কুণাল চট্টোপাধ্যায়
নির্বাচন , শ্রেণী সংগ্রাম ও খেটে খাওয়া মানুষের মুক্তি
ছোটো বিপ্লবী গোষ্ঠীরা, বা এমনকি কিছুটা বড় বিপ্লবী গোষ্ঠীরাও, নির্বাচন এবং সরকারী /প্রশাসনিক বিভিন্ন স্তরের সংস্থায় অংশগ্রহণের প্রশ্নে ঠিক কোন অবস্থান নেবে? অতীত থেকে শিক্ষা নিতে গেলে মার্ক্স-এঙ্গেলসের এবং লেনিন ও বলশেভিকদের অভিজ্ঞতার কথা বলা দরকার, যদিও তাদের যুগ থেকে আমরা অনেক পরে বাস করছি। এখানে প্রথম ও প্রধান শিক্ষা হল, নির্বাচনী লড়াইকে নির্বাচনের বাইরের লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত করা আবশ্যক, এবং সংসদ বা যে কোনো স্তরের আইন নির্মাতা ও প্রশাসনিক সংস্থায় ঢুকলে সংসদ-বহির্ভূত কাজের সঙ্গে সংসদীয় কাজকে যুক্ত করা, আইনি কাজের সঙ্গে ধর্মঘট, রাস্তা সহ প্রকাশ্য স্থান দখল করা (যেমন শাহীন বাগ), আইন অমান্য করে নানা পদক্ষেপ নেওয়া, যেমন করছেন উত্তর ভারতের কৃষকরা, ইত্যাদি। বস্তুত মূল ক্ষেত্রটাই হবে নির্বাচন ও সংসদের বাইরে। সংসদ, বিধানসভা ইত্যাদিতে কাজ হবে ঐ বাইরের কাজের পরিপূরক, বাইরের কাজের সহায়ক। কোনো পরিস্থিতি দেখা যায় যখন ভোট বয়কটও করতে হয়, পার্লামেন্ট বয়কট করতে হয়, বা এমনকি গণভোটও বয়কট করতে হয়। দুটি উদাহরণ দেওয়া যায়। ১৯৭৫ সালে ভারত সিকিমকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে। ১০ এপ্রিল সিকিমের পার্লামেন্ট দুটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল—রাজতন্ত্র উচ্ছেদ এবং ১৪ এপ্রিল গণভোট। তাতে সিকিমের মানুষকে আলাদা করে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ (যে রাজতন্ত্র ছিল খুবই ঘৃণিত) আর ভারতের অঙ্গ হয়ে যাওয়া, এ নিয়ে দুটি আলাদা ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হল না। স্বতন্ত্র ভোট হলে ভারতের অঙ্গ হয়ে যাওয়ার প্রস্তাব সম্ভবত হেরে যেত। সেই সুযোগ দেওয়া হয় নি। তাই এক্ষেত্রে বয়কটই একমাত্র সঠিক ডাক ছিল। দ্বিতীয় উদাহরণ – ১০০ দিনের বেশি সময় ধরে কৃষকরা জোট বেঁধে কৃষি আইন রদ করার দাবিতে তীব্র লড়াই চালাচ্ছেন। এর মধ্যে কেউ কেউ প্রস্তাব করেছিলেন, পার্লামেন্টের বিশেষ অধিবেশন ডেকে আলোচনা করা হোক। এ হত বিজেপিকে, তথা তারা যে ধনী ব্যবসায়ী-কর্পোরেট পুঁজির হাতে কৃষিক্ষেত্রকে তুলে দিতে চাইছে তারই সুযোগ করে দেওয়া, কারণ পার্লামেন্টে বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। তিনদিন নাটকের পর ওই আইনগুলোকেই আবার পাশ করা হতো। এই প্রস্তাব তাই বিপজ্জনক ও আন্দোলন বিরোধী, কৃষক বিরোধী।
জারের আধা-সামন্ততান্ত্রিক শাসনে, সীমিত ক্ষমতার দুমাতে এবং পরে বুর্জোয়া সংসদে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে লেনিনের মত স্পষ্ট ছিল। শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে এবং বিশেষ করে তাদের পিছিয়ে পড়া অংশের মধ্যে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের উপকারিতার সম্পর্কে যে অতিরঞ্জিত, কিন্তু বাস্তব ও ব্যাপক ধারণা ছিল, তাকে কাটিয়ে ওঠার জন্য সংসদের ভিতর থেকে লড়াই করা ও সেইভাবেই মোহ কাটানোর কথা বলেছিলেন তিনি। একশ বছর আগের এই মত এখনো জরুরী, কারণ শ্রেণী সংগ্রামের ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে আজ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক চেতনা অত্যন্ত সীমিত। কিন্তু লেনিন-লুক্সেমবুর্গ-ট্রটস্কীরা যখন সংসদীয় লড়াই ও তার সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন, সেটা ছিল একটা বিপ্লবের যুগ। তখন বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে সোভিয়েত বা শ্রমিক পরিষদীয় গণতন্ত্র দিয়ে হঠিয়ে দেওয়ার একটা বাস্তব সম্ভাবনা ছিল। ১৯১৭-১৯২৩এর বিপ্লবী পর্ব শেষ হওয়ার পর অনেক পরিবর্তন এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বুর্জোয়া শ্রেণী একদিকে তাদের শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই শ্রেয় বলে ধরল, আর অন্যদিকে তাকে আরো বেশি বেশি করে অন্তঃসারশূণ্য করে ফেলল। আর, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন সহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে সমাজতন্ত্রের নামে একদলীয়, আমলাতান্ত্রিক শাসনের ফলে, সেই সব দেশের শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যেও সংসদীয় গণতন্ত্র প্রীতি বাড়ল। পুঁজির শাসনকে আড়াল করে রাখার মত মৌলিক মতাদর্শগত হাতিয়ার আজ সংসদীয় ব্যবস্থা। তাই সংসদীয়তা সম্পর্কে মোহ কাটানোর লড়াই জটিল, কিন্তু একেবারেই আবশ্যক। এখানেই ফ্যাসীবাদের উত্থান এক বাড়তি সমস্যা এনে দিয়েছে। উগ্র দক্ষিণপন্থী বা ফ্যাসীবাদী ধরনের শক্তিদের ক্ষমতায় আসা ঠেকাতে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা তো বটেই, স্ট্যালিনবাদী-মাওবাদী রাজনীতি থেকে আসা অধিকাংশ দল এই ফাঁপা, অন্তঃসারশূণ্য সংসদীয় ব্যবস্থার মধ্যেও আরো মোহ সৃষ্টি করেন, কারণ তারা ভোটের ক্ষেত্রে, এবং ভোটের বাইরেও, ‘কম ক্ষতিকর’ বুর্জোয়া শক্তির সঙ্গে নির্বাচনী ও অন্যরকম জোট গড়তে চান, এমনকি তাদের সরাসরি ভোট দিয়ে সংসদে পাঠাতে চান। আজকের ভারতে এই ভ্রান্ত রাজনীতি প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে।
একটি বিপ্লবী সংগঠন কি করতে পারে, সেটা নির্ভর করে তাদের নিজেদের আয়তন, এবং তাদের গণভিত্তির আয়তন ও চরিত্রের উপরে। গণভিত্তি ও পরিচিতি বাড়ানোর জন্য, নিজের রাজনীতি বহু মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য, একটি বিপ্লবী সংগঠনের নির্বাচনে প্রার্থী দেওয়া উচিত। শ্রমিক আন্দোলনে নিজেদের উপস্থিতি বাড়ানো এবং বিপ্লবী রাজনীতি নিয়ে যাওয়া হবে সেই নির্বাচনী প্রচারের প্রধান উদ্দেশ্য। সাধারণ সময়ে বেঁচে থাকার লড়াই করতে গিয়ে, নিজেকে ও পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতে গিয়ে, ব্যাপক শ্রমজীবী মানুষকে রাজনীতি নিয়ে ভাবতে পারে না। নির্বাচনের সময়ে, খুব সীমিতভাবে হলেও, মানুষ রাজনীতি নিয়ে শোনে, ভাবে। ভোট দেওয়া অবশ্যই একরকম নিষ্ক্রিয় অংশগ্রহণ। তাই বিপ্লবীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সময় থাকা দরকার র্যাডিক্যাল প্রচার, স্বাধীন শ্রেণী সংগ্রামের জন্য জোট বাঁধা ও বাস্তবে সেইরকম সংগ্রাম গড়ে তোলা। ভোট দেব না দেব না, আর দিলে কাকে দেব, এই সাধারণ প্রচার ছাড়াও ধারাবাহিক যে প্রচার করা দরকার, তা হল শ্রমিকশ্রেণীর এগিয়ে থাকা, রাজনৈতিকভাবে সচেতন মানুষদের কাছে বিপ্লবী চিন্তা, মতামত, আরো স্পষ্টভাবে নিয়ে যাওয়া।
বাস্তব চিত্র যা, তাতে ছোটো বিপ্লবী গোষ্ঠীরা অধিকাংশ সময়েই সর্বত্র নিজেদের প্রার্থী দিতে পারে না। এই জন্য দুই স্তরে কাজ করা জরুরী। যারা বিপ্লবী শিবিরের অংশ মনে করেন, তাদের উচিৎ নিজেদের মধ্যে সমন্বয়ের ভিত্তিতে যতটা সম্ভব শক্তিশালী ফ্রন্ট গড়া, যেমন হয়েছে বিভিন্ন সময়ে ইউরোপ এবং লাতিন আমেরিকার নানা দেশে। এর ফলে, (১) বিপ্লবীদের বক্তব্য বলে একটি অভিন্ন প্রচার করা যেতে পারে, (২) শ্রমজীবিদের কাছে বহু কেন্দ্র থেকে একই উদ্যোগের পক্ষে প্রার্থী দেওয়া সম্ভব হয় এবং (৩) নির্বাচনের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী লড়াইয়ের জোটকে যুক্ত করা যায়। এই কথা আবার বলা জরুরী, যে এইরকম নির্বাচনী লড়াইয়ে সংসদের বাইরের লড়াই যেন প্রাধান্য পায়, সেটা দেখা আবশ্যক।
সমস্যাটা আসে অন্য দলদের সমর্থন করার প্রশ্ন উঠলে - কাকে সমর্থন করব, কোন রাজনৈতিক ভিত্তিতে সমর্থন করব, ইত্যাদি। এখানে আমরা যা মৌলিক প্রভেদ করি, তা হল যে কোনো বুর্জোয়া দলের (তার গণভিত্তি যত প্রশস্ত হোক, আপাতঃভাবে সেই দল যত উদার-গণতান্ত্রিক হোক না কেন) সঙ্গে অবিপ্লবী, বামপন্থী, সংস্কারবাদী শ্রমিক দলের পার্থক্য। এই প্রসঙ্গে র্যাডিক্যাল পত্রিকার বিগত সংখ্যায় আমরা আলাদা একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করছি। তাই এখানে খুব বিস্তারিত আলোচনা করা হবে না, কিন্তু কিছু আলোচনা করা আবশ্যক। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক, অবিপ্লবী, বামপন্থী, সংস্কারবাদী শ্রমিক দলেরাও সংসদীয় ক্ষেত্রে কাজ করে। কর্মসূচী, আনুষ্ঠানিকভাবে ধনতন্ত্র-বিরোধী কথা বলা, দলের কর্মীদের চরিত্র ও রাজনৈতিক শিক্ষা, এবং তারা কোন কোন সামাজিক শ্রেণী ও স্তরের কাছে তাদের আবেদন রাখছে সেটা বোঝাও জরুরী। এই সমষ্টিকে না দেখে কেবল সরকারে গিয়ে এরা কতটা শাসকশ্রেণীর পক্ষে দাড়াচ্ছে বা তাদের পছন্দের নীতিকেই কার্যকর করছে, সেটা দেখা ভ্রান্ত। কারণ তাহলে মনেই করা হচ্ছে, খাঁটি বিপ্লবী দল ভোটে জয়ী হয়ে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের সংসদ ইত্যাদিতে শ্রমজীবিদের স্বার্থে সমস্ত পদক্ষেপ নিতে পারবে। অবশ্যই, যে দলেরই সরকার হোক না কেন, তাদের অনুসৃত নীতি জনবিরোধী হলে তার বিরুদ্ধে লড়াই হবে।
২০১১-র নির্বাচনের তৃণমূল কংগ্রেসের জয়ের পর আমরা বিশ্লেষণ করে তার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করি। ২০১৬ ও ২০১৯-এ এই নিয়ে আরো আলোচনা হয়। আমরা সিপিআইএম, সিপি আই প্রভৃতি দল কিছু ভুল করেছে, কিন্তু কমিউনিস্ট, এমন কথা মনে করি না। কিন্তু আমরা বামফ্রন্টভুক্ত দলগুলি আর বামফ্রন্ট সরকারের প্রভেদ করি। ২০১১-র বিশ্লেষণে বলা হয়েছিলঃ “বামফ্রন্ট সরকার ছিল বুর্জোয়া রাষ্ট্রে সংস্কারবাদীদের সরকার। রাষ্ট্রায়ত্ত্ব অর্থনীতির মধ্যে কিছু পাইয়ে দেওয়ার ভিত্তিতে, বেতনক্রম-মহার্ঘ্যভাতা, সরকারী আনুকূল্য, লাইসেন্স রাজের ভিত্তিতে, একরকম ভারসাম্য এনেছিল। ‘বামপন্থা’ বলতে বোঝানো হত ঐ কাঠামোতে শ্রমজীবী মানুষের জন্য কিছু দান।“ (র্যাডিক্যাল, জুলাই ২০১১, পৃঃ ৪)। বিশ্বায়নের যুগে শ্রেণীসংগ্রাম ও বিপ্লবী বামপন্থা নতুন করে গড়া, তার নতুন সংজ্ঞা নির্মাণের দরকার ছিল, কিন্তু যে দল বা জোট সরকারে থেকে, সরকারী অনুদানের মাধ্যমে সমর্থন চায়, তাদের পক্ষে অবশ্যই এই রকম জঙ্গী শ্রেণী সংগ্রাম গড়ে তোলা সম্ভব না।
সিপিআইএম যে বিপ্লবী দল না, সেটা প্রমাণ করতে খুব কষ্ট পেতে হয় না। কিন্তু সমস্যাটা হয় যখন বৈপরীত্যটা করা হয় – বিপ্লবী না বুর্জোয়া - এইভাবে। সিপিআইএম দলকে নানা সময়ে সংগ্রামী ধারার কিছু বামপন্থীরা ‘সামাজিক ফ্যাসিবাদী’ বা বুর্জোয়া দল বলে অভিহিত করেন। আমরা সিপিআইএমকে ফ্যাসীবাদী (সামাজিক, অসামাজিক) মনে করি না। সামাজিক ফ্যাসীবাদের তত্ত্ব একটা জঘন্য তত্ত্ব, যেটা ১৯২৮-২৯ থেকে স্ট্যালিনবাদ তৈরী করেছিল। দীর্ঘ ইতিহাসের পর্যালোচনা এখানে সম্ভব না। শুধু এইটুকু মনে রাখা জরুরী - ইতালীতে মুসোলিনীর উত্থান, জার্মানীতে ১৯২১-এর ক্যাপ অভ্যুত্থান, ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে লেনিন, ট্রটস্কী, জেটকিন প্রমুখ লড়াই করেছিলেন শ্রমিক শ্রেণীর যুক্তফ্রন্টের জন্য। ১৯২৪ থেকে জিনোভিয়েভ ও স্ট্যালিনের নেতৃত্বে এর পাল্টা একটা নীতি দানা বাঁধে। তারা বলতে থাকেন, যেহেতু সোশ্যাল ডেমোক্রেসী এবং ফ্যাসীবাদ উভয়েই ধনতন্ত্রের স্বার্থ দেখে, তাই সোশ্যাল ডেমোক্রেসী হল আরেক রকম ফ্যাসীবাদ। ১৯২৯-এর মে দিবসে বার্লিনে কমিউনিস্টদের আলাদা মিছিল ছিল এবং তাতে সোশ্যাল ডেমোক্রেসীর সরকারের পুলিশের আক্রমণের ফলে তিনদিন ধরে যে সংঘাত হয় তাতে ৩৩ জনের মৃত্যু হয়। কমিউনিস্ট পার্টি দাবী করে - এই ঘটনা দেখাল, তাদের প্রচার সঠিক, সোশ্যাল ডেমোক্রেসী আর ফ্যাসিবাদে তফাত নেই, তাই সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নেতাদের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সম্ভব নয়। হিটলারের জয়ের পরেও সরাসরি নিজেদের ত্রুটি তারা স্বীকার করে নি। ১৯৩৫ সালে আবার ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে গিয়ে যে নয়া পপুলার ফ্রন্ট নীতি ঘোষিত হল, তাতে বলা হল, সব (বুর্জোয়া) ‘গণতান্ত্রিক’ দলেদের সঙ্গেই ফ্যাসিবিরোধী জোট করা যাবে। সোশ্যাল ডেমোক্রেসী যে শ্রমিকশ্রেণীরই একটি অংশ, সে কথা স্পষ্ট করে বলা হল না। নিজেদের আগের যে নীতি হিটলারকে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় বসাতে সাহায্য করেছে সে কথাও স্বীকার করা হল না। তাই স্ট্যালিনবাদ প্রভাবিত ‘কমিউনিস্ট’ দলেদের মধ্যে একই সঙ্গে হঠকারী অতিবাম, আর দক্ষিণপন্থী ধারণা ঢুকে আছে। অতিবামপন্থা শেখায়, অবিপ্লবী শ্রমিক দল বাস্তবে বুর্জোয়া দল, এমন কি ‘সামাজিক ফ্যাসিবাদ’। দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদ শেখায়, ফ্যাসিবাদকে ঠেকানোর জন্য বুর্জোয়া দল সহ সবার সঙ্গেই হাত মেলানো যেতে পারে।
এর সঙ্গে আমাদের মতের তফাৎ সংক্ষেপে বলা দরকার। আসলে, শ্রমিক দলেদের একটা খুব ছোটো অংশই বিপ্লবী দল হয়ে ওঠে। ২০১১-র বিশ্লেষণে আমাদের দিক থেকে বলা হয়েছিল - “একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী সোশ্যাল ডেমোক্রেসী হওয়ার দিকে তারা এগোচ্ছে, না স্তালিনবাদী কাঠামো রেখে দিয়ে মুখে বিপ্লব, কাজে বুর্জোয়া ব্যবস্থার তল্পিবাহক, এই ভূমিকা পালন করবে, তর্কটা এইটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।“ (র্যাডিক্যাল, জুলাই ২০১১, পৃঃ ৬)। যতদিন সোভিয়েত স্ট্যালিনবাদ সব দেশের কমিউনিস্ট পার্টিদের উপর নিয়ন্ত্রণ রেখেছিল, ততদিন তারা নিজেদের এক কেন্দ্রীয় কর্তব্য মনে করত সোভিয়েত রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্রের স্বার্থ দেখা। সোভিয়েত-চীন ফাটলের সময়ে কেউ কেউ কিছুটা স্বাতন্ত্র্য পেয়েছিল। কিন্তু ইতিমধ্যে দশকের পর দশক শ্রেণী সমঝোতা তাদের অনেকের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গিয়েছিল। কিন্তু সেটাই বুর্জোয়া দলেদের সঙ্গে তাদের বড় তফাৎ। শ্রেণী সমঝোতার রাজনীতি তখনই করা যায়, যখন দলের সামাজিক ভিত্তি হয় বুর্জোয়া শ্রেণীর শত্রু, অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণী। যারা এই বক্তব্য মানেন না, তারা বলেন, ভারতে তো সব দলেরই ট্রেড ইউনিয়ন শাখা থাকে। আইএনটিইউসি, বিএমএস-ও তো আছে। তাই এআইটিইউসির সঙ্গে সিপিআই, বা সিটু-র সঙ্গে সিপিএমের সম্পর্ক থেকে বাড়তি কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।
কিন্তু ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে দলের পারস্পরিক সম্পর্ক কী সবক্ষেত্রে এক? সিপিআই-সিপিএম সরকারে গেলে এবং বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে অজস্র রফা, হরেক সহযোগিতা করলেও, নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাতে, ভোট রক্ষা করতে, শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যে নিবিড় সম্পর্ক রাখতে হয়, তথাকথিত গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া দলেরা সেটা করে না। ফ্যাসিবাদীরা হাতুড়ির বাড়ি মেরে শ্রমিক আন্দোলনকে খতম করতে চায়। অন্য বুর্জোয়া দলেরা যখন ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করে, তখন তাদের উদ্দেশ্য, আর সংস্কারবাদী-সুবিধাবাদী দলেদের গড়া বা নেতৃত্ব দেওয়া ট্রেড ইউনিয়ন এক ভূমিকা পালন করে না। গত এক দশক ধরে যে সারা ভারত সাধারণ ধর্মঘটগুলি হয়েছে, তাতে এআইটিইউসি, সিটু যে ভূমিকা পালন করেছে, কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস বা আরএসএস পরিচালিত ইউনিয়নরা সেই ভুমিকা পালন করে নি। দলের মধ্যেও, ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের যে ভূমিকা সিপিআই-সিপিএমের ক্ষেত্রে, কংগ্রেস, তৃণমূল বা বিজেপি ক্ষেত্রে তা আলাদা। দলের কিছু নেতাকে ট্রেড ইউনিয়নের নেতা বলে ঘোষণা করা, আর বাস্তবে ট্রেড ইউনিয়ন করা নেতাদের দলের নেতৃত্বে আনা, এক না। তখন বলা হবে, খিদিরপুরের ডকে গুলি চলা, সাঁওতালডিহির বিদ্যুতকর্মী আন্দোলনের উপরে হামলা, মরিচঝাঁপিতে দলিত শরণার্থী যারা মধ্যপ্রদেশ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে এসেছিলেন, তাদের উপর নির্মম আক্রমণের কথা। প্রশ্ন করা হবে, আমরা কি ভুলে যাচ্ছি বিনয় কোঙারের উদ্ধত উক্তির কথা যে “ওদের লাইফ হেল করে দেব”, আমরা কি ভুলে যাচ্ছি তাপসী মালিকদের কথা?
না, আমরা ভুলি নি। আমরা আশা করি না, যে কিছু বছর কেটে গেছে, তাই পুরোনো অন্যায় খাতা থেকে কেটে বাদ চলে যাবে। কিন্তু শ্রেণী সংগ্রাম কেবল আক্রোশের উপরে দাঁড়িয়ে থাকে না। সিঙ্গুরের জমি দখল ছিল চাষীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এবং এক অত্যাচারী ঔপনিবেশিক আইন ব্যবহার করে। এই কথা সিপিআইএম গুলিয়ে দিতে চায়। আমরা অন্য বহু বামপন্থী সংগঠনের সঙ্গে গলা মিলিয়ে স্মরণ করাব সেই সময়ে সরকারী মদতে কী হয়েছিল সে সব কথা। রোজা লুক্সেমবুর্গদের হত্যার পরেও, অস্ট্রিয়াতে, হাঙ্গেরীতে, জার্মানীতে, ইটালীতে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দলগুলির বিশ্বাসঘাতকতার পরেও লেনিনের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গেই যুক্তফ্রন্টের ডাক দিয়েছিল। তখনও কাউন্সিল কমিউনিস্ট ধারা, জার্মানীর কেএপিডি, ইটালীর কমিউনিস্ট নেতা বর্দিগা ইত্যাদি অনেকেই বলেছিলেন, এ অন্যায়, এটা করা যায় না। লেনিন ও তার কমরেডরা সচেতন ছিলেন, শ্রমিকশ্রেণীর মুক্তি যদি শ্রমিকশ্রেণীকে আনতে হয়, তাহলে শ্রমিকশ্রেণীর অধিকাংশকে এক পতাকার নীচে একজোট হতে হবে এবং বিপ্লবীদের কর্তব্য হবে তাকে বিপ্লবী রাজনীতির অভিমুখ দেওয়ার চেষ্টা করা। সেটা কেতাবী ঢংয়ে হবে না। যখন আজকের ভারতে শ্রমিক শ্রেণী বাস্তবে পিছু হঠেছেন, তখন দলে দলে শ্রমিক একজোট হবেন বিপ্লবী দলের পতাকার তলায়, সেটা অবাস্তব। সেটা আরো অবাস্তব কারণ আজকের ভারতের সঙ্গে লেনিনদের যুগের একটা বিরাট তফাত, তখন বিপ্লবীরা সংখ্যালঘু হলেও, বহু দেশেই তারা ছিলেন একটা বড় শক্তি। এই কারণে, সংস্কারবাদী ও বিপ্লবী শিবিরের শক্তির ভারসাম্যের এত ফারাক অভাব, যে বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজ্যস্তরে সিপিআই-সিপিআইএম-এর সঙ্গে বিশেষ ক্ষেত্রে ইস্যুভিত্তিক যুক্তফ্রন্ট করা গেলেও, সাধারণ যুক্তফ্রন্ট হয়তো সম্ভব না। কিন্তু এই বিশ্লেষণ দেখাচ্ছে, আমরা কেন শুধুমাত্র বহিরঙ্গের কিছু উদাহরণ দিয়ে বিজেপি তো নয়ই, এমন কি তৃণমূল বা কংগ্রেস বা অন্য বুর্জোয়া দল, আর অন্যদিকে সিপি আই-সিপিআইএমকে একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ ভাবতে রাজি নই। “সমস্ত বিজ্ঞানই অপ্রয়োজনীয় হয়ে যেত, যদি বস্তুর বাইরের চেহারা সরাসরি তার অন্তর্বস্তুর সঙ্গে মিলে যেত” (কার্ল মার্ক্স, ক্যাপিটাল, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৯৫৬, পেঙ্গুইন ১৯৯১)।
ফ্যাসিবাদের বিপদ কি তবে মেকী?
না। আদৌ তা নয়। একদিক থেকে যেন ২০২১-এর নির্বাচন অনেক সহজ-সরল ছবি তুলে ধরছে। বিজেপির বিরোধী যারা, তাঁরা সকলেই বলছেন, বিজেপি ফ্যাসিবাদী, বা অন্তত ‘ফ্যাসিবাদী ধাঁচের হিন্দুত্ব’ (সিপিআই(এম) এর কেন্দ্রীয় কমিটির ৩০-৩১ জানুয়ারী ২০২১-এ গৃহীত প্রস্তাবের বয়ান অনুসারে)।তবে কি আমরা মনে করতে পারি, আমরা ও আমাদের পূর্বসুরী সংগঠন, ইনকিলাবী কমিউনিস্ট সংগঠন যে ১৯৯০ থেকে বিজেপি-আরএসএস-কে ফ্যাসিবাদী বলে এসেছে, তা সকলে স্বীকার করছে। বাস্তবে, এমন মনে করা হবে খন্ডিত সত্য।
ক্ল্যাসিকাল ফ্যাসিবাদের সঙ্গে আজকের ভারতের কিছু পার্থক্য আছে। ক্ল্যাসিকাল ফ্যাসিবাদের উত্থান ও জয় হয়েছিল এমন যুগে, এমন সব দেশে, যেখানে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি ছিল দুর্বল। মার্ক্সবাদী লেখক আর্নো মেয়ার গবেষণা করে দেখিয়েছেন, প্রায় গোটা ইউরোপ (ফ্রান্স এবং অংশত ব্রিটেন বাদে) ১৯১৪ অবধি আধা-সামন্ততান্ত্রিক, অত্যন্ত আমলাতান্ত্রিক, অভিজাতপ্রধান একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ধরে রেখেছিল। এর বিপরীতে ভারতে ১৯১০-এর দশকের শেষ দিক থেকে প্রধান বুর্জোয়া দল জাতীয় কংগ্রেস সাধারণ মানুষকে জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের ভিত্তিতে একজোট করতে চেয়েছিল। ১৯২০-র দশক থেকে কংগ্রেসের মধ্যে একটি ধারা দেখা দেয়, যারা গণতন্ত্র দাবী করেছিল। ১৯৩০-এর দশক থেকে কংগ্রেস মুখে অন্তত এই দাবির পক্ষে ছিল এবং তার ফলে, ও যুদ্ধোত্তর গণবিদ্রোহে কৃষক-শ্রমিক সকলের ভূমিকার ফলে, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটের অধিকার সহ অনেকগুলি গণতান্ত্রিক অধিকার মেনে নেওয়া হয়। দেশীয় রাজন্যবর্গের রাজনৈতিক ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হল – হায়দ্রাবাদ ও জুনাগড়ে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে। অনেক সময়ে অবশ্য কমিউনিস্ট বিপ্লবী শিবিরে মনে করা হয়েছে, ভারতীয় গণতন্ত্র মেকী গণতন্ত্র। এটা হল এক স্বপ্নের আদর্শ বুর্জোয়া গণতন্ত্রের কথা ভাবা। প্যারি কমিউনের ১৫০ বছরে মনে রাখা দরকার, গণতান্ত্রিক ফ্রান্সও বিপ্লবী শ্রমিক শ্রেণীকে কতটা হিংস্রভাবে দমন করেছিল। তাই বরং বুঝতে হবে, বুর্জোয়া গণতন্ত্র ভারতের শ্রমিকসহ মেহনতী মানুষের উপরে কতটা প্রভাব ফেলতে পেরেছিল এবং তা উগ্র দক্ষিণ এবং বাম, দু’রকম রাজনীতির উপরে কীভাবে ছায়া ফেলেছিল।
ফ্যাসিবাদ কী, আর শুধু সঙ্ঘ পরিবারই কী ফ্যাসিবাদী? আরএসএস ফ্যাসিবাদী হলে, কেন্দ্রে কী ফ্যাসিবাদী রাজ পুরোদমে কায়েম হয়ে গেছে? আর এই ফ্যাসিবাদ সাধারণ মানুষের বাড়তি কোনো ক্ষতি করবে কী?
ফ্যাসিবাদের উত্থানের সময় থেকেই মার্ক্সবাদীদের মধ্যে তার চরিত্র নিয়ে বিতর্ক ছিল। তিন ধরণের ব্যাখ্যার কথা বলা যায়। প্রথমটি ফ্যাসিবাদকে দেখেছিল মালিক শ্রেণীর চক্রান্ত হিসেবে। ১৯২৩ সালে, জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির অতিবাম নেতারা দাবী করেন, ফ্যাসিবাদ ইতিমধ্যেই ক্ষমতা দখল করেছে। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকেও তারা ফ্যাসিবাদের সঙ্গে জুড়ে দিতে চাইলেন। ১৯২৪ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের পঞ্চম বিশ্ব কংগ্রেসে ইতালীর কমিউনিস্ট পার্টির নেতা বোর্ডিগা একই তত্ত্ব গ্রহণ করেন। এই আপাতঃ বামপন্থী ব্যাখ্যাকে ধরে নিলেন গ্রেগরী জিনোভিয়েভ ও জোসেফ স্ট্যালিন। স্ট্যালিন বলেন, ফ্যাসিবাদ ও সোশ্যাল ডেমোক্রেসী একে অপরের বিপরীত মেরুতে নেই, বরং তারা যমজ। তাঁর কথায়, “ফ্যাসিবাদ হল বুর্জোয়া শ্রেণীর জঙ্গী সংগঠন, যা নির্ভর করে সোশ্যাল ডেমোক্রেসীর সক্রিয় সমর্থনের উপর”। এই আপাতঃ বামপন্থার সবচেয়ে বড় বিপদ হল, ফ্যাসিবাদ শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি ঠিক কতটা বিপজ্জনক, সেটা অগ্রাহ্য করা, কারণ সাধারণ বুর্জোয়া রক্ষণশীলতা আর ফ্যাসিবাদকে এরা অখন্ড বলে ধরেন।
এর বিপরীতে ছিলেন নরমপন্থী ধারা, যাঁরা ফ্যাসিবাদের গণ আন্দোলনের চরিত্র দেখে বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে তার সংযোগ দেখতে ব্যর্থ হলেন। এরা মনে করলেন, ধনতন্ত্রের মধ্যেও সংস্কার সাধন করে উন্নতির সম্ভাবনা আছে, তাই ব্যাপকতম ফ্যাসিবিরোধী জোট চাই।
তৃতীয় যে দ্বান্দ্বিক ধারা দেখা যায়, তাতে ছিলেন ক্লারা জেটকিন, অগাস্ট থ্যালহাইমার, লিওন ট্রটস্কী প্রমুখ। তাদের বিশ্লেষণে দেখানোর চেষ্টা করা হয়, একদিকে ফ্যাসিবাদ পুঁজিবাদের সংগে যুক্ত এবং শ্রমিকের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদীরা পুঁজিবাদের পক্ষ নেয়। আর অন্যদিকে ফ্যাসিবাদ বুর্জোয়া এলিটের থেকে স্বতন্ত্র, এবং পুঁজিবাদের সঙ্গে তার মৈত্রী হলেও সে নিজের স্বাতন্ত্র বজায় রাখে। যে সব মার্ক্সবাদীরা ফ্যাসিবাদকে অন্য পুঁজিবাদী প্রতিক্রিয়ার থেকে গুণগতভাবে ভিন্ন মনে করতেন না, তাঁদের সমালোচনা করে ট্রটস্কী বলেন, “এরা প্রকৃতপক্ষে বলতে চাইছে, আমাদের সংগঠন টিকে আছে না ধ্বংস হয়ে গেছে, তার মধ্যে কোনো ফারাক নেই”। তি্নি বলেন, “ফ্যাসিবাদ হল, আর্থপুঁজির সামাজিক স্বার্থে পেটিবুর্জোয়াদের জমায়েত করা ও সংগঠিত করার একটি বিশেষ পন্থা”। সেই সঙ্গে তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদ ক্ষমতা দখলের ফলে একদিকে শ্রমিকশ্রেণীর সংগঠনদের চুরমার করে দেওয়া হবে, আর অন্যদিকে, একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ দেখলেও ফ্যাসিবাদ নিজের স্বতন্ত্র দিশাকে বজায় রাখে।
ফ্যাসিবাদের দিকে বুর্জোয়া শ্রেণী কখন ঝোঁকে?
আমরা আগে বলেছি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বুর্জোয়া শ্রেণী দেশে দেশে একরকম প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র বজায় রাখতে চেয়েছিল। তাই উগ্র দক্ষিণপন্থীদের অবস্থা অনেকদিন প্রান্তিক ছিল। কংগ্রেস দল ভারতে মূল শাসক শ্রেণীর দল হিসেবে যে শাসন চালিয়েছিল, তাতে একই সঙ্গে ছিল একটা খুব হাল্কা গণতন্ত্রের ছবি, যেখানে দলিত-আদিবাসী-সংখ্যালঘু ধর্মীয় মানুষের নিরাপত্তা, সামাজিক অগ্রগতির কথা মুখে বলা হত, খুব সীমাবদ্ধ কিছু আইনী ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হত। সেই সঙ্গে ছিল বড় পুঁজির স্বার্থেই অর্থনীতি পরিচালনা করা। সেই পর্বে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা, মৌলিক বহু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রাধান্য বা একচেটিয়া অধিকার রেখে পরিকাঠামো নির্মাণ, শিল্পায়ন ইত্যাদি ঘটেছিল। তার উপর, শ্রেণীসংগ্রামের এক নির্দিষ্ট ভারসাম্যের ফলে শ্রমিকশ্রেণী এবং কৃষকরাও শ্রেণীগত ও সামাজিক গোষ্ঠীগতভাবে কিছু কিছু অধিকার আদায় করেছিলেন। একটা উদাহরণ হল – ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের দীর্ঘ লড়াই, যা বাদ দিয়ে, শুধু ইন্দিরা গান্ধীর চতুর চাল হিসেবে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণকে দেখা যায় না। তেমনি, ১৯৬০ সালে তৃতীয় বেতন কমিশন ভোগ্যপণ্যের মূল্যের সঙ্গে মহার্ঘ্যভাতাকে যে যুক্ত করেছিল, সেটাও সংগঠিত শ্রমিক-কর্মচারী আন্দোলনের ফল। সব ক্ষেত্রে সরাসরি যোগাযোগ অবশ্যই দেখানো যাবে না, কিন্তু ১৯৪৮-৫১ পর্বে সিপিআই, আরসিপিআই দের জঙ্গী লড়াইয়ের পর, তারা তাৎক্ষণিক বিপ্লবের পথ ছাড়লেও, এই লড়াই-এ তার পিছনে যে শ্রমিক-দরিদ্র কৃষকদের এক উল্লেখযোগ্য অংশের সমর্থন ছিল, তার প্রমাণ ১৯৫১-৫২র সাধারণ নির্বাচনে সিপিআই-এর অন্যতম বড় দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ। এই সময়েই পাশ হল ইএসআই আইন, প্রভিডেন্ট ফান্ড আইন, প্রভৃতি। খাদ্য সংকট ও সবুজ বিপ্লব নীতির সময় থেকে দুটি পদক্ষেপ আসে - একদিকে ন্যূনতম সাহায্য মূল্য দিয়ে খাদ্যশস্য কেনা, আরেক দিকে রেশনব্যবস্থা সম্প্রসারিত করে সস্তায় বন্টন। মনে রাখা ভাল ১৯৬৭র সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস দলের বড় রকম ধাক্কা হয়েছিল। অর্থাৎ, সাধারণ মানুষ (শ্রমিক, নিম্ন মধ্যবিত্ত শহুরে পেটি বুর্জোয়া, কৃষক) ভোটে যেখানে পারেন ধাক্কা দিয়েছিলেন।
১৯৮০-র দশক থেকে অর্থনীতির চেহারা পাল্টাতে থাকে। উদারীকরণের পথ ধরে ভারতের শাসক বড় বুর্জোয়ারা। এটা তাদের একার সিদ্ধান্ত নয়, যদিও তারা সচেতনভাবেই ঐ পথ ধরেছিল। কিন্তু ওই সময়ের আগে পরে ‘কল্যাণমূলক’ রাষ্ট্রের বেশভূষা সব দেশে বুর্জোয়ারাই ত্যাগ করতে শুরু করে। এই রূপান্তরের ফলে উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদন এবং তাকে মুনাফা ও নতুন মূলধনে রূপান্তরের জন্য লড়াই তীব্র হয়। অতএব, বেশি শক্তিশালী পাশ্চাত্য, জাপানী পুঁজি, এমনকি অনেক বেশি শক্তিশালী উঠতি চীনা পুঁজির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য ভারতের বড় বুর্জোয়ারা অনেক বেশী বল প্রয়োগ চায়। ভারতের যেহেতু উপনিবেশ লুঠের মাধ্যমে অতিমুনাফা কামানোর জায়গা ছিল না তাই দেশের ভিতরেই সেই অতিমুনাফার ব্যবস্থা করার খাঁই দেখা গেল। সুতরাং বারে বারে দাবী উঠল, অপ্রয়োজনীয় (মালিকের জন্য অবশ্যই) শ্রম আইন ‘সংস্কার’ করতে হবে, কৃষিতে সবক্ষেত্রে বড় পুঁজির অবাধ প্রবেশের ব্যবস্থা করে দিতে হবে ইত্যাদি।আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে আইন পাল্টে, আদিবাসী উচ্ছেদ করে, খনিজ সম্পদ লুঠ করা, আদিবাসিদের সস্তায় শ্রমশক্তি বিক্রী করতে বাধ্য করা ছিল তাদের দিশার এক কেন্দ্রীয় দিক। এই প্রতিটা ক্ষেত্রেই নয়া নীতির স্রষ্টা কংগ্রেস। কিন্তু তাদের মধ্যে এ নিয়ে আভ্যন্তরীণ সংকট ছিল, যেহেতু ভোটে জয়ী হওয়ার জন্য তারা দলিত, আদিবাসী, মুসলিম, এই সমস্ত অত্যাচারিত বা অবহেলিত সামাজিক গোষ্ঠী ও স্তরের উপরে নির্ভর করত। তারা মাঝেমধ্যে কিছু ‘প্রগতিশীল’ সামাজিক ছাড় দিত বা দিতে বাধ্য হত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যদিও কংগ্রেসের তত্ত্বাবধানে গড়া ভারতীয় সংবিধানে উল্লেখযোগ্য ব্রাহ্মণ্যবাদী উপাদান আছে, তবু তারাই আবার সংরক্ষণ চালু রেখেছিল বা দলিত আদিবাসীদের উপর অত্যাচার প্রতিরোধে আইন প্রণয়ন করেছিল। মনমোহন সিং-এর সরকার বিশ্ব ব্যাঙ্ক, আইএমএফ ও ভারতীয় বড় পুঁজির স্বার্থে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প চালু করল। কিন্তু বুর্জোয়া গণতন্ত্রের এই ভারসাম্য রক্ষা করে চলা ততদিনই সম্ভব, যতদিন সামাজিক ও অর্থনৈতিক শক্তিদের ভারসাম্য থাকে, আর যতদিন না মুনাফা সঞ্চয় প্রক্রিয়া বড় আকারে বিপদে পড়ে। এই ভারসাম্য চলে গেলে বড় বুর্জোয়ারা রাষ্ট্রের ক্ষমতা বাড়িয়ে, তাদের ঐতিহাসিক স্বার্থরক্ষা করতে চায়। সেজন্য তারা গণতান্ত্রিক পরিসর কমাতে, এমনকি তুলে দিতেও রাজি থাকে। এর এক নির্দিষ্ট রূপ হল ফ্যাসিবাদী শাসন।
আধুনিক সমাজে, যেখানে বুর্জোয়ারা সংখ্যায় অল্প, বড় বুর্জোয়াদের পক্ষে সরাসরি সামনে এসে শাসন করা কঠিন। এমনকি শুধু পুলিশ বা সেনাবাহিনী ব্যবহার করে শাসনেও জটিলতা আছে। শুধুমাত্র কাশ্মীরকে সেনা, আধা-সেনা ও পুলিশ দিয়ে দমন করে রাখতে ভারতের অনেক সমস্যা হয় এবং সেটাও করা যায় জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের সাহায্যে। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মধ্যে খেটে খাওয়া মানুষ লড়াই করে অনেক অধিকার আদায় করেছে। এর মধ্যে আছে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার, ধর্মঘট করার অধিকার। আছে বহু অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার—কাজের ঘন্টা কমানো, ন্যূনতম মজুরী, দলিত-আদিবাসী ও অন্য নিপীড়িত মানুষের জন্য শিক্ষা ও চাকরিতে সংরক্ষণ ইত্যাদি। নারী শ্রমিকদের কাজ করার পরিবেশ সংক্রান্ত বেশ কিছু অধিকারের কথাও বলা যায়—যার মধ্যে সবার আগে পড়ে কাজ করার মৌলিক পরিবেশ থাকা এবং এইজন্য কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বিরোধী আইন। যে অল্প কিছু ক্ষেত্রে মেয়েরা সংগঠিত, সেখানে আছে মেটারনিটি বেনিফিট, আছে ক্রেশের কথা। এই সব অধিকার নিছক এককথায় বাতিল করা যায় না। এর জন্য দরকার হয় একটা বিকল্প মতাদর্শের, যার মাধ্যমে শ্রেণীর বিরুদ্ধে শ্রেণী নয়, বরং কৃত্রিমভাবে জাতির বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীদের তথাকথিত লড়াইকে হাজির করা হয়। এর জন্য গড়ে তোলা হয় তলা থেকে এক প্রতিক্রিয়াশীল গণআন্দোলন।
এই ধরনের গণআন্দোলন প্রত্যেক দেশের নির্দিষ্ট সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে তৈরী হয়। ভারতের ক্ষেত্রে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাবাদ তার সূচনা। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদ আর উগ্র জাতীয়তাবাদ। গোড়া থেকে আরএসএসের এই মতাদর্শ ও তার আন্দোলন বড় বুর্জোয়াদের হাতিয়ার ছিল না। কিন্তু ৯০ বছর ধরে এই শক্তি ভারতে একটি বিকল্প, প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয়তাবাদ গড়তে চেয়েছে এবং সমাজে প্রবেশ করে অনেকটা সফল হয়েছে।
আরএসএস তার জন্মের সময় থেকেই বলে এসেছে, তাদের দেশপ্রেম মানে এক দেশ যেখানে মুসলিমের স্থান হিন্দুত্বের আধিপত্য মেনে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে, যেখানে দলিতদের নীচে থাকতে হবে। এরা আন্তঃ-জাতি সামাজিক সম্পর্ককে ঘৃণার চোখে দেখে। তাই এদের নব্য মহাপীঠস্থান আদিত্যনাথ শাসিত উত্তরপ্রদেশে পাশ করা হয় ‘লাভ জিহাদ আইন’ যেখানে সরকারী অনুমতি ছাড়া হিন্দু মেয়ে মুসলিম পুরুষকে বিয়ে করতে পারবে না। ঐ রাজ্যেই ধারাবাহিকভাবে দলিত মেয়েদের ধর্ষণ ও খুন; প্রতিবাদ করলে তাদের পরিবারের পুরুষ সদস্য খুন; যা প্রতিদিনকার ঘটনাতে পরিণত হয়েছে।। এর তাত্ত্বিক রূপ হল, শুধু মুসলিম বিদ্বেষ নয়, এদের তাত্ত্বিকরা, যেমন সাভারকার বা অরুণ শৌরি, বাবা সাহেব আম্বেদকারের বিরুদ্ধেও বিষোদ্গার করেছে। ভারতীয়দের সকলকে হিন্দু হতে হবে বা হিন্দুত্বের মাহাত্ম্য স্বীকার করতে হবে, এই কথার প্রাথমিক অর্থ ছিল মুসলিমদের এককোণে ঠেলে দেওয়া - যেটা হল ২০০২ একপেশে দাঙ্গার পর গুজরাটে, যেটা অনেকটা হল মুজফফরনগর দাঙ্গার পর উত্তর প্রদেশে।
১৯৯০-এর দশক থেকে পশ্চিমবঙ্গেও আরএসএস ও তার শাখা সংগঠনগুলির প্রভাব বেড়েছে। শুধু অর্থনৈতিকভাবে হতাশাগ্রস্থ পেটি বুর্জোয়া বা অনগ্রসর চেতনাসম্পন্ন শ্রমিকরা না, শিক্ষিত, সুপ্রতিষ্ঠিত পেটি বুর্জোয়া ও দক্ষ শ্রমিকদের মধ্যে এরা প্রবলভাবে ঢুকেছে। এর কারণ হল এই রাজ্যে ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী চেতনা দুর্বল। আর অন্যদিকে, দেশভাগের ফলে দলিতদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ যারা পূর্ব পাকিস্তান/বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে এসেছেন, তাদের মধ্যেও মুসলিম বিদ্বেষ জাগিয়ে তুলে ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতিতে সামিল করা গেছে।
যেহেতু ভারতে খুব হাল্কা ধরণের হলেও একটা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক কাঠামো বজায় রয়েছে ৭০ বছরের বেশি,তাই ক্লাসিকাল ফ্যাসিবাদের সঙ্গে এদেশের ফ্যাসিবাদের কৌশলে ফারাক আছে। গণতন্ত্রের নামেই তারা এক উগ্র জাতীয়তাবাদী, ব্রাহ্মণ্যবাদী এবং অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আনার দিকে এগোতে চাইছে। যদি ক্রমাগত মেরে মুসলিমদের আরো সংকুচিত হয়ে থাকতে বাধ্য করা যায়, যদি তাদের আরো এক কোণে ঠেলে দেওয়া যায়, তাহলে দুটো জিনিস হয়। প্রথমত, তাদের বড় অংশ নিছক বেঁচে থাকতে চাইবেন, মাথা নীচু করে। ঠিক এইটা হয়েছে ২০০২ এর পরে গুজরাটে। দ্বিতীয়ত, মুসলিমরা যদি আরো এক জায়গাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে বসবাস করতে বাধ্য হন, তাহলে মুসলিম প্রভাবিত লোকসভা – বিধানসভা আসন কমবে, আর ওই কটাকে দেখিয়ে সব হিন্দু মিলে হিন্দুর খাঁটি দলকে ভোট দাও এই আহবান করা আরো সহজ হবে। এখানে বিজেপির কৌশল গত তিন দশকে ক্রমে হিটলারের সর্বাত্মক খতম নীতি (ফাইনাল সল্যুশন) থেকে সরে গেছে ইজরায়েলের জায়নবাদীদের পথে। নামে ইজরায়েল ‘গণতন্ত্র’। কিন্তু সে দেশে ইহুদিরা প্রধান। যে কোনো ইহুদী্ সে পৃথিবীর যে প্রান্তে জন্মাক না কেন, তার ‘ফিরে আসার অধিকার’ বলে একটা আইন আছে। আর প্যালেস্তিনীয় আরব, যারা চিরকাল এখানে ছিল, তাদের যখন ইচ্ছা অত্যাচার করা হয়, ড্রোন পাঠিয়ে আক্রমণ করা হয়, পেলেট গান চলে, তাদের ডাক্তারদের গ্রেপ্তার করা হয় – এক কথায়, ছোটো মাপে ভারতে বিজেপি যা শুরু করেছে, সেটারই বড় আকার দেখা যায় ওই দেশে।
এই অবস্থায় ২০১৪ থেকে আর এস এস-বিজেপির সঙ্গে ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর যে রফা, তার চরিত্র অতীতের থেকে স্বতন্ত্র। একদিকে, ২০০৮ থেকে বিশ্ব ধনতান্ত্রিক সংকট পুজি সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়িয়ে তুলেছিল। অন্যদিকে ২০১০, ২০১২, এবং ২০১৩ তিনবার সারা দেশজোড়া শ্রমিক ধর্মঘট ঘটেছিল। সংসদে বামপন্থীদের গুরুত্ব বাড়ছিল। প্রাদেশিক স্তরে বিভিন্ন রাজ্যে সরকারেরা নিজস্বভাবে চলতে চেয়েছিল। ফলে দেখা গেল, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউ পি এ সরকারের দিশা দক্ষিণপন্থী হলেও ক্ষমতা সীমিত। তাই বুর্জোয়াশ্রেণী মুনাফা এবং পুঁজিসঞ্চয় অব্যহত রাখতে সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে যে রফা করল তার চেহারা আজ স্পষ্ট।
একদিকে, গত ক’বছরে (২০১৪-২০২১) তারা দেখিয়ে দিয়েছে, আইন পরিবর্তন, বেসরকারীকরণ, ইত্যাদি ক্ষেত্রে গোটা দেশের মানুষকে পথে বসিয়ে, শোষণের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর করে, ব্যাঙ্ক-বীমা বেসরকারীকরণ, রেল ও বিমান বেসরকারীকরণ, পরিষেবার দাম বাড়ানো, নানা ভাবে মুনাফা এনেছে শুধু বড় পুঁজিপতিদের। একটা পরিসংখ্যান দেখাবে, সাধারন মানুষের অবস্থা কী হয়েছে।
|
২০১৪ |
২০২১ |
পেট্রোল |
৬০ টাকা |
১০১ টাকা |
এল পিজি গ্যাস |
৪১৪ টাকা |
৮১৯ টাকা |
প্ল্যাটফর্ম টিকিট |
৫ টাকা |
৫০ টাকা |
সর্ষের তেল |
৫২ টাকা |
১৩৫-১৫০ টাকা |
দুধ |
৩৬ টাকা |
৫৬ টাকা |
দেশি ঘি |
৩৫০ টাকা |
৫৫০ টাকা |
এর উল্টো দিকে দেখতে পাই, ২০১৪ সালে মুকেশ আম্বানির সম্পদ ছিল ১৭১৪৩১ কোটি টাকা। অতিমারি সত্ত্বেও, ২০২০ সালে সেটা হল ৬৬৫০০০ কোটি টাকা। গৌতম আদানীর ২০১৪ সালে ছিল ৫০৪০০ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে সেটা হল ১১০০০০ কোটি।
পুঁজির স্বার্থ দেখার জন্য তারা ভয়ঙ্ককরভাবে গণতন্ত্রের কন্ঠরোধ করেছে। একের পর এক সাজানো মামলাতে মানুষের অধিকারের জন্য যারা লড়াই করছেন তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিচারব্যবস্থার উপরে চাপ বেড়েছে। আর একটা কথা বোঝা খুব জরুরী। তাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য কিন্তু কংগ্রেস, আরজেডি, সমাজবাদী পার্টি ইত্যাদিরা নয়। আক্রমণের মূল লক্ষ্য বামপন্থীরা, আর দলিত-আদিবাসী আন্দোলনের কর্মী ও সংগঠনরা। এখানে তারা কোনো প্রভেদ করে না, কে বেশি আর কে কম বামপন্থী। উমর খালিদ, ঐশি ঘোষ, কানহাইয়া কুমার কে কোন দল করে তার জন্য ছাড় পায় নি। এলগার পরিষদ মামলা ইত্যাদিতে আটক বহু গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মী।
কেন এই বাম বিরোধিতা
কেন এই বাম বিরোধিতা, সেটা ভাল করে বুঝে নিতে হবে।এর জন্য তাকাতে হবে পার্লামেন্টারী হিসেবের বাইরে, এমনকি আজ সিপিআইএম, সিপিআই, আরএসপি কতটা সহী বাম সেই হিসেবের বাইরে। ফ্যাসিবাদ বুর্জোয়া শ্রেণীকে প্রতিশ্রুতি দেয়, তারা সাধারণ মানুষের মধ্যে পাল্টা (প্রতিক্রিয়াশীল) গণআন্দোলন গড়বে। সেটা কখনো লাভ জিহাদের ধুয়ো তুলে, কখনো দেশপ্রেমের নামে, কখনো গো-রক্ষার নামে, কখনো মুসলমানরা দেশের শত্রু এবং সন্ত্রাসবাদী এই মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে। কেন এটা করে? এর একই সঙ্গে দুটো কারণ। একদিকে, তারা যে দেশ চায়, আমরা বলেছি, সেটা হল অত্যাচারী, উচ্চবর্ণের হিন্দু শাসিত দেশ। তাই হিন্দুত্ব,এবং তার মধ্যেই আবার জাতের লড়াই, দুটোই করতে হবে। কিন্তু অন্য কারণ হল, মালিকদের স্বার্থে তারা যে কাজ করছে, তার বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষ জোট বাঁধলে সেটা শ্রেণীগতভাবে হবে। সেখানে আরজেডি, ডিএমকে, ইত্যাদি কেউ আসে না। ভোটবাক্সের বাইরে এই লড়াইয়ে দুটো শ্রেণীগত অবস্থানের লড়াই চলছে। ফ্যাসিবাদিরা শ্রেণীর নাম নেয় না - তারা পবিত্র হিন্দু-ভারতীয় জাতির কথা তোলে এবং শ্রেণী চেতনার সরাসরি বিরোধিতা করে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহন সস্তা করা, সকলের জন্য রেশন ফেরানো, কৃষি আইন বাতিল করা, শ্রম কোড বাতিল করা—এগুলো তো কংগ্রেসের অ্যাজেন্ডাতে একবিন্দুও পড়ে না। সীতারাম ইয়েচুরি বা ডি রাজারা যে রোজ এই নিয়ে ভীষণ উত্তেজিত এবং লড়ছেন তা নয়। কিন্তু বাস্তব কথাটা হল, ভারতে এখনও এই সব দাবী যে ভাষায় ওঠে, সেটা বামপন্থার ভাষা। ভোটের জন্য যখন তৃণমূল কংগ্রেস ২০২০-র ডিসেম্বর থেকে কল্পতরু সাজতে চেয়েছে, তখন তাকে বুর্জোয়া সংবাদপত্র বা টেলিভিশনে বামপন্থীদের অনুকরণ করার দায়েই অভিযুক্ত করা হয়েছে। বিজেপি এই ব্যাপারে একেবারে খোলা কথা বলছে। তারা হাত জোড় করে ভোট চাইবে না। তারা প্রতিশ্রুতি যেটা দেবে সেটা সবার জন্য চাকরির লড়াই নয়। ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো, ১০০ দিনের কাজে ব্যয়বরাদ্দ বাড়ানো, ফসলের সরকারি মান্ডি খারিজ না করা, ফসলের ন্যূনতম গ্যারান্টি দাম, এই ধরনের প্রসঙ্গে কথা উঠলে, ভোটে যেই জয়ী হোক না কেন, বামপন্থী পরিভাষা, বামপন্থী চেতনার একটা রূপ এসে যায়। ২০১৪ থেকে, এই প্রতর্ক, এই চেতনাকে ধংস করা বিজেপির কেন্দ্রীয় লক্ষ্য। পাকিস্তানে বোমা ফেলা, অর্ণব গোস্বামীর টুইটারের কথোপকথন ফাঁস হয়ে দেখা যায় কিভাবে পরিকল্পিত ঘটনা ঘটিয়ে ফয়দা ওঠানোর ছক ছিল। ৩৭০ ধারার বিলোপ, রামমন্দির ইত্যাদি করেও শ্রেণী সংগ্রামের ভূতকে তারা ঘাড় থেকে নামাতে পারে নি। শ্রম আইন, ব্যাঙ্ক ও বীমা বেসরকারীকরণ, যে অনেকটা পরে হয়েছে ও হতে চলেছে, তার জন্য পার্লামেন্টে বিরোধীরা দায়ী না। তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিয়ে ফ্যাসিবাদ রোখার স্বপ্ন যারা দেখছেন, তারা দেখান, পার্লামেন্টে বহু গুরুত্বপূর্ণ ভোটে তৃণমূল আসলে কি করেছিল। লড়াই যা করেছে সেটা ট্রেড ইউনিয়নরা করেছে, এখন কৃষক আন্দোলন করছে। কিন্তু ভোট সবসময়েই বাস্তব শ্রেণী সংগ্রামের এক বিকৃত প্রতিফলন ঘটায়। কংগ্রেস হাতও তোলে নি কৃষক আন্দোলনের লড়াইয়ে নামতে, অথচ পাঞ্জাবে এই ক’দিন আগে তারা বিপুল ভোটে স্থানীয় নির্বাচনে জয়ী হল। কিন্তু যারা নিজেদের বিপ্লবী মনে করি, কমিউনিস্ট মনে করি, তাদের কাজ নয়, যেন তেন ভোট পরিচালিত করার চেষ্টা করা। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বুঝতে হবে, তাতে ঐক্য আনার চেষ্টা, সর্বভারতীয় স্তরে সাধারণ ধর্মঘটে সকলকে টানার চেষ্টা করেছে বাম ট্রেড ইউনিয়নগুলিই।
একইভাবে, গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা তুললে বিজেপি বা তার সমর্থকরা বারে বারে বলে - রাশিয়াতে, চীনে, উত্তর কোরিয়াতে কি গণতন্ত্র ছিল বা আছে? আমরা স্ট্যালিন জমানা, মাও-দেং জমানা, উত্তর কোরিয়া, কোনোটাকেই সমাজতন্ত্রী মনে করি না।ওই সমস্ত শাসনে সন্ত্রাসের সবচেয়ে বড় শিকার ছিলেন সাধারণ শ্রমিক ও কৃষকরাই। কিন্তু আমরা একথাও জানি, যে মার্ক্স-এঙ্গেলস থেকে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক হয়ে রুশ বিপ্লব ও কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের গোড়ার যুগ প্রশস্ততর গণতন্ত্রের জন্যই লড়াই করেছিল এবং এদেশের বাম আন্দোলনে স্ট্যালিনবাদের পাশাপাশি ঐ ঐতিহ্যের উপস্থিতিও আছে। দ্বিতীয় যে জায়গাটা আছে, যেখানে বামপন্থার মধ্যে দুর্বলতা আছে, সেটা হল বিশেষ নিপীড়ন সম্পর্কে তত্ত্বগত স্তরে, লড়াইয়ের দাবিতে এবং সাংগঠনিক স্তরে দুর্বলতা।
বাম রাজনীতি ছাড়া বিজেপি কিন্তু ঠিক এই জায়গাগুলিতেই শত্রু খুঁজে নিয়েছে। তাদের চোখে স্বাধীন দলিত আন্দোলন ক্ষতিকর এবং তাকে থামাতে হবে। ডঃ আম্বেদকার বা কাঁশিরাম বিভিন্ন সময়ে দলিতদের একজোট করে যে লড়াই করেছেন বিজেপি তাকে নষ্ট করতেই চায়। দলিতদের তারা চায় তাদের ফ্যাসিবাদী যুদ্ধের পদাতিক সৈন্য হিসেবে। তাই পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তারা মতুয়াদের মধ্যে সংগঠিত প্রচার করেছে। অথচ তারা স্বাধীন দলিত রাজনীতিকে, আদিবাসী রাজনীতিকে ধংস করতে চায়। যারা মনে করে, দলিত সমতার চিন্তাই অপরাধ, তারা স্বাভাবিকভাবে স্বাধীন দলিত সংগঠনের বিরোধী হবে। কিন্তু দলিতদের দলে টানতেও হবে। তাই একদিকে প্রগতিবাদী দলিত আন্দোলন, আম্বেদকারবাদী চেতনা ও সংগঠনকে আক্রমণ করার সঙ্গে সঙ্গে দলিতদের আত্মসাৎ করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। কিন্তু মনে রাখা, দলিতদের কাছে ব্যাখ্যা করা দরকার, সংঘের ‘হিন্দু সমাজ’ দলিতদের ঠাঁই দিতে চায় দাঙ্গাতে মুসলিমের গলা কাটার জন্য, ভোটে জেতার জন্য। কিন্তু তার বেশি না। তাই তথাগত রায় বাঙ্গালী শরণার্থীদের (প্রধানত নিপীড়িত জাতের) জন্য চোখের জল ফেলে, আর ওই বিজেপি-ই রোহিত ভেমুলার প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা, আম্বেদকার স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের উপর আক্রমণ, হাথরাসে দলিত মেয়ে ধর্ষণ ও হত্যার পর তার দেহ দাহ করে ফেলা (যাতে পোস্ট মর্টেম ঠিক করে না হয়) এই সব করে।
পৃথিবীর সর্বত্রই, ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের আর একটি ভিত্তি হল লিঙ্গ বৈষম্য।। সেটা এক এক দেশে সেই দেশের পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্দিষ্ট রূপ নেয়। এদেশে একদিকে তারা আনছে লাভ জিহাদ আইন। আবার সুপ্রীম কোর্ট যেখানে এক শ্রেণির তিন তালাককে অবৈধ বলেই দিল, তার পরেও যে আইন পাশ করা হল, তাতে তিন তালাক দিলে স্বামীকে জেলে দেওয়া হবে বলা হল। যেখানে ওই ধরণের তিন তালাক অবৈধ, সেখানে আলাদা আইন কেন? আর স্বামীকে জেলে ঠেলে দিলে কীভাবে পরিত্যক্তা স্ত্রীর ভরণপোষণ স্বামী করবে? বাস্তবে এটা স্রেফ মুসলিম বিদ্বেষী জিগির তোলার জন্য এবং লিঙ্গ রাজনীতিকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য পদক্ষেপ। একই ভাবে, রূপান্তরকামী/রূপান্তরিতরা নিজেদের আত্মপরিচিতির যে লড়াই করছিলেন, আর তাকে যেভাবে বিকৃত করে আইন পাশ করা হল তা তাদের প্রতি সমর্থন দেখায় না।বরং দেখা গেল, ২০১৪-র নালসা মামলার রায় এবং ২০১৮-র ৩৭৭ ধারা সমকামীদের উপর প্রয়োগ অসাংবিধানিক এই রায়ের পরও বিজেপি এবং তাদের সরকার বাধ্যতামূলক বিসমকামী বিবাহ এবং তা ধর্মীয় চেতনাকেন্দ্রীক করে রাখা নিয়ে কত লড়াই করছে। এই বিষয়ে আদালতে যে মামলা চলছে, তাতে সরকারের প্রতিবেদনে ধর্মের উপর যে জোরটা পড়েছে সেটা স্পষ্ট। ধর্মে বিয়ের কারণ সন্তান উৎপাদন - বিশেষ করে পুরুষ সন্তান উৎপাদন । আমরা ভালই জানি, এক নারী ও এক পুরুষের বিয়েতেও সন্তানের জন্ম দেওয়া একমাত্র বা প্রধান উদ্দেশ্য নাই হতে পারে। কিন্তু একই লিঙ্গের দুজনের বিয়ে হলে স্পষ্টভাবেই সন্তানের জন্ম হবে না। তাই এখানে পরিবারের রক্ষণশীল ধারণাকে সামনে এনে দিয়ে ওই বিয়ে ঠেকাতে চাওয়া হচ্ছে।
পরিবার কেন জরুরী? পরিবার সঙ্গ দেয়, পরিবার নিরাপত্তা দেয়। তাহলে সেই পরিবার কেন দুই মেয়ের বা দুই পুরুষের পরিবার হবে না? কেনই বা ট্রান্সজেন্ডারদের পরিবার হবে না? (সরকার জোর দিয়েছে—বায়োলজিক্যাল ম্যান এন্ড বায়োলজিক্যাল ওম্যান কথা দুটোর উপরে) এর কারণ হল পুরুষতন্ত্র এবং পুঁজির আজকের সম্পর্ক। রাষ্ট্র এবং মালিক, সবকিছু থেকে হাত গোটাচ্ছে। রাষ্ট্র সামাজিক নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব অস্বীকার করছে। মালিক মুনাফার পাহাড় ছাড়া কিছুই বোঝে না। তাহলে শ্রমিকের নিরাপত্তা কে দেবে? পরের প্রজন্মের শ্রমিকের জন্ম, লালন-পালন, সব কে করবে? বিনা খরচে সে সব করতে হলে পরিবারের পুরোনো মতাদর্শের সঙ্গে আধুনিক ধনতন্ত্রের যোগাযোগ করে দিতে হবে। আর সেইজন্য, সমলিঙ্গের দুজনের বিয়ে রাষ্ট্রের পছন্দ না। সরাসরি বলা দরকার, লিঙ্গ সমতার রাজনীতিকে হিন্দুত্ব ও ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে।
করণীয় কি?
ওপরের আলোচনার ভিত্তিতে আমরা বলতেই পারি ফ্যাসিবাদকে দুর্বল করতে চাই যুক্তফ্রন্ট। সমস্ত ধরণের বামপন্থীদের এবং পরিচিতিসত্তার কারণে বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রগতিবাদী সংগঠন,মঞ্চ, উদ্যোগের যুক্তফ্রন্ট। চাই ইতিহাস, শিক্ষাক্ষেত্র, সংস্কৃতি, বিজ্ঞানের জগতে তীব্র মতাদর্শের লড়াই। আর সর্বোপরি এই লড়াইয়ে চাই শ্রেণী অভিমুখ, কেননা ফ্যাসিবাদকে অর্থ যোগানো, গণমাধ্যমের ব্যবহার থেকে সমস্ত ধরণের উপাদান সরবরাহ করে যে পুঁজিবাদ, তাকে সরাসরি আঘাত না করে ফ্যাসিবাদকে হারানো সম্ভব নয়। শ্রেণী অভিমুখ চাই যুক্তফ্রন্টের ঐক্যের সাধারণ ভিত্তি হিসেবে।