Socialist and Peoples' History

ট্রটস্কী হত্যার দিনে ট্রটস্কীর বিপ্লবী ঐতিহ্যকে স্মরন করে

কুণাল চট্টোপাধ্যায় 

 

১৯৪০ সালের ২০ অগাস্ট এক স্তালিনবাদী খুনে মেক্সিকো সি্টিতে নির্বাসনে বসবাসকারী লিওন ট্রটস্কীকে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে, এবং পরদিন, ২১শে অগাস্ট, তাঁর মৃত্যু হয়। এই গুপ্তহত্যা ছিল স্তালিনীয় আমলাতান্ত্রিক প্রতিবিপ্লবের অঙ্গ, এবং বারো বছরের অবিরাম আক্রমণের শেষ পরিণতি। ১৯২৭ সালে গণতান্ত্রিক আন্তঃপার্টি আলোচনা, এবং সোভিয়েত গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা দাবী করেছিল সংযুক্ত বিরোধীপক্ষ। এই দাবী মানার পরিবর্তে বলা হল, বিরোধীদের মত মানা পার্টি সদস্য হওয়ার পরিপন্থী। ট্রটস্কী ও জিনোভিয়েভকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করে পার্টি কংগ্রেসে থাকতেই দেওয়া হল নাকয়েক হাজার বিরোধীকে কংগ্রেসে ও কংগ্রেসের পরে তাড়ানো হয়। ১৯২৮ সালে আলমা আটাতে আটকে রাখা হয় ট্রটস্কীকে। জিনোভিয়েভ, কামেনেভ ও তাঁদের সমর্থকরা পার্টিতে ফেরার চেষ্টা করেন। কিন্তু বামপন্থী বিরোধী বা বলশেভিক-লেনিনবাদী গোষ্ঠী বোঝেন, এ এক প্রতিবিপ্লবের সূচনা। তাই হাতজোড় করে পার্টিতে ফেরা কাজের কথা নয়। ১৯২৮ সালেই তাঁদের মতের সারসংক্ষেপ  করে ট্রটস্কী কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ষষ্ঠ কংগ্রেসের উদ্দেশ্যে একটি দলিল লেখেন। এই দলিল হাতে পেলেন খুব অল্প কিছু প্রতিনিধি। তবু তাঁদের দুজন, জেমস কেনান এবং মরিস স্পেক্টর, দলিল লুকিয়ে দেশে ফেরেন, এবং আন্তর্জাতিক বামপন্থী বিরোধী গড়ার উদ্যোগ আরম্ভ হয়। ১৯২৯ সালে ট্রটস্কীকে বে-আইনীভাবে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ তাকে কোনো সে দেশে যাওয়ার ভিসা দিতে অরাজি ছিল। তাঁর ভাষায়, এর ফলে তিনি ভিসাহীন পৃথিবীতে পড়লেন। ১৯৩২ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিতরে ঘটনা আরো জটিল হতে থাকে। অর্থনৈতিক সংকট বাড়ে, ফলে অসন্তোষও বাড়ে। এই সময় থেকে স্তালিন সব বিরোধী ও সম্ভাব্য বিরোধীদের শেষ করে ফেলার দিকে যেতে থাকেন। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য ও ট্রটস্কিবাদীদের ঘোর বিরোধী রিউটিন স্তালিনের বাধ্যতামূলক যৌথ খামার গঠনের সমালোচনা করলে পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হন, এবং ১৯৩২ সালে পার্টি সদস্যদের প্রতি একটি ২০০ পাতার দলিল তৈরী করলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়, এবং প্রতিবিপ্লবী আখ্যা দেওয়া হয়। স্তালিন পলিটব্যুরোতে তাঁর মৃত্যুদন্ড দাবী করেন, কিন্তু  স্তালিনবাদী ‘নরমপন্থী’ বলে যারা পরিচিত, তাঁদের চাপে শুধু দশ বছরের জেল হয়। ১৯৩৬ সালে কিরভের হত্যার পর জিনোভিয়েভ ও কামেনেভকে দায়ী করে বিচারের নামে এক প্রহসনের পর গুলি করে খুন করা হয়। ১৯৩৭ সালে রাডেক, পিয়াতাকভ ও অন্যদের বিচার হয় এবং একইভাবে অনেককে হত্যা করা হয়১৯৩৮ সালে বুখারিন, রাইকভ, র‍্যাকভস্কি প্রমুখকে হত্যা করা হয়। পুরোনো বলশেভিকদের উপর হত্যা চলতে থাকে, এবং যে সব পুরোনো বলশেভিক স্তালিনকে ১৯২০-র দশকে সমর্থন করেছিলেন, তাঁদের অনেকেও জল্লাদের হাতে প্রাণ হারান। এই গোটা প্রক্রিয়াকে বাইরে থেকে চ্যালেঞ্জ করে গেলেন, বিশ্লেষণ করলেন, বিচারের মিথ্যাগুলি ধরিয়ে দিলেন ট্রটস্কী এবং তাঁর ছেলে লেভ সেদভ। উপরন্তু, ১৯২৯ থেকে ট্রটস্কী গড়ে তুলছিলেন আন্তর্জাতিক বামপন্থী বিরোধী গোষ্ঠী। জার্মানীতে ফ্যাসীবাদের উত্থান, এবং তার ক্ষমতা দখলের পর্বে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের জঘন্য ভূমিকা [কার্যত সব অ-কমিউনিস্ট দলই ফ্যাসিবাদী, তাই আলাদা করে হিটলারের বিরুদ্ধে লড়াই করা অপ্রয়োজনীয়, এই অবস্থান নিয়ে প্রলেতারিয় যুক্তফ্রন্ট গড়তে অস্বীকার করা] ট্রটস্কীর মত পরিবর্তন করল। তিনি এতদিন মনে করেছিলেন, স্তালিনবাদী আমলাতন্ত্র ক্ষতিকর হলেও, শ্রমিক শ্রেণীর চাপে তার সংস্কার করা সম্ভব। এই সময় থেকে তিনি জার্মানীতে নতুন বিপ্লবী দল, এবং জার্মান কমিউনিস্ট পার্টিকে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সঠিক বলে প্রস্তাব নেওয়ার পরে নতুন বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ার ডাক দেন। ১৯৩৬ সালে রচিত হয় তাঁর বই দ্য রেভল্যুশন বিট্রেড, যেখানে তিনি স্তালিনবাদী শাসনকে একটি আমলাতান্ত্রিক আংশিক প্রতিবিপ্লব বলে চিহ্নিত করেন, এবং বলেন যে শ্রমিক শ্রেণীর গণতান্ত্রিক বিপ্লব অথবা আমলাতন্ত্রের হাতে ধনতন্ত্র ফিরে আসা—এই হল দুই সম্ভাব্য ফল। ট্রটস্কী তুরস্ক, ফ্রান্স, নরওয়েতে বা মেহিকোতে, যেখানে, যে অবস্থায় নির্বাসনে থাকুন না কেন, ফ্যাসীবাদ এবং স্তালিনবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, এবং বিশ্ববিপ্লবের জন্য কমিউনিস্ট রাজনীতির নবীকরণের লড়াই চালিয়ে গেলেন। তাই এটা সামান্যতম অস্বাভাবিক নয়, যে স্তালিনবাদ তাঁর মৃত্যুর জন্য , এবং ট্রটস্কীর সমর্থকদের মৃত্যুর জন্য সচেষ্ট থাকবে। ট্রটস্কীবাদী কথাটা সে সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে যত্রতত্র ব্যবহার করা হত। কিন্তু বামপন্থী বিরোধী গোষ্ঠীর প্রকৃত সদস্য ছিলেন মোটামুটি ৪৪,০০০ জন। স্তালিনের অজানা ছিল না যে ফেব্রুয়ারী ১৯১৭তে বলশেভিকদের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৪,০০০, অথচ বিপ্লবী বছরের শেষদিকে প্রায় ৪০০,০০০ সদস্যের বলশেভিক দলের নেতৃত্বে শ্রমিক ও সৈনিকদের সোভিয়েতরা ক্ষমতা দখল করেছিল। ফলে হাতে গোণা জনকয়েক ছাড়া ঐ ৪৪,০০০কে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়। এঁদের প্রধান তাত্ত্বিক-রাজনৈতিক নেতাকেও যে খতম করা হবে, তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না। ১৯৩৬ থেকে একটা গোটা উপদপ্তরের এটাই ছিল কাজ। বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতাবাদ ও ১৯১৭-র আশার প্রতীক, তাই ট্রটস্কীকে হত্যা করা আমলাতান্ত্রিক প্রতিবিপ্লব একটা কেন্দ্রীয় কর্তব্য হিসেবেই নিয়েছিল। অবশেষে ১৯৪০-এর ২১ অগাস্ট তাদের দীর্ঘ প্রয়াস সফল হল। আজকের যুগে, অবিকৃত মার্ক্সবাদ নতুন করে খুঁজছেন যে জঙ্গী কর্মীরা, তাঁদের কাছে ট্রটস্কী মার্ক্সবাদের বিকাশের অন্যতম উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ত্ব।

কলম আর তরবারিঃ

ট্রটস্কী ছিলেন এক অসামান্য মানুষ, যিনি বহু কাজে প্রবল দক্ষতা দেখিয়েছিলেন। বিপ্লবী জীবনের গোড়ার দিকে তাঁর লেখনীশক্তির জন্য লেনিন তাঁর ছদ্মনাম রেখেছিলেন পেরো – কলম। সাইবেরিয়ার নির্বাসন থেকে রাজধানীতে ও বিদেশে, বলকান যুদ্ধ থেকে মহাযুদ্ধে, তিনি সাংবাদিক হিসেবে অসাধারণ রচনা রেখে গেছেন, এবং ১৯০৫-এর বিপ্লবের সময়ে বিপ্লবী সাংবাদিকতারও নজীর রেখেছেন। বক্তা হিসেবে তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রসিদ্ধ মানুষ। মেনশেভিক নেতা ও প্রত্যক্ষদর্শী নিকোলাই সুখানভের লেখা ইতিহাসে বারে বারে উল্লেখ আসে ১৯১৭ সালে রাজধানীর শ্রমিক ও সৈনিকদের উপরে ট্রটস্কীর বক্তৃতার প্রভাবের। তিনি ছিলেন একজন উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সমালোচক, যার প্রায় ১০০ বছর আগে লেখা লিটারেচার অ্যান্ড রেভল্যুশন এখনো মার্ক্সীয় সাহিত্য সমালোচনার একটি উল্লেখযোগ্য বই হিসেবে দেখা হয়। তিনি ছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষণে পটু, মার্ক্সীয় তত্ত্বে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ভাবার ক্ষমতাসম্পন্ন তাত্ত্বিক, এবং ইতিহাসবিদ হিসেবে তাঁর স্থান থুকি্ডিডিস এবং এডওয়ার্ড গিবনের সঙ্গে এক স্তরে আসে।

কিন্তু তিনি নিছক লেখক ও বক্তা ছিলেন না। উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে তিনি রাশিয়ার গোপন মার্ক্সবাদী আন্দোলনে যোগ দেন এবং এই সময় থেকে প্রলেতারীয় বিপ্লবী আন্দোলনের যোদ্ধা ছিলেন। গ্রেপ্তার হয়ে সাইবেরিয়াতে নির্বাসনে যান। সেখান থেকে পালিয়ে বিদেশে যান এবং ইস্ক্রা গোষ্ঠীর সক্রিয় কর্মী হিসেবে দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসে সাইবেরিয়ার প্রতিনিধি হন। ১৯০৫-এর রুশ বিপ্লবে না-মেনশেভিক, না বলশেভিক অবস্থানে থাকা এই ২৬ বছর বয়স্ক সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট সেন্ট পিটার্সবুর্গ সোভিয়েতের সভাপ্রধান ছিলেন। ১৯১৭ সালে তিনি বলশেভিক দলে যোগ দেন, এবং ছিলেন পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের সভাপ্রধান এবং অক্টোবর অভ্যুত্থানের প্রধান সংগঠক। ১৯১৮ থেকে তিনি ছিলেন সেনা ও নৌবাহিনীর কমিশার, এবং এই পদে লালফৌজের প্রধান সংগঠক। প্রথম প্রতিবিপ্লবী আগ্রাসন, যখন দেশীয় প্রতিবিপ্লবের সঙ্গে হাত মেলায় চোদ্দটি অন্য দেশ, তখন কলম ও ভাষণ ছেড়ে বন্দুক হাতেই বলশেভিকদের লড়তে হয়েছিল। ১৯২৩ থেকে আমলাতন্ত্রের ক্ষমতাবৃদ্ধির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সামনের সারিতে ছিলেন ট্রটস্কী, যদিও তিনি নিজে তখন পলিটব্যুরো সদস্য। অর্থাৎ, যে সব লেখক দাবী করেছেন,  আমলাতন্ত্র সম্পর্কে ট্রটস্কীর আপত্তি ভুয়ো, ক্ষমতা হারিয়ে ঈর্ষাজনিত, তারা না জেনে লিখেছেন অথবা সচেতনভাবে বিকৃতিসাধন করেছেন। হিটলারের উত্থানপর্বে কমিউনিস্ট-সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট যুক্তফ্রণ্টের জন্য যে সামান্য কয়েকজন মার্ক্সবাদী চেষ্টা করে গেছেন, তাঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন ট্রটস্কী। কমিউনিস্ট পার্টিদের অধঃপতন দেখে হতাশায় পিছু হঠার বদলে তিনি উদ্যোগ নেন চতুর্থ আন্তর্জাতিক গড়ার। প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে তাঁর গোটা জীবন কেটেছিল শোষণ ও বঞ্চনামুক্ত পৃথিবী গড়ার সংগ্রামে যুক্ত থেকে।

নিরন্তর বিপ্লবঃ

মার্ক্সবাদের বিকাশে ট্রটস্কীর অন্যতম মূল অবদান হল নিরন্তর বিপ্লবের তত্ত্ব। এর উৎস মার্ক্সের চিন্তা, কিন্তু যা অনেকটাই বিস্মৃত হয়েছিল। ১৯০৫-এর রুশ বিপ্লবের সময়ে যে অভিজ্ঞতা, তা থেকে এই তত্ত্বের বিকাশ, এবং ১৯২৫-১৯২৭-এর চিন বিপ্লবের অভিজ্ঞতা থেকে এর বিশ্বব্যাপী প্রয়োগের প্রসঙ্গ আসে। রুশ বিপ্লবী মার্ক্সবাদীরা মনে করতেন, রুশ বিপ্লব হবে ‘বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব’। অর্থাৎ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আসবে, বুর্জোয়া অর্থনীতির বিকাশ হবে। মেনশেভিকরা, বিশেষ করে প্লেখানভ, মনে করেছিলেন যে এই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেবে বুর্জোয়া শ্রেণী। তাই শ্রমিক শ্রেণী বুর্জোয়া শ্রেণী যতটুকু যেতে প্রস্তুত, তার চেয়ে বেশী যেতে পারবে না। তা হলে বুর্জোয়া শ্রেণী ভীত হয়ে বিপ্লবের পথ থেকে সরে আসবে। বলশেভিকরা একমত ছিলেন যে রাশিয়ার সামনে আছে তার ১৭৮৯। কিন্তু লেনিন মনে করেছিলেন, বুর্জোয়া শ্রেণী এত ভীরু, এবং জমিদারদের ও জারতন্ত্রের সঙ্গে রফা করার প্রবণতা তাদের মধ্যে এত বেশী, যে তারা নেতৃত্ব পেলে বুর্জোয়া বিপ্লবের গণতান্ত্রিক উপাদান অসমাপ্তই থেকে যাবে। বুর্জোয়া বিপ্লবের বিপ্লবী বুর্জোয়া শক্তি হিসেবে লেনিন দেখেছিলেন কৃষকদের, এবং শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে ও কৃষকের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে বিপ্লব হবে মনে করেছিলেন। কিন্তু তিনি নিশ্চিত ছিলেন, কৃষক প্রধান রাশিয়াতে এই বিপ্লব বুর্জোয়া স্তরের বেশী এগোবে না, এবং বুর্জোয়া বিকাশের এক দীর্ঘ সময়ের ফলে শ্রমিক শ্রেণীর সংখ্যা বাড়বে, শিল্পায়ন হবে, তবেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা আসবে।     

ট্রটস্কী এর বিপরীতে এক বিকল্প সম্ভাবনা তুলে ধরলেন। তিনি লেনিনের সঙ্গে একমত ছিলেন যে শ্রমিক শ্রেণীকেই বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে হবে। কিন্তু তিনি ১৯০৫-এর গোড়া থেকেই দেখাতে চাইলেন, যে রাশিয়ার বিকাশের পথ ব্রিটেন বা ফ্রান্সের পথ হবে না। এর কারণ বিশ্ব অর্থনীতির অসম বিকাশ। শিল্পবিপ্লব ঘটে যাওয়ার এক শতাব্দী পরে যখন রাশিয়াতে ধনতন্ত্রের বিকাশ হল, তখন তা আর ব্রিটেনের প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করল না। বরং রুশ শিল্পায়নে প্রাক-পুঁজিবাদী কুটির শিল্পের পর এক লাফে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি চলে এল। অবশ্য, সে এল সব ক্ষেত্রে না, বাছাই করা কিছু ক্ষেত্রে। এর ফলে গোটা দেশের জনসংখ্যার তুলনায় শ্রমিক সংখ্যা অল্প হলেও তারা অনেকটা সংহত, বড় ফ্যাক্টরীতে কর্মরত, এবং লড়াকু  ছিলেন। ফলে, শ্রমিক শ্রেণীর পক্ষে কৃষক সমাজের নেতৃত্ব দিয়ে বিপ্লব সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল।

কিন্তু ১৯০৫-এর অভিজ্ঞতা থেকে ট্রটস্কী আরেকটা দিক দেখলেন ও তার ভিত্তিতে তত্ত্বগত অবস্থান তৈরী করলেন। বিপ্লবী পরিস্থিতিতে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে প্রাচীর ভেঙ্গে পড়ে। শ্রমিক শ্রেণী আটঘন্টার শ্রমদিবস নিয়ে লড়াই করেছিলেন। যদিও এটা কোনোরকম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দাবী না, তবু বুর্জোয়া শ্রেণী এই বিপ্লবের পরিস্থিতিতে সেটা মানতে রাজি ছিল না। ফলে তিনি একটা মৌলিক প্রশ্ন তোলেন—যদি শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে, শ্রমিক-কৃষক-পেটি বুর্জোয়াদের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে, বিপ্লবের প্রাথমিক সাফল্য আসে এবং একটা বিপ্লবী সরকার গড়ে ওঠে,  তাহলে শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে বুর্জোয়া শ্রেণীর দ্বন্দ্ব তো আরো বাড়বে। বিপ্লবী দল তখন কী করবে? শ্রমিকরা আট ঘন্টা শ্রমদিবস, ন্যূনতম মজুরী, এরকম যে কোনো দাবী করলেই মালিকরা লক আউট ঘোষণা করতে পারে। সেক্ষেত্রে বিপ্লবী শ্রমিক দলের নেতৃত্বাধীন সরকার হয় ন্যূনতম কর্মসূচিতে থাকার নাম করে বুর্জোয়া মালিকের গায়ে হাত তুলবে না, আর তা হলে ন্যূনতম কর্মসূচিও চালু করা যাবে না; অথবা আটঘন্টা শ্রম দিবস চালু করতে গিয়ে ফ্যাক্টরী বাজেয়াপ্ত করতে বাধ্য হবে, অর্থাৎ বিপ্লব আর বুর্জোয়া স্তরে আটকে থাকবে না। এই অর্থে বিপ্লব হবে ‘পার্মানেন্ট’। কিন্তু সেই সঙ্গে ট্রটস্কী বুঝেছিলেন, অনগ্রসর রাশিয়াতে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে ক্ষমতা দখল করলে বিপ্লবের স্থায়ীত্ব আসতে পারে না, যদি না বিপ্লব উন্নততর বুর্জোয়া দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। এই হল নিরন্তর বিপ্লবের দ্বিতীয় দিক। নিরন্তর বিপ্লবের তৃতীয় দিক হল, একটা প্রশ্নের জবাব — কম শিক্ষিত, কম সংস্কৃতিবান শ্রমিক যে দেশে এত বেশী, সেই দেশে কীভাবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হবে? ট্রটস্কীর উত্তর ছিল—রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল উত্তরণের সূচনা করবে, উত্তরণ সম্পন্ন করবে না। তার জন্য চাই সমাজবিপ্লবের এক দীর্ঘ পর্যায়। ১৯১৭-র বিপ্লবের ইতিহাস দেখায়, এই ঘটনাই ঘটেছিল। বুর্জোয়া শ্রেণী হাতে ক্ষমতা রাখতে অক্ষম ছিল, কারণ তারা কৃষকের স্বার্থ, ব্যাপক সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখতে রাজি ছিল না। তাই শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃতে সোভিয়েত বিপ্লব প্রেলেতারীয় রাজ কায়েম করে, যা হল এক দিকে রাশিয়ার রূপান্তরের সূচনা, আর অন্যদিকে বিশ্ববিপ্লবের যুদ্ধঘোষণা।  

কিন্তু এই অভিজ্ঞতাকে তখনই সারা পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে সম্প্রসারিত করা হয় নি। চিন বিপ্লবের অভিজ্ঞতা থেকে সেটা হল। ট্রটস্কী বলেন, যে সব উপনিবেশে কিছুটা শিল্পায়ন হয়েছে, সেখানে, যেমন চিনদেশে, বুর্জোয়া শ্রেণী দুর্বল, এবং সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ওতপ্রেতভাবে জড়ানো। তাই জাতীয় মুক্তি, কৃষি বিপ্লব এবং গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামকেও তারা প্রগতিশীল পথে বেশিদূর নিয়ে যেতে পারবে না। সেই দায়িত্ব পড়বে শ্রমিক শ্রেণীর উপরে। এই কারণে তিনি ও তাঁর সমর্থকরা চিনের কমিউনিস্ট দলকে কুওমিনতাং থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দিতে চেয়েছিলেন। আর, চিয়াং কাই শেকের হাতে শহরাঞ্চলে পার্টি প্রবলভাবে আক্রান্ত হওয়ার পর তারা হঠকারী ক্যান্টন অভ্যুত্থানের বিরোধী ছিলেন। [এই অভ্যুত্থান একেবারেই মস্কো থেকে, স্তালিনের চাপে করানো হয়, কিন্তু তার পরাজয়ের পর গোটা দায় চাপানো হয় প্রথমে ইয়ে তিংয়ের উপরে (অভ্যুত্থান হেরে গেল বলে) ও পরে চু চিউ পাইয়ের উপরে (হঠকারিতার জন্য)।] ট্রটস্কীর বক্তব্য কখনোই ছিল না যে, যে কোনো পরিস্থিতিতে বিপ্লবকে সামনের দিকে ঠেলার হঠকারী পদক্ষেপ নিতে হবে। বরং, তাঁর বক্তব্য ছিল, পার্টিকে শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে গভীরে নিয়ে যেতে হবে, কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে (এই কারণে তাঁর অজানা এক চিনা কমিউনিস্টের হুনান রিপোর্ট রুশ ভাষায় অনুবাদে পড়ে তিনি তার উচ্ছসিত প্রশংসা করেন), এবং গণতান্ত্রিক স্লোগান ধরে তার ভিত্তিতে প্রলেতারীয় রাজনৈতিক-মতাদর্শগত প্রাধান্যের দিকে এগোতে হবে। ১৯৪৯ এর চিন বিপ্লব দেখাল, ট্রটস্কীর দিশা কতটা সঠিক ছিল। কিউবার বিপ্লব অন্যভাবে একই কথা দেখাল। স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে ডিক্টেটর বিরোধী গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্ভব হল না—অতি অল্প সময়ের মধ্যেই কাস্ত্রো, গ্যেভারা, ও তাঁদের কমরেডরা পুঁজি জাতীয়করণের মত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হলেন।  জাতীয় বুর্জোয়ারা যে বিপ্লবী শক্তি হবে না, এবং সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা, কৃষি সমস্যার প্রাথমিক সমাধান, ও  সমাজতন্ত্রের লড়াইকে একত্রে আনা যে প্রলেতারিয়েতের বিপ্লবী কর্তব্য, সেটা ট্রটস্কীর বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট বেরোয়, এবং ঐ বিশ্লেষণই স্তালিনবাদের বিপ্লব-ধ্বংসকারী নীতির একমাত্র একনিষ্ঠ তত্ত্বগত প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়ায়। কেবলমাত্র মস্কোপন্থী রাজনীতি নয়, বরং ইন্দোনেশিয়াতে চিনের কমিউনিস্ট পার্টির অনুগামী আইদিতের নেতৃত্বে পি কে আই-এর সুকর্ণর কাছে অবনত থাকা ও তার ফলে পাঁচ লাখ কমিউনিস্টের মৃত্যুও, এই নীতিরই ফসল।    

ফ্যাসীবিরোধী প্রলেতারীয় যুক্তফ্রন্টঃ

১৯১৮-১৯২০ পর্বে একটা আধা বাস্তব পরিস্থিতি ছিল, যখন ইউরোপের বহু দেশে প্রলেতারীয় বিপ্লব সম্ভব

মনে হয়েছিল। জার্মানী, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরী, ইতালী, বহু দেশে বিপ্লব হয় বা বিপ্লবী পরিস্থিতি দেখা দেয়।

হাঙ্গেরীতে স্বল্পকালের জন্য অতিবাম এক কমিউনিস্ট নেতৃত্বে একটি সোভিয়েত সাধারণতন্ত্র দেখা দেয়।

কিন্তু সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক দলের নেতাদের অবিপ্লবী, বেশ কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি প্রতিবিপ্লবী ভূমিকা অন্য

সব ক্ষেত্রে এই বিপ্লবগুলিকে পরাজয়ের দিকে ঠেলে দেয়। ১৯১৯ সালে গঠিত হয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক,

 এবং ১৯২০ থেকে ইউরোপের অনেকগুলি দেশে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক দল ভেঙ্গে কমিউনিস্ট দল গঠিত

হয়। এই পর্বে স্বাভাবিকভাবেই জোর পড়েছিল বিভাজনের উপরে। কিন্তু ১৯২১ থেকে ক্রমে বোঝা যায়,

বিশ্ব ধনতন্ত্রে একরকম স্থিতিশীলতা আসছে। একদল কমিউনিস্ট – রাশিয়াতে জিনোভিয়েভ, হাঙ্গেরির

বেলা কুন, ইতালীর বর্ডিগা, জার্মানীতে এক বড় গোষ্ঠী, এই সময়ে অতিবাম অবস্থান নিয়েছিলেন। এর

বিপরীতে লেনিন, ট্রটস্কী, ক্লারা জেটকিন, হাইনরিশ ব্রান্ডলাররা জোর দিলেন দীর্ঘমেয়াদী লড়াইয়ের উপরে,

এবং এই কারণে তারা বললেন যে সোশ্যাল ডেমোক্রেসি অবিপ্লবী হলেও, শ্রমিক শ্রেণীর অঙ্গ, তাই প্রশ্নটা

যখন শ্রমিকদের আত্মরক্ষার, তখন একে অপরের সঙ্গে প্রতিরক্ষামূলক জোট গড়তে পারে।  এই হল

প্রলেতারীয় যুক্তফ্রন্টের উদ্ভব। এই সময়েই কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকে ট্রটস্কী এই ফ্রন্টের চরিত্র ব্যাখ্যায় বড়

ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯২৪ সালে, লেনিনের মৃত্যুর পরে, কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের পঞ্চম কংগ্রেসে

জিনোভিয়েভ ও স্তালিন বাম হঠকারিতাকে সাময়িকভাবে ফেরালেন। বলা হল, যুক্তফ্রন্টের মূল কাজ শুধু

সংস্কারবাদীদের ‘মুখোশ খুলে দেওয়া’, বা ‘তলা থেকে যুক্তফ্রন্ট’। অথচ, যদি সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক দলের

নীচের তলার কর্মী নিজের নেতাদের বাদ দিয়েই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে  লড়তে রাজি থাকতেন, তাহলে 

সেখানে তো আর দুই রাজনীতির মধ্যে সাময়িক যুক্তফ্রন্টের প্রশ্নই ওঠে না। এই সময়ের হঠকারিতা

বেশীদিন থাকে নি। কিন্তু এর প্রভাব থেকে গেল। ১৯২৮-২৯ থেকে, বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের ফলে,

মধ্যপন্থী রাজনীতির জমি সংকুচিত হতে থাকে। জার্মানীতে কমিউনিস্ট পার্টির ভোট ও সদস্যসংখ্যা বাড়ে।

১৯২৮ সালে কমিউনিস্টদের ভোট ছিল ১০.৬২%, এবং আসন ৫৪টি। নাজীদের ভোট ছিল ২.৬৩%, আসন

১২টি। ১৯৩০ সালে, দারিদ্র, বেকারত্ব বৃদ্ধির মাঝে সেটা হল – নাজীরা ১৮.৩% (১০৭টি আসন),

কমিউনিস্টরা ১৩.১% (৭৭টি আসন)।  পরিস্থিতি বিচার করে ট্রটস্কী দেখান, হিটলার ক্ষমতা দখলের বাস্তব

সম্ভাবনা আছে। ‘জার্মানী, দ্য কী টু দ্য ইন্টারন্যাশনাল সিচুয়েশন’ প্রবন্ধ থেকে ১৯৩৩ সালে হিটলারের

ক্ষমতা দখল অবধি তিনি একের পর এক প্রবন্ধ ও পুস্তিকা লিখে জার্মান শ্রমিক শ্রেণীকে এই বিপদ কতটা

সাংঘাতিক সেকথা বোঝাতে চান (এর জন্য দেখা যায় দ্য স্ট্রাগল এগেইন্সট ফ্যাশিজম বইটি)।  কিন্তু ট্রটস্কী

মনে করেছিলেন, হিটলারের ক্ষমতা দখল অনিবার্য নয়। শ্রমিক শ্রেণীর যুক্তফ্রন্ট গড়ে তাকে ঠেকানো সম্ভব

ছিল। কিন্তু এই সময়ে স্তালিনের পরিচালনায় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক এক আপাতঃ অতিবাম অবস্থান

নিয়েছিল। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ঘোষণা করল, মহাযুদ্ধের পর তৃতীয় পর্ব এসেছে, যখন বিপ্লব আসন্ন।

তারা আরো বলল, ক্রমবর্ধমান “সাম্রাজ্যবাদী অন্তর্দ্বন্দ্বের এবং শ্রেণী সংগ্রাম তীব্রতর হওয়ার

এই পরিস্থিতিতে ফ্যাসীবাদ ক্রমে ক্রমে হয়ে পড়েছে বুর্জোয়া শাসনের প্রধান রূপ। যে সব দেশে শক্তিশালী

সোশ্যাল ডেমোক্র্যা্টিক দল আছে সেখানে ফ্যাসীবাদ সামাজিক ফ্যাসীবাদের রূপ নেয়, ফ্যাসীবাদী

একনায়কন্ত্রের সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রামকে পক্ষাঘাতগ্রস্থ করার কাজ করে ক্রমে বেশি করে

বুর্জোয়াদের সেবা করে”। অতএব, এই যুগে নাকি সব বুর্জোয়া সরকারই ফ্যাসিবাদী বা ফ্যাসিবাদমুখী।

যুক্তফ্রন্ট সম্ভব কেবল তলা থেকে। সোশ্যাল ডেমোক্রেসীকে কার্যত তাদের নাজীদের চেয়েও বড় শত্রু বলে

ঘোষণা করে কোনোরকম ফ্যাসীবিরোধী প্রলেতারীয় যুক্তফ্রন্ট গড়া অসম্ভব করা হল। নাজী বিপদ যত বাড়ে,

ট্রটস্কী তত প্রবলভাবে যুক্তফ্রন্টের প্রচার করেন—নেমেতস্কায়া রেভলিউতসিয়া ই স্তালিনস্কায়া বুরোক্র্যাটিয়া

[জার্মান বিপ্লব ও স্তালিনবাদী আমলাতন্ত্র – ইংরেজিতে হোয়াট নেক্সট নামে প্রকাশিত], দি ওনলি রোড,

ইত্যাদির  মাধ্যমে।        


ফ্যাসীবাদের বিরুদ্ধে তাঁর প্রচার বুর্জোয়া গণতন্ত্র সম্পর্কেও নির্দিষ্ট এক বিশ্লেষণ করে। তিনি জানতেন,

কমিউনিস্ট ও ফ্যাসীবাদের মধ্যে বুর্জোয়া উদারনৈতিক রাজনীতি ব্রাউনশার্টদেরই বেছে নেবে। সোশ্যাল

ডেমোক্র্যাটিক দলের উপরেও তাঁর বিপুল আস্থা ছিল এমন নয়, কারণ তারা ১৯১৮-১৯এর বিপ্লবকে বধ

করেছিল, এবং সরকার থেকে ঠেলে বার করে দেওয়া অবধি তারা উদারপন্থীদের সংগেই হাত মিলিয়ে

চলেছিল। তাই তিনি যুক্তফ্রন্টের ভরকেন্দ্র পার্লামেন্ট (রাইখস্ট্যাগ)-এ রাখার প্রস্তাব করেন নি। তাঁর প্রস্তাব

ছিল, দুই দলের মধ্যে বোঝাপড়া হোক, নাজী আক্রমণের মুখে সংসদের বাইরে জোট হোক। এর কাজ

হবে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা, নাজীরা যে কোনো পার্টি বা ট্রেড ইউনিয়ন দপ্তর, কোনো শ্রমিক এলাকা

আক্রমণ করলে একজোট হয়ে তাদের প্রতিহত করা হোক। তিনি ব্যাখ্যা করেন, এতে একদিকে গনতান্ত্রিক

অধিকার রক্ষিত হবে, এবং তার ফলে শ্রমিক শ্রেণীর জঙ্গী লড়াইয়ের মেজাজ বাড়বে। আর অন্যদিকে এর

মাধ্যমে কমিউনিস্টদের পক্ষে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক কর্মীদের কাছে বাস্তব কাজের মাধ্যমে নিজেদের

রাজনীতি কেন শ্রেয় সেটা বোঝানো যাবে। যুক্তফ্রন্টের অগ্রগতি হবে কমিউনিস্ট রাজনীতির ও জার্মান

বিপ্লবের অগ্রগতির সূচনা।    
.
জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি, ও তাঁদের পিছনে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, এই রাজনীতি গ্রহণ

করতে একেবারে রাজি ছিলেন না। কেন এই হঠকারী, অতিবাম ও নিষ্ক্রিয়তার নীতি গৃহীত হল? সোশ্যাল

ডেমোক্রেসী তো নানাভাবে শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষতি নিশ্চয়ই করছিল। কিন্তু তার উত্তরে ট্রেড ইউনিয়ন

ভাঙায় জার্মানীতে জঙ্গী কমিউনিস্ট শ্রমিকরা ব্যাপক শ্রমিকদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন।

১৯২৪-২৫-এর অতিবামপন্থা ছিল ভ্রান্ত, কিন্তু তা ছিল বিপ্লবীদের হঠকারী রণনীতি। ১৯২৯-৩৪ পর্বের বামপন্থা কিন্তু তা ছিল না। গোড়ার দিকের বামনেতারা অভ্যুত্থান সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন. লড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯২৮-৩৪-এ যাঁরা নেতা হলেন, তাঁরা ছিলেন স্তালিন, মলোটভদের মনোনীত নেতা, যাঁদের কোনো গণভিত্তি ছিল না, যা ছিল তা হল সোভিয়েত সূর্যের রশ্মি গায়ে পড়ে প্রতিফলিত আলো মাত্র।

কমিউনিস্ট কর্মীরা অনেকে পূর্ববর্তী পর্বের দক্ষিণ-পন্থায় ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাই তাঁরা এই আপাতঃ বাম লাইনকে আসল বামপন্থা বলেই আঁকড়ে ধরলেন।

স্তালিনের প্রকৃত উদ্দেশ্য খুঁজতে হলে তাকাতে হবে সোভিয়েত পররাষ্ট্র নীতির দিকে। ১৯২৩-এর বিপ্লবী আন্দোলন ব্যর্থ হলেও, রুশ-জার্মান সম্পর্ক তার ফলে ক্ষুন্ন হয়েছিল। স্ট্রেসেম্যানের সরকার ক্রমেই পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতির উপর জোর দেওয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সমস্যা বাড়ছিল। ‘‘একদেশে সমাজতন্ত্রের’’ পূর্বশর্ত হল, কোনো না কোনো সাম্রাজ্যবাদী দেশকে মিত্র হিসেবে পেলে তাতে সুবিধা হবে।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একদেশে সমাজতন্ত্র” গড়ার অর্থ তাহলে বিশ্ব ধনতন্ত্র ও তার শ্রমবিভাজনের উপর নির্ভরতা। দশ বছরে পাশ্চাত্যকে ছাড়িয়ে যেতে হবে এই অবাস্তব স্লোগানকে অন্তত আংশিকভাবে কার্যকর করার জন্য প্রয়োজন ছিল জার্মান প্রযুক্তির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ। 

হিটলার ক্ষমতা দখল করল, ইউরোপের সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন বিনাযুদ্ধে ধ্বংস হয়ে গেল। ১৯৩৭ সালে সোভিয়েত আমলাতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করার পর ওয়াল্টার ক্রিভিটস্কি যে বহু গোপন তথ্য ফাঁস করে দেন, তার একটি হলঃ যদি ক্রেমলিনে জার্মানপন্থী বলে কারো কথা বলা যায়, তবে তিনি হলেন স্তালিন।.....নাজীদের জয় তাঁর মধ্যে জার্মানীর সঙ্গে নিবিড়তর সম্পর্কের অনুসন্ধানের ইচ্ছা দৃঢ়তর করল। 

শোভনলাল দত্তগুপ্ত কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের এই পর্বের দলিল ধরে দেখাতে চেয়েছেন, আংশিকভাবে স্তালিনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব করেই ডিমিট্রভের যুক্তফ্রন্ট রণনীতি আসে। কিন্তু এর সঙ্গে ১৯২১-থেকে ১৯২৩ এবং পরে ট্রটস্কী প্রস্তাবিত যুক্তফ্রন্টের বিরাট পার্থক্য ছিল। প্রথমত, এই প্রস্তাবিত যুক্তফ্রন্ট প্রলেতারীয় যুক্তফ্রন্ট না, এ হল ‘ফ্যাসীবিরোধী যুক্তফ্রন্ট’ যাতে নাকি সামিল হবে ‘গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া’ দলরাও। ফলে, স্পেনে, ফ্রান্সে, যখন কমিউনিস্ট, সমাজতন্ত্রী, এবং স্পেনের ক্ষেত্রে নৈরাজ্যবাদী ও ট্রটস্কীবাদী দলের সমর্থক শ্রমিকরা একজোট হয়ে লড়াই করলেন, তখন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের চেয়েও উৎসাহের সঙ্গে আন্দোলনের রাশ টেনে ধরলেন স্তালিনবাদী কমিউনিস্ট নেতারা। ফ্রান্সে মরিস থোরেজ বললেন, কখন ধর্মঘট শেষ করতে হবে তাও জানতে হয়। সাধারণ ধর্মঘট থেকে বিপ্লবের পথে যাওয়া ছিল ট্রটস্কীবাদ। স্পেনে ফ্র্যাঙ্কোর নেতৃত্বে সেনাবিদ্রোহের জবাবে ক্যাটালোনিয়াতে নৈরাজ্যবাদী ও ট্রটস্কীবাদী নেতৃত্বে শ্রমিকরা বুর্জোয়া সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করলে কমিউনিস্ট-সমাজতন্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের নিরস্ত্র করে, মালিকদের কাছে ফ্যাক্টরী ইত্যাদি ফিরিয়ে দেয়। যুক্তফ্রন্ট সংসদ বহির্ভূত লড়াই থেকে সংসদীয় লড়াইয়ের দিকে চলে গেল। ধনতান্ত্রিক ইউরোপে স্পেনের মতো দেশেও প্রলেতারীয় বিপ্লবকে এজেন্ডার বাইরে বলে দেখা হল। ফলে শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে হতাশা দেখা দিল। যে ‘গণতান্ত্রিক’ বুর্জোয়াদের তোষণ করতে এই কাজ করা হল, তারা পরোক্ষে ফ্র্যাঙ্কোকেই সাহায্য করল। কমিউনিস্ট বিশ্বাসঘতকতা স্পেনের বিপ্লবকে ফ্র্যাঙ্কোর হাতে তুলে দিল। আর সে পার্লামেন্টে ফ্রান্সে একদিন কমিউনিস্ট সমর্থিত পপুলার ফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়, ১৯৩৯ সালে, নতুন নির্বাচন ছাড়াই, ঐ পার্লামেন্টেই, ঐ ‘গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া’ র‍্যাডিক্যাল দলের সাহায্যে কমিউনিস্ট দলকে নিষিদ্ধ করা হল, আর ১৯৪০ সালে ঐ সাংসদরাই পেত্যাঁর নেতৃত্বে নাজীদের সঙ্গে সহযোগিতা করবে এমন এক সরকারকে গঠন করলেন।

অধঃপতন ও পুনর্গঠনঃ

আমরা আলোচনা করেছি, যে নিরন্তর বিপ্লবের তত্ত্ব অনুযায়ী, রাশিয়াতে প্রলেতারীয় বিপ্লব এককভাবে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্পন্ন করতে পারত না। প্রয়োজন ছিল বিশ্ববিপ্লবের সম্প্রসারনের। গৃহযুদ্ধ, অবরোধ, জার্মানী সহ সব দেশে বিপ্লবের পরাজয়, এই ধারণা কত সঠিক ছিল তা দেখাল। সোভিয়েত রাষ্ট্র বাঁচল, কিন্তু এক জটিল অবস্থায়। নিঃসংগতা , দারিদ্র, এবং গৃহযুদ্ধের ফলে  সোভিয়েত গণতন্ত্রের অবক্ষয় ঘটল।   

১৯২১ থেকে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য নয়া অর্থনৈতিক পলিসী নামে একটি নীতি গৃহীত হল। এর বিভিন্ন উপাদানের একটি হল, ফ্যাক্টরির উতপাদনশীলতা বাড়ানো, তাকে লাভজমক রাখা, কারণ তা না হলে বেসরকারি ক্ষেত্রের সঙ্গে বাণিজ্য করা সম্ভব হবে না। এর ফলে একদিকে বেকারত্ব এল, আর অন্যদিকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক আমলাতন্ত্র এল। এই অর্থনৈতিক আমলাতন্ত্র যুক্ত হল ইতিমধ্যেই গড়ে ওঠা রাষ্ট্রীয় ও পার্টি আমলাতন্ত্রের সঙ্গে। এর নেতা হিসেবে এলেন স্তালিন। এই আমলাতন্ত্রের নতুন মতাদর্শ হল, জার্মানী বা অন্য কোনো বিপ্লবের থেকে সাহায্য নিয়ে না, বিশ্ববিপ্লবের মাধ্যমে বিশ্ব সমাজতন্ত্র না, (যেটা মার্ক্স থেকে লেনিন সকলেরই তত্ত্ব ছিল), বরং রাশিয়াতে ‘এক দেশে সমাজতন্ত্র গঠন’ সম্ভব হবে। ট্রটস্কী ও বামপন্থী বিরোধী গোষ্ঠী ব্যাখ্যা করেন, এ হল এক জাতীয়তাবাদী রাজনীতি। উপরন্তু, তাঁরা লড়াই করলেন গণতান্ত্রিক পরিকল্পনা, সোভিয়েত ও পার্টি গণতন্ত্র, এবং আন্তর্জাতিকতাবাদের জন্য। বামপন্থী বিরোধীদের পরাজয় হলেও, তাঁদের বিপ্লবী দিশা আমলাতন্ত্রের দুঃস্বপ্নের কারণ ছিল। মস্কোর বিচার-প্রহসনের প্রত্যেকটাতে যে ট্রটস্কীকে মূল ‘চক্রান্তকারী’ বলা হল, সেটা হঠাৎ না। স্তালিন পুরোন বলশেভিক, তাই তিনি জানতেন, তিনি ক্ষমতা নিশ্চিত করতে পারবে্ন গোটা পুরনো বলশেভিক দল ও তার ঐতিহ্য, তার রাজনীতিকে ধ্বংস করে। তিনি ভাল বুঝতেন, যে ট্রটস্কীর দিশা  আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা ও বিশেষ সুবিধার একেবারে পরিপন্থী।  

আমলাতন্ত্র শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক ক্ষমতা কেড়ে নিলেও, সোভিয়েত ইউনিয়নে নতুন কোনো শ্রেণী শাসন তারা আনে নি। ট্রটস্কী এই কথা বুঝেছিলেন। স্তালিনবাদকে তিনি প্রতিবিপ্লবী মনে করতেন। কিন্তু তিনি ব্যাখ্যা করেন, ধনতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হওয়ার অর্থ সম্পত্তিসম্পর্কে মৌলিক পরিবর্তন আসা, যেটা ঘটে নি। সোভিয়েত অর্থনীতি ছিল আগাগোড়া জাতীয়করণের ভিত্তিতে, কিন্তু আমলাতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত। আমলাতন্ত্র একটা পরগাছা সামাজিক স্তর, একটা শোষক শ্রেণী না।  দেশের ভিতরে ও বাইরে শ্রেণী সংগ্রামের ভারসাম্যের এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে এই ঘতনা ঘটেছিল। একে তিনি তুলনা করেন বোনাপার্ততন্ত্রের সঙ্গে, যেখানে সামন্ত ও বুর্জোয়ার শক্তির ভারসাম্য, এবং বিংশ শতাব্দীতে বুর্জোয়া ও শ্রমিকের ভারসাম্যের ফলে বুর্জোয়া সমাজ আছে অথচ সমগ্র শ্রেণী ক্ষমতায় নেই, এমন পরিস্থিতি হয়েছে। তফাতও ছিল, যা এখানে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে না। কিন্তু ট্রটস্কীর বক্তব্য ছিল, হয় আমলাতন্ত্র নিজের ক্ষমতাকে স্থায়িত্ব দিতে ধনতন্ত্র ফিরিয়ে আনবে, অথবা  শ্রমিক শ্রেণী আরেকবার বিপ্লব করে প্রলেতারীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবে। এই বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনিই একমাত্র কেন্দ্রীয় স্তরের বলশেভিক নেতা, যিনি স্বীকার করেন, ১৯২১ সালে গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর অন্য পার্টিদের নিষিদ্ধ করা আন্তঃপার্টি গণতন্ত্রকেও খতম করেছিল। ১৯৯০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তিম অবস্থা ও তার উত্তরসূরী দেশগুলিতে ধনতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা দেখিয়ে দিল, ট্রটস্কীর বিশ্লেষণ কেন ঠিক ছিল। অবশ্যই, তিনি এই ফল চান নি, চেয়েছিলেন প্রলেতারীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব – ১৯৫৩ সালে পূর্ব জার্মানীতে, ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরী ও পোল্যান্ডে, ১৯৮০ তে পোল্যান্ডে,  যা ঘটেছিল, বা ঘটার দিকে অনেকটা এগিয়েছিল।   

কিন্তু ট্রটস্কীর বিশ্লেষণের গুরুত্ব হল, এর ফলে রুশ বিপ্লবের প্রগতিশীল ঐতিহ্য এবং তার আংশিক ধারাবাহিকতাকে বোঝা সম্ভব ছিল। স্তালিনবাদী আমলাতন্ত্রকে প্রলেতারীয় বিপ্লবের শত্রু বলে চিনলেও, তিনি ব্যাখ্যা করেন যে সাম্রাজ্যবাদ সমাজতন্ত্রের মূল শত্রু। সোভিয়েত আমলাতন্ত্রকে যে কেউ উচ্ছেদ করা তাই প্রগতিশীল না—শ্রমিক শ্রেণী প্রলেতারীয় বিপ্লবী দিশা থেকে উচ্ছেদ করলে তবেই সেটা প্রগতিশীল। তাই সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বে সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিঃশর্ত সমর্থন ছিল তাঁর নীতি।

এই দিশা বিপ্লবী মার্ক্সবাদীদের একটা মেকী বাইনারী এড়াতে সাহায্য করেছিল। সেই মেকী বাইনারী হল, হয় বিপ্লব স্বৈরতান্ত্রিক তাই তার বিরোধিতা করতে হবে, অথবা বিপ্লবকে যেহেতু সমর্থন করতে হবে তাই তাকে সমালোচনা করা, এমনকি তার তথাকথিত নেতৃত্বকে উচ্ছেদ করে বিকল্প প্রলেতারীয় নেতৃত্ব আনার কথা বলা যাবে না। প্রথম অবস্থানের অর্থ, সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আমলাতান্ত্রিক অধঃপতিত বা আমলাতান্ত্রিক বিকৃতিপ্রাপ্ত শ্রমিক রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ থাকা, বা এমনকি সাম্রাজ্যবাদ গণতান্ত্রিক এই ছুতোয় তার পক্ষ নেওয়া। দ্বিতীয় অবস্থানের অর্থ তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির সমস্ত অপরাধকে চুনকাম করে দেখানো। ট্রটস্কীর অবস্থান থেকে আমরা ধনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সব চেষ্টার বিরুদ্ধে যে কোনো শ্রমিক রাষ্ট্রকে সমর্থন করতে পারি, কিন্তু একই সঙ্গে আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রলেতারীয় গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে সামিল হতে পারি।
দুর্ভাগ্য এটাই, যে এই নীতিনিষ্ঠ অবস্থান বামপন্থীদের মধ্যে কম।

নিষ্কলঙ্ক ঝাণ্ডাঃ

ট্রটস্কীর লড়াই ছিল প্রলেতারীয় বিশ্ববিপ্লবের জন্য লড়াই। তিনি স্তালিনবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন স্তালিনের সঙ্গে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের জন্য না। তা ছিল মার্ক্স থেকে লুক্সেমবুর্গ ও বলশেভিকবাদের বিপ্লবী রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনার লড়াই। তিনি জানতেন,ধনতন্ত্র কোন সামনের দিকে পথ দেখাতে পারে না। সাম্যবাদের জন্য লড়াই করতে হলে সংস্কারবাদী পথ, তত্ত্বগত বোঝা হাল্কা করা, ‘গণতান্ত্রিক’ বুর্জোয়াদের উপরে নির্ভর করা, এর প্রত্যেকতা ত্যাগ করতে হবে। শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্য, শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সব শোষিত , নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের ঐক্য ও বিপ্লবী লড়াই-ই একমাত্র পারে দাসত্ব, শোষণ ও অন্ধকার থেকে মুক্তি এনে মানুষকে মানুষ হিসেবে বাঁচতে দিতে। চতুর্থ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠার সময়ে ট্রটস্কী এই দিশাকে তুলে ধরে বলেছিলেন, চতুর্থ আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীর সামনে তুলে ধরবে এক নিষ্কলঙ্ক ঝাণ্ডা। ট্রটস্কীর ঐতিহ্য রক্ষা মানে এই দিশার ভিত্তিতে  লড়াই করা।