমিকের উৎপাদনে থাবা বসাতো। যেহেতু গণতন্ত্র ছিল না, তাই আমলাতন্ত্র “পরিকল্পনা” নামে উপর থেকে যা চাপিয়ে দিত, তার পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতিরও হিসেব করা হত না। প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতা ও বিশ্ববিপ্লবের দিশা ছেড়ে এল জাতীয়তাবাদ, “এক দেশ সমাজতন্ত্র” তত্ত্বের নামে আমলাতন্ত্রের স্বার্থরক্ষার কর্মসূচী। ফলে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির সঙ্গে প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়ন, পরে চীন, পাশ্চাত্যের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সমতার চেষ্টায় যে পথ ধরেছিল, তা পরিবেশ ধ্বংসকারী।৩
এই কারণে, আমরা প্রথমে মার্ক্স ও অন্য মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদের পরিবেশ চিন্তা সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করব।
শিল্পায়ণ, বিশ্ব উষ্ণায়ন ও সাম্যবাদ
যদি পৃথিবীর গড় তাপ আজকের চেয়ে ৬ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড বেড়ে যায়, যার প্রবল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তাহলেও বহু লক্ষ, এমন কি বহু কোটি বছর পর এই গ্রহে নতুন প্রাণের উদ্ভব সম্ভব, বায়োডাইভারসিটিও ফিরতে পারে। কিন্তু তা হবে মানুষের ধরা ছোঁয়া এমন কি কল্পনারও বাইরে। পার্মিয়-ট্রায়াসিক যুগে, অর্থাৎ ২৫ কোটি বছরেরও বেশী আগে, প্রায় ৯৫ শতাংশ প্রাণ (উদ্ভিদ, পশু সবই) ধ্বংস হয়ে যায়। পৃথিবীর বায়োডাইভারসিটি তার পুরোনো স্তরে ফিরতে পেরেছিল ৫ কোটি বছর পরে। বিশ্ব উষ্ণায়ণ হলে সভ্যতা ভেঙে পড়বে। এবং তার ফলে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু হবে। শুধু তাই নয়, দ্রুত পরিবেশ পরিবর্তনের ফলে ৫০ থেকে ৯০ শতাংশ প্রজাতির মৃত্যু হবে।
এক শতাব্দীর বেশী আগে ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস শ্রেণীবিভক্ত সমাজে স্বল্পমেয়াদী স্বার্থসিদ্ধি ও তার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা উদ্রেকের নিবিড় আন্তঃসম্পর্ক ব্যাখ্যা করেছিলেন। “আমরা মানুষরা প্রকৃতির উপর যে বিজয় অর্জন করেছি তা নিয়ে নিজেদের বেশী পিঠ চাপড়ানি দেওয়ার দরকার নেই। প্রতিটি বিজয়ের জন্য প্রকৃতি আমাদের উপর প্রতিশোধ নেয়। একথা ঠিক যে প্রতিটি বিজয় প্রথমত, আমরা যে ফল চেয়েছিলাম, তা এনে দিয়েছে; কিন্তু দ্বিতীয়ত এবং তৃতীয়ত, ভিন্ন, অপ্রত্যাশিত ফল দেখা দিয়েছে, যা অনেক ক্ষেত্রে প্রথমটির নেতি ঘটিয়েছে। মেসোপটেমিয়া, গ্রিস, এসিয়া মাইনর ও অন্যত্র যারা বনভূমি ধ্বংস করে কৃষিযোগ্য জমি সংগ্রহ করেছিল, তারা স্বপ্নেও ভাবেনি যে বনের সঙ্গে জল সংগ্রহের কেন্দ্র বা আর্দ্রতার ভান্ডার সরিয়ে তারা ঐ দেশগুলির বর্তমান হতাশ পরিস্থিতির ভিত্তি স্থাপন করছে। আল্পসের ইতালীয়রা যখন উত্তরের ঢালে সযত্নে রক্ষিত পাইন বনগুলিকে দক্ষিণের ঢাল থেকে কেটে সাফ করে, তখন তারা জানত না যে এর ফলে তারা বছরের বড় সময়ের জন্য তাদের পার্বত্য ঝর্ণাগুলির জল কেড়ে নিচ্ছে। তার ফলে আবার বর্ষাকালে আরো তীব্রভাবে তাদের জলধারা সমতলভূমিরতে আসতে থাকে.....। এইভাবে, প্রতি পদক্ষেপে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, যে আমরা প্রকৃতির উপর সেইরকম শাসন চালাই না, যা চালায় কোনো বিজয়ী এক বিদেশী জাতির উপর, যেন আমরা প্রকৃতির বাইরে দাঁড়িয়ে। বরং আমরা, আমাদের রক্ত, মাংস ও মগজ সহ, প্রকৃতির অঙ্গ; আমরা তার মাঝেই বিদ্যমান, এবং আমরা তার উপর প্রভুত্ব করার যে কথা বলি, তার বাস্তবতা এইটুকুই, যে অন্য সব প্রাণীর তুলনায় আমাদের সুবিধ্ আমরা তার নিয়মাবলী শিখতে ও সার্থকভাবে প্রকাশ করতে পারি।”৪
মানুষের কাজের দীর্ঘমেয়াদী ফল কী হতে পারে মানুষ কেন তাকে যথাযথভাবে দেখে নি ? এর কারণ হল, শ্রেণীবিভক্ত সমাজে, একদিকে রয়েছে শাসক শ্রেণী, যাদের কাছে গচ্ছিত আছে জ্ঞান (অন্তত সাধারণভাবে), অথচ যারা সেই জ্ঞানকে ব্যবহার করতে চায় নিছক তাদের শ্রেণীস্বার্থে; আর অন্যদিকে শ্রমজীবি মানুষ, যারা বিকল্প চায়, কিন্তু বিকল্প কোন পথে, সে সম্পর্কে সব সময় তাদের ধারণা স্বচ্ছ নয়। এই কারণে, শাসক শ্রেণী বিরোধী বিদ্রোহ-বিপ্লবকে অনেক ক্ষেত্রেই কুক্ষিগত করে নতুন উদীয়মান উচ্চবর্গীয়রা। এই পদ্ধতিতেই, ইউরোপে সামন্ততন্ত্র বিরোধী লড়াইয়ে শ্রমিক, ক্ষেতমজুর, ছোটো চাষী, এরা সকলেই সামিল হলেও, নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়েছিল বুর্জোয়া শ্রেণী। আর বুর্জোয়া শ্রেণী ক্ষমতা দখল করার ফলে দীর্ঘমেয়াদী ফল বিশ্লেষণ করার চেষ্টা আরো সরে গেল।
বিখ্যাত বুর্জোয়া (সংস্কারপন্থী, এবং যে সব বামপন্থীরা বুর্জোয়া ববস্থার মধ্যেই শ্রমিকের কর্মসংশ্থান, রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ, এ সবের স্বপ্ন দেখেন তাঁদের গুরু) অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনসের এক প্রসিদ্ধ উক্তি হল, “in the long run we will all be dead”। অর্থাৎ, বেশী দীর্ঘমেয়াদী ফলের কথা ভেবে কী হবে ? আমরা তো সবাই একদিন মরব।
ধনতন্ত্রের বিকাশের ফলে, প্রতিটি পুঁজিপতি অন্য প্রতিটি পুঁজিপতির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। সবচেয়ে কম ব্যয়ে উৎপাদন করে কীভাবে মুনাফার হার বৃদ্ধি ও পুঁজি সঞ্চয় করা যায়, তাই হয় তাদের একমাত্র লক্ষ্য। ফলে তারা একই সঙ্গে নির্মম আঘাত হানে শ্রমিকের উপর এবং পরিবেশের উপর। আমরা আবার এঙ্গেলসের রচনার দিকে তাকালে দেখতে পাব তিনি লিখেছিলেনঃ
শাস্ত্রীয় পোলিটিক্যাল ইকনমি, যা হল বুর্জোয়া শ্রেণীর সমাজবিজ্ঞান, তা উৎপাদন ও বিনিময়ের ক্ষেত্রে মানুষের কাজের সামাজিক প্রভাবগুলিকে ততটুকুই পরীক্ষা করে দেখে, যতটুকু বাস্তবে চাওয়া হয়েছে। এই তত্ত্ব যে সামাজিক সংগঠনের তত্ত্বগত বহিঃপ্রকাশ, তার সঙ্গে এই দৃষ্টিভঙ্গি খাপ খেয়ে যায়। ব্যক্তি পুঁজিপতি যেমন তাৎক্ষণিক লাভের জন্যই উৎপাদন আর বিনিময়ে লিপ্ত হয়, তেমনি [এই সমাজবিজ্ঞানে] তাই কেবলমাত্র সবচেয়ে নিকটবর্তী, সবচেয়ে তাৎক্ষণিক ফলাফলগুলিকেই হিসেবের মধ্যে নেওয়া হয়। একজন ব্যক্তি উৎপাদক বা বণিক যতক্ষণ উৎপাদিত বা ক্রয় করা পণ্য তার সাধারণ কাম্য মুনাফায় বিক্রি করতে পারে, ততক্ষণ সে খুশী থাকে। সে ভাবে না, ঐ পণ্য আর তার ক্রেতাদের এর পরে কী হবে? একই কথা প্রযোজ্য, ঐ একই কাজের পরিবেশগত প্রভাবের প্রতি। কিউবাতে স্পেনদেশীয় কুঠিয়ালদের কী এসে গিয়েছিল, যারা পাহাড়ের ঢালে জঙ্গল পুড়িয়ে যে ছাই পেয়েছিল তা দিয়ে এক প্রজন্মের মত ভীষণ লাভজনক কফি গাছের মতো সার পেয়েছিল, তাদের কী এসে গিয়েছিল যে এর পর ভারী ক্রান্তিয় বর্ষা জমির উপরিতল ধুয়ে নিয়েছিল, আর রেখে গিয়েছিল কেবল ন্যাড়া পাথর। যেমন সমাজের প্রেক্ষিতে, তেমনই প্রকৃতির প্রেক্ষিতে, বর্তমান উৎপাদন ব্যবস্থা প্রধানত চিন্তা করে কেবল তাৎক্ষণিক, সবচেয়ে হেতেনাতে পাওয়া যায় এমন ফলের জন্য।৫
আজকের জগতে মানুষের এবং সেই সঙ্গে বর্তমানে জীবিত বহু প্রজাতির বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যক হল আবহাওয়া পরিবর্তনের (Climate Change) যে সার্বিক সংকট ঘনীভূত হয়েছে, তাকে ঠেকানো। আমরা বর্তমান প্রবন্ধের পরিপূরক, অন্যান্য কয়েকটি প্রবন্ধে সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। এই মুহুর্তে আমাদের দাবী যে যে কাজ করলে, যে যে নতুন পথ নিলে, বিপজ্জনক পরিবর্তন বন্ধ হবে, তার প্রযুক্তি ইতিমধ্যেই মানুষের করায়ত্ব। তাহলে কেন সে সব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না ? তার কারণ ধনতন্ত্র। টাকা নেই বলে নয়, সমাধান নেই বলেও নয়, আমাদের বিদ্যমান সামাজিক সম্পর্ক, সর্বাগ্রে উৎপাদন সম্পর্ক, তা চায় না বলেই পদক্ষেপগুলি নেওয়া হচ্ছে না। ১৯২৬ সালে ত্রৎস্কি লিখেছিলেনঃ
“আমার একটা সময়ের কথা মনে আছে, যখন মানুষ লিখেছিল বিমান আবিষ্কারের ফলে যুদ্ধের অবসান ঘটবে, কারণ তা গোটা জনসমষ্টিকে সামরিক কাজের আওতায় টেনে আনবে, গোটা দেশের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে, ইত্যাদি। বাস্তবে কিন্তু বাতাসের চেয়ে ভারী উড়ন্ত যান আবিষ্কার সমরবাদের ইতিহাসে এক নতুন ও নিষ্ঠুরতর অধ্যায়ের সূচনা ঘটালো।....প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের নিজস্ব যুক্তি রয়েছে – প্রকৃতিকে জানার যুক্তি এবং তাকে মানুষের স্বার্থে ব্যবহার করার যুক্তি। কিন্তু প্রযুক্তিকে সমরবাদী বা শান্তিবাদী কোনোটাই বলা যাবে না। যে সমাজে শাসক শ্রেণী সমরবাদী, সেখানে প্রযুক্তি সমরবাদের সেবাতেই লাগে”।৬
ধনতন্ত্রের একমাত্র চিন্তা হল ক্রমাগত অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ভিত্তিতে মুনাফা বাড়ানো। ফলে ধনতন্ত্র মানুষকে প্রকৃতির থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। সে জমিকে ব্যক্তি মালিকানায় এনেছে, সমস্ত কিছুকে পণ্যে পরিণত করেছে। এমনকি দূষণও আজ পণ্য। যে দেশ অনগ্রসর তাই তার শিল্প দূষণ কম, তাকে দূষণ দিয়ে তার বিনিময়ে ডলার- ইউরো দিচ্ছে পুঁজিবাদ। মানুষকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার এই প্রক্রিয়াকে সনাক্ত করে মার্ক্স লিখেছিলেনঃ
“খামারের মালিক, শিল্পপতি ও ক্ষেতমজুর, কেউ যে জমিকে ব্যবহার করে তার সঙ্গে যুক্ত নয় এমন মালিক বা শ্রমিক যে ফ্যাক্টরীতে সুতিবস্ত্র বা পশম উৎপাদন করে সেই ফ্যাক্টরীরর সঙ্গে যুক্ত নয়। তারা টান অনুভব করে কেবল তাদের উৎপাদনের মূল্যের প্রতি”।৭
এই কারণে, আমাদের গ্রহকে যদি তার বর্তমান অবস্থায়, বর্তমান প্রাণীজগতকে নিয়ে বাঁচতে হয়, তাহলে পুঁজিবাদের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব অনিবার্য। ধনতন্ত্র যেহেতু ক্রমাগত বাড়তে চায়, তাই তার ক্রমাগত বেশী শক্তি দরকার, দরকার অজস্র কাঁচামালের। পুঁজিবাদীরা যদিও দাবী করে, তারা অধিক দক্ষ ভাবে কাঁচামাল ব্যবহার করছে, তবু বর্জ্য পদার্থ বেড়েই চলেছে। শিল্পোন্নত দেশগুলির অর্থনীতি সম্পর্কে ২০০০ সালে পাঁচটি বড় গবেষণা কেন্দ্রের গবেষমা থেকে দেখা যাচ্ছে, সম্পদ ব্যবহার বাড়ছে, কমছে না, এবং অর্থনীতিতে বার্ষিক যত সম্পদ প্রবেশ করছে তার অর্ধেক থেকে তিন চতুর্থাংশ এক বছরের মধ্যে বর্জ্য পদার্থ হিসেবে পরিবেশে ফিরে আসছে।৮
ধনতন্ত্র মানুষ ও পৃথিবী উভয়কেই শোষণ করে, উভয়ের স্বার্থকেই জলাঞ্জলি দেয় মুনাফার লোভে। ধনতন্ত্র এমন এক সর্বগ্রাসী ব্যবস্থা, যে এই ব্যবস্থার উচ্ছেদ না করলে ব্যক্তিগতভাবে একজন যতই পরিবেশবন্ধু হতে চান না কেন, তাঁকে পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতেই হবে। গান্ধী চেয়েছিলেন, এবং মদৎ দিয়েছিলেন, নেচারোপ্যাথিকে। মানুষের দেহ, প্রকৃতির সঙ্গে তার সম্পর্ক, পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে দেহের উপযোগী খাদ্য সরবরাহ, চিকিৎসা, ইত্যাদি তারা মূল কথা। বাস্তবে কী হয় ? পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নেচারোপ্যাথি পরিণত হয় একরকম বাণিজ্যে। আর তার সঙ্গে যুক্ত হয় পুঁজিবাদের অন্যান্য অঙ্গ। তাই প্রবল অনিয়ম অত্যধিক মদ্যপান, বিপুল পরিমাণ মাংস ভক্ষণ, সাপ্তাহিক “পাটি”-র পর দেহ যখন টক্সিনে (বিষাক্ত পদার্থ) পরিপূর্ণ হয়ে যায়, তখন “ডি-টক্সিফিকেশন” (বিষ তাড়ানো)-এর জন্য বহু মানুষ বিপুল অর্থব্যয় করে কোলোন হাইড্রোথেরাপী, নিয়মিত জীবন যাপন, নিরামিষ ও কম তেলের রান্না খাওয়া, ব্যায়াম করা, এ সবের জন্য ভারেতের বিভিন্ন স্থানে নেচারোপ্যাথি কেন্দ্রে জান এবং হাজার হাজার টাকা ব্যয় করেন।
উপরের উদাহরণ গান্ধীবাদের “ব্যর্থতা” প্রমাণের জন্য দেওয়া হয় নি। আমাদের বক্তব্য ধনতন্ত্র যে বিচ্ছিন্নতা ঘটায় এবং যে মুনাফা সর্বস্ব দর্শনকে প্রাধান্য দেয়, তার ফলে যে কোনো সমাধানই অসম্পূর্ণ, যতক্ষণ ধনতন্ত্র অক্ষত থাকছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে ধনতন্ত্রকে উচ্ছেদ করা পর্যন্ত পরিবেশের দিকে আমরা তাকাবো না।
ক্যাপিটাল, ১ম খন্ডে পুঁজিবাদ যে বিচ্ছিন্নতা ঘটায় সে বিষয়ে মার্ক্স আলোচনা করেছেনঃ
ধনতান্ত্রিক উৎপাদন.... মানুষ ও পৃথিবীর মধ্যে Metabolic আদান-প্রদানে ব্যাঘাত ঘটায়; অর্থাৎ, মানুষ খাদ্য বস্ত্ররূপে জমির যে সব উপাদান গ্রহণ করেছে, সেগুলিকে জমিতে ফিরে যাওয়ার পথে বাধা দেয়। তার ফলে ধনতন্ত্র জমির ধারাবাহিক উর্বরতা রক্ষার শর্তাবলীকে লঙ্ঘন করে....। শ্রম প্রক্রিয়াসমূহের সামাজিক সংযোগ ও সংগঠন পর্যবসিত হয় শ্রমিকের ব্যক্তিগত প্রাণশক্তি মুক্তি ও স্বাধীনতাকে চুরমার করে দেওয়ার এক সংগঠিত পদ্ধতিতে ....। উপরন্তু ধনতান্ত্রিক কৃষিতে সব প্রগতিই হল একাধারে শ্রমিক এবং জমি, উভয়কেই লুন্ঠন করে এমন এক বিদ্যার প্রগতি। একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জমির উর্বরতাবৃদ্ধিতে যত প্রগতি, তা হল দীর্ঘমেয়াদী ভাবে ঐ উর্বরতা বিনষ্ট করার উৎসের দিকেো প্রগতি। একটি দেশ যত তার বিকাশের সূচনা করবে আধুনিক শিল্পের ভিত্তিতে যেমন করেছে, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মার্কিন পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রযুক্তির বিকাশ ঘটায়.... কেবল সব সম্পদের মূল উৎস, অর্থাৎ জমি ও শ্রমিক, তাদের শুষে নিয়ে”।৯
এ থেকে বোঝা যায়, মার্ক্স-এঙ্গেলস উৎপাদন সর্বস্ব দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করেন নি। মানুষ ও প্রকৃতির পাস্পরিক সম্পর্কের বিষয়ে মার্ক্স উক্তি করেছিলেন যে প্রকৃতি যেখানে মানব দেহ নয়, সেখানে প্রকৃতি মানুষের অজৈব দেহ। মানুষ প্রকৃতির দ্বারাই জীবনধারণ করে, এবং প্রকৃতির সঙ্গে ধারাবাহিক কথোপকথন তাকে চালাতেই হবে। “মানুষের শারীরিক ও মানসিক জীবন প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত, এ কথা বলার অর্থ কেবল, প্রকৃতি নিজের সঙ্গে যুক্ত, কারণ মানুষ প্রকৃতির একটি অঙ্গ।”১০
মানবদেহ পরিবেশের উপর প্রভাব ফেলে। একই সঙ্গে পরিবেশও মানবদেহের উপর প্রভাব ফেলে। এই পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে উভয়েরই পরিবর্তন ঘটে। এই দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী, পরিবেশ নিস্ক্রিয় না। যে কোনো জীবিত প্রাণী, যাদের মধ্যে মানুষও পড়ে, মানুষের সামাজিক ক্রিয়াও পড়ে, তারা সকলে সকলের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। তারা ধারাবাহিকভাবে এতে অপরের সঙ্গে আদান-প্রদান ঘটায় এবং একে অপরকে রূপান্তরিত করে। আমরা যখন বলি, ‘ক’ প্রজাতি অমুক পরিবেশগত স্থান দখল করেছে (has occupied বা is occupying an environmental niche) তখন একটা ধারণা তৈরী হয়, যেন ঐ স্থান বা niche-টি এমনিই তৈরী ছিল, আর ঐ প্রাণীটি পথ চলতে চলতে সেটি দেখতে পেয়ে আনন্দের সঙ্গে নিজেকে সেখানে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। বস্তুত, প্রাণীদের সঙ্গে সম্পর্ককে প্রথম থেকে মাথায় না রাখলে “পরিবেশ” কথাটাই অর্থহীন। মার্ক্স-এঙ্গেলসের যৌবনের যুগ্ম রচনা দ্য জার্মান আইডিওলজি ব্যাখ্যা করেছিল, ধনতান্ত্রিক সমাজে মানুষের ক্রিয়া কেন যেকোনো প্রাণীকে তাদের পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রবণতা দেখায়।
“মাছের নির্যাস হল তার অস্তিত্ব, জল...। মিঠেপানির মাছের নির্যাস হল নদীর জল। কিন্তু ঐ পদার্থটি মাছের নির্যাস হওয়া বন্ধ হয়, অতএব তার অস্তিত্বের উপযোগী মাদ্যমে থাকে না, সেই নদীকে সিল্পের সেবায় লাগানো হয়, যেই কৃত্রিম রং এবং অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ তাকে দূষিত করে, বাষ্পীয়গোচরে যখন তার উপর দিয়ে চলে, বা যখনই তার জলকে খালে সরিয়ে দেওয়া হয়, যেখানে নিছক সেচের দ্বারা মাছকে তার অস্তিত্বের মাধ্যম থেকে বঞ্চিত করা যায়।”১১
আবহাওয়া, এবং সাধারণভাবে পৃথিবীর ইকোসিস্টেম, গতিশীল ও জটিল। বহু উপাদানের পাস্পরিক ঘাত-প্রতিঘাতের সমষ্টি হিসেবেই তাকে দেখা দরকার। প্রতিটি পরিবর্তন সব উপাদানের উপর নতুন করে প্রভাব ফেলে। এর ফলে দুটো তত্ত্বগত ধারণার উল্লেখ করা যায়। একটা হল এমন একটা মূহুর্ত আসা, যখন মৌলিক রূপান্তর ঘটে (tipping point)। অন্যটা হল গোটা সিস্টেমকে একত্রে দেখার চাহিদা। এই দুই ধারণাই কিন্তু মার্ক্সীয় দর্শনেরও কেন্দ্রীয় বিষয়ের মধ্যে পড়ে। সমাজ পরিবর্তন এবং আবহাওয়া পরিবর্তন, দুই ক্ষেত্রেই, অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে গোটা ব্যবস্থাটার উপর জোর ধাক্কা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। মানব সমাজ ও আবহাওয়া ব্যবস্থা, দুটো ক্ষেত্রেই অনেক সময়ে কোনো বাহ্য প্রতিক্রিয়া ছাড়াই চাপ জমতে থাকে। তারপর হঠাৎ যেন শূন্য থেকে দ্রুত ও তীব্র পরিবর্তন ফেটে বেরোয়। বাস্তবে কিন্তু তা শূন্য থেকে ঘটে না। ছোটো ছোটো, আপাতঃভাবে নগণ্য পরিবর্তন, যা এক দীর্ঘ সময় ধরে ঘটেছিল, তা অবশেষে ব্যাপক রূপান্তর ঘটায়। এ কথা আবহাওযা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সত্য। এ কথা সত্য বৈপ্লবিক সামাজিক রূপান্তরের ক্ষেত্রেও । দুইক্ষেত্রেই, পরিমাঙত পরিবর্তন গুণগত পরিবর্তনের জন্ম দেয়। বিজ্ঞানীদের মধ্যে গভীর চিন্তা যে গোটা পৃথিবীর আবহাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা এই রকম এর রূপান্তরের খুব কাছে দাঁড়িয়ে। সমস্য হল, সামাজিক ক্ষেত্রে যেমন কোনো রূপান্তর কাছে নেই, যাতে পৃথিবীজোড়া বিপর্যয়কে রোখা যায়।
মার্ক্স-এঙ্গেলসের পরবর্তীকালের সমাজতন্ত্র
স্তালিনবাদী প্রতিবিপ্লবের সাফল্য এখানে, যে তাকেই সমাজতন্ত্র বলে মেনে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রাক-স্তালিনবাদী ও অ-স্তালিনবাদী, এবং স্তালিনবাদ বিরোধী সমাজতন্ত্র পরিবেশ সম্পর্কে অনেক সচেতন ছিল।
মার্ক্সবাদ কোনো ধর্ম নয়, তাই কোনো আদি গ্রন্থে তার নির্যাস বন্ধ থাকে না। একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও কর্মপদ্ধতি হিসেবে তার পরিবর্তন হয়। নতুন পরিস্থিতি থেকে, নতুন জ্ঞানের ভিত্তিতে, তার বিবর্তন ঘটে। তাই পরিবেশ চিন্তার ক্ষেত্রে আরো বিভিন্ন মার্ক্সবাদী ও অন্যান্য সমাজতন্ত্রীর অবদান পর্যালোচনা করা দরকার।
১৯২০-র দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে এক বিশিষ্ট সমাজতান্ত্রিক পরিবেশবাদী সক্রিয় ছিলেন। তিনি হলেন ভ্লাদিমির ভার্নাদস্কি। বলশেভিক সরকারের সমর্থক এক অগ্রগণ্য বিজ্ঞানী ভার্নাদস্কি ১৯২২ সালের এক বক্তৃতায় পরমাণু শক্তির অপব্যবহারের বিপদ সম্পর্কে শ্রোতাদের সচেতন করেন। ১৯২৬ সালে তিনি প্রকাশ করেন তাঁর গ্রন্থ দ্য বায়োস্ফিয়ার।
প্রায় যেন মার্ক্সের অনুসরণে ভার্নাদস্কি পৃথিবী গঠনে সব রকম জৈব ও অজৈব পদার্থের যোগাযোগের কথা লেখেন। তিনি বলেন, “জীবন এইভাবে ক্রমাগত আমাদের গ্রহের উপরিতলে রাসায়নিক জাড্যের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। তা প্রকৃতির বর্ণ ও রূপ সৃষ্টি করে, পশু ও গাছ-গাছড়ার সংযোগ ঘটায়, সভ্য মানুষের সৃজনশীল শ্রম সৃষ্টি করে, এবং ভূত্বকের বিবিধ রাসায়নিক প্রক্রিয়ার অঙ্গে পরিণত হয়। ভূত্বকের এমন কোনো বড় রাসায়নিক ভারসাম্য নেই, যার উপর জীবনের প্রভাব দৃশ্যমান নয়, এবং যেখানে রসায়ন জীবনের কাজ দেখায় না। সুতরাং জীবন ভূত্বকের একটি বাহ্য বা আকস্মিক ঘটনা নয়.... সব জীবিত পদার্থকে বায়োস্ফিয়ারের কার্যপ্রণালীর একটি অখন্ড অস্তিত্ব মনে করা যায়”।১৪
সুতরাং ভার্নাদস্কির চোখে বায়োস্ফিয়ার হল বৃহত্তম ‘সিস্টেম’, যার মধ্যে পড়ে সব জীবিত ও প্রাণহীন পদার্থ। মানবসমাজ তার একটি উপ-সিস্টেম। অর্থনীতি মানব সমাজের একটি অঙ্গমাত্র, যদিও সমাজ বিবর্তনে অত্যন্ত কেন্দ্রীয় অঙ্গ। বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদদের কাছে ঘটনাটা ঠিক উল্টো। অর্থনীতিই তাদের চোখে সিস্টেম। মানব সমাজ আর পরিবেশের যেটুকু দেখার তাদের প্রয়োজন আছে, তারা সবাই তার অধীন। এই উল্টোদিক থেকে দেখার ভিত্তিতে, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে ধারণার জন্ম হয় তা হল, অর্থনীতি সীমাহীনভাবে বেড়ে চলতে পারে, এবং ধনতন্ত্রের সম্প্রসারণের কোনো সীমা নেই। এই দাবী যে মহাবিশ্বের পদার্থবিদ্যা ও জীববিদ্যা সংক্রান্ত নিয়মাবলীর বিরোধী, তা স্বীকার করা হয় না। বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির যে ব্যাখ্যা দেন, তাকে মনে হয়, ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রায় উনবিংশ শতাব্দীতে অবাস্তব বলে প্রমাণিত চিরন্তন গতি যান (perpetual motion machine)-এর নতুন সংস্করণ। তাপগতিবিদ্যার প্রথম ও দ্বিতীয় সূত্র মহাবিশ্বের মৌলিক সূত্র। অথচ, অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের ব্যবহার করলেও অর্থনীতির ক্ষেত্রে তাদের কার্যত অস্বীকার করা হয়। সে কারণে কল্পনা করতে হয় যে অর্থনীতি প্রকৃতি থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন।
মার্ক্সবাদী ঐতিহ্য ছিল ভিন্ন। তত্ত্ব ও প্রয়োগ, উভয় ক্ষেত্রেই সোভিয়েত ইউনিয়ন লেনিন, বুখারিন, লুনাচারস্কিদের দৃষ্টিভঙ্গী ছিল পরিবেশের প্রতি ইতিবাচক। ভার্নাদস্কি ছাড়াও ভাভিলভ, হেসেন ও অন্যান্য বিজ্ঞানীরা পরিবেশ নিয়ে চিন্তা করেছিলেন।
ভাভিলভ ছিলেন লেনিন কৃষি আকাদেমির প্রথম সভাপতি। গাছ, তৃণজ প্রাণ, এদের জিন-এর প্রভেদ সম্পর্কে তিনিই প্রথম বস্তুবাদী বিশ্লেষণ করেন। ভাভিলভ বলেন, মানব সংস্কৃতি সাতটি প্রধান কেন্দ্রে গড়ে উঠেছিল। সেগুলি ছিল জেনেটিক বৈচিত্র্যের কেন্দ্র। সমস্ত প্রধান শস্য ঐ কেন্দ্রগুলি থেকে উদ্ভূত। ভাভিলভের গবেষণার বহু দশক পর পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীরা বারে বারে ঐ সব কেন্দ্রগুলিতে (মেক্সিকো, পেরু, ইথিওপিয়া, তুরস্ক, তিব্বত, ইত্যাদি) গেছেন ও তথ্য সংগ্রহ করে উন্নত পুঁজিবাদী দেশের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানদের মুনাফা বাড়ানোর কাজ করেন। আজ সাম্রাজ্যবাদ ও অনুন্নত দেশগুলির মধ্যে লড়াইয়ের অন্যতম বিষয়বস্তু হল ঐ সব এলাকার জিন ব্যাঙ্ক, যা সাম্রাজ্যবাদী কৃষি-বাণিজ্য সংস্থাগুলি দখল করতে চায়, ও তাদের উপর পেটেন্ট নিতে চায়।
বুখারিন-ঘনিষ্ঠ দুই বিজ্ঞানী ডি.এল. কোমারোভ এবং বোরিস হেসেন সম্পর্কে সংক্ষেপে কথা বলা যায়। কোমারোভ এঙ্গলসের অনুসরণ করে বলেন, ব্যক্তি মালিকানা যেহেতু নিছক লাভ চায়, তাই তার কাজ কৃষিকে ধ্বংস করা। বোরিস হেসেন বিজ্ঞানের ইতিহাস চর্চা প্রসঙ্গে দেখালেন যে বুর্জোয়া বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও দর্শন যান্ত্রিক বস্তুবাদ এবং ভাববাদের মধ্যে আবর্তিত হতে থাকে।১৫
স্তালিনবাদের উত্থানের আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিবেশবাদী তত্ত্বের প্রয়োগে পৃথিবীর সবচেয়ে অগ্রণী দেশ ছিল। বিপ্লবী সোভিয়েত রাষ্ট্রই প্রথম পরিবেশবিদদের পরামর্শ শুনে অনেকটা করে জমি নিয়ে ঝাপোভেদনিকি বা প্রাকৃতিক এলাকা প্রতিষ্ঠা করে। এই অঞ্চলগুলিতে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছাড়া অন্য কোনো রকম মানব হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ ছিল। গাছ কাটা, শিকার, চাষ, বা ভ্রমণ, সবই নিষিদ্ধ ছিল।
অক্টোবর বিপ্লবের পরেই যে যে মৌলিক আইন প্রণীত হয়, তার মধ্যে অন্যতম ছিল জমি বিষয়ক আইন। এই আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি ব্যক্তিগতভাবে জমির পূর্ণ মালিকানা পেতে পারত না। তা সত্ত্বেও, দেখা গেল, বনাঞ্চলে বেআইনী গাছ কাটা, শিকার, ইত্যাদি চলছে। ১৯১৮-র মে মাসে লেনিনের উপস্থিতিতে প্রণীত হল বনাঞ্চল বিষয়ক ডিক্রী। ১৯২৩-এ গৃহীত হয় “ফরেস্ট কোড”।
১৯১৯ সালে, গৃহযুদ্ধে যখন বলশেভিকদের পরিস্থিতি সবচেয়ে সঙ্গীন, যখন লাল ফৌজ পেত্রোগ্রাদকে বাঁচাবার লড়াই লড়ছে, তখনও বলশেভিকরা পরিবেশ বিষয়ক চিন্তা ত্যাগ করেন নি। ঐ অবস্থাতেও লেনিন কৃষিবিশারদ এন.এন. পোদিয়াপোলস্কির সঙ্গে ঝাপোভেদনিক প্রতিষ্ঠা নিয়ে আলোচনা করেন এবং পোদিয়াপোলস্কিকে দায়িত্ব দেন, আইনের খসড়া রচনা করার।১৬
লালফৌজ শ্বেতরক্ষীদের পরাস্ত করার পর ১৯২১ সালে নতুন আইন প্রণীত হয়। ১৯২৪ সালে গঠিত হয় সারা রাশিয়া সংরক্ষণ সমিতি। এই সংগঠনের পত্রিকা ওখরানা প্রিরোদিতে পরিবেশ বিষয়ক তত্ত্বগত প্রবন্ধ, সংবাদ, ইত্যাদি প্রকাশ করা হত। ১৯২৪ থেকে রাশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে ইকলজির আনুষ্ঠানিক চর্চা শুরু হয়।
১৯২০-র দশকের শেষ দিক থেকে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে থাকে। প্রকৃতিকে রক্ষা করার দাবীকে “বুর্জোয়া” আখ্যা দেওয়া হয়। ঘোড়দৌড় চালিয়ে যে কোনো মূল্যে পাশ্চাত্যের ধনতান্ত্রিক দেশগুলির চেয়ে “উন্নত” অর্থনীতি তৈরী করে “এক দেশে সমাজতন্ত্র গঠন সম্পূর্ণ করার” অবাস্তব স্লোগানের ফল হল অর্থনীতি, পরিবেশ, সব কিছুতে বিকৃতি আনা। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার নামে যে আমলাতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু হল, তাতে সব প্রাণীদের অন্য চোখে দেখা হল। যেগুলি দ্রুত “সমাজতন্ত্র নির্মাণের” জন্য “উপযোগী”, তারা ভাল, বাকিদের নির্মূল করা সম্ভব।
আমরা দেখেছি, লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। এবার দেখা যাক স্বৈরতন্ত্রী নেতার সম্বন্ধে ম্যাক্সিম গোর্কীর স্তুতি।
“স্তালিন একটি পেনসিল ধরে আছেন। তাঁর সামনে রয়েছে এলাকাটির মানচিত্র। জনবর্জিত উপকূল। দূরবর্তী গ্রাম। পাথরে ঢাকা কুমারী মাটি। আদিম অরণ্য। বস্তুত, বড় বেশী অরণ্য; তা সেরা জমিকে ঢেকে রেখেছে। আর জলাভূমি। জলাভূমি সর্বদা ঝিলমিল করছে, জীবনকে করে তুলেছে ভোঁতা, অপরিচ্ছন্ন। কর্ষিত জমি বাড়াতে হবে। জলাভূমি সেচ করতে হবে......। কারেলিয় সাধারণতন্ত্র শ্রেণীহীন সমাজের স্তরে প্রবেশ করতে চায় ফ্যাক্টরী ও মিলদের প্রজাতন্ত্র হিসেবে। এবং কারেলিয় সাধারণতন্ত্র শ্রেণীহীন সমাজে প্রবেশ করবে নিজের চরিত্র পাল্টে”।১৭
স্তালিন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের পরোয়া করলেন না, যদি না তা মতাদর্শগতভাবে পার্টির শাসনকে ন্যায্যতা অর্পন করত, বা পাশ্চাত্যের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার তত্ত্বকে “সঠিক” বলে প্রমাণ করত। ফলে কোনো বিজ্ঞানীর বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ আনা হত যে তিনি “বিজ্ঞানের জন্য বিজ্ঞান” অনুশীলন করছেন, তার অর্থ হত, তিনি বুর্জোয়া, প্রতিবিপ্লবী, এবং বিধ্বংসী। তেমন ব্যক্তির জন্য জুটত বিচার, গুলাগ, মৃত্যুদন্ড।১৮ পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, পরিবেশবিদ্যা, প্রতিটি বিজ্ঞানের স্বাধীনতার দাবীকে কড়া হাতে দমন করা হয়। পরিবেশবিদ্যার ক্ষেত্রে, এর ফল হল শুধু নির্দিষ্ট কিছু বিজ্ঞানীর কারাদন্ড, নির্বাসন বা মৃত্যু নয়, গোটা সরকারী দপ্তরদের রেচন বা নিছক অবলুপ্তি। যেমন, ইউক্রেনে ১৯৩০-এর দশকে প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক সমস্ত সরকারী ও বেসরকারী (পেশাদার, স্বেচ্ছামূলক) সমিতিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। “উন্নয়ন”--এর চেয়ে পরিবেশকে গুরুত্ব দেওয়ায় অনেককে জাতীয়তাবাদী, প্রতিবিপ্লবীদের মিত্র প্রভৃতি আখ্যা দেওয়া হয়। প্রধান সংরক্ষণবাদী কমিটির এক-তৃতীয়াংশের বেশী সদস্যকে হত্যা করা হয়।
রাশিয়ার বাইরে মার্ক্সবাদ, স্তালিনবাদ ও পরিবেশ ভাবনা
মার্ক্স এবং এঙ্গেলসের পরবর্তী মার্ক্সবাদের দার্শনিক অবস্থান সবসময় প্রতিষ্ঠাতাদের গভীরতা অর্জন করতে পারে নি। এঙ্গেলস তাঁর শেষ জীবনে মার্ক্সের ডক্টরাল থিসিসের সঙ্গে আধুনিক দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের নিবিড় সম্পর্কের উপর জোর দিয়েছিলেন। রুশ বিপ্লবী অ্যালেক্সেই ভোডেন প্লেখানভের প্রতিনিধি হিসেবে এঙ্গেলসের কাছে গেলে এঙ্গেলস তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে অষ্টাদশ শতাব্দীর যান্ত্রিক বস্তুবাদীদের চেয়ে গ্রীক দার্শনিক এপিকুরাস অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ভোডেনের স্মৃতিচারণ থেকে বোঝা যায়, প্লেখানভ এঙ্গেলসের সঙ্গে একমত ছিলেন না। প্লেখানভ, কাউটস্কি প্রমুখের দর্শনে পজিটিভিজমের প্রভাব যথেষ্ট ছিল। এর প্রতিক্রিয়াতে ১৯২০-র দশকে লুকাচ, কর্শ ও গ্রামসি, এবং পরে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল, পজিটিভিজমকে ঠেকাতে গেলেন জ্ঞানতত্ত্বের ভিত্তিতে, যা ভাববাদী তত্ত্বগত অনুশীলনে জড়িয়ে পড়ল। এটা দেখা যায় এঁদের অনুগামী পাশ্চাত্য মার্ক্সবাদীরা এঙ্গেলস-এর যে সমালোচনা করেছেন তা থেকে। তাঁরা দাবী করেছেন যে এঙ্গেলসের বস্তুবাদ ছিল যান্ত্রিক, আবার তিনি নাকি হেগেল থেকে উদ্ভূত এক ভাববাদী প্রকৃতি-দর্শন মার্ক্সবাদের উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন। এ ধরণের সমালোচনা কার্যত বিজ্ঞানতত্ত্ব ও বস্তুজগৎ যে মার্ক্সীয় বিশ্ববীক্ষার অঙ্গ হতে পারে তাকেই অস্বীকার করে।
পাশ্চাত্য মার্ক্সবাদে কেউ বিজ্ঞানকে গুরুত্ব দেন নি, তা নয়। ১৯৩০-এর দশকে, স্তালিনবাদের উত্থান এবং কমিউনিস্ট পার্টির উপর তার সর্বময় কর্তৃত্ব সত্ত্বেও কিছু কমিউনিস্ট ঘেঁষা বিজ্ঞানী উল্লেখযোগ্য কাজ করেন। ১৯৩১ সালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাসের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বুখারিন, ভাভিলভ ও হেসে্নের উপস্থাপনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জন বার্নাল এবং জোসেফ নীডহ্যাম বিজ্ঞানের ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক ও বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করেন। জন বানার্ড স্যান্ডারসন হ্যালডেন সোভিয়েত জীবরসায়নবিদ ওপারিনের সঙ্গে সমান্তরাল (কিন্তু স্বাধীনভাবে) প্রাণহীন জগতে প্রাণের উদ্ভবের প্রথম প্রকৃত বস্তুবাদী ব্যাখ্যা করেন। আজ এই তত্ত্ব ওপারিন-হ্যালডেন তত্ত্ব নামে খ্যাত।
কিন্ত পাশ্চাত্যের মার্ক্সবাদে সে যুগের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চিন্তাবিদের অবদান বিস্মৃতপ্রায়। এই চিন্তাবিদ এক তরুণ, ক্রিস্টোফার সেন্ট জন স্প্রিগ, যিনি তাঁর ছদ্মনামেই বেশী পরিচিত -- ক্রিস্টোফার কডওয়েল। ১৯৩৭ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধে ফ্যাসীবাদীদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে তিনি শহীদের মৃত্যু বরণ করেন। এর আগে, মাত্র দুবছরের (১৯৩৫-১৯৩৬) মধ্যে, তিনি রচনা করেন ইলিউশন অ্যান্ড রিয়্যালিটি, স্টাডিজ অ্যান্ড ফার্দার স্টাডিজ ইন আ ডাইং কালচার, দ্য ক্রাইসিস ইন ফিজিক্স, রোম্যান্স অ্যান্ড রিয়্যাকশন, এবং হেরেডিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট। সবই প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পরে। স্তালিনবাদী প্রভাব তাঁকে কোথাও স্পর্শ করে নি, এমন কথা বলা যায় না। কিন্তু কডওয়েল একটি মৌলিক সত্য বুঝেছিলেন। “স্টাডিজ অ্যান্ড ফার্দার স্টাডিজ” এর মুখবন্ধে তিনি উক্তি করেছিলেন, “হয় শয়তান স্বয়ং মহা শক্তি ধারণ করে আমাদের মধ্যে নেমে এসেছে, নচেৎ অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও শিল্পের মধ্যে সাধারণ এক রোগের কোনো কার্যকারণ ভিত্তিক ব্যাখ্যা রয়েছে।”১৯
কডওয়েল বুর্জোয়া সমাজে সবরকম চিন্তার মধ্যে এক সাধারণ সমস্যা বা রোগ দেখেছিলেন, যা হল প্রতিটি ক্ষেত্রের আপাতঃ স্বয়ংসম্পূর্ণতার দাবীর আড়ালে প্রত্যেকটি খন্ডের বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব। প্রকৃতি ও সমাজের মধ্যে ভেদরেখা, ভাববাদ ও যান্ত্রিকতার আপাতঃ বিভেদ, ইত্যাদি তার চারিত্রিক গঠনের অঙ্গ। এই দ্বৈতবাদ, এ একপেশে যুক্তিসর্বস্বতা হল বুর্জোয়া সমাজের আত্মরক্ষার প্রয়াস, একটি মূমূর্ষূ সংস্কৃতির নিজেকে বাঁচাবার লড়াইয়ের অঙ্গ।
এ প্রসঙ্গে কডওয়েল নিজে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হলেও, স্তালিনবাদী “দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের” জ্ঞানতত্ত্বকে আক্রমণ করেন। তিনি মনে করেছিলেন, মার্ক্সের বস্তুবাদ ছিল সক্রিয় ও দ্বান্দ্বিক, এবং তা যে পূর্ববর্তী যান্ত্রিক বস্তুবাদের উর্দ্ধে উঠতে পেরেছিল, তার কারণ অংশত বিবর্তনবাদী তত্ত্ব, এবং বিজ্ঞানের মধ্যে তা যে অধিকতর বস্তুবাদী ও দ্বান্দ্বিক সংহতি এনে দিয়েছিল। এই ধারণা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছিল হেরেডিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এ। কিন্তু এই রচনাটি ১৯৮৬ পর্যন্ত, অর্থাৎ অর্ধ-শতাব্দীর জন্য, অপ্রকাশিত থাকে।
এই অসাধারণ রচনাতে কডওয়েল জীববিদ্যায় উদ্ভূত সংকটের জ্ঞানতাত্ত্বিক এবং মতাদর্শগত সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। ঐ সংকটের কারণ ছিল ডারউইনবাদী তত্ত্বের সংকট, নয়া-লামার্কবাদের উত্থান, এবং জেনোটিকসের বিকাশ। কডওয়েলের বিশ্লেষণে ত্রুটি রয়েছে। কিন্তু পরবর্তী বেশ কয়েক দশকের মার্ক্সবাদী তত্ত্বের চেয়ে তা অনেক অগ্রসর ছিল। তিনি বলেন, প্রাণী ও পরিবেশের মধ্যে সম্পর্কটা যে একটা সম্পর্ক, তার অর্থ হল, এরা একে অপরকে প্রভাবিত করে এবং এরা যুক্ত থাকে বস্তুগত রূপান্তরের সঙ্গে। এই রচনায় তিনি নয়া-লামার্কবাদকে আক্রমণ করেন। তার মধ্যে ছিল ত্রোফিম লাইসেঙ্কোর নেতৃত্বে স্তালিনবাদী মেকী-জীববিদ্যার উপর সরাসরি আক্রমণ। এই কারণেই হেরেডিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অপ্রকাশিত থেকে যায়।
অবশ্যই, বর্তমান প্রবন্ধে আমরা পরিবেশ রক্ষার আজকের লড়াইয়ের প্রসঙ্গসমূহে সরাসরি আসি নি। কিন্তু আমরা দেখেছি, স্তালিনবাদী প্রতিবিপ্লবের আগে, মার্ক্সবাদের মধ্যে পরিবেশ ও শ্রেণী সংগ্রামকে যুগ্মভাবে দেখা্র, এবং পরিবেশ রক্ষাকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচীগত উপাদান হিসেবে দেখার চেষ্টা ছিল। আজকের সমস্যার দিকে যখন তাকাব, তখন আমরা ঐ মার্ক্সবাদী উপকরণগুলি ব্যবহার করে বিশ্লেষণ করতে পারি।
টীকা
১. ধ্রুপদী মার্ক্সবাদের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের জন্য দেখুন Soma Marik, Reinterrogating the Classical Marxist Discourses of Revolutionary Democracy, Aakar Books, Delhi, 2006. স্তালিনবাদের উত্থান ঐ গ্রন্থে সংক্ষেপে আলোচিত হযেছে। স্তালিনবাদ কীভাবে সাম্যবাদী আন্দোলনের গণতান্ত্রিক মর্মবস্তুকে ধ্বংস করেছে সে প্রসঙ্গে দেখুন Tariq Ali (Ed), The Stalinist Legacy, Penguin, Harmondsworth, 1984.
2. স্তালিনবাদ কীভাবে পরিবেশ ও বিজ্ঞান বিরোধী ছিল, সে প্রসঙ্গে দেখুন Zhores Medvedev, Nuclear Disaster in the Urals, W.W Norton & Co., 1979; KunalChattopadhayay, ‘Class Struggle Among the Molecules ; The Rise and Fall of “Proletarian Science”, Jadavpur University Journal of History, vol xv, 1996-97, pp 35-46; এবং কুনাল চট্টোপাধ্যায়, ‘বিজ্ঞানের ইতিহাসের মার্ক্সবাদী চর্চা ও বোরিস হেসেন’, বিভাগীয় সভাপতির ভাষণ, ভারত ব্যতীত অন্যান্য দেশ বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ, ইতিহাস অনুসন্ধান-২১, কলকাতা, ২০০৭।
৩. “একদেশে সমাজতন্ত্র গড়া সম্পূর্ণ” করার তত্ত্বে্র ফল, এক দেশের অর্থনীতির মধ্যে উৎপাদন সর্বস্বতা চরমে নিয়ে যাওয়া।
৪. Fredrick Engels, ‘The Part Played by labour in the Transition from Age to Man’, in Marxist Internet Archive, www.marxist.org/archive/marx/works/1876/part played labour/index.htm.
৫. ঐ
৬. Leon Trotsky, Problems of Everyday life, Pathfinder Press, New York, 1973, p.317
৭. Karl Marx, The Poverty of Philosophy, New York, International Publishers, 1963, pp. 98-99.
৮. এ প্রসঙ্গে দেখুন James GustaveSpeth, The Bridge at the End of the World, New Haven, CT, Yale University Press, 2008, p.56.
৯. Karl Marx, Capital, vol 1, in www.marxists.org/archive/marx/works/1867-c1/ch15.htm.
১০. Karl Marx, ‘Economic and Philosophical Manuscripts of 1844’ http://www.marxists.org/archive/marx/works/1844/manuscripts/labour.htm.
১১. Karl Marx and Fredrick Engels, The German Ideology, http://www.marxists.org/archive/marx/works/1845/german-ideology/ch01b.htm.
১২. Fredrick Engels, ‘The Part Played by Labour….’,পূর্বোক্ত।
১৩. Karl Marx, quoted by John Bellamy Foster, ‘A Failed System’, www.amandapublishers.co.za/special-featured/global-financial-crisis/73-a-failed-system.
১৪. Vladimir Vernadsky, The Biosphere, New York, Nevranmont Publishing Company, 1998, p.57.
১৫. হেসেন প্রসঙ্গে কুণাল চট্টোপাধ্যায়ের পূর্বোল্লিখিত প্রবন্ধ ছাড়া দেখুন Gideon Freudenthal, ‘The Hessen-Grossman Thesis, An attempt at Rehabilitation’, in Perspectives on Science, Summer 2005, vol.13, no.2, pages 166-193; এবং Pablo Huerga Melcón, La ciencia en la encrucijada. Análisiscrítico de la célebreponencia de Boris Mihailovich Hessen, "Las raícessocioeconómicas de la mecánica de Newton", desdelascoordenadas del materialismofilosófico", Biblioteca Filosofía en español, Fundación Gustavo Bueno, Pentalfaediciones, Oviedo 1999.
১৬. দেখুন, Douglas Weiner, Models of Nature : Ecology, Conservation and Cultural Revolution in Soviet Russia, Pittsburgh, P.A.: University of Pittsburgh, 2000, p.27.
১৭. ঐ, পৃঃ ১৬৯।
১৮. এ প্রসঙ্গে দেখুন Michael Lowy, ‘Stalinist Ideology and Science’, in Tariq Ali (Ed), The Stalinist Legacyএবং টীকা -২-এ উল্লিখিত প্রবন্ধ।
১৯. Christopher Caudwell, Studies and Further Studies in a Dying Culture, New York, Monthly Review Press, 1971, p.xix.