কুণাল চট্টোপাধ্যায়
পর্যায় ১ -- নিরন্তর বিপ্লবের পথে
১৯১৭ সালে, বা তার অব্যবহিত পরে, রুশ বিপ্লবের শত্রু-মিত্র সকলেই জানত, প্রলেতারীয় বিপ্লবের দুই প্রধান নেতা লেনিন এবং ট্রটস্কী। হিংস্র দক্ষিণপন্থী কার্টুনে ইহুদী দানব ট্রটস্কী কীভাবে রুশ সংস্কৃতি ধ্বংস করছে সেটা দেখানো হত। মেনশেভিক ও সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীদের সঙ্গে অক্টোবর অভ্যুত্থানের পরেই যখন সব সমাজতন্ত্রী দলদের সরকার গড়া নিয়ে শেষবারের মত আলোচনা হয়, তখন তাঁদের দাবী ছিল, সেরকম সরকার হতে পারে কেবল লেনিন ও ট্রটস্কীকে বাদ দিলে।১ আবার রোসা লুক্সেমবুর্গ যখন রুশ বিপ্লবের উপর তাঁর অসমাপ্ত পুস্তিকাটি লেখেন, তখন তিনি প্রশংসা ও সমালোচনা, দুই ক্ষেত্রেই এক নিঃশ্বাসে “লেনিন , ট্রটস্কী ও তাঁদের কমরেডদের” কথা বলেছেন।২
স্তালিনবাদের উত্থানপর্ব থেকে ইতিহাসের বারে বারে পুনর্লিখন ও নয়া নয়া বিকৃতিসাধন হয়েছে। ট্রটস্কীকে কখনো বলা হয়েছে মেনশেভিক, কখনো প্রতিবিপ্লবী। গর্বাচভের আমলে, দলিল প্রকাশ্যে আনার যুগেও যে একজন বলশেভিক নেতার সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ তোলা হল না, তিনি ট্রটস্কী। ফলে ভারতের মত দেশে, যেখানে রুশ-চীনপন্থী কমিউনিস্টদের রুশবিপ্লব সম্পর্কিত লেখার উপরে প্রভাব বহুদিন থেকে গেছে, সেখানে ট্রটস্কীর ঐতিহাসিক ভূমিকা নিয়ে, বিশেষ করে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষাতে আলোচনা, প্রায় হয় নি বলা চলে। বাংলা ভাষায় তো একটিও তথ্যনিষ্ঠ জীবনী নেই, নেই ডয়েটশার বা পিয়ের ব্রুয়ের লেখা (যথাক্রমে ইংরেজী ও ফরাসিতে) জীবনীর কোনো অনুবাদও।
বর্তমান প্রবন্ধ সেই সার্বিক ইতিহাসের একটি দিকের উপর আলোকপাত করতে চাইবে, যা হল লেনিন ও ট্রটস্কীর আন্তঃসম্পর্ক। এর একাধিক দিক আছে, একটা বড় সমস্যা অতিক্রম করার প্রথমে দরকারও আছে। সমস্যাটা হল, ১৯২৩-এ লেনিন বাকশক্তি হারানোর সময় থেকে, জিনোভিয়েভ এবং স্তালিন যে “লেনিনবাদ” চালু করলেন, তাতে অন্য সকলের যাচাই শুরু হল কে লেনিনের সঙ্গে কতটা সহমত তাই দেখে।৩ এই কারণে ইতিহাস পুনর্লিখনও হয়। যেমন আলেক্সান্দর শ্লিয়াপনিকভের ১৯১৭ সম্পর্কে স্মৃতিচারণে স্তালিনকে বিশেষ ভালভাবে দেখানো হয় নি বলে ১৯৩০ নাগাদ তাঁকে দিয়ে “আত্মসমালোচনা” প্রকাশ করানো হয়।৪ সেই প্রবণতা এখনও অনেক সময়ে দেখা যায়।
লেনিন ও ট্রটস্কীর সম্পর্কের সবটা একটি প্রবন্ধে আলোচনা করা কঠিন, তাই বর্তমান প্রবন্ধে শুধু দেখা যাবে বিপ্লবের চরিত্র নিয়ে তাঁদের মতের বিকাশ, এবং ১৯১৭-র বিপ্লবে রণনীতি ও কৌশলের প্রসঙ্গে তাদের অবস্থান। কেউ মনে করতেই পারেন, পার্টি গঠন, বিশ্বযুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক গঠন, এবং বিপ্লবের পরও গৃহযুদ্ধ ও নতুন সমাজগঠন প্রসঙ্গগুলি কম জরুরী নয়। সে কথা স্বীকার করে শুধু বলব, এখানে আমি একটি প্রবন্ধ লিখতে বসেছি, পূর্ণদৈর্ঘ্য গ্রন্থ নয়।
মার্ক্স-এঙ্গেলস ও “বুর্জোয়া-গণতন্ত্র”:
মার্ক্স-এঙ্গেলস আরম্ভ করেছিলেন অগ্রসর দেশে শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবের দিশা থেকে। তাঁরা একাধিক বিকল্প কমিউনিস্ট মতের সঙ্গে তর্ক করে নিজেদের রণনীতি ও দিশা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। একদিকে ছিল সেই মত, যাকে তাঁরা বলতেন “ক্রিটিক্যাল-ইউটোপিয়ান সমাজতন্ত্র”। এই মতের প্রবক্তারা বুর্জোয়া অর্থনীতি, রাষ্ট্র, ধর্ম, এবং পুরুষপ্রাধান্যবাদের তীব্র সমালোচনা করেন। কিন্তু তাঁরা মনে করতেন, তাঁদের ব্যাখ্যা সবার কাছে প্রচার করে কেবল যুক্তির জোরে তাঁদের মত গ্রহণ করাতে হবে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনে তাঁদের আস্থা ছিল না, বিপ্লবে তো নয়ই। অন্যদিকে ছিলেন ফরাসী বিপ্লবের জ্যাকব্যাঁ ধারাতে অনুপ্রাণিত বিপ্লবীরা, যেমন লুই ব্লাঁকি। তাঁরা মনে করতেন, ছোটো, সুশৃঙ্খল গোপন বিপ্লবী দল গঠন, গোপনে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা চাই, এবং অভ্যুত্থান সফল হলে বিপ্লবী দলের একক শাসনের একটা পর্ব চাই।
এই দুই ধারার বিপরীতে মার্ক্স-এঙ্গেলস ১৮৪৬-৪৭ থেকে যে রণনীতি প্রস্তাব করলেন ও অভিজ্ঞতার থেকে তার প্রসার ঘটালেন, তার প্রথম কথা হল, শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তি শ্রমিক শ্রেণী নিজেই আনবে। কীভাবে তা হবে? প্রলেতারীয় বিপ্লব, এই কথাটা আগের দুই ধারার থেকে প্রচন্ড ভাবে স্বতন্ত্র, যদিও মার্ক্সের নামে এবং প্রলেতারীয় বিপ্লবের নামে পরে বারে বারে ওই দুই ধারাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। মার্ক্স-এঙ্গেলস একদিকে প্রস্তাব করেন প্রচারসর্বস্বতার বিরুদ্ধে গণবিপ্লব, অন্যদিকে দলের গোপন পরিকল্পনা নয়, বরং সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতান্ত্রিক বিপ্লব। শ্রেণী সংগ্রামের তীব্রতা বাড়লে শোষকরা সেই গণতন্ত্রের অংশীদার হবে না, কিন্তু ব্যাপক শোষিত মানুষ গণতন্ত্র গড়বেন। কমিউনিস্ট ইস্তাহার বলেছিল, গণতন্ত্র বিজয় বিপ্লবের প্রথম পদক্ষেপ হবে।৫ আর ১৮৯১ সালে, মার্ক্সের ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ বইয়ের ভূমিকাতে এঙ্গেলস লেখেন, ডিক্টেটরশিপ অভ দ্য প্রলেতারিয়েতের নজীর হল পারী কমিউন।৬ বহু দল বিশিষ্ট, গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থায় পরিচালিত, পুলিশ ও আমলাতন্ত্রকে নির্বাচিত ও ফিরিয়ে আনা যায় এমন জনপ্রতিনিধিদের অধীনে রাখা এই আধা-রাষ্ট্র সম্পর্কে ঐ শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করে এঙ্গেলস দেখিয়েছিলেন, ওটা যাই হোক, একনায়কতন্ত্র নয়।
মার্ক্সের যুগ থেকেই যে প্রশ্নটা ওঠে, তা হল, যে সব দেশে বুর্জোয়া বিকাশ কম হয়েছে, তাদের কী হবে? ১৮৪৮-এর বিপ্লবের ঠিক আগে লেখা কমিউনিস্ট ইস্তাহারে ইতিমধ্যেই এ নিয়ে জটিলতা ছিল। এতে তাঁরা লেখেন, জার্মানীর আসন্ন বিপ্লব বুর্জোয়া বিপ্লব। কিন্তু তার পরই লেখেন, “কমিউনিস্টরা তাঁদের দৃষ্টি ফেরান প্রধানত জার্মানীর দিকে, কারণ ঐ দেশ এমন এক বুর্জোয়া বিপ্লবের প্রাক্কালে, যা ঘটবে সপ্তদশ শতকের ইংল্যান্ডের, এবং অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্সের তুলনায় ইউরোপীয় সভ্যতার অনেক বেশী অগ্রসর পরিস্থিতিতে এবং অনেক বেশী বিকশিত শ্রমিক শ্রেণীর উপস্থিতিতে, এবং যেহেতু জার্মানীর বুর্জোয়া বিপ্লব হবে তার পরই আসন্ন প্রলেতারীয় বিপ্লবের পূর্বরাগ মাত্র”।৭
কি এই বুর্জোয়া বিপ্লব? ১৮৪৮-এর জার্মান বিপ্লবে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে মার্ক্স অনুভব করলেন, জার্মান বুর্জোয়া শ্রেণী বিপ্লবী নয়। তিনি লেখেন, ১৬৪০-এ, বা ১৭৮৯-এ, বুর্জোয়াদের বিজয় ছিল নতুন সমাজ ব্যবস্থার বিজয়। কিন্তু প্রাশিয়ার বিপ্লবে বুর্জোয়া শ্রেণী দ্রুত প্রতিবিপ্লবের দিকেই সরতে থাকে, এই ছিল তাঁর মত।৮ তাহলে স্বতন্ত্রভাবে একটা বুর্জোয়া বিপ্লবের ধারণা কেন জরুরী ছিল? তা ছিল দুটি কারণে। প্রথমত, সামন্ততন্ত্র থেকে ধনতন্ত্রে উত্তরণের যে কয়েক শতাব্দীব্যাপী ইতিহাস, তার থেকে, অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে সামন্ত শ্রেণীর রাষ্ট্রকে ভেঙ্গে বুর্জোয়া রাষ্ট্র গড়ার নাটকীয় ঘটনার পৃথকীকরণের দরকার ছিল। দ্বিতীয়ত, অতীতের বুর্জোয়া বিপ্লবের সঙ্গে প্রলেতারিয়েতের উত্থানপর্বে বুর্জোয়া শ্রেণীর অবিপ্লবী ভূমিকার মধ্যে মার্ক্স একটা পার্থক্য দেখাতে চেয়েছিলেন।
সুতরাং ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের বিপ্লবকে ধরা হল বুর্জোয়া বিপ্লবের (পরবর্তীকালে যার নামটা দৃঢ়ভাবে হয়ে যাবে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব) আদর্শ বা প্যারাডাইম। তাদের সঙ্গে মিলিয়ে অন্যান্য বিপ্লব কতটা বিপ্লবী সেটা নির্ধারিত হবে। কিন্তু ফরাসী বিপ্লবকেই বা মার্ক্স এইভাবে কেন দেখলেন? এর উত্তর দিতে হলে আমাদের তাকাতে হবে উদারনৈতিক ফরাসী ইতিহাসবিদদের রচনার দিকে। বুর্জোয়া বিপ্লবের কাহিনী প্রথম দানা বাধে অষ্টাদশ লুইয়ের এবং দশম চার্লসের শাসনকালে, বুর্জোয়া উদারনৈতিক তাত্ত্বিক ও রাজনীতিবিদদের হাতে। অগুস্ত্যাঁ থিয়েরী, ফ্রাঁসোয়া মিঞে বা ফ্রাঁসোয়া গিজোর মত লেখকেরা ফরাসী বিপ্লবকে একটা শ্রেণী সংগ্রাম ভিত্তিক বিপ্লব হিসেবে দেখিয়েছিলেন। মার্ক্স এই কারণেই তাঁর বন্ধু জোসেফ ওয়েডেমেয়ারকে চিঠিতে লিখেছিলেন যে বুর্জোয়া ইতিহাসবিদরা তাঁর (মার্ক্সের) অনেক আগেই শ্রেণী সংগ্রামের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন।
মিঞের ইতিহাসে ফরাসী বিপ্লবকে দেখানো হয়েছিল তৃতীয় এস্টেটের দীর্ঘমেয়াদী ফল হিসেবে (অর্থাৎ বুর্জোয়া শ্রেণীর বাণিজ্যিক ও শিল্পগত সম্পত্তির উদ্ভবের ফল হসেবে)। গিজোর ইতিহাসে ইংল্যান্ডের বিপ্লব ও ফরাসী বিপ্লবের সাদৃশ্যের কথা বলা হয়। এঁরা তৃতীয় এস্টেট আর সমগ্র জাতিকে অভিন্ন বলে দেখাতে চেয়েছিলেন। বুর্জোয়া শ্রেণী এবং কৃষক ও শহরের দরিদ্র জনতার মধ্যে তাঁরা কোনো দ্বন্দ্ব দেখেন নি। গিজো এমন কি বলেন, ১৬৪০-এর দশকে ইংল্যান্ডের বিপ্লবে ধর্ম ছিল শ্রেণী সংগ্রামের আবরণ মাত্র। অর্থাৎ, ফরাসী উদারনৈতিক ইতিহাসবিদরাই দেখাতে চাইলেন ইতিহাসে বুর্জোয়া বিপ্লব বলে কিছু ঘটেছিল, এবং তার নেতৃত্ব দিয়েছিল বুর্জোয়া শ্রেণী, যারা গোটা সমাজটাকে তাদের পিছনে টেনে এনেছিল। মার্ক্স এঁদের রচনা পড়েই বুর্জোয়া বিপ্লবের তত্ত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবঃ কাউটস্কি থেকে রুশ মার্ক্সবাদ
১৮৮৯ সালে, ফরাসী বিপ্লবের শতবর্ষে, জার্মান মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক কার্ল কাউটস্কি একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ (বা পুস্তিকা) রচনা করেন – ফরাসী বিপ্লবের যুগে শ্রেণীদ্বন্দ্ব। সাধারণভাবে মার্ক্সীয় ইতিহাস রচনা এবং বিশেষভাবে ফরাসী বিপ্লবের ইতিহাসের মার্ক্সীয় চর্চার ক্ষেত্রে এই প্রবন্ধটি খুবই প্রভাব বিস্তার করেছিল। তথ্যের জন্য কাউটস্কি নির্ভর করেছিলেন ইতিমধ্যে যে সব গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে তাঁর উপর। কিন্তু ঐ তথ্যকে শ্রেণী সংগ্রামের আলোকে কীভাবে দেখা যায়, এবং সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণকে কীভাবে ঐতিহাসিক আখ্যানের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায়, এই ছিল তাঁর কাজের বৈশিষ্ট্য। রুশ বিপ্লবের পর কমিউনিস্ট মহলে কাউটস্কির দুর্নামের ফলে তাঁর এই পুস্তিকাটি পড়া কমে যায়। কিন্তু ১৯২৩ পর্যন্ত, চারটি জার্মান সংস্করণে এর ১৮,০০০ কপি মুদ্রিত হয়, এবং এটি আটটি ভাষায় অনুদিত হয়।
কাউটস্কি দেখাতে চাইলেন, ফরাসী বিপ্লবের কারণ হল তৃতীয় এস্টেটের সঙ্গে প্রথম দুই, সুবিধাভোগী এস্টেটের দ্বন্দ্ব, যার ভিত্তি ছিল অর্থনৈতিক সম্পর্ক। পুরোনো সমাজে ধনতন্ত্রের বিকাশের পায়ে বেড়ী ছিল, যেটা সরে গেল বিপ্লবের ফলে। একই সঙ্গে, কাউটস্কি শ্রেণী সংগ্রামে বিভিন্ন পক্ষের ভূমিকা দেখালেন। বুর্জোয়াদের বিপ্লবী অংশ শহরের দরিদ্র জনতা বা সাঁ-কুলোৎদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। কিন্তু তার ফলে একটা নতুন দ্বন্দ্ব তৈরী হল – একদিকে ধনতন্ত্রের বিকাশের ঐতিহাসিক প্রয়োজন, আর অন্যদিকে পেটি বুর্জোয়া সাঁ-কুলোৎদের মধ্যে শুধু সামন্ততন্ত্র-বিরোধী চেতনা নয়, বুর্জোয়া বিরোধী চেতনারও বিকাশ। কাউটস্কি বলেন, সাঁ- কুলোৎদের পরাজয় ছিল অনিবার্য, কারণ তাঁরা ইতিহাসের গতির বিপরীতে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর ঐতিহাসিক বর্ণনাতে শ্রেণী সংগ্রামের বাস্তব রূপ ধরার চেষ্টা ছিল, কিন্তু তাঁর সমাজতাত্ত্বিক চিন্তায় ছিল অতিমাত্রায় কঠোর নিয়মভিত্তিকতা বা, বলা যায় নির্ধারণবাদ। তাঁর খসড়া পড়ে এঙ্গেলস মন্তব্য করেছিলেন, তিনি শ্রেণী সংগ্রামের জীবন্ত বাস্তবতার চেয়ে বিমূর্ত সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গীর উপর জোর দিয়েছেন (অর্থাৎ জীবন্ত ইতিহাসকে তিনি তত্ত্বের ছাঁচে ফেলতে চেয়েছেন)। এছাড়া বলা দরকার, রুশ বিপ্লবের পর বইটি সংস্কার করার আগে, তিনি কৃষকদের ভূমিকা নিয়ে বিশেষ আলোচনা করেন নি, যেখানে ফরাসী বিপ্লবের অন্যতম প্রধান গুরুত্বই হল ভয়ানক কৃষি বিপ্লব ও তার ফলে সামন্ততন্ত্র ধ্বংস হওয়া। দ্বিতীয়ত, সাঁ- কুলোৎরা হেরে যেতে বাধ্য, এই ধারণার ফলে তিনি তাঁদের নেতৃত্ব, চেতনা, এ সবকে অবহেলা করেছিলেন। ইতিহাস মানে উৎপাদন ব্যবস্থার বিবর্তন, এই কেন্দ্রীয় ধারণা তাঁর বর্ণনাকে প্রধানত প্রভাবিত করেছিল।
কাউটস্কির এই পুস্তিকা, এবং জর্জ প্লেখানভের রচনা, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কে মার্ক্সীয় দিশাকে মার্ক্স বা এঙ্গেলসের লেখার চেয়ে অনেক বেশী পুষ্ট করেছিল। কাউটস্কি সম্পাদিত নয়ে জাইট পত্রিকায় প্লেখানভ “বুর্জোয়া শ্রেণী যখন তার বিপ্লবকে স্মরণ করে” শীর্ষক একটি প্রবন্ধে বলেন, মতাঞিয়ার বা পর্বত গোষ্ঠী ছিলেন প্রলেতারিয়েতের নেতা, এবং সন্ত্রাসের রাজ যে পর্বকে বলা হয়, তা ছিল শ্রেণী সংগ্রামের ফল। তিনি বলেন, সে যুগে প্রলেতারিয়েতের বিকাশ ও শ্রেণীচেতনা ছিল খুবই সীমিত, তাই সন্ত্রাস এত বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। কিন্তু তিনি একই সঙ্গে সতর্ক করেন যে মতাঞিয়ার নেতাদের বাস্তব চিন্তা ছিল নিছক বুর্জোয়া। সে যুগের সবচেয়ে উগ্র বিপ্লবীর কর্মসূচিতেও ব্যক্তি মালিকানাই প্রাধান্য পেয়েছিল। প্লেখানভের সিদ্ধান্ত হল, রাজনৈতিক শক্তি ছিল প্রলেতারিয়েতের, কিন্তু নেতৃত্ব ছিল পেটি বুর্জোয়ার। (প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, আধুনিক মার্ক্সবাদী গবেষকরা জ্যাকব্যাঁদের বুর্জোয়া নেতৃত্ব এবং পেটি বুর্জোয়া গণভিত্তিই দেখেন, প্রলেতারিয়েতের উপস্থিতি দেখেন না। সবুল, গের্যাঁ প্রমুখ সাঁ-কুলোৎদের একাংশের মধ্যে প্রলেতারিয়েতের ছবি দেখেছেন, কিন্তু সমগ্র সাঁ-কুলোৎদের তাঁরাও প্রলেতারিয়েত বলেন নি)।
প্লেখানভের সিদ্ধান্ত ছিল কাউটস্কির চেয়ে নরমপন্থী। ১৯০২-৩ থেকে, রুশ বিপ্লবের প্রস্তুতিপর্বে, সেটা বোঝা গেল। এই সময়ে লেনিন এবং প্লেখানভ ইস্ক্রা গোষ্ঠীর পক্ষে রুশ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক শ্রমিক দলের খসড়া কর্মসুচী তৈরী করছিলেন। ঐ খসড়াতে বলা হয়, “রুশ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক শ্রমিক দল রাশিয়ার বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে কোনো বিরোধী বা বিপ্লবী আন্দোলনকে সমর্থন করবে”।৯ এই সময় থেকেই কিন্তু লেনিন ও প্লেখানভের আপাত মতৈক্যের আড়ালে ছিল ভিন্নতা। বিতর্ক শুরু হলে সেটা বোঝা যায়। লেনিনের সঙ্গে খসড়া লেখার সময়েই প্লেখানভের তর্ক হয়। প্লেখানভ লিখেছিলেন, রাজনৈতিক ও নাগরিক স্বাধীনতা হল ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের স্বাভাবিক আইনী পরিপূরক। লেনিন “স্বাভাবিক” কথাটাতে আপত্তি তোলেন, এবং বলেন যে “স্বাভাবিক” শব্দটা ব্যবহার করা হল উদারনৈতিক দাবী। খসড়াটি প্রকাশিত হলে ডেভিড রিয়াজানভ একটি প্রবন্ধ লেখেন, যাতে তিনি বলেন, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের নেতৃত্বে শ্রমিক শ্রেণী গণতান্ত্রিক অধিকার এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য অগ্রণী যোদ্ধা হিসেবে দেখা দিলে, বিপ্লবের লাভ প্রধানত যাবে বুর্জোয়া শ্রেণীর কাছে, এ কথা মনে করা ভুল হবে।১০ এর জবাবে প্লেখানভ প্রচন্ড আক্রমণাত্মক একটি প্রবন্ধ লেখেন, এবং তাতে বলেন, যে সমাজ রূপান্তর ঘটতে চলেছে, তা হবে বুর্জোয়া বিপ্লব, তাই এতে বুর্জোয়া শ্রেণীর বিশিষ্ট ভূমিকা থাকবে।১১ এর সঙ্গে তুলনীয়, ১৮৪৮-এর বিপ্লবের পরাজয়ের পর মার্ক্স-এঙ্গেলসের মত, যে বুর্জোয়া শ্রেণী বিপ্লবের বিরোধী, এবং পেটি-বুর্জোয়ারাও দোদুল্যমান।
প্লেখানভের অবস্থানকে ব্যাখ্যা করে ট্রটস্কী পরে লেখেন, সেটা ছিল এরকমঃ রাশিয়া ধনতান্ত্রিক বিকাশের পথ ধরেছে। সমাজতন্ত্রের জন্য শ্রমিক শ্রেণীর প্রথমে দরকার গণতান্ত্রিক অধিকার, রাজনৈতিক স্বাধীনতা। এই কারণে রুশ শ্রমিক শ্রেণীকে উদারনৈতিক সমাজের ও বুদ্ধিজীবিদের সংবিধানের দাবীকে সমর্থন করতে হবে।১২ মাইকেল লোয়ি ব্যাখ্যা করেন, প্লেখানভ মনে করতেন, শ্রমিক শ্রেণীকে বুর্জোয়া শ্রেণীর একক শাসন মেনে নিতে হবে, যাতে বুর্জোয়া শ্রেণী তার ঐতিহাসিক কর্তব্য পালন করতে পারে।১৩ অর্থাৎ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব, এই ধারণা রূপান্তরিত হল বুর্জোয়া শ্রেণীর ঐতিহাসিক কর্তব্যে। ১৯০৫ সালে, প্লেখানভ নাচালো পত্রিকার মেনশেভিক সদস্যদের চিঠিতে লেখেন, “এখন সুযোগ বুর্জোয়া শ্রেণীর, এবং প্রলেতারীয়েত ইতিহাসকে নিজের হাতে নিয়ে তা পাল্টাতে পারে না”।১৪
রুশ বিপ্লবে শ্রমিক শ্রেণী ও “বুর্জোয়া গণতন্ত্র” : কাউটস্কি, লুক্সেমবুর্গ ও অন্যরা
১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয় বলশেভিক দল, এবং তার প্রধান নেতা ও তাত্ত্বিক ছিলেন লেনিন। এর ফলে ইতিহাসবিদ এবং রাষ্ট্রচিন্তার তাত্ত্বিকরা ১৯০৫-এর বিপ্লবের ক্ষেত্রেও লেনিনের প্রভাবকে বড় করে দেখেছেন। কিন্তু আমরা যদি ১৯০৩ থেকে ১৯০৭-৮ পর্যন্ত রুশ বিপ্লবের চরিত্র ও শ্রমিক শ্রেণীর কর্তব্য নিয়ে আলোচনা দেখি, তাহলে বুঝব, এই সময়ে সমাজতন্ত্রী শিবির দুভাগে বিভক্ত ছিল, এবং বামপন্থীদের প্রধান তাত্ত্বিক ছিলেন কাউটস্কি। পার্ভুস, লুক্সেমবুর্গ, লেনিন, ট্রটস্কী সকলেই তাঁর লেখা থেকে নিজেদের চিন্তার রশদ সংগ্রহ করেছিলেন। ১৯২২ সালে ট্রটস্কী তাঁর বই ১৯০৫-এর নতুন মুখবন্ধে লেখেন, ঐ যুগে (১৯০৫-এ) কাউটস্কি পোলিশ সমাজতন্ত্রী লিউসনিয়ার উত্তরে প্রবন্ধ, রুশ ও মার্কিণ শ্রমিক শ্রেণী সম্পর্কে তাঁর গবেষণা, প্লেখানভের প্রশ্নের উত্তরে রুশ বিপ্লব সম্পর্কে প্রবন্ধ, এগুলিতে মেনশেভিকদের নির্মমভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।১৫ ১৯০২ সালে ইস্ক্রাতে তাঁর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় (‘স্লাভরা ও বিপ্লব’), এবং ১৯০৩ সালে কমিউনিস্ট ইস্তাহারের নতুন একটি পোলিশ সংস্করণে তিনি মার্ক্স-এঙ্গেলসের ১৮৫০ সালে লেখা ‘কমিউনিস্ট লীগের প্রতি কেন্দ্রীয় কমিটির চিঠি’-র উল্লেখ করেন ও বলেন এমন এক বুর্জোয়া বিপ্লবের কথা, যা নিরন্তর হয়ে ওঠে, নিজের সীমা ছাড়িয়ে প্রলেতারীয় বিপ্লবে রূপান্তরিত হয়। ১৯০৫-এর ডিসেম্বরে তিনি “পুরোনো ও নতুন বিপ্লব” শীর্ষক প্রবন্ধে বলেন, “রুশ বিপ্লব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে এক ইউরোপীয় বিপ্লবের যুগের সূচনার, যা সমাপ্ত হবে ডিক্টেটরশিপ অভ দ্য প্রলেতারীয়েতের মাধ্যমে, এবং যা সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ার পথ সুগম করে দেবে”।১৬ আর, ১৯০৬-এর নভেম্বরে, প্লেখানভ রুশ বিপ্লবের চরিত্র এবং রুশ সমাজতন্ত্রীদের কর্তব্য সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে একটি চিঠি পাঠালে কাউটস্কি লেখেন “রুশ বিপ্লবের চালিকা শক্তি ও ভবিষ্যত”।১৭ এই প্রবন্ধে কাউটস্কি অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ আলোচনা করেন। প্রবন্ধটির চারটি স্বতন্ত্র রুশ অনুবাদ প্রকাশিত হয়। একটিতে মুখবন্ধ লেখেন লেনিন, আরেকটিতে ট্রটস্কী। ট্রটস্কী লেখেন, সামাজিক সম্পর্ক বিশ্লেষণে আবশ্যক দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রয়োগ। সেটা করলে দেখা যায়, যে যুগ এসেছে, তাতে কোনো স্বাধীন ও বিপ্লবী বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক আন্দোলন নেই, এবং তার কারণ হল, স্বাধীন, শক্তিশালী ও প্রগতিশীল পেটি বুর্জোয়া শ্রেণী বিলুপ্ত। লেনিনের মুখবন্ধে লেনিন লেখেন, প্লেখানভের প্রশ্নগুলির উদ্দেশ্য, বুর্জোয়া ক্যাডেট দলের সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণিকে জোট গঠনের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া, আর কাউটস্কি প্লেখানভের জবাবে বলেছেন, প্রশ্নটাই ঠিক না।
লেনিন ও ট্রটস্কীর মধ্যে মতভেদ থাকলেও, দুজনেই দাবী করেন, কাউটস্কি তাঁর পক্ষে। এখানে প্রথমত প্রতিষ্ঠিত হয়, কাউটস্কি সেই সময়ে সংস্কারবাদ-সুবিধাবাদ-নরমপন্থার বিপরীত দিকে ছিলেন। তাঁর প্রথম আলোচ্য বিষয় ছিল কৃষি সমস্যার প্রশ্ন। কাউটস্কি দেখান, উদারনৈতিক রাজনীতি তার শ্রেণীগত অবস্থানের ফলে আমূল বিপ্লবী রূপান্তরের বিরোধী। কিন্তু কৃষকের হাতে জমি বাড়া জরুরী, যেমন জরুরী উন্নততর কৃষি ব্যবস্থা, সম্পদ, ও প্রশিক্ষণ। জারতন্ত্র কৃষকদের এ সব দেবে না। উদারনৈতিক রাজনীতিও তা পারবে না, কারণ উদারনীতির প্রবক্তারা ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমিদারী নিতে চাইছে। সেই ক্ষতিপূরণের বোঝা তো আবার কৃষকদের উপরেই পড়বে। তাই দরকার সমস্ত বড় জমিদারী বাজেয়াপ্ত করা। তার পূর্বশর্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রূপান্তর। তিনি বলেন, সেনা বাহিনীকে ভেঙ্গে দেওয়া, রাজবংশের ও মঠদের জমি বাজেয়াপ্ত করা, রেলপথ, খনিজ তেল, কয়লা খনি, লৌহ-ইস্পাত শিল্প প্রভৃতি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব করা ছাড়া, রুশ কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ সম্ভব নয়। এই কাজ উদারনৈতিক রাজনীতির পক্ষে সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, কাউটস্কি বলেন, বুর্জোয়া গণতন্ত্রের গণভিত্তি হল একটি প্রগতিশীল পেটিবুর্জোয়া শ্রেণী। রুশ পেটি বুর্জোয়ারা ভুগছে অস্থিতিশীলতায়, প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার মাঝে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে কাউটস্কি বলেন, রাশিয়াতে শ্রমিক শ্রেণী রাজনৈতিকভাবে বুর্জোয়া শ্রেণীর অধীনস্থ নয়। বুর্জোয়া শ্রেণী জারতন্ত্রকে যতটা ঘৃণা করে তার চেয়ে বেশী ঘৃণা করে ও ভয় পায় বিপ্লবকে। তাই তারা রুশ বিপ্লবের চালিকা শক্তি নয়। শ্রমিক শ্রেণী একা রুশ বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। কিন্তু কৃষকের সঙ্গে স্বার্থের মেলবন্ধন থাকলে বিজয় সম্ভব। এতে নতুন দ্বন্দ্ব থাকবে, কারণ কৃষিবিপ্লব শক্তিশালী ব্যক্তি মালিকানার প্রবক্তা এক কৃষকের স্তর তৈরী করলে তাঁদের সঙ্গে শ্রমিকদের দ্বন্দ্ব হবে। তিনি শেষ করেন এই কথা বলেঃ “রুশ বিপ্লব আমাদের জন্য যে কর্তব্য সাজায় সেগুলিকে দেখা উচিৎ পরম্পরাগত অর্থে বুর্জোয়া বিপ্লব হিসেবে না, আবার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হিসেবেও না, বরং একটি অনন্য প্রক্রিয়া হিসেবে, যা ঘটছে বুর্জোয়া ও সমাজতান্ত্রিক সমাজের সীমানাতে”।১৮
কাউটস্কি ঐ সময়ে ছিলেন রোসা লুক্সেমবুর্গের ঘনিষ্ঠ, অর্থাৎ বামপন্থী। তিনি মেনশেভিক রণনীতিকে স্পষ্টভাষায় প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু লেনিন ও ট্রটস্কীর মতভেদ সম্পর্কে তিনি কোনো মন্তব্য করেন নি। আমরা এর তিনটি কারণ বলতে পারি। প্রথমত, কাউটস্কি নিজেই লিখেছিলেন, বিদেশী হিসেবে, তিনি রুশ কমরেডদের পরামর্শ দিতে অক্ষম। তিনি দূর থেকে নির্দেশ নয়, সাবধানে নিজের মত প্রকাশ করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, কাউটস্কি রুশ ভাষা জানতেন না, আর তখনও ট্রটস্কীর বক্তব্য প্রধানত রুশ ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল। তৃতীয়ত, (এবং এটা নিছক অনুমান) তিনি হয়তো বামপন্থী শিবিরের মতভেদ নিয়ে বেশী কথা বলতে চান নি। কাউটস্কির রাজনৈতিক জীবন দেখায়, কাউটস্কি অনেক সময়েই চাপ না থাকলে সূক্ষ্ম বিতর্কে যেতে চাইতেন না। আর, এর সঙ্গে জড়িত ছিল একটি মৌলিক বিষয়ে মার্ক্স-এঙ্গেলসের সঙ্গে তাঁর মতভেদ। রাষ্ট্র সম্পর্কে ১৮৯১-এর নতুন (এরফুর্ট) কর্মসূচীকেও এঙ্গেলস সমালোচনা করেছিলেন। সেই সমালোচনা বুঝতে না পারার ফলে ক্রমে কাউটস্কির মত সংশোধনবাদের দিকে যেতে থাকে। ১৯১২ সালে তিনি লেখেন, “আমাদের রাজনৈতিক সংগ্রামের উদ্দেশ্য এতদিন যা ছিল আজও তাই আছেঃ পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা জয়ের মাধ্যমে এবং রাষ্ট্রে পার্লামেন্টকে নির্দেশক অবস্থানে ওঠাবার মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা”।১৯
এই কারণেই হয়ত, কাউটস্কি রাশিয়া সম্পর্কে বামপন্থী বক্তব্য রাখলেও, এবং ১৯০৫-৬তে সে বক্তব্য মেনশেভিকদের বিরুদ্ধে গেলেও, পরবর্তী কালে তিনি এই বিতর্ক থেকে সরে গিয়েছিলেন। এর বিপরীতে দেখা যায় রোসা লুক্সেমবুর্গের মত। তিনি ১৯০৫-৬তেও মেনশেভিকদের বিরোধী ছিলেন, এবং সব সমালোচনার পরও, ১৯১৭-১৮তে তিনি বলশেভিকদেরই সমর্থন করেছিলেন। ১৯০৭ সালে রুশ পার্টির পঞ্চম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় লন্ডনে, ৩০ এপ্রিল থেকে ১৯ মে। কংগ্রেসে ছিলেন ৩৩৬ জন প্রতিনিধি – ১০৫ জন বলশেভিক, ৯৭ জন মেনশেভিক, ৫৭ জন (ইহুদী শ্রমিক সংগঠন) বুন্ড প্রতিনিধি, ৪৪ জন পোলিশ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট, ২৯ জন ল্যাটভিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট, ও চার জন কোনো উপদলের সদস্য না। এই কংগ্রেসে রোসা লুক্সেমবুর্গ একটি দীর্ঘ ভাষণ দেন। শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে অন্য শ্রেণীদের সম্পর্কের প্রশ্নে ট্রটস্কী ঐ ভাষণের সঙ্গে সংহতি জানান। কী বলেছিলেন লুক্সেমবুর্গ? তিনি প্লেখানভের প্রস্তাবিত বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে সমঝোতার নীতিকে তীব্র নিন্দা করেন। তিনি বলেন, প্লেখানভ মুখে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির কথা বললেও কাজে গোঁড়ামির বাইরে যাচ্ছেন না। রুশ বিপ্লবে উদারপন্থার কোনো নেতৃত্ব দেওয়ার আকাংখ্যা নেই। শ্রমিক শ্রেণী একটি স্বাধীন শক্তি, তাঁরা নিজেদের শ্রেণী স্বার্থে চলেন, এ কথা বুঝেই উদারনীতির প্রবক্তারা পিছু হঠছে। এই পর্যন্ত তিনি, লেনিন ও ট্রটস্কী একমত ছিলেন। কিন্তু লেনিনের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য তিনি খোলাখুলি বলেন। তিনি বলেন, প্লেখানভ [বা অন্য বহু মেনশেভিক] কৃষকদের দেখছেন প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণী হিসেবে। সেটা সংকীর্ণ, একপেশে দিশা। এমনকি অবিপ্লবী যুগেও ছোট চাষী এবং ক্ষেতমজুরেরা বিপ্লবী শক্তির দিকে ঝুকতে পারেন। তাই সমগ্র গ্রামীণ জনতাকে অভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল পেটিবুর্জোয়া হিসেবে দেখাটা হল প্রাণহীন তত্ত্ব। আর বিপ্লবের সময়ে পরিস্থিতি আরো পালটায়। রাশিয়াতে কৃষকরা বস্তুগতভাবে বিপ্লবী, কারণ জমির প্রশ্নকে বুর্জোয়া সমাজের মধ্যে সমাধান করা যায় না, তাই এই প্রসঙ্গ তুলে ওই সমাজকে অতিক্রম করার দিক নির্দেশিত হয়।২০ স্পষ্টতই লুক্সেমবুর্গ বলছেন যে কৃষিবিপ্লব বুর্জোয়া ব্যবস্থার মধ্যে থাকলে গরিব চাষীর সমস্যার সমাধান হবে না। কিন্তুএই সঙ্গে, লেনিনের অবস্থানের কার্যত সমালোচনা করে তিনি বলেন, “কৃষক আন্দোলন কোনো স্বাধীন ভূমিকা পালন করতে সম্পূর্ণ অপারগ, এবং প্রতিটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেই যে সব শ্রেণীর বেশী দম আছে, এবং যাদের চেহারা বেশী স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত, কৃষকরা তাঁদের নেতৃত্বে যেতে বাধ্য হয়। ... এ কথা স্পষ্ট যে আজকের রাশিয়ার বিশৃঙ্খল কৃষক আন্দোলনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়া, ও তাঁর উপর প্রভাব বিস্তার করা, হল সচেতন প্রলেতারিয়েতের স্বাভাবিক ঐতিহাসিক দায়িত্ব”।২১
অর্থাৎ কৃষকদের কোনো স্বাধীন, সচেতন রাজনৈতিক দল থাকবে, এবং তারা বিপ্লবে শ্রমিক শ্রেণীর দলের সঙ্গে সমতা রেখে লড়াই করবে, এবং তার ভিত্তিতে গড়ে উঠবে শ্রমিক ও কৃষকের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক ডিক্টেটরশিপ, লুক্সেমবুর্গ এই বক্তব্যের সমালোচনা করছিলেন। পার্টি কংগ্রেসে পোলিশ কমরেডদের প্রস্তাবকে বলশেভিকরা এবং ট্রটস্কী ও তাঁর সমর্থকরা গ্রহণ করেন, যাতে বলা হয়, চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে “ কৃষক সমর্থনের উপর দাঁড়িয়ে থাকা শ্রমিক শ্রেণীর ডিক্টেটরশিপ”[1]।
পার্ভুস, ট্রটস্কী ও নিরন্তর বিপ্লবঃ ১৯০৪-১৯০৭
এই বৃহত্তর প্রেক্ষাপট মাথায় রাখলে বোঝা যায়, ১৯০৫ সালে ট্রটস্কী প্রস্তাবিত নিরন্তর বিপ্লবের রণনীতিতে নতুনত্ব থাকলেও, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের বামপন্থী অংশের চিন্তা থেকে তা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল না। বস্তুত, ট্রটস্কী নিজে এমন দাবী করেন নি। তিনি বিভিন্ন সময়ে কাউটস্কি, লুক্সেমবুর্গের সঙ্গে তাঁর মতের মিল এবং বিশেষ করে পার্ভুসের প্রতি তাঁর ঋণের কথা বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর বক্তব্যে বৈশিষ্ট্যও ছিল।
১৯০৩-এর পার্টি কংগ্রেসে যখন বলশেভিক ও মেনশেভিক দুটি উপদল তৈরী হয়, ট্রটস্কী তখন ছিলেন মেনশেভিকদের পক্ষে। এর কারণ রাজনৈতিক নয়, ব্যক্তিগত, বা বলা যায় রাজনৈতিক চেতনার অভাব, যা বিপ্লবী দল গঠন প্রসঙ্গে আলোচিত হবে। কিন্তু ঐ কংগ্রেসের প্রথমার্ধে তিনি কর্মসূচীগত বিভিন্ন প্রশ্নে লেনিনের এমন কঠোর সমর্থক ছিলেন যে বিরোধীরা তাঁকে বলতেন লেনিনের মুগুর। ফলে রাজনৈতিক প্রশ্নে অল্পদিনের মধ্যেই মেনশেভিকদের সঙ্গে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়। ১৯০৪ সালে, মেনশেভিক পরিচালিত ইস্ক্রা লেখে, “রাশিয়াতে লড়াইয়ের মঞ্চের দিকে তাকালে আমরা কী দেখতে পাই? কেবল দুটিমাত্র শক্তিঃ জারের স্বৈরতন্ত্র এবং উদারনৈতিক বুর্জোয়া শ্রেণী, যে দ্বিতীয় শক্তিটি সংগঠিত, এবং প্রভূত নির্দিষ্ট ভর সম্পন্ন। শ্রমজীবি জনতা বিভক্ত, এবং কিছুই করতে পারেনা। একটি স্বাধীন শক্তি হিসেবে আমাদের কোনো অস্তিত্ব নেই, তাই আমাদের কাজ হল দ্বিতীয় শক্তিকে – উদারনৈতিক বুর্জোয়া শ্রেণীকে – সমর্থন করা। আমাদের তাঁদের উৎসাহ দিতে হবে, এবং কোনো অবস্থাতেই শ্রমিক শ্রেণীর স্বাধীন দাবী তুলে তাদের ভয় দেখালে চলবে না”।২২
এই সময় থেকে ট্রটস্কী মেনশেভিক উপদল ছেড়ে দেন। তাঁর উপর তখন প্রভাব পড়েছিল কাউটস্কি ছাড়া, পার্ভুসের। আলেক্সান্দর ইস্রায়েল হেলফ্যান্ড নামের এই রুশদেশে জন্ম বিপ্লবী বহুদিন জার্মানীতে বাস করছিলেন পার্ভুস ছদ্মনাম নিয়ে, এবং বার্নস্টাইনের সংশোধনবাদের তীব্র সমালোচক হিসেবে নাম (বা দুর্নাম) করেছিলেন। পার্ভুস ট্রটস্কীকে দুভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। প্রথমত, তিনি বিশ্ব ধনতন্ত্রকে এক দ্বান্দ্বিক ঐক্যের আদলে যেভাবে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন, তা ছিল মার্ক্সের ক্যাপিটাল-এ ধনতন্ত্রের যে ব্যাখ্যা, তা থেকে নতুন যুগের বিশ্ব ধনতন্ত্রের রূপান্তরকে বোঝার অন্যতম প্রচেষ্টা। মার্ক্স ক্যাপিটালে এক একটি দেশের ধনতন্ত্রের বিকাশকে স্বতন্ত্রভাবে দেখেছিলেন, এবং শিল্পপুঁজিকে ধনতন্ত্রের সর্বোচ্চ স্তর হিসেবে দেখিয়েছিলেন। পার্ভুস দেখাতে চাইলেন, অর্থনৈতিক বিকাশের ফলে পুঁজি আন্তর্জাতিক আকার ধারণ করেছে, ফলে উৎপাদনের উপাদানের উপর ব্যক্তি মালিকানা এবং জাতিরাষ্ট্র, দুটিই অর্থনীতির উন্নয়নের পথে বেড়ি হয়ে পড়েছিল। ধনতন্ত্রের মধ্যে এর কোন সমাধান নেই। ধনতন্ত্র নিজেকে জাতিরাষ্ট্রে আবদ্ধ রাখতে ব্যর্থ। কাঁচা মাল, আন্তর্জাতিক বাজার, পুঁজি বিনিয়োগের নিরাপদ ক্ষেত্র, এগুলির জন্য প্রতিযোগিতার ফলে উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলি সাম্রাজ্য বিস্তার ও বিশ্বযুদ্ধের দিকে যাচ্ছে। তিনি আরো লেখেন যে আন্তঃ-সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তে রাশিয়া বাধ্য হবে, কিন্তু তা হলে জারতন্ত্রী ব্যবস্থার দুর্বলতাও ধরা পড়বে। রাশিয়াতে বিপ্লব হলে গোটা ধনতান্ত্রিক দুনিয়া প্রভাবিত হবে, এবং রুশ শ্রমিক শ্রেণী আন্তর্জাতিক সামাজিক বিপ্লবের অগ্রণীর ভূমিকা নিতে পারবে।২৩
দ্বিতীয়ত, পার্ভুস, লুক্সেমবুর্গের মতই বার্নস্টাইনের সংশোধনবাদের বিরোধী ছিলেন, আর লুক্সেমবুর্গের আগেই অনুভব করেন যে ট্রেড ইউনিয়নের অর্থনৈতিক লড়াই আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ, এই দুয়ের বাইরেও তৃতীয় একটা কোনো পথের দরকার আছে। ১৮৯৫-৯৬তেই তিনি নয়ে জাইট পত্রিকায় কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন, যাতে রাজনৈতিক দাবীতে সাধারণ ধর্মঘটের গুরুত্ব আলোচিত হয়। ১৯০৪ সালে তিনি বলেন, শ্রমিক শ্রেণীর আক্রমণের পর্বে সাধারণ ধর্মঘট হল একটি মৌলিক হাতিয়ার।
পার্ভুসের ট্রটস্কীর উপরে প্রভাব বুঝতে অসুবিধা হয় না। ১৯০৪-এর ডিসেম্বরে ট্রটস্কী একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন। ১৯০৫-এর ২২শে জ্যানুয়ারী (রুশ ক্যালেন্ডারের ৯ই জ্যানুয়ারী) রাশিয়ার রাজধানী সেন্ট পিটার্সবুর্গে শান্তিপূর্ণ শ্রমিক মিছিলের উপর নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটে। এই খবর পেয়ে অল্প সময়ের মধ্যে ট্রটস্কী ফিরে গেলেন রাশিয়াতে। প্রবন্ধের পান্ডুলিপি পার্ভুস জার্মানী থেকে প্রকাশ করেন দো ৯ ইয়ানভারা (‘৯ই জ্যানুয়ারী পর্যন্ত’) শিরোনাম দিয়ে, এবং সঙ্গে একটি মুখবন্ধ লিখে।২৪ মেনশেভিক রাজনীতির বিপরীতে, এতে বলা হয়, উদারনৈতিক রাজনীতি ভীরুতার রাজনীতি, যা মুক্তকন্ঠে সংবিধান, সার্বজনীন ভোটাধিকার, এবং সাধারণতন্ত্রের দাবী (“বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক” দাবী) তুলতে পারছে না। এর বিপরীতে তিনি দেখান শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী চরিত্র। তিনি বলেন, শহরাঞ্চলের শিল্প শ্রমিকরা হবেন অগ্রণী বিপ্লবী শক্তি। তাই লড়াইয়ের পদ্ধতিতে থাকবে মিছিল, এবং রাজনৈতিক ধর্মঘট। কিন্তু, ট্রটস্কী সাবধান করে দেন, একা শ্রমিকরা লড়াই জিতবেন না। তাই সাধারণ ধর্মঘটের পাশে কৃষকদের জমায়েত করতে হবে, সংবিধান সভার দাবী তুলে। এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রচার তীব্র করতে হবে, যাতে সৈনিকদের যখন বিদ্রোহ দমনে পাঠানো হয়, তখন তাঁরা বোঝেন, ঠিক কেন রাষ্ট্র এই কাজ করতে বলছে।
পুস্তিকার ভূমিকায় পার্ভুস লেখেন, বিপ্লবকে সংহত করতে হলে চাই শ্রমিক শ্রেণীর শক্তিতে নির্ভরশীল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক অস্থায়ী সরকার। কিন্তু তিনি স্পষ্টভাষায় লেখেন, “একটি সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক অস্থায়ী সরকার রাশিয়াকে সমাজতন্ত্রের পথে সরাসরি নিয়ে যেতে পারবে না, কিন্তু স্বৈরতন্ত্র উচ্ছেদ ও গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াটা তাঁর রাজনৈতিক কর্তব্যের জন্য সুবিধাজনক জমি তৈরি করে দেবে”।২৫
কাউটস্কি, লুক্সেমবুর্গ বা পার্ভুসের সঙ্গে ট্রটস্কীর প্রভেদ দেখা দিল ১৯০৫ সালে তাঁর রুশ বিপ্লবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। ১৯০৫-এ যত সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক নেতা বিদেশে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ট্রটস্কী প্রথম রাশিয়াতে ফেরেন। বলশেভিক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ক্রঝিঝানভস্কির সঙ্গে তিনি সহযোগিতা করেন, এমনকি বলশেভিকদের আসন্ন কংগ্রেসে ক্রঝিঝানভস্কির খসড়া দলিল লেখাতেও সাহায্য করেন। এরপর, আবার শ্রমিক আন্দোলন তীব্র হলে তিনি চলে যান সেন্ট পিটার্সবুর্গে। অক্টোবর মাসে সাধারণ ধর্মঘটে রাজধানী বন্ধ হয়ে যায়। রেল শ্রমিকরা ধর্মঘটে যোগ দেন, এবং টেলিগ্রাফের তারের পথে ধর্মঘট ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। যে ধর্মঘট শুরু হয়েছিল স্টিটিনের ছাপাখানার শ্রমিকদের অর্থনৈতিক দাবী থেকে, তা এবার আট ঘন্টার শ্রম দিবস, নাগরিক অধিকার, বন্দীমুক্তি, এবং সংবিধান সভার মত রাজনৈতিক দাবীতে সোচ্চার হয়। ১০ই অক্টোবর মস্কো, খার্কভ, রেভাল, ১১ই স্মলেনস্ক, কোজলভ, বিয়েলোগরোদ, সামারা, সারাতভ এবং পোলতাভা, ১৩ই ওর্শা, মিনস্ক, ক্রেমেনচুগ এবং সিমফেরোপল, ১৪ই রস্তভ, টিফলিস ও ইরকুটস্ক শহর, ১৫ই ভিলনা, ওডেসা আর বাটুম, ১৭ই টমস্ক, ভিটেবস্ক এবং ইউয়রিয়েভ শহর পড়ে সাধারণ ধর্মঘটের কবলে। শুধু শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকরা না, শ্রমিকদের নেতৃত্ব এবং জঙ্গী লড়াই বাণিজ্যিক জীবনেও ধর্মঘটকে ক্রমে সর্বব্যাপী করে তোলে। ১৭ই অক্টোবর, শ্রমিক শ্রেণীর এই তীব্র আন্দোলন সেই কাজ করতে পারল, যা পূর্ববর্তী দুবছরে অজস্র সভা, ভোজসভাতে ভাষণ, পিটিশন ইত্যাদির মাধ্যমে উদারপন্থীরা পারে নি। পিছু হঠল জারতন্ত্র। জার দ্বিতীয় নিকোলাস তাঁর অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাউন্ট উইটেকে প্রধানমন্ত্রী করলেন, এবং ১৭ই রাত্রে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল, নির্বাচনী আইন প্রশস্ত করে দুমা (প্রতিনিধি সভা) নির্বাচিত হবে, সভা-সমিতির অধিকার মানা হবে, ইত্যাদি।
এই লড়াইয়ের নেতৃত্ব ছিল শ্রমিক শ্রেণীর হাতে, এবং তাঁদের মধ্য থেকে উঠে আসা গণতান্ত্রিক শ্রেণী সংগঠনের হাতে। এই সংগঠনের নাম সোভিয়েত (পরিষদ বা council-এর রুশ প্রতিশব্দ)। ১৩ই অক্টোবর টেকনোলজি ইনস্টিটিউটে নির্বাচিত শ্রমিক প্রতিনিধিদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। স্থির হয়, প্রতি পাঁচশ’ জনে একজন করে প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন, যদিও কার্যক্ষেত্রে কোনো কোনো প্রতিনিধি ১০০-২০০ জন শ্রমিকেরও প্রতিনিধি ছিলেন। যেহেতু শ্রমিকদের মধ্য থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি, তাই বিপ্লবী দলগুলির (সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট – বলশেভিক, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট – মেনশেভিক, এবং সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারী) অ-শ্রমিক সদস্যরা সরাসরি সোভিয়েতে আসেন কেবল ভোটাধিকার ছাড়া। ১৫ তারিখের মধ্যে সোভিয়েতের প্রভাব এতটা বেড়েছিল, যে ধর্মঘট ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সোভিয়েতের নামে আহবান করা শুরু হল। ৩রা ডিসেম্বর পর্যন্ত সেন্ট পিটার্সবুর্গের শ্রমিক আন্দোলন পরিচালনা করেছিল সোভিয়েত। আর এই সোভিয়েতের কার্যনির্বাহী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য, এবং প্রথম সভাপ্রধান খ্রুস্তালেভ-নোসার গ্রেপ্তার হওয়ার পর সভাপ্রধান ছিলেন ট্রটস্কী। ফলে বিপ্লবী পরিস্থিতিতে শ্রমিক আন্দোলনকে তিনি যে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছিলেন, অধিকাংশ মেনশেভিক বা বলশেভিক নেতার সেই অভিজ্ঞতা ছিল না।
এই অভিজ্ঞতা ট্রটস্কীকে দেখায় সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা তাঁদের কর্মসূচীকে যে দুভাগে বিভক্ত রেখেছিলেন, সেটা বিপ্লবী পরিস্থিতিতে অকেজো হয়ে পড়বে। ন্যূনতম কর্মসূচী বলা হত, প্রস্তাবিত “বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে” শ্রমিক শ্রেণীর দাবীকে। অন্যদিকে ছিল পূর্ণ, অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচী। কিন্তু যে দাবী হয়তো শান্ত, অবিপ্লবী পরিবেশে বুর্জোয়া অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেটাই বিপ্লবী পরিস্থিতিতে দেখাতে পারে অন্য রকম। ট্রটস্কীর লেখা ১৯০৫-এর বিপ্লবের ইতিহাসে আমরা পড়ি এইরকম এক লড়াইয়ের কথা। সাধারণ ধর্মঘটে যে সব দাবীগুলি অগ্রাধিকার পেয়েছিল, সেগুলি সব রকম বিরোধী স্তরের মানুষের জন্য প্রযোজ্য, যদিও তার মানে শ্রমিকরাও লাভবান হয়েছিলেন। কিন্তু আট ঘন্টার শ্রমদিবসের দাবী ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দাবী, যেটা ন্যূনতম কর্মসূচীর একটি প্রধান দাবী। ২৬শে অক্টোবর থেকে শ্রমিকদের মধ্যে এই দাবী নিয়ে আলোড়ন হতে থাকে। ২৯শে অক্টোবর সোভিয়েত প্রস্তাব নেয়, সমস্ত ফ্যাক্টরীতে আট ঘন্টা শ্রমদিবস চালু হোক। ৩১শে অক্টোবর থেকে বহু ফ্যাক্টরীতে শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে আটঘন্টার বেশী কাজ করতে অস্বীকার করেন। এর জবাবে মালিকরাও ঐক্যবদ্ধ হয়। প্রথমে সরকার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ফ্যাক্টরীগুলি বন্ধ করে দেয়। তারপর লক আউট বাড়তে থাকে। পুঁজি ও রাষ্ট্রের ঐক্যবদ্ধ জোটের মুখে সেন্ট পিটার্সবুর্গ সোভিয়েত ১২ই নভেম্বরে পিছু হঠতে বাধ্য হয়। তাঁদের প্রস্তাবে বলা হয়, এই মালিক ও রাষ্ট্র ঐক্য দেখাচ্ছে, আট ঘন্টা শ্রম দিবস শুধু অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, রাজনৈতিক সমস্যাও। বিপ্লবের রাজনৈতিক বিজয় ছাড়া আটঘন্টার শ্রমদিবস চালু করা যাবে না। ট্রটস্কী ব্যাখ্যা করেন, শুধু সাধারণ ধর্মঘট, শুধু আটঘন্টার দাবী নয়, এমন কি সোভিয়েত থাকাও যথেষ্ট নয়, চাই শ্রমিক শ্রেণীর হাতে অস্ত্র, চাই সশস্ত্র অভ্যুত্থান।২৬
এই অভিজ্ঞতা থেকে, ৩ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার হওয়ার পর, ট্রটস্কী একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন। ১৯০৫-এ লেখা তাঁর বেশ কিছু প্রবন্ধের সঙ্গে শেষ অধ্যায় হিসেবে এটি যুক্ত হয়। ‘আমাদের বিপ্লব’ শীর্ষক বইয়ের এই শেষ দীর্ঘ প্রবন্ধ ছিল ইতোগি ই পার্স্পেক্টিভি বা ফলাফল ও ভবিষ্যতের দিশা।২৭
ট্রটস্কীর রণনীতির ভিত্তি ছিল একদিকে শ্রেণী সংগ্রামের অভিজ্ঞতা, অন্যদিকে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর সচেতনতা ও মেনশেভিকদের প্রতি ঠিক তা নিয়ে তাঁর সমালোচনা। তিনি হেগেলের ‘টোট্যালিটি’-র বর্গটি অবলম্বন করেন, এবং এই কারণে ধনতন্ত্র ও শ্রেণী সংগ্রামকে বিশ্বজোড়া প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেন। তাই তিনি ব্যাখ্যা করেন, আগে যে সব দেশে পুঁজিবাদের বিকাশ হয়েছে, অনুন্নত রাশিয়াতে তাদের মত “স্বাভাবিক” বিকাশ ঘটবে না। অ-রুশ, বিকশিত পুঁজি যেভাবে বিশ্ব বাজার দখল করেছে, তার ফলে রাশিয়াতে বিদেশী পুঁজির চাপ প্রচুর পরিমাণে পড়েছে, অগ্রসর ধনতন্ত্রের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা রাশিয়ার আমূল আধুনিকীকরণ ও শিল্পায়ণকে বাধা দেবে। এর ফলে, তিনি প্রস্তাব করলেন, যে রুশ ধনিক শ্রেণী বিপ্লবী বুর্জোয়ার ভূমিকা নিতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, তিনি মেনশেভিকদের বিপ্লব সম্প্ররকিত ধারণাকে সরাসরি অ-দ্বান্দ্বিক বলে আক্রমণ করেন। “চেরেভানিন তাঁর রণকৌশল নির্মাণ করেছেন স্পিনোজা যেভাবে তাঁর নীতিশাস্ত্রকে করেছিলেন, অর্থাৎ জ্যামিতিকভাবে”। ২৮
ট্রটস্কীর চিন্তার আরেকটা উল্লেখযোগ্য দিক হল অর্থনীতিবাদ বর্জন। প্লেখানভ-ধাঁচের মার্ক্সবাদ থেকে ভেঙ্গে বেরোতে না পারলে ট্রটস্কীর পক্ষে নিরন্তর বিপ্লবের রণনীতি প্রস্তাব করা সম্ভব হত না। প্লেখানভদের বক্তব্য ছিল, প্রথমে বুর্জোয়া শ্রেণী ক্ষমতায় আসবে, তারপরে অর্থনীতিতে রূপান্তর হবে, তবে শ্রমিক শ্রেণীর ক্ষমতার প্রশ্ন উঠবে। ট্রটস্কী সবরকম সামাজিক, রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত দ্বন্দ্বকে “অর্থনৈতিক ভিত্তির” মাধ্যমে সমাধান করার এই প্রয়াসকে সমালোচনা করে বলেন, “শ্রমিক শ্রেণীর ডিক্টেটরশিপ যান্ত্রিকভাবে একটি দেশের প্রযুক্তিগত বিকাশ ও সম্পদের উপর নির্ভরশীল বলে কল্পনা করা হল “অর্থনৈতিক” বস্তুবাদের হাস্যকর সরলীকরণ। এই দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে মার্ক্সবাদের কোনো সাদৃশ্য নেই”। ২৯
সবশেষে, ট্রটস্কীর পদ্ধতি ছিল দৃঢ়ভাবে ইতিহাসাশ্রয়ী। রাশিয়ার সমাজবিন্যাসের ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্যকে আলোচনা করে তবেই তিনি তাঁর রণনীতি প্রস্তাব করেছিলেন। একই সঙ্গে, তা ছিল ঐতিহাসিক বিকাশকে ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে চলা প্রক্রিয়া হিসেবে দেখার প্রবণতা। এটা জরুরী ছিল। রুশ মার্ক্সবাদের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল কৃষক সমাজ ভিত্তিক সমাজতন্ত্র গড়ার নারোদনিক রাজনীতির সঙ্গে লড়াই করে। প্লেখানভদের কাছে সেটা ছিল জরুরী লড়াই। কিন্তু সেই কাজ করতে গিয়ে তাঁরা জোর দিয়েছিলেন কেবল সারা পৃথিবীর প্রলেতারীয় শ্রেণী সংগ্রামের মিলের উপরে। রাশিয়ার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কোনো কথাকে তাঁরা গুরুত্ব দিতে চাইতেন না। ট্রটস্কীর রাজনীতি শুরু হয়েছিল নারোদনিক হিসেবে। নারোদনিক চিন্তাতে কল্পনার (কৃষকদের সঙ্ঘবদ্ধ জীবন – মীর বা ওবশ্চিনা – হবে ভবিষ্যত সমাজতন্ত্রের ভিত্তি ) সঙ্গে যেটুকু বাস্তব (রুশ কৃষকরা শুধু সামন্ততন্ত্র নয়, ধনতন্ত্রের দ্বারাও শোষিত, তাই তাঁরা ধনতন্ত্র বিরোধী লড়াইতেও অংশ নিতে পারেন) মিশে ছিল, ট্রটস্কী এটা গ্রহণ করতে অনেক বেশী প্রস্তত ছিলেন। তাই তিনি প্লেখানভের মতো, প্রতি ধাপে রাশিয়ার ভবিষ্যতকে পশ্চিম ইউরোপের অতীত ইতিহাসের সঙ্গে মেলাতে রাজি ছিলেন না। অনেক পরে, রুশ বিপ্লবের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন, নারোদনিকদের নানা মোহ থাকলেও, তাঁদের চিন্তা রুশ সমাজ বিকাশের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের উপর দাঁড়িয়ে আছে, যদিও নারোদনিকরা সেটা বুঝেছিলেন একপেশে ভাবে। প্লেখানভরা এর উল্টোদিকে, সাধারণ যেটা, তার উপর জোর দিতে গিয়ে অবহেলা করেছিলেন যেটা বিশেষ, তাকে। ৩০
পদ্ধতিগত অগ্রগতির ফলে ট্রটস্কী মেনশেভিক চিন্তা থেকে ভেঙ্গে রুশ সমাজ, ও তাতে শ্রমিক শ্রেণীর ভূমিকাকে অন্যভাবে দেখেছিলেন। তিনি বলেন, রাশিয়াতে শহরাঞ্চলে শ্রমিক শ্রেণী ছাড়া অন্য কোনো বড় বিপ্লবী শ্রেণী নেই। রুশ শিল্পায়ণের যে চরিত্র, তার ফলে শহুরে পেটি বুর্জোয়া কারিগর, যারা ছিলেন ফরাসী বিপ্লবে সাঁ কুলোতদের বড় অংশ, তাঁরা রাশিয়াতে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিলেন। তাই রুশ বিপ্লবে বৈপ্লবিক পরিসমাপ্তির জন্য শ্রমিক শ্রেণীর কোনো বিকল্প ছিল না। ট্রটস্কী কোনো রকম “তাৎক্ষণিক সমাজতন্ত্রের” প্রবক্তা ছিলেন না। কিন্তু তিনি শ্রেণী সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে যে মৌলিক কথাটা তুলে ধরেন, তাকে দুভাগে ভাগ করে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথমত, বুর্জোয়া শ্রেণী প্রতিক্রিয়াশীল, আর কৃষকরা নিজেদের কেন্দ্রীয়ভাবে সংগঠিত করতে পারে না। তাই বিপ্লবের শীর্ষে যে বিপ্লবী বিকল্প সরকার থাকবে, তাতে প্রধান ভূমিকা নেবে শ্রমিক শ্রেণী ও তার দল। কিন্তু তার ফলে এক নতুন দ্বন্দ্ব অনিবার্যভাবে তৈরী হবে। বিপ্লবী দল ও বিপ্লবী সরকার দেখবে, ন্যূনতম কর্মসূচী চালু করতে গেলে বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাধবে। তিনি দুটো নির্দিষ্ট উদাহরণ দেন। যদি বিপ্লবী সরকার শ্রমিক শ্রেণীর প্রাধান্যের ফলে আট ঘন্টার শ্রমদিবস চালু করে, তাহলে বুর্জোয়া শ্রেণী প্রতিরোধ করবে। তখন কি হবে? পার্টির নেতারা সরকার থেকে পদত্যাগ করবেন? এটা কেবল কয়েকজন মন্ত্রীর ভূমিকা হতে পারে। কিন্তু গোটা শ্রেণী কি করবে? তারা কি মালিকের প্রতিরোধের সামনে মাথা নোয়াবে? তাহলে তো ক্ষমতা দখলের দরকারই ছিল না।
একইভাবে, বেকার সমস্যা দূর করার ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণীর উৎসাহ থাকবে। কিন্তু বুর্জোয়া শ্রেণী তো নির্ভর করে শ্রমের উদ্বৃত্ত বাহিনীর উপর। বেকারদের সমস্যা সমাধান করার অর্থ বুর্জোয়াদের ঐ অর্থনৈতিক ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া। তার উপর, সরকার যদি শ্রমিক শ্রেণীর উপর নির্ভরশীল সরকার হয়, তাহলে ধর্মঘটের সময়ে সরকার ধর্মঘটরত শ্রমিকদের আর্থিক সাহায্য করতে পারে। সেক্ষেত্রে মালিকরা জবাব দেবে লক আউট—ক্লোজারের মাধ্যমে। তখন প্রশ্ন উঠবে, সরকার কি তাহলে বন্ধ কল-কারখানা অধিগ্রহণ করবে?
“এই সব খুব স্পষ্ট করে দেখায় যে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা একটি বিপ্লবী সরকারে ঢুকতে পারেন না, যেখানে তাঁরা আগাম শ্রমিক শ্রেণীকে প্রতিশ্রুতি দেবেন যে তাঁরা ন্যূনতম কর্মসূচীতে জমি ছাড়বেন না, আর বুর্জোয়া শ্রেণীকে প্রতিশ্রুতি দেবেন যে তাঁরা তার বাইরে যাবেন না। এরকম দ্বৈত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হওয়া অসম্ভব”। ৩১
অর্থাৎ ঃ
(১) বুর্জোয়া শ্রেণী প্রতিবিপ্লবী;
(২) শহরে কোনো বিপ্লবী পেটিবুর্জোয়া শ্রেণী নেই;
(৩) তাই বিপ্লবের জয়ের জন্য চাই শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে বিপ্লবী বিকল্প সরকার গড়ে তোলা;
(৪) সেক্ষেত্রে ন্যূনতম কর্মসুচির মধ্যে আটকে থাকা যাবে না;
(৫) শুরু হবে কৃষক সমর্থন পুষ্ট শ্রমিক শ্রেণীর ডিক্টেটরশিপ।
লেনিন ও ট্রটস্কীঃ
এর পর যে প্রশ্ন আমাদের সামনে আসে, তা হল, সেক্ষেত্রে লেনিন আর ট্রটস্কীর মতভেদ কোথায়, কতটা ছিল? আমরা এই প্রবন্ধে তার সংক্ষিপ্ত আলোচনাই করতে পারব।৩০ কিন্তু কিছুটা আলোচনা আবশ্যক, কারণ তা না হলে, “পুরোনো বলশেভিকবাদ” বনাম এপ্রিল থিসিস বিতর্ক কেন হয়েছিল, কেনই বা ১৯১৭তে লেনিন ও ট্রটস্কীর মধ্যে দ্রুত মতৈক্য হয়েছিল, তা বোঝা যায় না।
লেনিনের রুশ বিপ্লব সম্পর্কিত দিশা নির্মিত হয়েছিল কয়েকটি ধাপে – তাঁর দর্শন চিন্তা , অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ, তার ভিত্তিতে শ্রেণী সংগ্রাম সম্পর্কে তাঁর বিশ্লেষণ, এবং তা থেকে বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কে তাঁর অবস্থান। লেনিনের প্রাথমিক দ্বন্দ্বতত্ত্ব সম্পর্কিত ব্যাখ্যা এবং মার্ক্সের ক্যাপিটালের ভিত্তিতে ও রাশিয়া সম্পর্কে বিপুল তথ্য সংগ্রহ করে তাঁর অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ থেকে তিনি দাবী করেন, ইতিমধ্যেই রাশিয়াতে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা প্রাধান্য বিস্তার করেছে। কিন্তু একই সঙ্গে, তিনি উল্লেখ করেন যে রাশিয়াতে ধনতন্ত্রের বিকাশ ও পুঁজি সঞ্চয় প্রক্রিয়া ছিল অপেক্ষাকৃত প্রাথমিক স্তরের। মার্ক্স ক্যাপিটাল-এ ধনতন্ত্রের বিকাশের যে বিভিন্ন স্তরের উল্লেখ করেছিলেন, তার অনুসরণে লেনিন বলেন, উন্নত শিল্পভিত্তিক ধনতন্ত্রের স্ব-বিরোধগুলি ধনতান্ত্রিক বিকাশের গোটা ইতিহাসের মধ্যেই দেখা যায়, কিন্তু সেগুলি স্পষ্ট রূপ পায় ধীরে ধীরে, যে পরিমাণে ধনতন্ত্র তার সর্বোচ্চ স্তরের দিকে এগোয়। মার্ক্সের ক্যাপিটালের ভিত্তিতে লেনিন এই পর্বে শিল্পপুঁজিকে ধনতন্ত্রের সর্বোচ্চ স্তর বলে মনে করেছিলেন। নারোদনিকদের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে তিনি দেখাতে চাইলেন কৃষিক্ষেত্রেও পুঁজির প্রাধান্য গড়ে উঠেছিল। তিনি বলেন, সামন্ততন্ত্রের উপর ধনতন্ত্রের প্রাধান্য বিস্তার করার শেষ স্তর হল বড়, যন্ত্রভিত্তিক শিল্প উৎপাদনের ব্যাপ্তি। আর, সেই স্তর এলে তবেই ধনতন্ত্র তার নিজের মধ্য থেকে তার বিরোধিতা করার শক্তি তৈরী করে। ৩৩
লেনিনের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ও তার সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক পন্থার সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন নীল হার্ডিং।৩৪ আমাদের সচেতন থাকতে হবে যে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ লেনিনের রাজনৈতিক পন্থা নির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ । তিনি শ্রমিক শ্রেণীকে অগ্রণি বলেছেন নিছক মার্ক্স বা প্লেখানভ বলেছেন বলে না, বরং তাঁর বিশ্লেষণ অনুযায়ী এই শ্রেণীই একমাত্র শ্রেণী যারা শোষণের পূর্ণ চরিত্র উপলব্ধি করতে পারবে, সেই কারণে। ফ্যাক্টরী উৎপাদন কৃষক সমাজ ও তাঁদের বিচ্ছিন্ন জীবনের থেকে স্বতন্ত্র একটি শ্রেণীকে গড়ে তোলে, যাদের শ্রমের সামাজিকীকরণের ফলে তারা ঐক্যবদ্ধ ক্ষমতার উপর ভর করে, এবং ফ্যাক্টরীতে একাধারে শ্রেণী দ্বন্দ্ব প্রকট হয়, আর জোটবদ্ধ লড়াই সম্ভব হয়।৩৫
সমাজতন্ত্র সম্ভব কেবল উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ হলে। এই বাস্তব সত্য, এবং জার্মান মতাদর্শ লেখার যুগ থেকে মার্ক্স-এঙ্গেলসের এই যে অন্যতম কেন্দ্রীয় বক্তব্য, লেনিন তাকে অস্বীকার করেন নি। কিন্তু তিনি তাকে যে সমীকরণের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেন, তা হল, এই উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের জন্য চাই প্রতিটি দেশে স্বতন্ত্র, স্বয়ংসম্পূর্ণ বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লব, যা বুর্জোয়া সমাজ ও অর্থনীতির বিকাশ ঘটাবে।
১৯০৫ সালে ও তারপরে, লেনিনের সঙ্গে এই ক্ষেত্রে ট্রটস্কীর পার্থক্য দেখা যায়। মার্চ-এপ্রিল ১৯০৫-এ লেনিন পার্ভুসের সমালোচনা করে একটি প্রবন্ধে লেখেন যে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার অসম্ভব, “যদি না আমরা আকস্মিক, ক্ষণস্থায়ী ঘটনার কথা বলি, কোনো স্থায়ী, ইতিহাসে নিজের দাগ রেখে যাওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন বিপ্লবী ডিক্টেটরশিপের কথা নয়। এটা অসম্ভব, কারণ জনগণের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনপ্রাপ্ত একটি ডিক্টেটরশিপই একমাত্র টেঁকসই হতে পারবে (চিরন্তন নয় অবশ্যই, কিন্তু আপেক্ষিকভাবে)। কিন্তু রুশ প্রলেতারিয়েত বর্তমানে রাশিয়ার জনসংখ্যায় সংখ্যালঘু। তারা বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারে শুধু যদি তারা আধা-প্রলেতারীয়, আধা-মালিক জনতার সঙ্গে, অর্থাৎ শহরের ও গ্রামের দরিদ্র পেটি-বুর্জোয়া জনতার সঙ্গে, জোটবদ্ধ হয়। সম্ভাব্য ও কাম্য বিপ্লবী-গণতান্ত্রিক ডিক্টেটরশিপের সামাজিক ভিত্তির এমন গঠন অবশ্যই বিপ্লবী সরকারের গঠনকে প্রভাবিত করবে, এবং অনিবার্যভাবে তাতে অংশ নেবে, এমনকি প্রাধান্য আবে, বিপ্লবী গণতন্ত্রের মিলিত প্রতিনিধিবর্গ ...। মহান হতে হলে, ১৮৪৮-৫০ নয়, ১৭৮৯-৯৩-র স্মৃতিকে তুলে ধরতে এবং ঐ বছরগুলিকে পেরিয়ে যেতে হলে, ব্যাপক জনতাকে জাগিয়ে তুলতে হবে...। ঐতিহাসিক বিকাশের বিষয়গত যুক্তি তাঁদের সামনে রাখে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নয়, গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্তব্যসমূহ”।৩৬
১৯০৫ সালেই, তৃতীয় (বলশেভিকদের ডাকা) পার্টি কংগ্রেসে তিনি আবার বলেন, বিপ্লবের কর্তব্য হল শ্রমিক ও কৃষকের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক ডিক্টেটরশিপ আনা।৩৭ এর পরেও রুশ বিপ্লব সম্পর্কে তিনি একই কথা বলেন। কৃষি কর্মসূচী সম্পর্কে তাঁর বইয়ে তিনি লেখেন, রাশিয়ার সামনে পথ একটাই – বুর্জোয়া বিকাশের পথ। সেই বিকাশ দুটি আঙ্গিকে হতে পারে। সংস্কার অথবা বিপ্লব, দুটোই সম্ভব। বড় জমিদাররা ধীরে ধীরে বুর্জোয়া হয়ে উঠতে পারে, অথবা কৃষকরা বিপ্লব করে সামন্ত মালিকানা উচ্ছেদ করতে পারে। এই দুই পথকে তিনি বলেছিলেন প্রাশিয়ার পথ আর আমেরিকার পথ। এর রাজনৈতিক পরিপূরক হিসেবে তিনি বলেন, বিপ্লবী গণ সংগ্রামের মর্মবস্তু হল, রাশিয়া জমিদার-বুর্জোয়া রাষ্ট্র হবে না কৃষক-বুর্জোয়া রাষ্ট্র হবে।৩৮
উদ্ধৃতি আরো বাড়ানো যায়। মূল কথা হল, লেনিন মনে করেছিলেন, যেহেতু কৃষকেরা পেটি-বুর্জোয়া, তাই তাঁদের সঙ্গে শ্রমিকদের জোট বিপ্লবে নেতৃত্ব দিলে, তলা থেকে, প্রশস্ত গণতান্ত্রিক পথে বুর্জোয়া বিকাশের পথ সুগম হবে, কিন্তু তার চেয়ে বেশী কিছু হবে না। উপরন্তু, তিনি মনে করেছিলেন, এই রকম জোট কোনো বিপ্লবী সরকার গড়লে তাতে শ্রমিক শ্রেণীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকতে পারে না। আগে একটা বুর্জোয়া অর্থনীতি-সম্বলিত সাধারণতন্ত্র কায়েম হবে, সেখানে এক “নতুন প্রজন্মের স্বাধীন ও সাহসী মানুষ নির্মিত হবে”, তবে সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম বাড়তে থাকবে।৩৯ গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সোশ্যাল ডেমোক্রেসীর দুই রণকৌশল গ্রন্থে তিনি এই ধারণাই ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, বুর্জোয়া বিপ্লব শ্রমিক শ্রেণীর কাছে একেবারে আবশ্যক। তিনি শ্রমিক নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সংজ্ঞা স্পষ্ট করে দেনঃ
“সবটা জমি কৃষকদের কাছে হস্তান্তর করা সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে চিহ্নিত করবে, এবং বিপ্লবের সামাজিক ভিত্তিকে তার শেষ পরিণতি অবধি নিয়ে যাবে, কিন্তু এটি কোনোক্রমেই একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হবে না ... । কৃষক অভ্যুত্থানের সাফল্য, গণতান্ত্রিক বিপ্লবের বিজয়, একটি গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের ভিত্তিতে সমাজতন্ত্রের জন্য প্রকৃত ও নির্ণায়ক সংগ্রামের জন্য কেবল জমি তৈরী করবে। সেই সংগ্রামে জমির মালিক শ্রেণী হিসেবে কৃষকেরা সেই একই বিশ্বাসঘাতক, অস্থিতিশীল ভূমিকা পালন করবে, যা এখন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে করছে বুর্জোয়া শ্রেণী”।৪০
লেনিনের চিন্তায় এই সময়ে একটা দ্বন্দ্ব ছিল, যা সরে যায় ১৯১৫-১৭তে, নতুন করে হেগেল চর্চা, সাম্রাজ্যবাদ ও বিশ্ব অর্থনীতির ঐক্য সম্পর্কে তাঁর নতুন ভাবনা, এবং বুর্জোয়া ও প্রলেতারীয় রাষ্ট্রের প্রভেদ সম্পর্কে তাঁর নতুন চিন্তার ফলে। এর রাজনৈতিক ফল হয় এপ্রিল থিসিস। কিন্তু আপাতত আমাদের দেখতে হবে লেনিন ও ট্রটস্কীর ১৯০৫-এর মতভেদকে। পঞ্চম পার্টি কংগ্রেসে ট্রটস্কী ছিলেন না বলশেভিক, না মেনশেভিক প্রতিনিধি। একটি বিশেষ ধারার প্রতিনিধি হিসেবে তাঁকে বক্তৃতা দিতে দেওয়া হয়, এবং তা ছিল প্রধানত মেনশেভিকদের প্রতি সমালোচনামূলক। ১৯২৪ থেকে, যখন জিনোভিয়েভ ও স্তালিন ট্রটস্কীর বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করেন, তখন বলা হয়, তিনি ছিলেন কৃষক বিরোধী। উপরন্তু বলা হয়, ১৯০৫ এবং ১৯১৭তে লেনিনের বক্তব্যের মধ্যে পার্থক্য ছিল না। দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি অন্যত্র আলোচিত হবে। এখানে দেখা দরকার, ট্রটস্কী কতটা কৃষক বিরোধী ছিলেন।
ইতোগি ই পার্স্পেক্টিভি-তে ট্রটস্কী প্রথমেই বলেছিলেন, “মার্ক্সবাদ আগাম এই বিপ্লবের সামাজিক চরিত্র অনুমান করেছিল। একে বুর্জোয়া বিপ্লব বলার মাধ্যমে মার্ক্সবাদ দেখিয়েছিল যে বিপ্লবের আশু বিষয়গত কর্তব্য হল ‘সার্বিকভাবে বুর্জোয়া সমাজের বিকাশের স্বাভাবিক পরিবেশ’ গড়ে তোলা”।৪১ কিন্তু, তিনি প্রশ্ন তোলেন, শ্রমিক শ্রেণীর প্রাধান্য ছাড়া বিপ্লব সফল হবে কি না , এবং প্রাধান্য থাকলে তা কোনদিকে যাবে? এখানে আসে কৃষক জনতার প্রশ্ন। ‘৯ই জ্যানুয়ারী পর্যন্ত’ প্রবন্ধে পার্ভুস যে মুখবন্ধ লেখেন, তাতে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “জার নয়! চাই শ্রমিকদের সরকার”। এই উক্তির দায় পরে ট্রটস্কীর উপর চাপিয়ে বলা হয়, তিনি এই কথা বলে কৃষকদের ভুলে গিয়েছিলেন। ট্রটস্কী দেখান, ঐ সময়ে তিনি রাশিয়াতে বলশেভিকদের সঙ্গে সহযোগিতা করে একটি লিফলেট লিখেছিলেন যার শিরোনাম ছিল “না জার, না জেমস্তভো, বরং জনগণ”। তিনি বলেন, জনগণ বলতে শ্রমিক এবং কৃষকদের কথা বলা হয়।৪২
লন্ডন কংগ্রেসে তাঁর পূর্বোল্লিখিত বক্তৃতায় তিনি বলেন, রাশিয়াতে শহরাঞ্চলে কোনো গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া শ্রেণী নেই, এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে পারীতে সাঁ-কুলোতরা যে ভূমিকা পালন করেছিল, সেটা দখল করেছে শিল্প শ্রমিকরা। অতএব, তিনি বলেন, অষ্টাদশ শতাব্দীর পেটি বুর্জোয়াদের মতই, রুশ প্রলেতারিয়েতকে “সমর্থন খুঁজতে হবে কৃষক জনতার মধ্যে, এবং বিপ্লবকে যদি জয়যুক্ত হতে হয়, তবে প্রলেতারিয়েতকে ক্ষমতা নিতে হবে। একটি সরকার, যাকে সরাসরি সমর্থন করছে প্রলেতারিয়েত, এবং তাঁদের মাধ্যমে বিপ্লবী কৃষকরা, তা এখনও একটি সমাজতান্ত্রিক ডিক্টেটরশিপ নয়”।৪৩
কৃষিবিপ্লব বলতে তিনি কি বুঝেছিলেন? ১৯০৫-এর ইতিহাস রচনা প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, “কৃষি সমস্যার সম্পূর্ণ ফর্মূলা এই রকমঃ অভিজাতদের জমি বাজেয়াপ্ত করা, জারতন্ত্রকে উৎপাটিত করা, গণতন্ত্র...। এর কোনোটাই কৃষি সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান দিতে পারে নাঃ ধনতন্ত্রে কোনো সমাধান পাওয়া যাবে না। কিন্তু যে কোনো ক্ষেত্রেই, আসন্ন সমাধানের আগে আসবে স্বৈরতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রকে নির্মূল করা।
“রাশিয়ার কৃষি সমস্যা ধনতন্ত্রের উপর একটা ভারী বোঝা, সেটা বিপ্লবী দলের প্রতি একাধারে সহায়ক এবং তাঁর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, এটা উদারনীতিবাদের হোঁচট খাওয়ার জায়গা এবং প্রতিবিপ্লবের যে মৃত্যু অবধারিত, তার একটা স্মারকচিহ্ন”।৪৪
সুতরাং লেনিন ও ট্রটস্কীর মতভেদ কৃষককে অবহেলা করা নিয়ে ছিল না। বিতর্ক ছিল দুটি বিষয় নিয়ে। প্রথমত, লেনিন মনে করেছিলেন, কৃষকরা নিজেদের স্বাধীন দেশজোড়া দল তৈরী করে বিপ্লবী সরকারে বড় ভূমিকা নিতে পারবে। ট্রটস্কী এই সম্ভাবনাকে অস্বীকার করেছিলেন। ১৯১৭র বিপ্লব, এবং বিংশ শতাব্দীর বহু বিপ্লব দেখিয়েছে, কৃষকরা কোনো না কোনো শহুরে দলের অনুবর্তীই হয়েছেন, কৃষকের দল, বা দরিদ্র কৃষকের দল বলে কিছু গড়ে ওঠে নি। দ্বিতীয়ত, লেনিন মনে করেছিলেন, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব হওয়ার পরও একটা মোটামুটি সময়সাপেক্ষ রূপান্তরের আগে প্রলেতারিয় বিপ্লবের কোনো সম্ভাবনা নেই। ট্রটস্কী মনে করেছিলেন, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব শ্রমিক শ্রেণীকে ন্যূনতম যা দেওয়ার কথা, সেটা পেতে গেলেও শ্রমিক শ্রেণীকে বুর্জোয়া শ্রেণীর সম্পত্তির উপর আঘাত নামাতে হবে। এমনকি, সামন্ততন্ত্রকে নির্মূল করার কাজও উদারনৈতিক রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই না করে সম্ভব হবে না। আর, বিপ্লবের নেতৃত্বে এলে শ্রমিক শ্রেণী নিজের স্বার্থে যে কোনো পদক্ষেপ নিলেই বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে তাঁদের দ্বন্দ্ব বাড়বে। ১৯১৭ সালের অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দিল, ঠিক এরকমই ঘটল। আট ঘন্টার শ্রমদিবস, মজুরী বৃদ্ধি, সমান কাজে সমান মজুরী, যে কোনো দাবী নিয়েই লড়াই সর্বাত্মক বুর্জোয়া বিরোধী লড়াইয়ের দিকে গেল। শুধু তাই নয়, শ্রমিক শ্রেণীর ডিক্টেটরশিপ কায়েম করে তবে কৃষি বিপ্লবের মৌলিক কর্তব্য পালন করা সম্ভব হল।
১৯১৭-র বিপ্লব, ‘পুরোনো বলশেভিকবাদ’, ও লেনিনের বিপ্লবী নীতি’ঃ
ফেব্রুয়ারী বিপ্লব যখন ফেটে পড়ে, তখন বলশেভিক, মেনশেভিক-আন্তর্জাতিকতাবাদী, মেঝরায়ঙ্কা, অর্থাৎ শ্রমিক আন্দোলনের বামপন্থী অংশ যেটা, তার সর্বোচ্চ নেতারা সকলে বিদেশে (লেনিন, জিনোভিয়েভ, ট্রটস্কী, মার্তভ, প্রমুখ), এবং তাঁদের পরের ধাপের নেতাদের বড় অংশ জেলে বা নির্বাসনে (কামেনেভ, সভের্দলভ ও অন্যরা)। বলশেভিক কেন্দ্রীয় কমিটির রুশ ব্যুরোর যারা পেত্রোগ্রাদে ছিলেন, তাঁরা হলেন শ্লিয়াপনিকভ, পিওতর জালুতস্কি, এবং ভিয়াচেস্লাভ মলোটভ। শ্লিয়াপনিকভরা সাদারণ ধর্মঘটের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, এবং শ্রমিকরা অস্ত্র চাইলে তাঁদের নিবৃত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারাও লিফলেটের মাধ্যমে তৃতীয় দিনে লড়াইকে সমর্থন করেন। অভ্যুত্থান যখন চলছে, তখনই ভাইবর্গ কমিটি একটি লিফলেট প্রচার করেন, যাতে তাঁরা আহবান করেন সোভিয়েত (শ্রমিক এবং সৈনিকদের প্রতিনিধি পরিষদ) নির্বাচন করার জন্য। তারা অবশ্য এর মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণীর রাজ বা ডিক্টেটরশিপ অফ দ্য প্রলেতারিয়েতের কথা ভাবছিলেন না। ১ মার্চে এক সাধারণ সভায় তাঁরা স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করেন, এই সোভিয়েত হবে অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার।৪৫ এর সঙ্গে বলশেভিকদের ১৯০৫-এর রণকৌশলের সাদৃশ্য স্পষ্ট। ১৯০৫ থেকে, লেনিনের বক্তব্য ছিল, রুশ বিপ্লব হবে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব, কিন্তু তার অগ্রগতির জন্য চাই উদারপন্থী বুর্জোয়াদের বিশ্বাসঘাতকতার সঙ্গে সব সম্পর্কচ্ছেদ করা, এবং শ্রমিক ও কৃষকের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক ডিক্টেটরশিপ কায়েম করা। ১৯০৫-এ সোভিয়েতের অভিজ্ঞতার পর তিনি বলেন, সোভিয়েত হবে এই বিপ্লবী গণতান্ত্রিক ডিক্টেটরশিপ বা অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের সাংগঠনিক রূপ। তৃতীয় (বলশেভিক) পার্টি কংগ্রেসে ক্রাসিনের প্রস্তাব থেকেও এই অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের প্রস্তাব উঠে আসে। ৪৬
পিটার্সবুর্গ কমিটির অবস্থা ছিল জটিল। ১৯১৪ সালে এই কমিটিতে অন্তত তিনজন পুলিশের চর ঢুকেছিল। একজন মার্চ ১৯১৭তেও ছিল। সে ধরা পড়ে ১৯১৭-র জুন মাসে। এই চরদের সাহায্যে পুলিশ কমিটির বহু সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। মার্চ ১৯১৭তে পুরোনো সদস্যরা জেল থেকে বেরবার পরও নতুন করে কমিটি গঠিত হয়, যাতে পুরোনো এবং নতুন দুরকম সদস্যই থাকেন। ৪৭ দেখা যায়, যারা ১৯১৪-১৫তে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তাঁরা অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল, এবং ৩রা মার্চ পিটার্সবুর্গ কমিটি যে সিদ্ধান্ত নেয়, তা ছিল ভাইবর্গ কমিটির চেয়ে অপেক্ষাকৃত মোলায়েম। তাদের প্রস্তাবে বলা হয়, তারা “অস্থায়ী সরকারের ক্ষমতার বিরোধিতা করবে না, পোস্তোল’কু, পোস্কোল’কু, তার কার্যক্রম শ্রমিক শ্রেণী ও ব্যাপক গণতান্ত্রিক মানুষের স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়”। ৪৮ Postol’ku, poskol’ku, শব্দদুটি এই সময়ে বলশেভিকদের একাংশ, মেনশেভিকদের সকলের, সোভিয়েতের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়। এই শব্দ ব্যবহার করার অর্থ, “যে পরিমাণে”, বা “যতদূর” এই অর্থ দেওয়া। সুতরাং, পিটার্সবুর্গ কমিটি বলল, যে পরিমাণে অস্থায়ী সরকার শ্রমিক শ্রেণী ও ব্যাপক গণতান্ত্রিক মানুষের স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহার করবে, তারা তার বিরোধিতা করবে না। নেতিবাচক শব্দচয়ন লক্ষ্যণীয় – সমর্থন করবে, এমন বলা হল না। এইখানে মেনশেভিকদের সঙ্গে তফাৎ।
বলশেভিক কেন্দ্রীয় কমিটির রুশ ব্যুরো প্রথমে “রাশিয়ার নাগরিকদের প্রতি” বলে যে ইস্তাহার প্রচার করে, সোভিয়েতের মুখপত্র ইজভেস্তিয়াতে তা পুনর্মুদ্রিত হয়। এতে তাঁরা বলেন, বড় বুর্জোয়া ও জমিদারদের প্রতিনিধিদের নিয়ে যে অস্থায়ী সরকার তৈরী হয়েছে, তাঁকে সমর্থন করা যায় না, এবং পার্টি ডাক দিচ্ছে এক বিপ্লবী অস্থায়ী সরকারের জন্য। সেই বিপ্লবী অস্থায়ী সরকারে থাকবেন সোভিয়েতে উপস্থিত সব দলের প্রতিনিধিরা, এবং তাঁদের কাজ হবে সমাজতন্ত্রীদের ন্যূনতম কর্মসূচী (অর্থাৎ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য সমাজতন্ত্রীদের কর্মসূচী) রূপায়ণ করা এবং সংবিধান সভা ডাকা। রুশ ব্যুরোর ১ মার্চের সভায় এই ইস্তাহারে ব্যক্ত মত আবার অনুমোদন করা হয়। কিন্তু তাঁরা শীঘ্রই বোঝেন, অন্য সমাজতন্ত্রী দলগুলি ন্যূনতম কর্মসূচী রূপায়ণকে প্রথম কাজ বলে মনে করছে না। তাঁরা তখন বললেন, তাঁরা এই অস্থায়ী সরকারকে সমর্থন করতে পারেন না, কিন্তু সরাসরি তার বিরোধিতা করতেও পারছেন না, কারণ “আমরা [একা] সরকারের দায়িত্ব নিতে পারব না”। ৪৯
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে বলশেভিকদের মত পরিবর্তন দেখা গেল। আর, আবারও তা ঘটল লেনিনবাদের নামেই। মার্চ মাসে দেশের নানা অঞ্চল থেকে পুরোনো কর্মীরা ফিরতে থাকেন। তাঁদের বেশ কয়েকজনকে রুশ ব্যুরোতে স্থান দেওয়া হয়। ১২ই মার্চ ১৫ জন পূর্ণ সদস্য ছিলেন। এরা হলেন সম্ভবত ঝালেস্কি, মুরানভ, শ্লিয়াপনিকভ, মলোটভ, জালুতস্কি, কালিনিন, শুটকো, শভেদচিকভ, ওলমিনস্কি, স্টাসোভা, উলিয়ানোভা, এলিঝারোভা, খাখারেভ, এরেমিয়েভ এবং বোকি। এছাড়া, ঐদিন স্থির হয়, স্তালিনকে সদস্যপদ দেওয়া হবে, কিন্তু ভোটাধিকার সহ নয়, কেবল সভাগুলিতে থাকা এবং কথা বলার অধিকার থাকবে।৫০ মুরানভ এবং স্তালিন একই সঙ্গে ফিরেছিলেন। ফলে এই সিদ্ধান্ত দেখায়, স্তালিন সম্পর্কে আপত্তি ছিল, এবং সম্ভবত মুরানভের সমর্থনের ফলেই তিনি কেন্দ্রীয় কমিটিতে ফেরেন।
আর এক জন সম্পর্কে কেন্দ্রীয় কমিটির ব্যুরো কড়া সিদ্ধান্ত নিল। তিনি হলেন লেভ বোরিসোভিচ কামেনেভ। তাঁকে ব্যুরোর সদস্যপদ দেওয়াই হল না, এবং বলা হল, তিনি প্রাভদায় স্বাক্ষরিত প্রবন্ধ লিখতে পারবেন না।৫১ কামেনেভের ক্ষেত্রে ব্যুরোর মত স্পষ্ট ছিল। ১৯১৫-র ফেব্রুয়ারিতে চতুর্থ ডুমার বলশেভিক সদস্যদের বিচার হয়েছিল। কামেনেভ তাঁদের সঙ্গে অভিযুক্ত ছিলেন। দেশদ্রোহের অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে পরিণত করার প্রস্তাবের সঙ্গে (অর্থাৎ রাশিয়ার বাইরে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের প্রস্তাবে) তিনি একমত নন।
কিন্তু পরবর্তী কয়েক দিনের মধ্যে একটা পরিবর্তন ঘটল। কেন্দ্রীয় কমিটিতে এবং পার্টির পত্রিকা প্রাভদাতে প্রাধান্যের জায়গাতে চলে এলেন কামেনেভ ও স্তালিন। কীভাবে তা হল সেটা অস্পষ্ট। শ্লিয়াপনিকভের স্মৃতিচারণে এর সমালোচনা করা আছে। কিন্তু ১৯২৩-এর সংস্করণ পাওয়া যায় না। ১৯২৫-এ তিনি কিছু অংশ পাল্টে লিখতে বাধ্য হন। তাই আমরা আভ্যন্তরীণ খবর পাই না, পাই তার ফলাফলের খবর। ১৫ই মার্চ, ৯ নং প্রাভদাতে প্রকাশিত হল কামেনেভের স্বাক্ষরিত প্রবন্ধ – “গোপন কূটনীতি ছাড়া”। প্রবন্ধের শুরুতে তিনি লেখেন, রুশ বিপ্লব যুদ্ধকে থামায় নি, এবং অবিলম্বে যুদ্ধ থামবে না। অতএব, তাঁর মতেঃ “যখন একটা সেনাবাহিনী আর একটা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তখন সবচেয়ে হাস্যকর নীতি হবে এক পক্ষের কাছে প্রস্তাব রাখা, যে তারা অস্ত্র নামিয়ে রেখে বাড়ি চলে যাক। এই নীতি শান্তির নীতি হবে না, হবে দাসত্বের নীতি, একটা নীতি যা এক স্বাধীন জনগণ ক্রুদ্ধভাবে প্রত্যাখ্যান করবেন। না, তাঁরা নিজেদের জায়গায় দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন, বুলেটের জবাব দেবেন বুলেটে, শেলের জবাব শেল দিয়ে”।
কামেনেভ তাহলে অস্থায়ী সরকারের কাছে কী দাবী করলেন? অবশ্যই একতরফা শান্তি প্রস্তাব নয়। তিনি বললেন, স্বাধীন জনগণের জানার অধিকার আছে, তাঁরা কেন লড়ছেন, অধিকার আছে যুদ্ধের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করার। “তাঁদের শুধু নিজেদের মিত্রদের কাছে নয়, বরং শত্রুদের কাছেও খোলাখুলি জানাতে হবে, যে তাঁরা কোনো দিগবিজয় আশা করেন না, কোনো বিদেশী জমি দখল করতে চান না, তাঁরা প্রত্যেক জাতিকে নিজের ভবিষ্যত স্থির করার অধিকার দেন”।৫২
কামেনেভ বলেন, বিপ্লবী রাশিয়াকে শান্তি আলোচনার জন্য মিত্রশক্তিকে বলতে হবে, কিন্তু ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীকে বিশৃঙ্খল করা বা “যুদ্ধ নিপাত যাক” এই ফাঁপা বুলি “আমাদের স্লোগান নয়”। এই কারণে তিনি সোভিয়েতের পক্ষ থেকে যে “সমগ্র পৃথিবীর জনগণের প্রতি আবেদন” প্রচার করা হয়েছিল৫৩, এবং যার সম্পর্কে শ্লিয়াপনিকভরা সন্দিহান ছিলেন, সেই দলিলকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন।
৭ই মার্চ প্রাভদা লিখেছিল, “অবশ্যই, আমাদের মনে পুঁজির শাসনের পতনের প্রশ্ন নেই, কেবল স্বৈরতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রের পতনের প্রশ্ন আছে”। কিন্তু ঐ সময়ে, অর্থাৎ স্তালিন-কামেনেভরা নেতৃত্বে প্রবেশ করার আগে, বুর্জোয়া অস্থায়ী সরকারের উপর আস্থা রাখার প্রশ্ন ওঠেনি।৫৪ কামেনেভের প্রবন্ধ প্রতিক্রিয়াশীল অস্থায়ী সরকারকে হঠানোর দাবী ছেড়ে সেনাবাহিনীকে পরামর্শ দিল, ওই সরকারের নেতৃত্বে যুদ্ধক্ষেত্রে সজাগ থাকতে।
সোভিয়েতের যে আবেদনকে কামেনেভ এত তারিফ করলেন, তার দিকেও আমাদের তাকানো দরকার। পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের উপর শ্রমিক এবং সৈনিকদের ধারাবাহিক চাপ ছিল। তাঁরা চাইছিলেন, কোনো তত্ত্বগত কারণে না, একেবারে বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে, যে যুদ্ধ শেষ হোক। সুখানভ, স্টেকলভ, সহ বেশ কয়েকজন মেনশেভিক গোড়ার দিকে সোভিয়েতে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন মেনশেভিক বামপন্থী বা মেনশেভিক-আন্তর্জাতিকতাবাদী। যুদ্ধের সময়ে পুরোনো বিভাজন ভেঙ্গে নতুন ধরণের বিভাজন তৈরী হয়েছিল। বলা যায়, তিনটি পক্ষ দেখা দিয়েছিল – যারা নিজের দেশের সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সমর্থক (defencist বলে পরিচিত), মধ্যপন্থী যারা যুদ্ধ বিরোধী, কিন্তু কমবেশী শান্তিবাদী অবস্থান থেকে, এবং যারা যুদ্ধ বিরোধী, এবং যুদ্ধের সময়েও শ্রেণী সংগ্রামকে চালু রেখে শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে আঘাত হানতে চান। রাশিয়াতে প্রথম পক্ষে পড়েছিলেন দক্ষিণপন্থী মেনশেভিকরা, মধ্যপন্থী মেনশেভিকদের বড় অংশ, সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারী দলের দক্ষিণপন্থী ও মধ্যপন্থীরা। প্লেখানভের গোষ্ঠী এত উগ্র যুদ্ধবাজ হয়ে পড়ে যে অধিকাংশ মেনশেভিকও তাঁদের থেকে আলাদা হয়ে থাকে। মার্তভ ছিলেন ছোট এক মেনশেভিক আন্তর্জাতিকতাবাদী গোষ্ঠীর নেতা। সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারী দলের কেন্দ্রীয় নেতা ভিক্টর চের্নভও ছিলেন যুদ্ধ বিরোধী। ১৯১৫ এবং ১৯১৬ সালে সুইজারল্যান্ডের জিমারোয়াল্ড এবং কিয়েনথালে দুটি সমাজতন্ত্রী সম্মেলনে এঁরা অংশ নেন, যেমন নেন জার্মানীর কাউটস্কিপন্থীরা সহ বেশ কিছু দেশের প্রতিনিধিরা। যুদ্ধকে শ্রেণী সংগ্রামের পথে মোকাবিলা করার কথা বলেন রাশিয়াতে বলশেভিকরা, ট্রটস্কী এবং নাশে স্লোভো গোষ্ঠীর বামপন্থীরা (নাশে স্লোভোতে মার্তভ ছিলেন নরমপন্থী), জার্মানীতে লিয়েবকনেক্ট-লুক্সেমবুর্গের সমর্থকরা, রোমানিয়াতে র্যাকভস্কি, বুলগেরিয়াতে কোলারভ প্রমুখ, পোল্যান্ডে ইয়োগিহেস-লুক্সেমবুর্গ-জারজিনস্কিদের এস ডি কে পি আই এল, এবং তাঁদের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কার্ল র্যাডেক, ফ্রান্সে প্রধানত রসমার, মোন্যাত, ও অন্যান্য নৈরাষ্ট্রবাদী-সিন্ডিকালবাদীরা, প্রমুখ। এঁদের সকলের সব বিষয়ে মতৈক্য ছিল না। কিন্তু এরাই ছিলেন বিপ্লবী ধারা।
রাশিয়াতে বিপ্লবের ফলে মধ্যপন্থীদের সংকট দেখা দেয়। তাঁরা যুদ্ধের বিরোধী। অথচ তাঁরা আবার নীতিগত ভাবে বিশ্বাস করতেন যে রুশ বিপ্লব হবে বুর্জোয়া বিপ্লব, এবং তাতে নেতৃত্ব থাকবে বুর্জোয়াদের হাতে। কিন্তু আবার, মধ্য এবং দক্ষিণপন্থী মেনশেভিকদের সঙ্গে তাঁদের, বিশেষত মেনশেভিক-আন্তর্জাতিকতাবাদীদের, মতভেদ ছিল। তাঁরা ভাইবর্গের বলশেভিকদের মত তোলা থেকে সোভিয়েত গড়েন নি, বরং আগে সোভিয়েতের কার্যনির্বাহী কমিটি তৈরী করেন, যাতে পার্টিগুলির অ-শ্রমিক নেতাদের স্থান নিশ্চিত করা হয় (১৯০৫-এর বিপ্লবে সোভিয়েত নির্বাচিত হয়েছিল ফ্যাক্টরী স্তর থেকে, এবং সমাজতন্ত্রী দলের অ-শ্রমিক নেতারা কেবল পরামর্শদাতার ভুমিকায় থাকতে পারতেন, যদি না সোভিয়েত নিজে কোনো পরিবর্তন করত)। কিন্তু তাঁরা সোভিয়েত গঠনে উৎসাহী ছিলেন। অস্থায়ী সরকারকে তাঁরা শান্তির জন্য চাপ দিয়েছিলেন, এবং সোভিয়েতের পক্ষ থেকে শান্তির আবেদন প্রকাশ করেছিলেন। সুখানভের লেখা খসড়ার ভিত্তিতে ওই আবেদনটি গৃহীত হয়। তাতে বলা হয় শান্তি চাই, গণতান্ত্রিক নীতি নিয়ে এবং দেশ দখল বা ক্ষতিপূরণের নামে লুন্ঠন বর্জন করে শান্তি প্রতিষ্টাহ করতে হবে। আপাতভাবে এ ছিল নীতিনিষ্ঠ বক্তব্য। কিন্তু ওই সুখানভরা তো অস্থায়ী সরকারকেও মেনে নিয়েছিলেন। ক্ষমতা নিজেদের হাতে না রাখার, এবং উদারনৈতিক বুর্জোয়াদের সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানে, তাঁরা কেবল আদর্শ কিন্তু বাস্তবায়িত হবে না এমন নীতির কথা বলছিলেন। অথচ, শুধু শ্রমিকদের না, সৈনিকদের মধ্যেও অস্থায়ী সরকারের প্রতি বিশেষ সমর্থন ছিল না। পশ্চিম রণাঙ্গনের প্রতিনিধিদের নিয়ে মিনস্ক শহরে একটি সম্মেলনে বিতর্ক হয়। দেখা যায়, অস্থায়ী সরকারের পক্ষে প্রায় কেউ নেই। সোভিয়েতের প্রস্তাবের সমর্থনে পড়ে ৬১০ ভোট, বিপক্ষে ৮ ভোট এবং ভোটদানে বিরত থাকেন ৪৬ জন। অথচ বিদেশ দপ্তরের মন্ত্রী এবং অস্থায়ী সরকারের প্রকৃত নেতা পাভেল মিলিউকভ, এবং যুদ্ধমন্ত্রী গুচকভ, তাঁদের নিজেদের বুর্জোয়া, আগ্রাসী নীতি নিয়েই চলতে থাকেন। সুতরাং সোভিয়েতের আহবান ছিল শ্রমিক এবং সৈনিকদের চোখে ধুলো দেওয়ার প্রস্তাব। তাঁকে সমর্থন করে কামেনেভ দেখালেন, তিনি বলশেভিকদের সঙ্গে নরমপন্থী সমাজতন্ত্রীদের দূরত্ব কমাতে চাইছেন। আর, এটা কামেনেভের একার অবস্থান ছিল না। সোভিয়েতের ইস্তাহার সম্পর্কে প্রাভদায় ১৪ই মার্চ সম্পাদকীয় লেখেন স্তালিন। তাঁর বক্তব্য হল, বিপ্লবী রাশিয়া ১৭৯২-এর ফ্রান্সের মত শত্রু জোটের সম্মুখীন নয়। তাই যুদ্ধ দীর্ঘজীবি হোক, এমন ঘোষণার কোনো জায়গা নেই। তিনি জিমারওয়াল্ড এবং কিয়েনথাল সম্মেলনের প্রস্তাবদের ইতিবাচক মনে করেন। কিন্তু সরাসরি যুদ্ধবিরোধী স্লোগানের বিরোধিতা করে তিনি লেখেন, “সরাসরি স্লোগান, ‘যুদ্ধ নিপাত যাক’, বাস্তব পন্থা হিসেবে একেবারে অকেজো, কারণ... তা যুযুধান শক্তিদের উপর বাস্তব প্রভাব ফেলার মত কিছু দেয় না”। এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের আহবানকে অভ্যর্থনা জানাতে হয়। তিনি সেই সঙ্গে বলেন, জার্মান জনগণ তাঁদের শাসকদের উচ্ছেদ করবেন, এটা যেহেতু নিশ্চিত নয়, তাই এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য কবে সফল হবে তাও নিশ্চিত নয়। তাই স্তালিনের সমাধান হল, অস্থায়ী সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে, শ্রমিক, সৈনিক ও কৃষকদের সভাতে ও মিছিলে শান্তি আলোচনার দাবী তুলতে হবে, যে আলোচনার ভিত্তি হবে জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতি।৫৫
স্তালিন এখানে দুটি বিষয় এড়িয়ে গেলেন। লেনিন ও অন্য বলশেভিকরা জিমারওয়াল্ড ও কিয়েনথাল প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন আপত্তি সত্ত্বেও, এবং তাঁরা নিজেদের “জিমারওয়াল্ড বাম” বলে একটি ধারাতে সংগঠিত করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, তাঁরা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে রূপান্তরিত করার ডাক দিয়েছিলেন। ভাইবর্গ কমিটির “যুদ্ধ নিপাত যাক” স্লোগানের বিরোধিতা করে স্তালিন বাস্তবে লেনিনের মতেরও বিরোধিতা করলেন। আর অস্থায়ী বুর্জোয়া সরকারকে “চাপ দিয়ে” যুদ্ধ বন্ধ করতে বলার পরামর্শের অর্থ, অবশ্যই, ওই সরকারকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকা। শ্লিয়াপনিকভ ভালই বুঝেছিলেন, এই সম্পাদকীয় রুশ ব্যুরোর নীতির তুলনায় অনেকটা নরম, অনেক শ্রেণী সমঝোতার দিকে ঘেঁষা। তাই তার স্মৃতিচারণে তিনি লেখেন, ১৪ই মার্চ, প্রথম এই নতুন নেতৃত্বের হাতে প্রাভদা প্রকাশিত হওয়ার পর টাউরিদে প্রাসাদে (অস্থায়ী সরকার এবং সোভিয়েত উভয়েরই দপ্তর) শোনা গেল, নরমপন্থী, বিচক্ষণ বলশেভিকরা উগ্রপন্থীদের উপর জয়ী হয়েছেন।৫৬ লারস লি বা এরিক ব্ল্যাঙ্ক আজকাল দাবী করেছেন যে ট্রটস্কীর অতিরঞ্জনের জন্য কামেনেভের ভূমিকাকে একপেশে ভাবে দেখা হয়েছে।৫৭ কিন্তু সোভিয়েতের কার্যনির্বাহীকমিটিতে আরেকজন বলশেভিক প্রতিনিধি হিসেবে স্তালিন প্রবেশ করেছিলেন। সোভিয়েতের কার্যবিবরণীতে, ইজভেস্তিয়ার রিপোর্টে, বা অন্য সংবাদপত্রে, কোথাও দেখা যায় না যে মেনশেভিক-সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারী জোটের আত্মসমর্পনবাদী রাজনীতির সরাসরি বিরোধিতা তিনি বা কামেনেভ করেছিলেন। যুদ্ধ চালু রাখতে হবে, এই বিষয়ে মধ্য-বাম মেনশেভিক সেরেতেলির সঙ্গে কামেনেভের বা স্তালিনের বিরাট তফাৎ ছিল না। আমার বক্তব্য এই না যে কামেনেভ মেনশেভিক ছিলেন। আমার বক্তব্য এই, যে দুই স্তর বিপ্লবের তত্ত্ব মেনে নেওয়ার ফলে, এবং যুদ্ধ থামানোকে বিপ্লবী দলের প্রথম শ্রেণীর কর্তব্য হিসেবে দেখেতে ব্যর্থ হয়ার ফলে, বাস্তব শ্রেণী সংগ্রামের মুখে কামেনেভের এই দোদুল্যমানতা দেখা দেয়।
লেনিন, ট্রটস্কী ও বিপ্লবী নীতিঃ
ফেব্রুয়ারী বিপ্লব যখন আরম্ভ হয় তখন লেনিন সুইজারল্যান্ডে। আর ট্রটস্কীকে ফ্রান্স থেকে স্পেনে পাঠানো হয় ১৯১৬-র শেষ দিকে, ও স্পেন থেকে তাড়িয়ে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রে। জারের উচ্ছেদের খবর পেয়ে দুজনেই একদিকে বিপ্লবী নীতি সম্পর্কে লেখেন (ট্রটস্কী বহু বক্তৃতাও দেন), আর অন্যদিকে রাশিয়া ফেরার চেষ্টা করেন। তাঁদের এই সময়ের বক্তব্য একটু খুঁটিয়ে দেখা দরকার। ৬ই মার্চ লেনিন পেত্রোগ্রাদে টেলিগ্রাম পাঠানঃ “আমাদের কৌশলঃ নতুন সরকারকে কোনো আস্থা না, তার প্রতি কোনো সমর্থন না। কেরেনস্কী বিশেষভাবে সন্দেহজনক; প্রলেতারিয়েতকে অস্ত্রে সজ্জিত করা একমাত্র গ্যারান্টি; পেত্রোগ্রাদ শহর পরিষদের এখনি নির্বাচন চাই; অন্য দলদের সঙ্গে কোনো বোঝাপড়া নয়”। ৫৮
১৯শে মার্চ, প্রাভদা অফিসে লেনিনের দূত হিসেবে হাজির হলেন আলেক্সান্দ্রা কোলোনতাই। তিনি প্রাভদার, তথা পার্টির পেত্রোগ্রাদে উপস্থিত সব নেতার জন্য দিলেন লেনিনের পাঠানো চিঠি।৫৯ প্রথম চিঠিটি কিছুটা কেটেছেঁটে প্রকাশিত হয় প্রাভদায়। দ্বিতীয়টি সাত বছর অপ্রকাশিত হয়ে বসে থাকে।এর পর লেনিন আরো তিনটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন, তবে সেগুলি সম্ভবত তিনি নিজে রশিয়া পৌছবার আগে তার কমরেডদের হাতে যায় নি।
প্রথম চিঠিতে লেনিন বলেন, ফেব্রুয়ারী বিপ্লব গুচকভ-মিলিউকভদের ক্ষমতায় এনেছে ‘এখনকার মতো’। কিন্তু বুর্জোয়া সরকার রুশ জনগণের সমস্যার সমাদান করতে পারবে না। এই সরকারের পাশে উঠে এসেছে এখনও পর্যন্ত স্বল্প বিকশিত, এবং অপেক্ষাকৃত দূর্বল শ্রমিক সরকার, যা শ্রমিক শ্রেণীর ও শহর ও গ্রামের সব গরীব জনতার স্বার্থ ব্যক্ত করছে। এই পরিস্থিতিকে তিনি চিহ্নিত করেন দ্বৈতক্ষমতার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বলে। “যে বলে যে শ্রমিকদের জারতন্ত্রী প্রতিক্রিয়র বিরুদ্ধে লড়াইয়ের স্বার্থে নতুন সরকারকে সমর্থন করতে হবে (এবং আপাতত এ কথা বলছে পত্রেসভ, গোভঝদেভ, চেঙ্খেলিরা, এবং সবরকম পিছলে যাওয়ার চেষ্টা সত্ত্বেও, চখেইদঝে) তারা শ্রমিকদের প্রতি বেইমান, শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থের প্রতি বেইমান, শান্তি ও স্বাধীনতার প্রতিও তাই”। ৬০
এই অবস্থায় লারস লি যখন দাবী করেন যে লেনিনের সঙ্গে কামেনেভের খুব বড় ফারাক ছিল না, তখন বুঝতে হবে, তিনিও একটা রাজনৈতিক দিশা থেকে লিখছেন, যে দিশা হল লেনিনের বক্তব্যকে যথাসম্ভব মোলায়েম করে দেখানো। কামেনেভ –স্তালিন-মুরানভ জোটের হাতে পোস্তোল’কু, পোস্কোল’কু নীতি আগের চেয়ে একটু বেশীই ডানদিকে ঘুরছিল। সোভিয়েতের ইসদতাহারকে প্রাভদা বলেছিল “সোভিয়েতে উপস্থিত বিভিন্ন ধারার মধ্যে সচেতন আপস”। সোভিয়েত নেতৃত্ব ও প্রাভদা দুয়েতেই স্তালিন উপস্থিত। আর কামেনেভ তো লেনিনের এপ্রিল থিসিস প্রকাশিত হয়ার পরের দিন লেখেন যে ঐ বক্তব্য লেনিনের একার, এবং তার সাধারণ ছক গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ তা শুরু হচ্ছে বিপ্লবকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে রূপান্তরিত করার দিশা থেকে। ৬১
এই একই সময়ে, লেনিনের থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে, ট্রটস্কী তার মত প্রকাশ করছিলেন। ট্রটস্কীর অল্প বয়সের বন্ধু, পরে মেনশেভিক এবং প্রতিপক্ষ, ডক্টর ঝিভ লিখেছেন, শহরের বিভিন্ন প্রান্তে রুশ বিপ্লব নিয়ে সভা ডাকা হলে, ট্রটস্কীর বক্তৃতা হত মুখ্য আকর্ষণ। ফলে অনেক সময়ে লোকে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করত, তিনি এক সভা থেকে আরেক সভা, শহরের বিভিন্ন এলাকাতে যাবেন বলে।৬২ এই বক্তৃতাগুলির কোনো বিস্তারিত রিপোর্ট নেই। কিন্তু নিউ ইয়র্কে তিনি বুখারিন ও অন্যদের সঙ্গে নোভি মির নামে যে রুশ পত্রিকাতে লিখতেন, তা থেকে তাঁর মতের মূল কিছু কথা পাওয়া যায়। নিউ ইয়ররকের ১৩, ১৭, ১৯ এবং ২০ মার্চ তিনি চারটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন [অর্থাৎ রুশ ক্যালেন্ডারের হিসেবে ১, ৫, ৭ এবং ৮ মার্চ]।
দ্বিতীয় প্রবন্ধে তিনি লেখেন ডুমার প্রগতিশীল জোট নামে পরিচিত জোট হল রুশ বুর্জোয়া শ্রেণীর বিভিন্ন দলের জোট। এরা চায় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার জয়, এবং দেশের মধ্যে এদের শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণ। কয়েকমাস আগে মিলিউকভ প্রদত্ত একটি বক্তৃতার উল্লেখ করে তিনি লেখেন, এরা বিপ্লবের ঘোর বিরোধী।৬৩
তৃতীয় প্রবন্ধে তিনি লেখেন, “আনুষ্ঠানিকভাবে, মুখের কথায়, বুর্জোয়া শ্রেণী সরকারের রূপ স্থির করার প্রশ্ন সংবিধান সভার হাতে ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছে। কাজের ক্ষেত্রে কিন্তু অক্টোব্রিস্ট-ক্যাডেট অস্থায়ী সরকার সংবিধান সভার জন্য প্রস্তুতির সমস্ত কাজকে সাধারণতন্ত্রের বিরুদ্ধে, রাজতন্ত্রের জন্য প্রচারে রূপান্তরিত করবে। সংবিধান সভার চরিত্র বহুলাংশে নির্ভর করবে যারা তাকে ডাকছে তাদের চরিত্রের উপর। তাই এটা স্পষ্ট যে বিপ্লবী প্রলেতারিয়েতকে এখনই প্রতিষ্ঠা করতে হবে তাঁদের নিজেদের সংস্থা, শ্রমিক, সৈনিক ও কৃষকদের প্রতিনিধিদের পরিষদ, যা থাকবে অস্থায়ী সরকারের কার্যনির্বাহী সংস্থাগুলির বিপরিতে। এই সংগ্রামে প্রলেতারিয়েতের অবশ্যকর্তব্য গোটা জনগণের উত্থানের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়া – একটি মাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে, যা হল সরকার পরিচালনার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া। কেবলমাত্র একটি বিপ্লবী শ্রমিক সরকার সংবিধান সভার প্রস্তুতি পর্বের কাজ হিসেবে দেশকে আগাগোড়া গণতান্ত্রিক ভাবে পরিশুদ্ধ করার ইচ্ছা ও ক্ষমতা রাখবে”।৬৪
চতুর্থ প্রবন্ধে যুদ্ধ ও শান্তি প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, “তাঁরা যে বিপ্লব চান নি এবং যে বিপ্লবের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, তারই দয়াতে গুচকভ ও মিলিউকভ এখন ক্ষমতায়। যুদ্ধ চালাবার জন্য, বিজয়ের জন্য? অবশ্যই! এঁরা তো সেই লোকেরাই, যাঁরা পুঁজির স্বার্থে দেশকে যুদ্ধে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন”।৬৫
রুশ অস্থায়ী সরকারকে খোলাখুলি সাম্রাজ্যবাদী সরকার বলে চিহ্নিত করে তিনি বলেন, শ্রমিক শ্রেণী উদারনৈতিক বুর্জোয়াদের স্বার্থে যুদ্ধ চালিয়ে গেলে জার্মান শ্রমিক শ্রেণীর লড়াইকে ধাক্কা দেওয়া ও জার্মান শ্রমিকদের উগ্র দেশপ্রেমিকদের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে।
লেনিন এবং ট্রটস্কী, দুজনেই চেষ্টা করেন দ্রুত রাশিয়াতে ফিরতে। লেনিন কয়েক দিনের মধ্যে বোঝেন, মিত্রশক্তিদের দেশগুলি দিয়ে ফেরার চেষ্টা ব্যর্থ হতে পারে। মার্তভের একটি প্রস্তাব অনুসরন করে তিনি তখন জার্মানির মাধ্যমে দেশে ফেরার পরিকল্পনা করেন। সুইজারল্যাণ্ডের সীমান্তে তাঁরা একটি বিশেষ ট্রেনে ওঠেন। জার্মান সেনাবাহিনীর সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, ঐ ট্রেনে অন্য কেউ উঠবে না (এই কারণে অনেক সময়ে ট্রেনটিকে সীল করা ট্রেন বলা হয়)। জার্মানির সাসনিৎস শহরে যাত্রীরা উঠলেন একটি সুইডিশ স্টিমারে। জেনারাল লুডেনডর্ফের হিসেব ছিল – এই সব উগ্রপন্থী বিপ্লবীরা রাশিয়াতে গিয়ে পড়লে রাশিয়া যুদ্ধ থেকে সরে যেতে পারে। তা হলে জার্মানী কেবল মাত্র পশ্চিম রণাঙ্গনে লড়াই করে যুদ্ধজয়ী হতেও পারে। লেনিনের হিসেব ছিল, একটি দেশে বিপ্লবের যথাযথ অগ্রগতি হলে অন্যান্য দেশেও, বিশেষত জার্মানীতে, বিপ্লবের অগ্রগতি হতে পারে। তা হলে যুদ্ধে জার্মানির সাময়িক লাভের চেয়ে গুরুত্বপুর্ণ হবে বিপ্লবের ফলে জার্মান সমরবাদের অবসান।
সুইডেনের ট্রেলবর্গ শহর থেকে তাঁরা গেলেন স্টকহোম, সেখান থেকে ফিনল্যান্ড। ২রা এপ্রিল বলশেভিকদের কাছে খবর এল, লেনিন পরদিন পেত্রোগ্রাদে ফিরবেন। ৩রা এপ্রিল ফিনল্যান্ড-রাশিয়া সীমান্তের বেলো অস্ত্রভ স্টেশনে হাজির হলেন আলেক্সান্দ্রা কোলোন্তাই, লেভ কামেনেভ, আলেক্সান্দর শ্লিয়াপনিকভ, মারিয়া উলিয়ানোভা (লেনিনের বোন), এবং আরো কয়েকজন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক্রোনস্টাড দ্বীপ-দূর্গের বলশেভিক নৌ-অফিসার ফিওডর ইলিন, যাকে ফিওডর রাসকোলনিকভ নামেই ইতিহাস বেশী চেনে। রাসকোলনিকভ পরে তাঁর স্মৃতিচারণ করে একটি বই এবং একাধিক প্রবন্ধ লেখেন। তার কাছে আমরা লেনিনের সঙ্গে রাশিয়ার ভিতরে থাকা বলশেভিকদের এতদিন বাদে প্রথম আলাপের বিবরণের জন্য কৃতজ্ঞ। রাসকোলনিকভের বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি, কে কে ছিলেন,এবং কি কি বিষয়ে কথা হয়েছিল। আবার স্মরণ করাব লারস লি-র মত, যে কামেনেভ-স্তালিনের সঙ্গে লেনিনের খুব একটা মতভেদ ছিল না। রাসকোলনিকভ লিখেছেন, লেনিনের প্রথম উক্তিই ছিলঃ “ এ সব তোমরা কি লিখছ প্রাভদাতে? আমরা অনেকগুলো সংখ্যা দেখে তোমাদের নামে প্রবল গালমন্দ করেছি”।৬৬
ট্রেন পেত্রোগ্রাদের ফিনল্যান্ড স্টেশনে থামলে লেনিনকে স্বাগত জানানো হয়। সোভিয়েতের পক্ষে ভাষণ দেন চখেইদঝে। ফিনল্যান্ড স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন সুখানভ, যার কাছ থেকে আমরা বর্ণনা পাই। কে কে এসেছিল, সেটা গৌণ হত, যদি না ১৯৩০-এর দশকে এ নিয়ে গল্প ফাঁদা হত। এমেলিয়ান ইয়ারোস্লাভস্কি লেখেন, ৩ এপ্রিল স্তালিন লেনিনের সঙ্গে দেখা করতে বেলা অস্ত্রভে যান। বিপ্লবের দুই নেতা, বলশেভিকবাদের দুই নেতা, গভীর আনন্দের সঙ্গে এত কাল বিচ্ছিন্ন থাকার পরও দেখা করেন। তাঁরা দুজনেই শ্রমিক শ্রেণীর ডিক্টেটরশিপের জন্য সংগ্রামে নামার মুখে ছিলেন...”। ৬৭ স্পষ্টত, স্তালিনের কাছে এইভাবে ইতিহাসের পুনর্লিখন ছিল জরুরী। তিনি ক্রমান্বয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, তিনি লেনিনের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ট্রটস্কী এ কথা বুঝে লিখেছিলেন, “এই ছোটো তথ্যটি অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে ভাল করে দেখায় যে দেখায় যে তার এবং লেনিনের মধ্যে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতার দূরতম সাদৃশ্য রয়েছে এমন কোনো সম্পর্ক ছিল না”।৬৮ এর এক বিকল্প, অথবা পরিপূরক কারণ হল, ঐ দিন স্তালিন বাস্তবে কোথায় ছিলেন এবং তাঁর রাজনৈতিক মত কি ছিল তা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়া। তিনি ছিলেন বলশেভিক ও মেনশেভিকদের মধ্যে ঐক্য নিয়ে এক আলোচনা সভাতে।
২৭শে মার্চ ট্রটস্কীও নিউ ইয়র্ক ছেড়ে রাশিয়ার দিকে পাড়ি দেন, একটি জাহাজে করে। কিন্তু যে কারণে লুডেনডর্ফ লেনিনকে রাশিয়া যেতে দিতে রাজি ছিলেন, সেই কারণেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ট্রটস্কীকে রাশিয়া ফেরা ঠেকাতে চায়। ক্যানাডার হ্যালিফ্যাক্সে তাঁকে জাহাজ থেকে নামিয়ে বন্দী করে পাঠানো হয় জার্মান যুদ্ধবন্দী শিবিরে। সেখানে তিনি সৈনিক ও নাবিকদের মধ্যে যুদ্ধবিরোধী প্রচার করেন। জার্মান অফিসাররা এতে ক্রুদ্ধ হয়ে শিবিরের ব্রিটিশ প্রধান, কর্নেল মোরিসের কাছে অভিযোগ করলে, মোরিস শ্রেণীগত অবস্থান থেকে অফিসারদের পক্ষ নিয়ে ট্রটস্কীকে সাধারণ সৈনিকদের কাছে বক্তৃতা দিতে বারণ করেন। ৫০০-র উপর জার্মান সৈনিক ও নাবিক এতে গণস্বাক্ষর করে প্রতিবাদ করেন। অবশেষে এক মাস পরে, ৪ঠা মে, তিনি পেত্রোগ্রাদে পৌঁছন।
এই এক মাসে রাশিয়াতে অনেক কিছু ঘটে গিয়েছিল, যার কিছুটা পর্যালোচনা আমাদের পরবর্তী কাজ।
লেনিন ও বলশেভিক দল – এপ্রিল থিসিস থেকে পার্টি নীতি পরিবর্তনঃ
৩রা এপ্রিল সন্ধ্যাবেলা লেনিন বলশেভিকদের এক সম্মেলনে উপস্থিত হন, এবং ট্রেনে আসতে আসতে যে প্রবন্ধ বা একগুচ্ছ কর্মসুচীগত প্রস্তাব লিখেছিলেন, সেটা পড়ে শোনান। এই প্রবন্ধ, যা ইতিহাসে এপ্রিল থিসিস নামে খ্যাত, তা পার্টি সম্মেলনে যেন বোমা ফাটাল। তাই লেনিন কী লিখেছিলেন তা দেখার আগে সম্মেলনে এ পর্যন্ত কী আলোচনা হয়েছিল, সেটা দেখতে হবে।
২৭শে মার্চ থেকে ৪ঠা এপ্রিল বলশেভিকদের প্রথম বড় সম্মেলন হয় (১৯১৭ সালে তাঁরা অনেকগুলি সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন)। একই সময়ে, ২৯শে মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত চলে পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের ডাকে প্রথম সারা রাশিয়া সোভিয়েত সম্মেলন। ইতিমধ্যে লেনিনের চিঠি এসেছে, কিছু নাড়াচাড়া শুরু হয়েছে। স্তালিন এর আগে কামেনেভের পুরো সমর্থক ছিলেন, কিন্তু এবার দোদুল্যমান ভাব দেখা যায় তাঁর লেখাগুলিতে।
মার্চ সম্মেলনের কার্যবিবরণী বহুকাল সোভিয়েত ইউনিয়নে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। প্রথম এগুলি পাওয়া যায় ১৯৩১ সালে ট্রটস্কী The Stalin School of Falsification শীর্ষক সংকলনে প্রকাশ করলে। ১৯৮৮ সালে অবশেষে ভপ্রোসি ইস্তোরি কেপিএসএস পত্রিকার সম্পাদকরা সোভিয়েত মহাফেজখানা থেকে মিলিয়ে জানান, ট্রটস্কী যা প্রকাশ করেছিলেন তা বাস্তব দলিল, কেবল প্রথম দুদিনের কার্যবিবরণী সেটাতে ছিল না (তিনি সে কথা স্বীকারও করেছিলেন)। ২৯শে মার্চ আলোচ্য বিষয় ছিল অস্থায়ী সরকার। মূল রিপোর্টার ছিলেন স্তালিন। কেউ মূল রিপোর্টার হওয়ার অর্থ, নেতৃত্ব বা সংখ্যাগরিষ্ঠরা তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছেন। স্তালিনের বক্তব্যে লেনিনের চিঠির প্রভাব কিছুটা দেখা যায়। তিনি এখন বলেন, ফেব্রুয়ারি বিপ্লব দুটি সরকার তৈরী করেছিল – অস্থায়ী সরকার এবং সোভিয়েত। এর আগে তাঁর প্রবন্ধগুলিতে এই স্বীকৃতি ছিল না। কিন্তু লেনিন যে সরাসরি অস্থায়ী সরকারের বিরুদ্ধাচরণের পক্ষে কথা বলছিলেন, স্তালিন তার সঙ্গে একমত ছিলেন না। তাঁর মতে, অস্থায়ী সরকারের কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। তাঁর বক্তৃতার যে সংক্ষিপ্তসার নোট আকারে আমাদের কাছে এসেছে, তাতে আমরা পড়িঃ “অস্থায়ী সরকার বিপ্লবী জনগণের অর্জিত অধিকারগুলি সুরক্ষা করার দায়িত্ব নিয়েছে। শ্রমিক ও সৈনিকদের প্রতিনিধিদের সোভিয়েত ক্ষমতা ব্যবহার করে ও নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে, আর অস্থায়ী সরকার, আপত্তি সত্ত্বেও, এবং ভুলভাল সত্ত্বেও, জনগণের যে সব জয়গুলি বাস্তবে পরিণত হয়েছে, সেগুলিকে সংহত করে। এমন এক পরিস্থিতির অসুবিধাজনক দিকও আছে, কিন্তু সুবিধাজনক দিকও আছে। যে বুর্জোয়া স্তরগুলি ভবিষ্যতে অনিবার্যভাবে আমাদের থেকে সরে যাবে, ঘটনার উপর চাপ দিয়ে তাদের সরে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে, আমাদের বর্তমানে কোনো সুবিধা নেই”।৬৯ বক্তব্যের পর স্তালিন রুশ ব্যুরো ২২শে মার্চ যে প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল সেটা পড়ে শোনান। ঐ প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, অস্থায়ী সরকার বিপ্লবের দায়িত্ব পালন করতে পারবে না, তাই সোভিয়েতকে বিপ্লবী ক্ষমতার ভ্রূণাকার রূপ হিসেবে দেখে বিদ্রোহী জনগণ তাকে ঘিরে জমায়েত হ’ন, এই আহবান করা হচ্ছে।৭০ আশ্চর্যের কথা, স্তালিন মন্তব্য করেন, তিনি নিজে ওই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত নন, বরং তিনি সমর্থন করেন ক্রাসনোয়ার্স্ক সোভিয়েতের প্রস্তাবকে। ক্রাসনোয়ার্স্ক সোভিয়েতের প্রস্তাব আবার ওই পোস্তোল’কু পোস্কোল’কু অবস্থান নিয়েছিল। বলা হয়, অস্থায়ী সরকারকে জনগণের দাবী মানতে হবে, এবং তার কাজ যতক্ষণ শ্রমিক শ্রেণী ও বিপ্লবী কৃষকদের দাবীকে সন্তূষ্ট করতে পারবে, ততদিন তাকে সমর্থন করা হবে।৭১
পার্টিতে একটা ছোটো, কিন্তু সুস্পষ্ট দক্ষিণপন্থী ধারা ছিল। তার একজন প্রতিনিধি ভইটিনস্কি পাল্টা রিপোর্ট দেন। তিনি অস্থায়ী সরকারের কাজের মধ্যে সরাসরি বিপ্লবী কাজ দেখতে পেলেন। তিনি বলেন, শ্রমিক শ্রেণী ক্ষমতা নিলে তা হত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সর্বনাশ।৭২ স্তালিন-কামেনেভের সঙ্গে ভইটিনস্কির দৃশ্যমান পার্থক্য ছিল। কিন্তু স্তালিনের বক্তব্য স্ববিরোধী ছিল। বিতর্কের শেষে তিনি জবাবী ভাষণে বলেন, শ্রমিকরা সরকারকে সমর্থন করছে বলার চেয়ে “বরং বলা যায়, সরকার আমাদের সমর্থন করছে... আমরা যে আমাদের কর্মসূচি বাস্তবে প্রয়োগ করছি, সরকার তাতে বাধা দিচ্ছে না”।৭৩ একটি প্রতিক্রিয়াশীল সরকার কীভাবে “আমাদের” (শ্রমিকদের? সোভিয়েতের? বলশেভিকদের?) কর্মসুচি রূপায়ণে বাধা দিচ্ছে না? কোন কর্মসূচি সেটা? বুঝতে হবে, স্তালিন এখানে উল্লেখ করছেন, শ্রমিকদের চাপে পড়ে অস্থায়ী সরকার যে ক’টি পদক্ষেপ নিয়েছিল, স্তালিন সেইগুলির উল্লেখ করছেন। যেমন, ১২ মার্চ মৃত্যুদন্ড বাতিল করা হল। ২০ মার্চ ধর্মের ভিত্তিতে বা জাতীয়তার ভিত্তিতে বৈষম্য নিষিদ্ধ হল।
কিন্তু বলশেভিকরা এমনকি জারের শাসনের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল সময়েও যে ন্যূনতম কর্মসূচীর কথা বলেছিলেন, তার মধ্যে পড়ত গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র, বড় জমিদারী বাজেয়াপ্তকরণ, এবং আট ঘন্টার শ্রম দিবস চালু করা। অস্থায়ী সরকার কি এই কর্মসূচী মেনে নিতে তৈরি ছিল? ১৯শে মার্চ প্রাথমিকভাবে বুর্জোয়া নারীবাদীদের উদ্যোগে একটি বড় মিছিল টাউরিডে প্রাসাদের দিকে রওনা দেয়। কোনো কোনো হিসেব অনুযায়ী এতে ছিলেন ৪০,০০০ মেয়ে। বিত্তবান মেয়েদের সঙ্গে নিম্ন পেটি বুর্জোয়া এবং শ্রমিক মেয়েরাও ছিলেন। মিছিলের কেন্দ্রীয় দাবী ছিল সার্বজনীন ভোটাধিকার বলতে যেন মেয়েদের ভোটাধিকারও স্বীকৃত হয়।৭৪ উল্লেখযোগ্য, মিছিল দাবীটা জানিয়েছিল প্রথমে সোভিয়েতের নেতাদের, অস্থায়ী সরকারকে নয়। বেশ কিছুটা ইতস্তত করে তবে সোভিয়েতের নেতারা স্বীকার করতে বাধ্য হন যে বিপ্লবী রাশিয়াতে মেয়েদের ভোট মানতেই হবে। সোভিয়েতের সমর্থন পেয়ে তবে তাঁরা গেলেন প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স ল’ভভের কাছে। ল’ভভ বলার চেষ্টা করেন যে ভোটের আইন তৈরি হয়ে গেছে, এখন আর মেয়েদের ভোট দেওয়া যাবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি মেয়েদের দাবী মুখে মেনে নিলেন, যদিও তা আইনে রূপান্তরিত হতে জুলাই গড়িয়ে গেল। অর্থাৎ, সব পুরুষ ভোট পাবে, এটা স্থির করতে লেগেছিল বড়জোর ১৮ দিন, কিন্তু মেয়েদের ভোট দিতেই লেগে গেল কয়েক মাস। এই অস্থায়ী সরকার যে প্রগতিশীল না, এবং বুর্জোয়া নারীবাদীরাও যে সেই কারণে প্রথমে সোভিয়েতের সমর্থন চেয়েছিলেন, সেটা বুঝলে, স্তালিনের এই সরকারের প্রতি আস্থা বিষ্ময়ের ঘটনা।
২৩শে মার্চ, অস্থায়ী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিলিউকভ একটি সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকারে বলেন, কোনো শান্তি সম্মেলন হলে রাশিয়ার দাবী হবে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সাম্রাজ্য-অধিকৃত ইউক্রেনীয় এলাকা, এবং কনস্ট্যান্টিনোপল ও দার্দানেলিস প্রণালী। সোভিয়েতের আবেদনের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী, এবং খোলাখুলি সাম্রাজ্যবাদী এই ঘোষণার ফলে সোভিয়েত প্রতিবাদ করে। অস্থায়ী সরকার একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয় যার ভাষা একটু অন্য। কিন্তু মিলিউকভ ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান পত্রিকাকে বলেন, মিত্রশক্তির প্রতি রাশিয়ার অঙ্গীকার অটুট থাকবে। ফলে, স্তালিন যখন দাবী করছিলেন যে অস্থায়ী সরকার “আমাদের” কর্মসূচী রূপায়ণে বাধা দিচ্ছে না, তখন আসলে অস্থায়ী সরকার নরমপন্থী সমাজতন্ত্রীদেরও চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছিল।
বলশেভিকদের সমস্যার কারণ ছিল তাঁদের ১৯০৫-এর রণনীতি – যে শ্রমিক ও কৃষকের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক ডিক্টেটরশিপের কাজ হবে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সম্পন্ন করা। কামেনেভ বা স্তালিন মেনশেভিকদের মত সরাসরি বুর্জোয়া নেতৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করেন নি। লারস লি-র সমস্যা, তিনি মনে করেন, কামেনেভকে সমালোচনা করার অর্থ তাঁকে মেনশেভিক বলা। তাঁরা অস্থায়ী সরকারকে ‘নিয়ন্ত্রন’ করার কথা বারে বারে তুলছিলেন। তাঁরা অস্থায়ী সরকারকে পুরো সমর্থনের কথা বলেন নি, কিন্তু তার কাজের মধ্যে প্রগতিশীলতা দেখেছিলেন এবং সেই প্রগতিশীলতাকে সমর্থন করতে চেয়েছিলেন, কারণ তাঁরা প্রতিবিপ্লব বলতে তখন পর্যন্ত বুঝেছিলেন জারতন্ত্রী শক্তিকে। জারের উচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে যে বুর্জোয়া উদারপন্থীরাই প্রতিবিপ্লবের প্রধান স্তম্ভে পরিণত হয়েছে, সেই বোধ তাঁদের লেখা বা বক্তৃতায় পাওয়া যায় না। সুতরাং বলশেভিকরা মেনশেভিকে পরিণত হন নি, কিন্তু কামেনেভ-স্তালিনের মতাবলম্বী বলশেভিকদের সঙ্গে মেনশেভিকদের দূরত্বটা কমে গিয়েছিল। মার্চ সম্মেলন মেনশেভিকদের সম্পর্কে যে অবস্থান নিল, তা ছিল লেনিনের বিপরীত। ৩০শে মার্চ কামেনেভ জানান, তিনি বামপন্থী মেনশেভিক ও সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন, এবং সোভিয়েতের কার্যনির্বাহী সমিতিতে আন্তর্জাতিকতাবাদীদের ঐক্যবদ্ধ প্রস্তাব আনতে হবে। ৭৫
সম্মেলনে সকলে অবশ্যই একমত ছিলেন না। এক বহুদিনের বলশেভিক কর্মী, ক্রাসিকভ, কামেনেভের জবাবে বলেন, “আমরা যদি সোভিয়েতকে জনগণের ইচ্ছা প্রকাশকারী সংস্থা মনে করি, তা হলে আমাদের সামনে প্রশ্ন নয়, যে এই বা ঐ নির্দিষ্ট প্রশ্নে কি পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা যদি মনে করি শ্রমিক শ্রেণীর ডিক্টেটরশিপের বাস্তবায়নের সময় এসেছে, তা হলে প্রশ্নটা সেভাবেই রাখা উচিৎ”। এর পর সভাপতি ক্রাসিকভকে বক্তব্য রাখা থেকে থামিয়ে দেন, কারণ , তিনি বলেন, “শ্রমিক শ্রেণীর ডিক্টেটরশিপের প্রশ্ন আলোচ্য বিষয় নয়”। ৭৬
রাত সাড়ে তিনটের সময়ে বসে বলশেভিক ও মেনশেভিকদের যৌথ অধিবেশন। দীর্ঘ আলোচনার পর ৭৪-৬৬ ভোটে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়, কার্যনির্বাহী কমিটির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে, যৌথভাবে একটি স্বাধীন প্রস্তাব পেশ করা হবে। লক্ষ্যণীয়, বলশেভিকদের সম্মেলনে কামেনেভ বলেছিলেন, বামপন্থী মেনশেভিকদের সঙ্গে বসা হবে, কিন্তু বাস্তবে নামের তালিকা দেখায়, লিবার-এর মত মধ্য-দক্ষিণপন্থী মেনশেভিকরাও উপস্থিত ছিলেন। এমন কি, দুই সংগঠনের যৌথ প্রস্তাব স্থির করার কমিটিতেও লিবারের নাম রাখা হয়েছিল।
১ এপ্রিল পার্টি ঐক্য ছিল আলোচনার বিষয়বস্তু। জর্জিয়ার মেনশেভিক নেতা, এবং ১৯১৭ সালে মেনশেভিকদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, ইরাকলি সেরেতেলি, ঐক্য নিয়ে যে প্রস্তাব করেছিলেন, তার উপর আলোচনা হয়। স্তালিন বলেন, ঐক্য আলোচনাতে বলশেভিকদের যাওয়া উচিৎ, এবং জিমারওয়াল্ড-কিয়েনথালের ভিত্তিতে ঐক্য সম্ভব। স্ক্রিপনিক এবং অংশত মলোটভ তার বিরোধিতা করেন। মলোটভ বলেন, সেরেতেলিও নিজেকে জিমারওয়াল্ডপন্থী বলেন, কিন্তু তার সঙ্গে জোট গড়ার চেয়ে রাজনৈতিকভাবে সঠিক হবে মজবুত আন্তর্জাতিকতাবাদী সমাজতন্ত্রী কর্মসূচীর ভিত্তিতে একটি সংখ্যালঘু ঐক্য। সমালোচকদের জবাবে স্তালিন বলেন, “আগাম দৌড়ে গিয়ে মতভেদ কি হবে তা ভাবার কোনো মানে হয় না। মতভেদ ছাড়া কোনো পার্টি জীবন নেই। আমরা পার্টির মধ্যে খুচরো মতভেদ কাটিয়ে উঠতে পারব”।৭৭ লেনিন যে জিমারওয়াল্ড প্রস্তাবকে মধ্যবর্তী, এবং আর গ্রহণযোগ্য নেই বলে মনে করছিলেন, স্তালিন-কামেনেভ সেই প্রস্তাবকেই যথেষ্ট ভিত্তি বলে ভাবছিলেন।
এই ছিল বলশেভিক পার্টিতে মার্চের শেষে এবং এপ্রিলের গোড়ায় অবস্থা। এই পরিস্থিতিতে ৩ এপ্রিল সন্ধ্যাবেলা এসে পৌছলেন লেনিন। সেই সভাতেই তিনি পড়ে শোনালেন তার হাতে লেখা দলিল, যা এপ্রিল থিসিস নামে ইতিহাসে বিখ্যাত। এই দলিল ১৯১৭-র বিপ্লবে, এবং লেনিনের রণনীতি রূপান্তর বোঝার ক্ষেত্রে, এতটাই গুরুত্বপূর্ণ, যে তার কয়েকটা অংশ খুঁটিয়ে দেখা আবশ্যক। লেনিনের ফেরার ফলে বলশেভিক দলে যে আলোড়ন হল, তার পরিণতি হল বলশেভিকদের রণনীতিতে মৌলিক রূপান্তর, যা না হলে অক্টোবর বিপ্লব এবং সোভিয়েত ক্ষমতা দখল ঘটত না।
লেনিনের দলিলে প্রথম থিসিসে বলা হল, যুদ্ধের চরিত্র পালটায় নি, যুদ্ধ এখনও সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ। নতুন সরকার পুঁজিবাদী সরকার, তাই “বিপ্লবী প্রতিরক্ষাবাদ”-এর প্রতি সামান্যতম ছাড় দেওয়া চলবে না। অর্থাৎ, লেনিন সরকারের যুদ্ধনীতিকে সর্বাত্মক আক্রমণ করলেন, এবং এই অবস্থায় কোনো অজুহাতে, এমন কি বিপ্লব রক্ষার নামে, যুদ্ধে অংশ নেওয়ার বিরোধীতা করলেন। তিনি বললেন, বিপ্লবী যুদ্ধ, প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ, তখনই সমর্থনযোগ্য, যখন ক্ষমতা যাবে শ্রমিক শ্রেণী ও দরিদ্রতম কৃষকদের হাতে, যখন শুধু মুখে না, কাজে অন্য দেশ দখলের লক্ষ্য ত্যাগ করা হবে, এবং যখন সরকার ধনতন্ত্রের সব স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়বে।
থিসিস ২ঃ “রাশিয়াতে বর্তমান মুহূর্তের বৈশিষ্ট্য হল যে বিপ্লবের প্রথম স্তর, যখন বুর্জোয়া শ্রেণী ক্ষমতা পেয়েছিল শ্রমিক শ্রেণীর সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতার জন্য, তা থেকে দ্বিতীয় স্তরে উত্তরণ, যা ক্ষমতা দিতে বাধ্য প্রলেতারীয়েত ও কৃষকদের দরিদ্রতম স্তরের হাতে”। দেখা যাচ্ছে, লেনিন মেনশেভিকদের সঙ্গে তো একমত না-ই, তিনি এমনকি ১৯০৫-০৭-এর বলশেভিক দিশার সঙ্গেও একমত না। তিনি মনে করেছিলেন, বুর্জোয়া শ্রেণী ক্ষমতা পেয়েছে কেবল শ্রমিকদের সীমাবদ্ধতার জন্য। এই থিসিসকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেনিন পার্টি ঐক্য এবং কামেনভদের নীতির খোলাখুলি সমালচনা করেন। “কমরেড, আপনাদের এই সরকারের উপর আস্থা রয়েছে। এই যদি আপনাদের অবস্থান হয়, তাহলে আমাদের পথ আলাদা হয়ে যাবে। ... একজন লিয়েবকনেখট ১১০ জন স্টেকলভ এবং চখেইদঝের ধাঁচের প্রতিরক্ষাবাদীর চেয়ে ভাল”।
থিসিস ৩ঃ অস্থায়ী সরকারকে কোনোরকম সমর্থন না। এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রাভদা এই সরকারের কাছে দাবি করছে, এরা যেন অন্য দেশ দখল করবে না বলে। পুঁজিবাদী সরকারের কাছ থেকে এমন দাবী করা অর্থহীন।
থিসিস ৪ঃ স্বীকার করতে হবে যে শ্রমিক ও সৈনিকদের প্রতিনিধিদের সোভিয়েতে আমাদের দল সংখ্যালঘু, এবং জনগণকে বোঝাতে হবে যে সোভিয়েত হল বিপ্লবী সরকারের একমাত্র সম্ভাব্য রূপ, তাই যতদিন এই সরকার বূর্জোয়া শ্রেণীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে, ততদিন কর্তব্য জনগণের কাছে ধৈর্য ধরে, সুশৃংখলভাবে ঐ কৌশলের ভ্রান্তি ব্যাখ্যা করতে হবে।
থিসিস ৫ঃ এখানে লেনিন সরাসরি সংসদীয় গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে উন্নততর গণতন্ত্র হিসেবে উপর থেকে তলা পর্যন্ত সোভিয়েতদের ভিত্তিতে সাধারণতন্ত্রের দাবী করলেন এবং বললেন যে সোভিয়েত থেকে পার্লামেন্টের দিকে যাওয়া হবে পিছু হঠা।
থিসিস ৬ঃ কৃষি কর্মসূচিতে ভরকেন্দ্র সরাতে হবে ক্ষেতমজুরদের প্রতিনিধিদের দিকে। সব জমিদারী বাজেয়াপ্ত করতে হবে। দেশের সব জমি জাতীয়করণ করতে হবে।
থিসিস ৮ঃ সামাজিক উৎপাদন, এবং দ্রব্য বন্টনকে সোভিয়েতদের নিয়ন্ত্রনে আনতে হবে।
লেনিন বলেন, অবিলম্বে পার্টি কংগ্রেস ডাকা দরকার, এবং সেখানে সাম্রাজ্যবাদ, রাষ্ট্র সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গী এবং পুরোনো ন্যূনতম কর্মসূচী পাল্টাতে হবে, এবং পার্টির নতুন নাম নিতে হবে। ৭৮
লেনিনের বক্তৃতায় তাঁর কমরেডদের অধিকাংশই হতবাক হয়ে পড়েন। সেদিনের সভায়, যেহেতু কামেনেভরা তখন বামপন্থী মেনশেভিকদের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছেন, তাই সেরকমও কয়েকজন ছিলেন। সুখানভ পরে লেখেন, “আমি কখনো ওই বজ্রনাদ বক্তৃতা ভুলব না, যা কেবল আমার মত অবিশ্বাসীকেই বিস্মিত করে নি ... বরং সব খাঁটি বিশ্বাসীদেরও...”। সবচেয়ে দক্ষিণপন্থী সমাজতন্ত্রী সংগঠন ছিল প্লেখানভদের ইয়েদিনস্তভো। তাঁরা তাঁদের পত্রিকাতে লেনিনের বক্তব্যকে পাগলের প্রলাপ বলে চিহিত করেন। ৬ই এপ্রিল রুশ ব্যুরোর সভায় স্তালিন এপ্রিল থিসিসের বিরোধীতা করেন।৭৯ ৭ই এপ্রিল প্রাভদা যখন লেনিনের ওই প্রবন্ধটি প্রকাশ করে, তখন তা একা তাঁর নামে প্রকাশিত হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির বামপন্থীরাও এতদূর যেতে রাজী ছিলেন না। পরদিন প্রাভদা কামেনেভের জবাব ছাপে, যাতে তিনি বলেন, রুশ ব্যুরো বা প্রাভদা সম্পাদকমন্ডলী কেউই লেনিনের সঙ্গে একমত না।
এরপর প্রায় একমাস ধরে চলে আন্তঃপার্টি বিতর্ক। “পুরোনো বলশেভিকবাদের” নামে কামেনেভের নেতৃত্বে অনেকে লেনিনের নয়া নীতির বিরোধীতা করেন। তাঁদের মনে হল, লেনিন ট্রটস্কীর অতীতে সমালোচিত “নিরন্তর বিপ্লব” রণনীতি মেনে নিচ্ছেন। লেনিনকে সাবধানে পা ফেলে এগোতে হয়। বাস্তববাদী বিপ্লবী হিসেবে তিনি জানতেন, পার্টির কমরেডদের নিজের মতের দিকে টেনে আনতে হবে। তাই তিনি তাঁর বক্তৃতায় কোনো নেতৃস্থানীয় কমরেডকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেন নি। কিন্তু ঐক্যের চেয়ে একা দাঁড়ানো ভাল, বা যুদ্ধকে সামান্যতম সমর্থন করার নিন্দা, মার্চের মাঝামাঝি থেকে যে প্রস্তাবগুলি আসছিল তাদের সমালোচনা। এপ্রিলের শেষে পার্টির সপ্তম সারা রাশিয়া সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে স্থির হয়। তার প্রস্তুতি হিসেবে ১৪ এপ্রিল থেকে ২২ এপ্রিল পেত্রোগ্রাদ নগর সম্মেলন হয়।
ইতিমধ্যে বহু শ্রমিক বামপন্থী দলগুলিতে আসছিলেন। বলশেভিকরা রাজনৈতিক শিক্ষার উপর বেশী জোর দিতেন বলে তাঁদের দলে সদস্য হওয়া তুলনামূলক ভাবে কঠিন ছিল। তবু, রাবিনোভিচের হিসেবে, ফেব্রুয়ারিতে পেত্রোগ্রাদে পার্টির সদস্য ছিলেন ২০০০ জন, আর এপ্রিলে সেটা বেড়ে হয় ১৬,০০০।৮০ মার্সেল লিয়েবম্যান মনে করেন, বহু জঙ্গী, তরুণ সদস্য আসার ফলে “পুরোনো বলশেভিকদের” তত্ত্বগত রক্ষণশীলতা ও স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠা সহজতর হয়েছিল।৮১ কিন্তু শুধু পার্টির আভ্যন্তরীণ চাপের কথা ভাবলে ভুল হবে। শ্রেণী সংগ্রামের বিকাশ দলে পরিবর্তন আনছিল। যুদ্ধ নিয়ে সংকট দেখা দেয় এপ্রিলের মাঝামাঝি, যখন জানা গেল, বিদেশমন্ত্রী মিলিউকভ ব্রিটিশ ও ফরাসী রাষ্ট্রদূতদের চিঠি লিখে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, অস্থায়ী সরকার ‘গ্যারান্টি’ চায় [অর্থাৎ সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ চায়], এবং সেই জন্য নির্দিষ্ট ফল অবধি যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। ২০ এপ্রিল এই চিঠি বিভিন্ন খবরের কাগজে ছাপা হয়।
শ্রমিক এবং সৈনিকরা মিলিউকভের মত ইতিহাসের অধ্যাপক না হলেও, এইটুকু বুঝতে তাঁদের অসুবিধা হল না, যে মিলিউকভ তাঁদের প্রতিনিধি না, মিলিউকভের শ্রেণীগত লক্ষ্য তাঁদের নয়। প্রিয়ব্রাজেনস্কি রেজিমেন্টের অন্যতম বিপ্লবী সৈনিক নেতা, ফেডোর লিন্ডে, প্রথমে সৈনিকদের জমায়েত করে সোভিয়েতের কাছে নিয়ে গেলেন। কিন্তু সোভিয়েত উলটে তাকেই নিন্দা করল। পরদিন, হাজার হাজার সৈনিক এবং শ্রমিক মিছিল করেন। একটি লিফলেট বিলি করা হয়, যাতে বলা ছিল, ‘অস্থায়ী সরকার নিপাত যাক’। সন্দেহ করা হয়, বলশেভিকদের পিটার্সবুর্গ কমিটির বামপন্থী সদস্য বাগদাতিয়েভ ঐ লিফলেটের জন্য দায়ী । ২২শে এপ্রিল লেনিন এই স্লোগানের সমা্লোচনা করেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন, যতদিন না বিপ্লবীরা শ্রমিক শ্রেণীর সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন পাচ্ছেন, ততদিন এমন স্লোগান তোলা হয় ফাঁকা আওয়াজ, নয় তো হঠকারিতা। কিন্তু এপ্রিলের এই ঘটনা শ্রমিকদের মধ্যে প্রথম বাঁয়ে ঘোরা আরম্ভ করল, আর বলশেভিকদের মধ্যে অস্থায়ী সরকার সম্পর্কে লেনিনের বক্তব্য কত ঠিক তা বুঝতে সাহায্য করল।
এই অবস্থায় ২৪শে এপ্রিল শুরু হল সপ্তম পার্টি সম্মেলন। পাঁচ সদস্যের যে সভাপতিমন্ডলী নির্বাচিত হল, তাতে ছিলেন লেনিন, জিনোভিয়েভ, ইয়াকভ সভের্দলভ, পিটার্সবুর্গ কমিটির এবং পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের নেতা ফেদোরভ, এবং মুরানভ। ভোট দেখাল, লেনিনের পক্ষে সমর্থন বাড়ছিল। সেটা আরো বোঝা যায়, যখন আমরা দেখি, এই সম্মেলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল পেশ করলেন স্তালিন, এবং লেনিনের সমর্থনে ‘বর্তমান পরিস্থিতি’ অ্যাজেন্ডাতে তিনি বক্তব্য রাখলেন। ‘বর্তমান পরিস্থিতি’ নিয়ে মূল রিপোর্ট দেন দুজন – লেনিন এবং কামেনেভ। কামেনেভ বলেন, যেহেতু সামন্ততান্ত্রিক জমি মালিকানার অবসান হয় নি, তাই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সমাপ্ত হয়নি। এই ছিল লেনিনের ১৯০৫-এর মতের অনুরণন। তিনি বলেন, শেষ অবধি অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে সোভিয়েতের খাদ্য, গণতন্ত্র ও যুদ্ধ নিয়ে দ্বন্দ্ব বাধবে। কিন্তু পার্টির কাজ নয়, সেই দ্বন্দ্ব তাড়াতাড়ি আনা। তিনি আরো বলেন, আগে থেকে সাবধান থাকলে ‘অস্থায়ী সরকার নিপাত যাক’ স্লোগান উঠত না – যেটা ছিল পরোক্ষে বলা, যে লেনিনই হঠকারিদের উৎসাহদাতা। ৮২
আরো ছ’জন বিভিন্ন বক্তব্য রাখার পর সভের্দলভের প্রস্তাবে স্থির হয়, দুই মূল বক্তার পক্ষে দুজন করে বলবেন, তার পরও আলোচনা শেষ হবে। লেনিনের পক্ষে বক্তব্য রাখেন স্তালিন ও জিনোভিয়েভ। এখানে লেনিনের সাংগঠনিক দক্ষতা দেখা জরুরী। তার দিকের বিভিন্ন সমর্থককে বাদ দিয়ে স্তালিনকে প্রথম বক্তা করার পিছনে অবশ্যই একটা উদ্দেশ্য ছিল সম্মেলনকে দেখানো, যে কামেনেভের পক্ষের একজন বড় নেতা লেনিনের সমর্থকে পরিণত হয়েছেন। আলোচনার শেষে জবাবী ভাষণে লেনিন এপ্রিল থিসিসে যে তীব্র বৈপরীত্য ছিল, তাকে কিছুটা মোলায়েম করেন। কিন্তু তিনি দেখান, তাঁর এবং কামেনেভের পার্থক্য আছে। রাইকভ তার বক্তৃতায় বলেন, রাশিয়াতে শিল্প দূর্বল, কৃষি প্রধান। তাই রাশিয়াতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্ভব নয়। লেনিন রাইকভের জবাবে বলেন, এটা মার্ক্সবাদ নয়, মার্ক্সবাদের হাস্যকর নকল মাত্র।৮৩ এরপর সম্মেলন ভোটের মাধ্যমে নয় সদস্যের একটি কমি্টি নির্বাচিত করে, ‘বর্তমান পরিস্থিতি’ নিয়ে চূড়ান্ত দলিল লেখার জন্য। এই ন’জনের মধ্যে চারজন ছিলেন লেনিনের সমালোচক – কামেনেভ, বুবনভ, মিলিউটিন এবং নোগিন। অর্থাৎ, লেনিন গোটা পার্টিকে নিজের মতের দিকে টেনে নিতে পারেন নি। ২৯শে এপ্রিল জিনোভিয়েভ প্রস্তাব আনেন, স্টকহোমে আগামী ১৮ই মে জিমারওয়াল্ডপন্থীদের যে আন্তর্জাতিক সম্মেলন ডাকা হয়েছে, তাতে যোগদান করা হোক। শুধু একজন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন – তিনি লেনিন।৮৪ বর্তমান পরিস্থিতি বিষয়ক দলিল শেষ অবধি গৃহীত হল -- পক্ষে ৭১ ভোট, বিপক্ষে ৩৯ ভোট, এবং ভোটদানে বিরত ৮ জন, এই ব্যবধানে।৮৫ নয় সদস্যের যে কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত হল তাতে থাকলেন লেনিন, সভের্দলভ, জিনোভিয়েভ, স্তালিন, স্মিলগা, কামেনেভ, নোগিন, মিলিউটিন এবং ফেদোরভ।৮৬
মে মাসের গোড়ায় ট্রটস্কী রাশিয়াতে ফেরেন। সোভিয়েতে দেওয়া তাঁর প্রথম বক্তৃতা শ্রেণী সমঝোতার সরকার সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছিল। ট্রটস্কীর বক্তব্য বলশেভিকদের শতর্ক করে দেয় যে তিনি লেনিনের অনুরূপ রাজনৈতিক অবস্থান নিচ্ছেন। ট্রটস্কীর সঙ্গে বলশেভিকদের প্রথম কয়েকদিনের মধ্যেই কথা হয়। ১০ই মে লেনিন, জিনোভিয়েভ এবং কামেনেভ ট্রটস্কী এবং মেঝরায়ঙ্কা নেতৃত্বের সঙ্গে দেখা করেন। এর আগে লেনিন কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রস্তাব করেছিলেন প্রাভদার সম্পাদক হতে ট্রটস্কীকে আহবান করা হোক। কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটি এ বিষয়ে লেনিনের চেয়ে অনেক কম নমনীয় ছিল। প্রস্তাব করা হয়, মেঝরায়ন্তসির একজন প্রাভদার সম্পাদকমন্ডলীতে বসুন, এবং কেন্দ্রীয় কমিটি একটি পার্টি কংগ্রেস ডাকুক, যাতে মেঝরায়ন্তসিরা তাঁদের প্রতিনিধি পাঠাবেন, যেমন পাঠাবেন অন্য আন্তর্জাতিকতাবাদীরা, যাঁরা ঐক্যবদ্ধ হতে চান।৮৭ লেনিন ও ট্রটস্কী দুজনেই এ নিয়ে কিছু লিখেছেন, এবং তাতে পার্থক্য থাকলেও, বিরোধ নেই। লেনিনের নিজের নোট থেকে দেখা যায়ঃ “ব্যুরো – (সিসি +...) গ্রহণযোগ্য।৮৮ এ থেকে মনে হয়, এই সময় থেকে লেনিন বড় কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছোটো একটি ব্যুরোর কথা ভাবছিলেন, যা পরে রাজনৈতিক ব্যুরো বা পলিটব্যুরো নামে খ্যাত হবে, এবং ট্রটস্কীকে তাতে নেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। ট্রটস্কীরও তাতে আপত্তি ছিল না, এই ছিল লেনিনের অনুমান। কিন্তু বলশেভিকদের একাংশের আপত্তি ছিল, এবং অন্যদিকে ট্রটস্কীরও কিছু বক্তব্য ছিল। ট্রটস্কী বলেন, তিনি ও তার সহযোদ্ধারা “বলশেভিক” পার্টিতে যোগ দিচ্ছেন না, তাঁরা পার্টি ঐক্য করছেন। ১৯২৭ সালে পার্টি ইতিহাস ব্যুরোর প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো কিছু কথা বলেন, যা তাঁর আত্মজীবনীতে পুনরাবৃত্তি করেন। তিনি বলেন, তিনি যখন ফিনল্যান্ড স্টেশনে উপস্থিত হন, সেখানে তার সঙ্গে দেখা করেন মেঝরায়ঙ্কার নেতারা এবং বলশেভিক কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে ফেদোরভ। তিনি বোঝেন, মেঝরায়ঙ্কার সদস্যরা বলশেভিকদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়া থেকে পিছিয়ে যাচ্ছেন। ঐ সংগঠনে তখন ৪০০০ জঙ্গী শ্রমিক। তাই একা বলশেভিক দলে না গিয়ে, তিনি চেয়েছিলেন মেঝরায়ঙ্কার কমরেডদের সকলকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ দলে যেতে। ৮৯
লেনিন ও ট্রটস্কী দুজনেই ছিলেন সক্রিয় বিপ্লবী। বিপ্লবের সময়ে মতের মিল দেখে তাঁরা কৌশলগত আলোচনাই করেছিলেন, তত্ত্বের সূক্ষ্ম বিচার করেন নি। কিন্তু ট্রটস্কী যে নিজের পুরোনো অবস্থানেই ছিলেন, এবং পার্ট যে সেটা মেনে নিয়েছিল, তাঁর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল অগাস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর লেখা কিছু প্রবন্ধ নিয়ে একটি পুস্তিকা, যা পার্টির তরফে প্রকাশ করা হয়। ‘রুশ বিপ্লবের চরিত্র’ শীর্ষক অধ্যায়ে তিনি লেখেন যে রুশ বিপ্লব একটি বুর্জোয়া বিপ্লব, এই সাধারণীকরণ বেশীদূর এগোতে দেবে না, কারণ বুর্জোয়া শ্রেণী বিপ্লবের দায়িত্ব পালনে অক্ষম। শ্রমিক শ্রেণিকে স্বাধীন উদ্যোগ নিতে হবে, কিন্তু নিঃসঙ্গভাবে না, বরং কৃষক জনতা এবং শহরের অন্য দরিদ্র জনতার নেতৃত্বে থেকে।৯০ আর, পরের অধ্যায়ে তিনি মার্তভের মত মেনশেভিক আন্তর্জাতিকতাবাদীদের সঙ্গে তর্ক করে লেখেন, রাশিয়াতে স্বয়ংসম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক বিপ্লব একটি স্বতন্ত্র বিপ্লব হিসেবে সম্ভব না, কারণ রুশ বিপ্লব ঘটছে বিশ্ব ধনতন্ত্রের এক পরিণত অবস্থায়। তাই, তিনি শেষ করেনঃ “হয় নিরন্তর বিপ্লব, না হয় নিরন্তর গণহত্যা!এই হল লড়াই, যা চলছে মানুষের ভবিষ্যতকে নিয়ে!”৯১ স্পষ্টতই, লেনিন, বা অন্য কেউ (প্রাভদার সম্পাদক স্তালিন সহ) এই সময়ে মনে করেন নি যে এই কথা বলে ট্রটস্কী পার্টির গৃহীত মতের বিরোধী কিছু বলছেন। বরং, এই পুস্তিকা পড়লে তাঁর এবং লেনিনের ঐকমত্যই দেখা যায়।
টীকাঃ
১। A. Kh. Burganov, ‘Byla li vozmozhnost’ sozdaniia demokraticheskogo praviyerl’stva pasle oktiabr’skoi revoliutsii’, Otechestvennaia istoriia, 5, 1993, pp. 26-38.
২। Rosa Luxemburg, Zur russischen Revolution, in Rosa Luxemburg, Gesammelte Werke, Band 4, Dietz Verlag, Berlin 1990, pp. 341, 349, 356, 365.
৩। Valentino Gerratana, “Stalin, Lenin, and ‘Leninism,’” New Left Review, no. 103, May-June 1977, newleftreview.org/I/103/valentine-gerratana-stalin-lenin-and-leninism
৪। Barbara.C. Allen, Alexander Shlyapnikov, 1885-1937: Life of an Old Bolshevik, Brill, Leiden, 2015
৫।K. Marx and F. Engels, Collected Works, [MECW] Vol. 6, Progress Publishers, Moscow, 1976, p. 504.
৬।K. Marx and F. Engels, Selected Works, Vol. 2, Progress Publishers, Moscow, 1977, p. 189.
৭।MECW:6, p. 519.
৮।K. Marx, ‘The Bourgeoisie and Counter-Revolution’, MECW:8, 1977, pp. 160-3.
৯।R.C. Elwood (Ed), The Russian Social Democratic Labour Party 1898 – October 1917, vol 1 of R. H. McNeal, General Editor, Resolutions and Decisions of the Communist Party of the Soviet Union, University of Toronto Press, Toronto, 1974, p. 45.
১০।N. Riazanov, ‘The Draft Programme of ‘Iskra’ and the Tasks of Russian Social Democrats’, in Richard B. Day and Daniel Gaido (Ed and trans), Witnesses to the Permanent Revolution: The Documentary Record, Haymarket Books, Chicago, 2011, pp. 67-134. [hereafter mentioned as Day and Gaido]
১১।G.V. Plekhanov,’ ‘Orthodox’ Pedantry’, in Day and Gaido, pp. 135-168.
১২।L. Trotsky, The Young Lenin, Penguin, Harmondsworth, 1974, pp. 165-66.
১৩।Michael Lowy, The Politics of Uneven and Combined Development, Verso, London, 1981, p. 33.
১৪।ঐ
১৫। L. Trotsky, 1905, Pelican, Harmondsworth, 1973, p. 10.
১৬।Karl Kautsky, ‘Old and New Revolution’, in Day and Gaido, pp. 529-536.উদ্ধৃতির জন্যp.536.
১৭।Karl Kautsky, ‘The Driving Forces of the Russian Revolution and Its Prospects’, in Day and Gaido, pp. 567-608.এর মধ্যে লেনিন ও ট্রটস্কীর লেখা মুখবন্ধ দুটিরও অনুবাদ রয়েছে।
১৮। ঐ p. 607.
১৯।Massimo Salvadori, Karl Kautsky and the Socialist Revolution , Verso London, 1979, p162.
২০।Rosa Luxemburg, ‘The Role of the Bourgeoisie and the Proletariat in the Russian Revolution’, in Day and Gaido, pp. 543-566.
২১।ঐ। কৃষকদের প্রসঙ্গে pp. 562-565.
২২।G. Zinoviev, History of the Russian Communist Party (Bolsheviks), New Parks, London, 1980, pp. 107-8.
২৩।Iskra, 1 January 1905
২৪।Leon Trotsky, ‘Up to the Ninth of January (1905)’, in Day and Gaido, pp. 273-332.
২৫।Parvus, ‘What Was Accomplished on the 9th of January’, Day and Gaido, pp. 251-272.
২৬।L. Trotsky, ‘Eight Hours and a Gun’, in L. Trotsky, 1905, pp. 194-201.
২৭।Kunal Chattopadhyay, Aninda Banerjee, Saurobijay Sarkar (Eds), Leon Trotsky, The Permanent Revolution and Results and Prospects [PRRP], Aakar Books, Delhi, 2005, pp. 3-93তে ইংরেজী অনুবাদ আছে। বাংলা অনুবাদের জন্য লিয়ঁ ট্রটস্কী, রুশ বিপ্লব ১৯০৫ঃ ফলাফল ও ভবিষ্যতের দিশা, নয়া আন্তর্জাতিক প্রকাশনা, কলকাতা ১৯৯১।
২৮। L. Trotsky, ‘The Proletariat and the Russian Revolution’, in L. Trotsky, 1905, p. 313.জ্যামিতিক বলতে কার্টেসীয়, বা প্রাক-দ্বান্দ্বিক যুক্তিবাদের কথা বলা হচ্ছে।
২৯। L. Trotsky, PRRP, p. 41
৩০।L. Trotsky, History of the Russian Revolution, Aakar Books, delhi, 2014.
৩১।L. Trotsky, PRRP, p. 58.
৩২।বিশদ আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য Kunal Chattopadhyay, Leninism and Permanent Revolution, Antar Rashtriya Prakashan, Baroda, 1987
৩৩। V. I. Lenin, Complete Works,[LCW], Progress Publishers, Moscow, 1965 onwards, vol 1, pp. 218, 93, 430, 437, 438.
৩৪।Neil Harding, Lenin’s Political Thought, 2 vols., MacMillan, London and Basingstoke, vol. 1, 1977, vol. 2, 1981.
৩৫।LCW, vol. 1, pp. 236, 379-80, vol.3, 316-17.
৩৬।V.I. Lenin, ‘Social Democracy and the Provisional Revolutionary Government’, LCW, vol. 8, pp. 291-2.
৩৭।LCW, vol. 8, p. 385.
৩৮।The Agrarian Programme of Social-Democracy in the First Russian Revolution, 1905-1907, in LCW, vol. 13, pp. 239, 343.
৩৯।LCW, vol. 8, pp. 328-9.
৪০।LCW, vol. 9, p. 136. এছাড়া pp. 50-1, 100, 130.
৪১।লিয়ঁ ট্রটস্কী, রুশ বিপ্লব ১৯০৫ঃ ফলাফল ও ভবিষ্যতের দিশা, পৃঃ ৮।
৪২। PRRP, p. 205.
৪৩।L. Trotsky, 1905, pp. 293-4.
৪৪।L. Trotsky, 1905, p.52.
৪৫। KPSS v bor’be za pobedu sotsialisticheskoi revolyutsii v period doevlastii, 27 Fevralya --- 4 iyulya 1917 g, Sbornik dokumentov, Moscow 1957, p. 1171; E. Burdzhalov, ‘O taktike bol’shevikov v marte-aprele 1917 goda’, Voprosy istorii, 1956, no. 4, pp. 38-56, esp. p. 41; KPSS v bor’be…, p. 72.
৪৬। Tretii S”ezd RSDRP Protokoly, Gospolitizdat, Moscow, 1958, p.15.
৪৭। পিটার্সবুর্গ কমিটির সম্পর্কে তথ্যের জন্য P.F. Kudelli (Ed), Pervyi legal’nyi Peterburgskii komitet bol’shevikov v 1917g, Sbornik materialov i protokolov zasedanii, Moscow-Leningrad, 1927.
৪৮। Ibid., pp. 9-10.
৪৯। ইস্তাহারের জন্য N. Avdeev, Revolutsiya 1917 goda. Khronika sobytii, Vol 1, Moscow, 1923, pp. 185-6. সরকার নিয়ে সমস্যা ও তা নিয়ে আলোচনার জন্য ‘Protokoly i Rezolyutsii Byuro, TsK RSDRP(b), (Mart 1917 g)’, Voprosy istorii KPSS, 1962, No.3, p. 141.
৫০। স্টাসোভা যে সদস্য ছিলেন তা নিশ্চিত। কিন্তু মারিয়া উলিয়ানোভা, আনা এলিজারভা, খাখারেভ, এরেমিয়েভ এবং বোকি সদস্য ছিলেন কি না তা নিয়ে সংশয় আছে। স্তালিন সম্পর্কে সিদ্ধান্তের জন্য দেখুন ‘Protokoly i rezolyutsii …’, p. 143. ১৯৫৬-র আগে কেন এই সব দলিল দুপ্রাপ্য ছিল তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এ বিষয়ে আরো আলোচনার জন্য দেখুন Robert Slusser, Stalin in October: The Man Who Missed the Revolution, The Johns Hopkins University Press, Baltimore, Maryland, 1987, pp. 11-12.স্লাসার বলেছেন, সরাসরি তথ্যের অনুপস্থিতিতে স্তালিনের জীবনীকাররা এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে নানা মত প্রকাশ করেছেন। রয় মেডভেডেভের ব্যবহৃত এক পুরোনো বলশেভিকের অপ্রকাশিত স্মৃতিচারণ থেকে মনে হয়, এর কারণ ছিল তুরুখানস্কে নির্বাসনের সময়ে স্তালিনের অ-কমরেডসুলভ ব্যবহারে অনেকের আপত্তি। Roy Medvedev, Let History Judge, Knopf, New York, 1971, p. 7.
৫১।‘Protokoly i rezolyutsii …’, p. 143.
৫২। প্রাভদা, ৯, ১৫ মার্চ ১৯১৭ [ পাশ্চাত্য ক্যালেন্ডারে ২৮ মার্চ]।
৫৩। প্রাভদা, ৭ মার্চ ১৯১৭তে মুদ্রিত।
৫৪। প্রাভদা, ৯ মার্চ, ১৯১৭ আহবান করেছিল সোভিয়েতের নেতৃত্বে অন্যরকম অস্থায়ী সরকার গড়তে হবে।
৫৫।J . Stalin, Works, Foreign Languages Publishing House, Moscow, 1952-55, vol 3, pp. 4-9.
৫৬।Aleksandr Gavrilovich Shliapnikov, Kanun semnadtsatogo goda; Semnadtsatyi god, in 3 volumes, Politizdat, Moscow, 1992 [originally 1923-31], vol 2, pp. 439, 452.
৫৭। Lars T. Lih, ‘Fully Armed: Kamenev and Pravda in March 1917’, The NEP Era: Soviet Russia 1921-1928: vol 8, 2014, pp. 55-68; Eric Blanc, A revolutionary line of march: ‘Old Bolshevism’ in early 1917 re-examined’, https://johnriddell.wordpress.com/2017/04/02/a-revolutionary-line-of-marc-old-bolshevism-in-early-1917-re-examined/ (accessed on 5/8/2017)
৫৮। উদ্ধৃত, Alan Woods, Bolshevism: the road to revolution, Wellred Publications, London, 1999, p. 528.
৫৯। এ বিষয়ে একটা তর্ক আছে। লারস লি দাবী করেছেন, লেনিনের পাঠানো চিঠিগুলির মধ্যে কেবল প্রথমটিই তিনি ফেরার আগে পার্টি নেতৃত্বের হাতে এসেছিল। উপরন্তু, ওই লেখাতে তাঁরা যে সম্পাদকীয় কলম চালিয়েছিলেন, তা কোনো দুরভিসন্ধি থেকে নয়। লেনিন বেশ কয়েকজন মেনশেভিক-সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারী নেতাকে এমন ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেছিলেন, যে সেটা ছাপলে লেনিনকে রাশিয়াতে ফেরানোর জন্য ওই নেতাদের সাহায্য পাওয়া সম্ভব ছিল না। Lars T. Lih, ‘Letter from Afar, Corrections from Up Close: The Bolshevik Consensus of March 1917’, Kritika: Explorations in Russian and Eurasian History, 16, 4, 2015, pp. 799-834. শুধু প্রথম চিঠিটাই এসেছিল, এটা ১৯২৪ সালে কামেনেভ দাবী করেছিলেন। রবার্ট স্লাসার লিখেছেন, লেনিন প্রথম চিঠিটা লিখেছিলেন ৭ই মার্চ, দ্বিতীয়টা ৯ই মার্চ। দুটোই কোলোনতাইয়ের হাত দিয়ে পাঠানো হয়। Robert M Slusser, Stalin in October, pp.32-33.কোলোনতাইয়ের প্রামাণ্য জীবনীকার ইভানস ক্লিমেন্টসও একই দাবী করেছেন – Barbara Evans Clements, Bolshevik Feminist: The Life of Alexandra Kollontai, Indiana University Press, Bloomington and London, 1979, pp. 103-5.
৬০।V. I. Lenin, Collected Works, Vol. 23, Progress Publishers, Moscow, 1981 (original ed. 1964), pp. 297-308. See p. 305 for the direct quotation.
৬১। প্রাভদা, ৮ এপ্রিল, ১৯১৭।
৬২। Isaac Deutscher, The Prophet Armed, Vintage, New York, 1953, p. 243.
৬৩। মিলিউকভ বলেছিলেন, “ যদি [যুদ্ধে] বিজয়ের জন্য বিপ্লবের প্রয়োজন হয়, তবে আমি চাইব যেন কোনো বিজয় না হয়”। দ্রষ্টব্য, Sarah Lovell (Ed), Leon Trotsky Speaks, Pathfinder Press, New York, 1972, p. 42.
৬৪।Ibid, p. 46.
৬৫।Ibid., p. 48
৬৬। F. F. Raskolnikov, Kronstadt i Piter v 1917 goda, Gosizdat, Moscow and Leningrad, 1925, p. 54.
৬৭।E. Yaroslavsky, Landmarks in the Life of Stalin, Foreign languages Publishing House, Moscow, 1940, p. 94.
৬৮।L. Trotsky, Stalin
৬৯। Leon Trotsky, The Stalin School of Falsification, Pathfinder Press, New York, 1979, p. 238
৭০।Ibid., pp. 240-1.
৭১। ibid., pp. 241-2.
৭২।ibid., pp. 242-5.
৭৩।Ibid, p. 255.
৭৪।Rochelle Goldberg Ruthchild, Equality and Revolution: Women’s Rights in the Russian Empire, 1905-1917, University of Pittsburgh Press, Pittsburgh, 2010, pp. 226-8.
৭৫।Leon Trotsky, The Stalin School of Falsification, p. 256.
৭৬।Ibid, p. 258.
৭৭।Ibid, p. 275.
৭৮।Ibid., pp. 289-98.
৭৯।Revoliutsionne dvizhenie v Rossii v aprele 1917g: Aprel’skii krizis, Izdatel’stvo Akademii nauk SSR, Moscow, 1958, pp. 15-16. স্বাভাবিক কারণেই, স্তালিনের জীবদ্দশায় এই সব দলিল মুদ্রিত হয় নি। এর বিপরীতে লক্ষ্যণীয় ইয়ারোস্লাভস্কির দাবী, যে স্তালিন দৃঢ়ভাবে বিপ্লবের প্রতি বিশ্বাসঘাতক জিনোভিয়েভ ও কামেনেভকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। দ্রঃ, E. Yaroslavsky, Landmarks, p. 94.
৮০।Alexander Rabinowitch, The Bolsheviks Come to Power, New Left Books, London, 1979, pp. xxi, xxxi.
৮১। Marcel Liebman, Leninism Under Lenin, Merlin, London, 1975, p. 134.
৮২।Sed’maia (aprel’skaia) Vserossiiskaia konferentsiia RSDRP (bol’shevikov), Petrogradskaia obshchegorodskaia konferentsiia RSDRD (bol’shevikov) aprel’ 1917 goda: Protokoly, Gozpolitizdat, Moscow, 1958, pp. 78-86.
৮৩।Ibid, p. 112
৮৪।Ibid., p 372.
৮৫। Ibid, p. 373.
৮৬।Ibid., p. 228. Robert Slusser, Stalin in October, pp. 81-87,দাবী করেছেন, নামগুলো সবটা লেনিনের স্থির করে রাখা। কিন্তু স্লাসারের নিজের কথা থেকেই আমরা দেখতে পাই, তিনি দুজনের নাম কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাখার পক্ষে বক্তৃতা দেন, যে দুজন হলেন স্তালিন এবং কামেনেভ। লেনিনকে প্রকাশ্য সভাতে এই বক্তৃতা দিতে দেখে আমরা কি বুঝব? প্রথমত, পিছন থেকে কলকাঠি নেড়ে না, সামনে থেকে নিজের প্রস্তাব রেখে তিনি নেতৃত্ব গড়তে চাইছিলেন। দ্বিতীয়ত, এই দুজনের নামের উপর জোর দেওয়া দেখায়, দলের রণনীতি পাল্টালে আগের নীতির প্রবক্তা সব নেতাকে নেতৃত্ব থেকে তাড়াতে হবে, এই মতে তিনি বিশ্বাস করতেন না, বরং গণতান্ত্রিকভাবে নানা মতকে নেতৃত্বে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন।
৮৭।V.I. Lenin, Collected Works, volume 24, p. 421, এবং Leninskii sbornik, no. 4, Gosizdat, Moscow, 1925, p. 303.
৮৮।Leninskii sbornik, no. 4, p. 303.
৮৯। Leon Trotsky, The Stalin School of Falsification, p. 5.
৯০।https://www.marxists.org/archive/trotsky/1917/next/ch05.htm
[1]আমি ডিক্টেটরশিপ কথাটা অনুবাদ করিনি। হ্যাল ড্রেপার এবং সোমা মারিকের গবেষণাতে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও দুজনেই দেখিয়েছেন, মার্ক্স-এঙ্গেলস ডিক্টেটরশিপ অফ দ্য প্রলেতারিয়েত বলতে “একনায়কতন্ত্র” বোঝান নি। অবশ্যই এক দল, এক নেতা, মহান কর্ণধার, এই ধরণের চিন্তা তাঁদের ছিল না। ড্রেপার মনে করেছেন এই কারণে এখানে আঙ্গিকের উপর আদৌ জোর দিতে হবে না। মারিক এ বিষয়ে ড্রেপারের বিরোধী। তিনি পারী কমিউন থেকে সোভিয়েত ধাঁচের দিকে তাকাতে চেয়েছেন। কিন্তু একনায়ক বললে যে এক নেতার উপরে শেষ অবধি জোর পড়ে, সেটা এড়াতে চেয়ে আমি বাঙ্গলায় সচরাচর যে শব্দটি ব্যবহৃত হয় তাঁকে সচেতন ভাবে সরিয়ে রেখেছি।