র্যাডিকাল সোশ্যালিস্টের বিবৃতি
মালদার সইয়দপুর গ্রামের মহম্মদ আফ্রাজুল জয়পুর থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে রাজসামান্দের ধোইন্দাতে লেবার কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করতেন এবং আরো চব্বিশজন শ্রমিকের সঙ্গে একটি চার ঘরের ভাড়া একতলা বাড়িতে থাকতেন। তাঁকে প্রথমে কুঠার দিয়ে আক্রমণ করা হয় ও তার পর পুড়িয়ে মারা হয়। গোটা প্রক্রিয়াটা ভিডিও করে ইন্টারনেটে তোলা হয়, গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করে যে হত্যাকারী হিন্দু হিসেবে একটি লাভ জিহাদ বন্ধ করছে। ৭ই ডিসেম্বর রাজস্থানে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা দেখিয়ে দিল, গত ২৫ বছরে হিন্দুত্ববাদী শক্তি ভারতে ঠিক কতদূর এগিয়েছে।
যখন ১৯৯২ সালে আদবানী আর তার অপরাধীবৃন্দ আক্রমণ করে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছিল, তখন সেই কাজকে বহু দিক থেকেই অপরাধ বলে দেখা হয়েছিল। ২৫ বছর পরে, তাঁরা ঐ দিনটিকেই শুধু সৌর্য দিবস বলে ঘোষণা করছে না, বরং অন্য বহু ক্ষেত্রে তাদের কর্মসুচী এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে।
এই শক্তিদের কিভাবে প্রতিহত করতে হবে, সেই বিতর্কের অনেকটাই কেটেছে তাঁরা ঠিক কতটা ফ্যাসিবাদী তা নিয়ে, কিন্তু আজ যা দরকার তা হল বোঝা, যে আমরা তাদের ফ্যাসিবাদী বলি আর আগ্রাসী সাম্প্রদায়িকতাবাদী বলি, মূল কথা হল, এ এমন এক রাজনৈতিক শক্তি, যারা তাদের স্বতন্ত্র কর্মসূচী বজায় রাখে, এবং ক্রমান্বয়ে সেটা সামনে ঠেলে। সব স্ময়ে জোর দিয়ে বলা দরকার যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ ও তার গোটা শাখা প্রশাখা শাসক শ্রেণীর তৈরি করা একটা হাতিয়ার নয়, যেটা তারা প্রয়োজন মত বার করে। ঐতিহাসিকভাবে ফ্যাসিবাদ ও বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে সম্পর্ক অনেক বেশী জটিল, এবং দেশ থেকে দেশে তার অদলবদল হয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রে, সঙ্ঘ-জোট নয় দশক ধরে উগ্র হিন্দুত্বভিত্তিক জাতীয়তাবাদ গঠনে জোর দিয়েছে। তারা অন্য সব ধর্মের মানুষকে শত্রু হিসেবে দেখিয়েছে, বিশেষত মুসলিমদের মনুষ্যেতর পশু হিসেবে এবং তথাকথিত ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের চিরন্তন শত্রু হিসেবে দেখিয়েছে। নৈর্ব্যক্তিক পুঁজিবাদী যুক্তিতে এমন কিছু নেই যা এই দৃষ্টিভঙ্গীকে মদত দেবে। কিন্তু আর এস এস –সঙ্ঘ পরিবার যে শর্ত আরোপ করেছে, তা হল, তারা শাসক শ্রেণীর এবং আন্তর্জাতিক পুঁজির জন্য খুবই লাভজনক কিছু পদক্ষেপ নেবে, যার বিনিময়ে তাদের থাকবে নিজেদের হিংসার রাজনীতি চালিয়ে যাওয়ার স্বাধীনতা। দাভোলকার, পানসারে, কালবুর্গি এবং লঙ্কেশদের মত যুক্তিবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ কর্মীদের হত্যা, নিছক মুসলিম হওয়ার অপরাধে সাধারণ মুসলিমদের হত্যা করা, যেখানে মহম্মদ আখলাক, পেহলু খান থেকে মহম্মদ আফ্রাজুল পর্যন্ত অভিযোগের চরিত্র হল গো-হত্যা, লাভ জিহাদ, আইসিসের চর হওয়া ইত্যাদি, এই হিঙ্গসার রাজনীতিকে নগ্নরূপে তুলে ধরে।
মহম্মদ আফ্রাজুলকে আক্রমণ করা ও হত্যা করার পিছনে অভিযোগটা ইতিমধ্যে মামুলী হয়ে যাওয়া অভিযোগ – সে নাকি লাভ জিহাদের অংশীদার। ব্যক্তিটি যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা মুসলিম শ্রমিক, সেটা তাৎপর্যপূর্ণ । বাংলাভাষী মুসলিমদের বারে বারে আক্রমণ করা হয়েছে, অভিযোগ করা হয়েছে তাঁরা বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী। এর প্রতিটি কথা বুঝে নিতে হবে। সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষ প্রধানত অর্থনৈতিক সংকটের ফলে এক দেশ থেকে আর এক দেশে যায়। সেটাকে এখন বলা হচ্ছে সন্তত্রাসবাদী চক্রান্ত। দ্বতীয়ত, নিজেদের ভারতীয়ত্ব প্রমাণ করতে না পারলে বাংলাভাষীদের, বিশেষত মুসলিমদের বিদেশী বলা হচ্ছে। এটাও হল সারা ভারতে “হিন্দী-হিন্দু-হিন্দুস্তান” চাপিয়ে দেওয়ার বৃহত্তর পরিকল্পনার অঙ্গ। আর অবশ্যই, যে কোনো মুসলিম, ভারতের যে কোনো প্রান্তে, আক্রমণের শিকার।
নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জয়পুরে তথাকথিত লাভ জিহাদ নিয়ে একটি পুস্তিকা প্রচার করা হচ্ছিল। সেটা তখনই বন্ধ করার বদলে পুলিশ কেবল তদন্ত করেছিল। লাভ জিহাদ একটা মিথ্যা, কিন্তু এমন এক মিথ্যা যার এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এতে দাবী করা হয় যে মুসলিমরা হিন্দুদের ভালবাসার ভান করে, তাঁদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করার উদ্দেশ্যে। সাম্প্রতিক কালের কুখ্যাত ঘটনা, হাদিয়ার মামলাতে, কেরালা হাই কোর্ট তার বিয়ে নাকচ বলে ঘোষণা করেছিল, যদিও সে সব প্রমাণ দাখিল করেছিল যে সে নিজের ইচ্ছায় প্রথমে ধর্মান্তরিত হয়েছিল, এবং তার পর তার ভবিষ্যত স্বামীর সঙ্গে তার আলাপ হয়েছিল এবং তারা বিয়ে করেছিল; এবং স্ররবোপরি, সে একজন প্রাপ্তবয়স্কা। এমন কি সুপ্রীম কোর্টের ভূমিকাও এ পর্যন্ত এই ঘটনাতে পুরোপুরি স্বচ্ছ নয়, কারণ সুপ্রীম কোর্ট এন আই এ কে এক সময়ে তদন্ত করতে বলেছে, এটা বাস্তবিক “লাভ জিহাদ” কি না।
আফরাজুলের ক্ষেত্রে, সে মাঝ বয়সী, তার পরিবার আছে, যাদের খাওয়া পরার জন্যই সে কাজের খোঁজে গিয়েছিল। গোটা ভয়ংকর ঘটনাটা দেখায়, মুসলিমদের খুন করা প্রায় একটা স্বাভাবিক ঘটনাতে পরিণত হয়েছে, এবং হিন্দু উচ্চজাতির লোকেরা সেটা হয় অবহেলা করে, অথবা সোশ্যাল মিডিয়াতে গিয়ে বাংলাদেশ, সিরিয়া বা অন্যান্য দেশের ঘটনা টেনে এনে ভারতে পরিস্থিতি কতটা বীভৎস সেটা লঘু করতে চায়। সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিদের, যারা বহুত্ববাদী ভারতের রামধনুর সবকটা রঙ রক্ষা করতে চান তাঁদের দ্বারা প্রতিরোধ আবশ্যক। আর আমাদের সচেতন হতে হবে যে তেমন প্রতিরোধ সমস্ত দক্ষিণপন্থী দলমুক্ত হতে হবে, কেবল আর এস এস – বিজেপি মুক্ত নয়। প্রতিবাদ যখন ফেটে পড়ে, সেই সময়েই, কলকাতার আর এস এস সদর দপ্তর কেশব ভবনের কাছে কলকাতা পুলিশ প্রায় পঁচিশজন প্রতিবাদীকে গ্রেপ্তার করে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার দেখাচ্ছে, মুখে বি জে পি-র সঙ্গে তাঁদের যে যুদ্ধ, সেটা আসল নয়, এবং তার যে কোনো স্বাধীন প্রতিবাদ ভেঙ্গে দিতে উৎসাহী।
এই আক্রমণগুলির জবাব দেওয়া সম্ভব রাস্তার লড়াই, আদালতের লড়াই এবং নির্বাচনী ক্ষেত্রের যৌথ সংগ্রামের মাধ্যমে। নির্বাচনী ক্ষেত্রে লড়াই নিশ্চয়ই করা দরকার। কিন্তু যারা সেটাকে প্রধান ক্ষেত্রে পরিণত করবেন, তাঁরা শেষ অবধি কংগ্রেস পরিচালিত জোটের বাড়তি চাকা হয়ে থাকবেন।সেখানে সামাজিক প্রসঙ্গ সব পিছনে চলে যাবে। এটা লক্ষ্যণীয় যে গুজরাটে নির্বাচনী প্রচার পুরোদমে চলছে, কংগ্রেসের সেখানে হঠাৎ উৎসাহ জন্মেছে রাহুল গান্ধীকে ভাল হিন্দু বলে প্রমাণ করার, এবং এই কারণে কংগ্রেস আফরাজুল হত্যার সরাসরি ও সুস্পষ্ট নিন্দা করে নি, যেখানে জোরটা পড়ার দরকার ছিল, সরকারী হিন্দুত্ববাদী প্রচার কীভাবে এইরকম ব্যক্তিগত খুনকেও ক্ষমতা দিচ্ছে। আর, সুপ্রীম কোর্ট বারংবার দেখিয়েছে, সামাজিক লড়াই বাদ দিয়ে নিছক আদালতের লড়াইয়ের কৌশল অনিশ্চয়তা পূর্ণ, কারণ আদালত খারাপ অবস্থান নিতেই পারে। গণ জমায়েত, রাস্তায় প্রতিরোধ, এদেরই থাকতের হবে সূচনাবিন্দু।
র্যাডিকাল সোশ্যালিস্ট , ৮ ডিসেম্বর ২০১৭