ভারতীয় দন্ডবিধির ৩৭৭ ধারা সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়কে স্বাগত। এই রায় ভারতের এলজিবিটিআইকিউএইচ (LGBTIQH) সমাজের কাছে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিজয়। এই বিজয় আদালতের কাছ থেকে পাওয়া কোন উপহার নয়। বরং এটি বহু দশকের লড়াইয়ের ফসল। এই লড়াই রাস্তায় হয়েছে, তৃণমূল স্তরে সংগঠনের মাধ্যমে হয়েছে, এবং অবশ্যই আইন-আদালতে গিয়েও হয়েছে। অধিকার আদায়ের এই মুহূর্তে আমরা অভিনন্দন জানাই সেই সব মানুষকে যাদের নিরন্তর সংগ্রাম এই দিনকে সম্ভব করেছে। লড়াই দৃশ্যমান হয়েছে কয়েক জন এলিট চরিত্রের জন্য নয়। কয়েকজন মূলস্রোতের উদারপন্থীর জন্যও নয়।এবং অবশ্যই বড় রাজনৈতিক দলগুলির জন্য নয়। বহু মানুষ নিজেদের সম্প্রদায়কে সংগঠিত করে পুলিশী সন্ত্রাসের মোকাবিলা করেছেন বলেই লড়াই গড়ে উঠেছে। তাঁরা পুলিশের টাকা আদায়ের জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। জঙ্গী এলজিবিটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন এবং প্রাইড-ওয়াক সহ বিভিন্ন প্রকাশ্য কর্মসূচীতে ঝুঁকি সত্ত্বেও অংশ নিয়েছেন।
সমকামীদের প্রতি ঘৃণা এবং বাধ্যতামূলক বিষমকামিতা আসলে পুরুষ প্রাধান্যবাদ, পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানকে মহিমান্বিত করা ও মেয়েদের জন্য লিঙ্গায়িত ভূমিকারই নামান্তর। ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং অন্য ধর্মীয় গোঁড়ামি এগুলিকে মদত দেয়। সর্বোপরি এগুলি সবই পুঁজির শোষণের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। এই কারণেই বহু এলজিবিটি কর্মী ৩৭৭ ধারার পতনে উল্লাস প্রকাশ করার সাথে সাথে ইউএপিএ(UAPA) এর বিরুদ্ধে স্লোগান তুলেছেন। মানবাধিকার কর্মীদের মুক্তির দাবিও করেছেন।
৩৭৭ ধারা রদ করলেই লড়াই শেষ হবে না। ভারতীয় সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদে সমতার অধিকারের কথা বলা থাকলেও বাস্তবতা হল সমাজে এখনো দলিতদের কোণঠাসা করে রাখা হয়,মানবেতর সম্প্রদায় হিসাবে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। তাঁরা যথেচ্ছ হিংসার শিকার হন। চাকরি, শিক্ষা ও বহু পরিষেবা থেকে বঞ্চিত। ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে সুপ্রিম কোর্ট তাঁর রায়ে স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে পারস্পরিক সম্মতি থাকলে প্রাপ্তবয়স্করা ৩৭৭ ধারার আওতায় পড়বেন না। তার অর্থ এই নয় যে এলজিবিটিরা এখনই সামাজিক এবং অন্যান্য আইনি সমতা পেয়ে যাবেন। বিশেষত, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন, সন্তান দত্তক নেওয়া, উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তিপ্রাপ্ত হওয়া ইত্যাদি।
এই লড়াই তখনই প্রশস্ত হবেযখন আরও বেশি সংখ্যায় মানুষ সাহস করে বেরিয়ে এসে নিজেদের পরিচিতি জানাবেন। কিন্তু সমস্যা হল একদিকে অল্পসংখ্যক এলিট এলজিবিটিদের প্রাধান্য দিয়ে লড়াইকে আত্মসাৎ করার চেষ্টা চলছে। আর অন্যদিকে বহুসংখ্যক সাধারণ এলজিবিটিদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মকহিংস্র প্রচার করাও হচ্ছে ও তাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের সামাজিক বঞ্চনা ও বৈষম্য আজও আছে। শুধুমাত্র আইনি সংস্কার সামাজিকভাবে একঘরে করে রাখা সংখ্যালঘুদের বঞ্চনার সমাধান করতে পারে না। অন্যদিকে আমরা দেখছি য্বে, প্রস্তাবিত ট্রান্সজেন্ডার আইন - The Transgender Persons (Protection of Rights) Bill, 2016 - যথেষ্ট একপেশে। সরকারি চাকরিক্ষেত্রে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণের দাবি এখনও মানা হয় নি।
এলজিবিটি হিসাবে স্বীকৃতির জন্য, নিজেদের শর্তে বাঁচার অধিকারের জন্য এবং খাদ্য-বাসস্থান-স্বাস্থ্য-শিক্ষাক্ষেত্রে সমান সুযোগ পাওয়ার জন্য লড়াই এখনও অনেক বাকি। একই সঙ্গে এই লড়াইগুলিতে আংশিক বিভাজন কাটিয়ে সমস্ত শোষিতের ঐক্য দরকার।
এই সার্বিক ঐক্যের আহবানকে যেন গুলিয়ে ফেলা না হয় সেই সব মেকী-শ্রেণীগত যুক্তির সাথে যা অনেকক্ষেত্রেই সংকীর্ণ শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে প্রান্তিক যৌনতার লড়াইকে অবহেলা করে। একে প্রত্যাখ্যান করা হয় পেটি বুর্জোয়া/বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীল শৌখীনতা বলে। বাস্তব শ্রেণী ঐক্য তখনই আসতে পারে যখন বিশেষ-ধরণের নিপীড়নকে স্বীকার করা হবে এবং তার প্রসঙ্গগুলিকে সার্বিক শ্রেণী আন্দোলনের মধ্যে যথাযথভাবে তুলে ধরা হবে। তাই আমাদের একই সঙ্গে দু'ধরণের কাজ করতে হবে। এলজিবিটিআইকিউএইচ সমাজের কাছে এবং শ্রমিকশ্রেণীর শ্রেণী-সংগঠন ও বাম দলগুলির কাছে একথা বার বার নিয়ে যেতে হবে যে এলজিবিটি-দের বড় অংশই শ্রমজীবী মানুষ। অন্যদিকে আমাদের একথা বলতে কোনো দ্বিধা নেই - যেসব বামপন্থীরা এই লড়াইকে অবজ্ঞা করেছেন বা এই লড়াইকে প্রতিক্রিয়াশীল বলে দাবি করেছেন -তাঁদের প্রচার নামে বামপন্থী হলেও বাস্তবে শ্রেণী রাজনীতির মোড়কে স্রেফ পেটি বুর্জোয়া নৈতিকতা।
র্যাডিক্যাল সোশ্যালিস্ট তার সাধ্যমত ক্ষমতা অনুযায়ী ভারতের এলজিবিটিআইকিউএইচ সমাজের লড়াইতে সমর্থনকারী শক্তি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই অংশ নিয়েছে। আমরা একথা বলে এসেছি যে সামনে যাওয়ার রাস্তা হল গণ-আন্দোলন এবং সমস্ত শোষিতের ব্যাপকতম ঐক্য যেখানে থাকবে বিশেষ-ধরণের নিপীড়নের স্বীকৃতি ও তার জন্য সংগ্রাম। র্যাডিক্যাল সোশ্যালিস্ট এই আন্দোলনের সহযোদ্ধা থাকবে যেখানে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের দাবিগুলি নিয়ে লড়াই করব।